দেবব্রত দত্ত
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, আইএমটি গাজিয়াবাদ এবং আশুতোষ কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
২০২৩ সালে, অর্থাৎ বর্তমান বছরে, অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে স্বেরিজেস রিক্সবাঙ্ক পুরস্কার— সোজা কথায় অর্থনীতিতে নোবেল— পেলেন অর্থনৈতিক ইতিহাসবিদ ক্লডিয়া গোল্ডিন। অর্থনীতিতে নোবেলপ্রাপক হিসাবে গোল্ডিন তৃতীয় মহিলা। উল্লেখযোগ্য, যে একক নারী প্রাপক হিসাবে গোল্ডিনই প্রথম। আগের দুই পুরস্কারপ্রাপক— ইলিনোর ওসট্রোম এবং এস্থার ডুফলো— এই পুরস্কার অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন। এই নোবেল পুরস্কারবিজয়ে লিঙ্গবিচার না করলেও হয়তো চলত, কিন্তু যেহেতু বর্তমান নোবেলবিজেতা গোল্ডিনের বিবিধ গবেষণার মূল বিষয় শ্রমের বাজারে মহিলাদের যোগদান এবং প্রাপ্তি, তাই হয়তো এই উল্লেখটি প্রাসঙ্গিক।
অধ্যাপিকা গোল্ডিন শ্রমের বাজারে মহিলা শ্রমজীবীদের অংশগ্রহণ এবং অবস্থান দেখেছেন মূলত মার্কিন অর্থনীতির ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে। অর্থনীতিতে শ্রম, শ্রমের বাজার, শ্রমিকের মজুরি এবং মোট জাতীয় আয়ে তাদের প্রাপ্তির অংশ অর্থনীতির শুরুর থেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে বিবেচিত হয়ে এসেছে।
উন্নয়নের চাবিকাঠি হিসাবে শ্রমবিভাগকে প্রথম চিহ্নিত করেন অ্যাডাম স্মিথ, তাঁর ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত কালজয়ী গ্রন্থ “ওয়েলথ অফ নেশনস”-এ। যেহেতু শ্রমিক অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং তাদের জোগান প্রচুর, জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় মজুরির বেশি কিছু তাদের প্রাপ্য হতে পারে না। সুতরাং, আর এক প্রবাদপ্রতিম অর্থনীতিবিদ রিকার্ডো এই ন্যূনতম মজুরিকেই ব্যবহার করলেন দেশের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে আয়বণ্টনের পদ্ধতি দেখাতে গিয়ে। শ্রমিকের বিষয়ে নতুন কথা বললেন কার্ল মার্ক্স। শ্রমিক এককভাবে দুর্বল, ঠিকই, কিন্তু সংঘবদ্ধভাবে নয়। সংঘবদ্ধ শ্রমিক বিপ্লবের মাধ্যমে আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে বদলে দিতে পারে। মার্ক্স আরও বললেন, ধনতন্ত্রে শ্রমিক সামন্ততন্ত্রের অধীনে কৃষিকাজের তুলনায় শিল্পক্ষেত্রের কাজে বেশি স্বাধীনতা পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু, শোষণের অবসান হয়নি।
কিন্তু যে প্রশ্ন থেকে গেল তা হল কৃষি থেকে শিল্পে উত্তরণের এই যুগে নারীশ্রমিকের অবস্থা কী হল। আলাদা করে নারীশ্রমিককে নিয়ে ভাবনার প্রচলন স্মিথ, মার্ক্স, মার্শালদের যুগে ছিল না, কিন্তু অবিন্যস্তভাবে বিভিন্ন পরিসরে বেশ কিছু তথ্য ও পরিসংখ্যান ছিল। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ক্লডিয়া গোল্ডিন এই অনালোচিত বিষয়ের গবেষণাতেই মনোনিবেশ করলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রম-সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখালেন যে শিল্পবিপ্লবের ফলে যেখানে আগের তুলনায় পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছিল, সেখানে মহিলা শ্রমিকের সংখ্যা গিয়েছিল কমে। এর কারণ হিসাবে তিনি বললেন, সেই সময়ে শিল্পক্ষেত্রের কাজের দীর্ঘতর সময় ও অমানুষিক পরিশ্রম মহিলাদের পক্ষে উপযোগী ছিল না। ফলে, গোল্ডিন দেখালেন, শিল্পবিপ্লব মহিলা শ্রমজীবীদের সেইভাবে লাভবান করেনি, যতটা করেছে পুরুষ শ্রমজীবীদের।
এই অভূতপূর্ব শিল্পবিকাশের সময় থেকে শুরু করে আজকের সময় পর্যন্ত নারীশ্রমিকের অবস্থার পরিবর্তনকে পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধরতে এবং মাপতে চেয়েছেন গোল্ডিন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শিল্পবিকাশের ফলে পৃথিবীর এক অংশে বিকশিত অর্থনীতির উদ্ভব হয়। এই বিকাশের ফল হিসাবে পরবর্তীকালে কৃষি ও শিল্পের পাশাপাশি পরিষেবার ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব বিকাশ ঘটে। অর্থনীতির এই পরিবর্তন মহিলাদের জন্য কাজের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করে। প্রচুরসংখ্যক মহিলা এর ফলে নার্স, শিক্ষিকা, টাইপিস্ট ইত্যাদি বৃত্তিতে যোগদান করতে থাকেন। গোল্ডিন দেখান যে ১৯৩০-এর মহামন্দার পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ ১৯৩০-১৯৪০-এর দশকে, এই নতুন কাজের ক্ষেত্রগুলিই একমাত্র মহিলাদের জন্য উপযুক্ত— এরকম একটি আখ্যান নির্মিত হয়। এর ফলে এই সময়ের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অল্পবয়সি মহিলারা এই ক্ষেত্রগুলিতে চাকরির জন্যই নিজেদের প্রস্তুত করতে থাকেন। এই কারণে ১৯৫০-এর পরে অন্যান্য অনেক নতুন ক্ষেত্রে যে সব দক্ষতানির্ভর কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়, মহিলারা তার সুযোগ নিতে পারেন না। নারী ও পুরুষ শ্রমিকের মধ্যে মজুরির বৈষম্য থেকেই যায়। মজুরি নির্ধারণে নব্য ধ্রুপদী অর্থনীতির প্রান্তিক উৎপাদন তত্ত্ব এখানে কার্যকরী হতে দেখা যায় না। গোল্ডিন তথ্য দিয়ে দেখিয়েছেন যে মার্কিন শ্রমবাজারে একই কাজে মহিলাদের মজুরি পুরুষদের তুলনায় কম।
গোল্ডিনের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী ১৯৭০-এর দশকের পর কাজের বাজারে যোগদান সম্পর্কে অল্পবয়সি মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গিয়েছে। মেয়েরা সব ধরনের কাজের জন্য নিজেদের যোগ্য মনে করছে এবং যোগ্যতা অর্জনের চেষ্টা করছে। এ ঘটনা শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নয়, উন্নয়নশীল দেশেও একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মহিলাদের শ্রমের বাজারে অবস্থান সম্পর্কে ক্লডিয়া গোল্ডিনের মতো এত তথ্যভিত্তিক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ আর কোনও অর্থনীতিবিদ করেননি। পরিবারে মহিলাদের ভূমিকা এবং শ্রমের বাজারে যোগদানের মধ্যে নিবিড় সম্পর্ককে গোল্ডিন পরিসংখ্যান বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে মহিলাদের শ্রমের বাজারে যোগদানের প্রকৃতি কীভাবে প্রথম শিশুর জন্মদানের পরে বদলে যায়। আজ ৭৭ বছর বয়সেও গোল্ডিন তাঁর গবেষণার কাজে একইরকমভাবে অনলস।
গোল্ডিনের গবেষণাক্ষেত্রের মধ্যে আমার প্রিয় বিষয় তাঁর শিক্ষা এবং প্রযুক্তির দৌড়-বিষয়ক গবেষণা। শিক্ষা এবং প্রযুক্তির দৌড় একটি ধারণা, যার মুখ্য প্রবক্তা প্রথম নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ টিনবারজেন। এই তত্ত্ব দেখায় কীভাবে শিক্ষা এবং প্রযুক্তির সাহায্যে একজন অন্যজনের চেয়ে কখনও এগিয়ে যায়, আবার পিছিয়ে পড়ে। মার্কিন অর্থনীতিকে বিশ্লেষণ করে গোল্ডিন এবং কাটজ (হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং ব্যাক্তিগত জীবনে গোল্ডিনের স্বামী) দেখিয়েছেন যে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে কিছুটা সরকারি সহায়তায় স্কুল এবং উচ্চশিক্ষায় অগ্রগতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে প্রযুক্তিক্ষেত্রে নেতৃত্বলাভের সুযোগ করে দিয়েছে। এই সময়ে দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে মজুরি বৈষম্য স্থিতিশীল থাকে। এর কারণ শিক্ষার প্রসার এবং দক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পাশাপাশি অদক্ষ শ্রমিকদের ইউনিয়ন এবং দরকষাকষির মাধ্যমে মজুরি নির্ধারণ। কিন্তু ১৯৮০-র দশকের পর থেকে দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে মজুরিবৈষম্য বিপুলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। গোল্ডিন ও কাটজ দেখিয়েছেন, এর কারণ একদিকে শিক্ষার ব্যয়বৃদ্ধি, যার ফলে দক্ষ শ্রমিকের জোগান বৃদ্ধির হারে হ্রাস। অন্যদিকে ইউনিয়নের ক্ষমতা কমায় অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরির স্থবিরতা। ১৯৮০-পরবর্তী সময়ে মুক্ত অর্থনীতির একটি বড় প্রভাব দুনিয়া জুড়ে অসাম্য বৃদ্ধি।
এতাবৎকালের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি যে প্রযুক্তি উন্নয়ন ঘটায়, দারিদ্র্য কমায়। গোল্ডিন এবং কাটজের গবেষণা থেকে হয়তো আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে একবিংশ শতাব্দীর বর্তমান পর্বের প্রযুক্তি উন্নয়ন দারিদ্র্য বাড়াতেও পারে। এই সম্ভাবনার কারণ, একদিকে শিক্ষার খরচ ক্রমবর্ধমান, আর অন্যদিকে প্রযুক্তি বিকাশের বর্তমান ধারায় সাধারণ চাকরি এবং প্রযুক্তিক্ষেত্রে প্রাথমিক ও মধ্যবর্তী স্তরে কাজের সুযোগ ক্রমহ্রসমান। এই প্রবণতা নারী ও পুরুষ কর্মী উভয়কেই প্রভাবিত করবে। গোল্ডিনের গবেষণায় ১৯৮০-পরবর্তী পরিসংখ্যান এই সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।