সৌরাংশু
লেখক রম্যরচনাকার এবং খাদ্যগবেষক। নেশা বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন ধরণের খাদ্যের সাথে পরিচিত হওয়া। অধুনা দিল্লিবাসী সৌরাংশু একটি ছোটগল্পের সংকলন, ফিসফাস ১ ও ২ নামক দুটি রম্যরচনার ব্লগ সংকলন এবং ফিসফাস কিচেন নামক বইয়ের রচয়িতা।
আরে মশাই, এসব নিয়ে বেশি কথা বলে কী লাভ আছে? এ যেন সায়েন্স ফিকশন লিখতে বসেছি:
সিরকা ২০২০
মানুষজন বোরখার মুখোশ পরে পাসপোর্টের ওয়াট লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। খেলাধুলো পড়াশুনো ইত্যাদি শরীর এবং মস্তিষ্কের পরিশ্রমকারী কাজে স্যাংশন জারি করা হয়েছে। বছরে তিন দিন খেলতে এবং তিনদিন পড়তে পারবেন। তার জন্য ডিজিটাল ইন্ডিয়া দ্বারা মঞ্জুরকৃত তাবিজ দেওয়া হয়েছে। তাতে প্রতিদিনের হিসাবে একটা করে কালো দাগ পড়ে যাবে আপনাআপনি। অক্সিজেন মাস্কের চাহিদা গত পাঁচ বছরে প্রায় দেড়শো গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সোনার দাম বারো ডলার প্রতি গ্রাম, জলের দাম তেরো ডলার প্রতি লিটার আর মানুষের জীবনের দাম? কী-বোর্ডে এটা টিপলেই শুধু বিপ্ বিপ্ শব্দ আসছে।
সিরকা ২০২১
মানুষজন বোরখার মুখোশ পরে বাড়িতে বসে আছে। ঘুরে বেড়ানোয় ওয়াট লেগে গেছে। তাবিজের একশো আট। অক্সিজেন মাস্ক পাওয়া যাচ্ছে না। অক্সিজেনই নেই তো মাস্ক দিয়ে কি গেণ্ডুয়া খেলবে? সোনা দিয়ে কান খুস্কি থেকে শুরু করে জলের গেলাস, বেল্টের বকলস এমনকি জুতোর ফিতের মুণ্ডু পর্যন্ত তৈরি হচ্ছে। সারকাজমের একটা লিমিট আছে তো! বাঁচবারই সম্ভাবনা নেই তো আবার ইয়ে! জল কেউ খুঁজে পেলে সরকার থেকে তাঁকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। আর কী-বোর্ডে টেপার মতো আঙুলগুলো সব খসে পড়ে যেতে শুরু করেছে।
সিরকা…………
ইয়ে মানে কোনও রকমে ভিনিগারের সংস্কৃত নামটাই টাইপ করতে পারলাম! ২০২২ লেখার আগেই কী-বোর্ডের কী এবং আঙুল, সবই খসে গেল!
আরে হাঁ করে কী ছাইপাঁশ পড়ছেন? এখন থেকেই শুধরে যান না হলে এগুলো পড়ার মতো অবস্থাও থাকবে না। আপনি যদি তিরিশে ঢুকে গিয়ে থাকেন তাহলে তো না হয় ষাট অবধি বেঁচে যাবেন। কিন্তু খবরদার ছেলেমেয়ে পয়দা করার কথা চিন্তা করবেন না। কচি ফুসফুসে বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া পৃথিবীর অঙ্গ হয়ে দাঁত বার করছেন! লজ্জা করছে না?
আর কিছু বলতে গেলেই তো বলবেন, “শুনুন, ‘বলেছিলাম না!’ মার্কা ডায়লগ বন্ধ করুন!” আফটার অল ট্র্যাডিশন বলে তো একটা কথা আছে!”
ট্র্যাডিশন! আমাদের একটা সভ্যতা যেটা নাকি অনাদির কেবিন থেকে অনন্তের চায়ের দোকান পর্যন্ত চলে আসছে। চলেই আসছে। তাতে কোন জন্মে রাবণ মেরে রাম বাড়ি ফিরেছিল বলে অযোধ্যার অবোধ্যরা মিলে তুবড়ি, চকোলেট বোমা আর দোদোমা ফাটিয়েছিল।
তা আপনি বলবেন, “আরে বাজি ফাটালে এত বড় ব্যাপার স্যাপার হয় নাকি? আসলে সরকারের দোষ, সুপ্রিম কোর্টের দোষ, চাষাদের দোষ, খড়ের দোষ, সারের দোষ, গরু-মোষের দোষ, আগুনের দোষ, অক্সিজেনের দোষ, দূষণ কণার দোষ, চিত্রগুপ্তের দোষ, জিউসের দোষ, আল্লা-যীশু-শিব টিব সবার দোষ। আর আমরা শুধুমাত্র চকিতচপলা হরিণী। দুটি ভাত আর একটা নতুন আলু সিদ্ধ করে মেখে খেয়ে বেঁচে থাকি, আর পিটপিটিয়ে ক্যামেরার দিকে চাই!”
হুজুর মাইবাপ! এসব বলে আপনাকে দাগা দেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। শুধু একটা কথাই বলছি, যে বাতাসে আমরা শ্বাস নিচ্ছি, সেটা দিল্লি হোক বা দল্লুপুরাই হোক, গাজিয়াবাদ হোক বা গাজোল, নয়ডা বা নয়নপুর, গুরুগ্রাম বা গুড়াপ, ধীরে ধীরে সেই বাতাসটাই আপনাকে গাপ করে দিতে চাইছে।
দিল্লিতে থাকি, গত বছর থেকে ঠিক দীপাবলির পরে পরেই (আরে নারে বাবা! কালীপুজোর বাজিকেই একমাত্র দোষারোপ করছি না রে!) আপাত হেমন্তের আগমনকে ধোঁয়া দিয়ে ঢেকে দিয়ে শীতকে ওয়েলকাম করার জন্য দূষণের কম্বল আমদানি হচ্ছে। টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র আর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা নাকে চশমা এঁটে গলার টাই বা শাড়ির প্লিট ঠিক করে গম্ভীরভাবে পিএম ২.৫ আর পিএম ১০ (প্রধানমন্ত্রীর সংস্করণ নয় বায়ুদূষণের পরিমাপক পার্টিকুলেট ম্যাটার ২.৫ এবং ১০ মাইক্রোমিটার সংক্রান্ত ব্যাপার স্যাপার।) নিয়ে গম্ভীরভাবে বুঝিয়ে যাচ্ছেন যে বিপদসীমানার কতটা উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার কারণ নিয়ে তো প্রচুর বার্তালাপ। কিন্তু কী করলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নির্মল বাতাসে শ্বাস নিতে পারবেন সেটাই তো গুরুত্বপূর্ণ। যা করলে সমস্যা, তা দূর কর আর যা করলে সমস্যার সমাধান হবে সেগুলো ফটাফট করতে শুরু কর।
তা সুপরামর্শগুলো কী কী?
শুকনো ধুলো যাতে না হয় তাই দিবারাত্র সুবহশাম সুপার সুইপার মেশিন দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার। (ইয়ে মানে আমরা তো তৃতীয় বিশ্ব! রাস্তাঘাট তো ইউরোপ অ্যামেরিকার মতো সমান নয়। সুপার সুইপার কি কাজ করতে নেমে ডিস্কো নাচবে?)
বাতাসের ধূলিকণাগুলিকে ভিজিয়ে দিয়ে মাটিতে ফেলার জন্য যান্ত্রিক ফোয়ারা ব্যবহার। (হ্যাঁ, জলাজমিগুলোকে বেমালুম বুজিয়ে বহুতল তুলে ফেলা হচ্ছে তো জল কি গাছে ফলবে?)
বায়ু সংশোধক বা এয়ার পিউরিফায়ার ব্যবহার। (পাতি কিতাবী কথাবার্তা ছাড়ুন দিকি, আউটডোরে এয়ার পিউরিফায়ার! যেন আমগাছে তালশাঁস সন্দেশ ফলেছে!)
অড ইভনের মতো একটা জগাখিচুড়ি দেখনদারি সিস্টেমকে জনগণের ঘাড়ে না চাপিয়ে জনসাধারণের ব্যবহারযোগ্য পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাকে সক্ষম এবং সুসফরের উপযুক্ত করে তোলা। যাতে ব্যক্তিগত বাহন ব্যবহার কম করলেও অসুবিধা না হয়। (বাস রাখবে কোথায়? জায়গা কি জাহাঙ্গীর দেবে? দিল্লি ডেভলপমেন্ট অথরিটির জমি আর দিল্লি ট্রান্সপোর্ট ডেভলপমেন্ট কর্পোরেশনের বাস। কেন্দ্র আর দিল্লি সরকারের মধ্যে তো একদম নম্বর ওয়ান ইয়ারি সম্পর্ক!)
আশেপাশের ক্ষেতখামারের কৃষকবন্ধুদের শিক্ষিত করে তোলা, যাতে খরিফ ফসল কেটে তোলার পর রবি শস্য বোনার আগের সময়টিতে খড় এবং শস্য গাছের অব্যবহৃত শুকিয়ে যাওয়া অংশটিকে দ্রুত সরিয়ে ফেলার জন্য জ্বালিয়ে না দিয়ে তা যেন সার বা গবাদি পশুর খাবারের জন্য ব্যবহার করা হয়। আর কেউ নিয়ম না মানলে? তাহলে ভোটের রাজনীতিই করুক। মানবসভ্যতা যাক কেরোসিনের লাইনে। (ইয়ে কেরোসিন এখনও পাওয়া যায়? গ্যাসের সাপসিঁড়িই তো তুলে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ বরং কচি ঘাস চিবোক! সস্তা, সুন্দর, এবং টিকাও!)
গাড়িটাড়ি থেকে বায়ুদূষণ দূর করার জন্য যেটা করা যেতে পারত তা হল, ডিজেলের ব্যক্তিগত বাহন বিক্রি বন্ধ করা এবং মালবাহী ট্রাকগুলিকে শহরের বাইরে বাইপাস দিয়ে চলাচল করানোর জন্য করিডোর সৃষ্টি। (এসব কাজে বুঝলেন সময় লাগে। বছর দশেক? একটু সহ্য করে নিন তদ্দিন!)
কিন্তু পানপরাগের বিজ্ঞাপনের মতো জিজ্ঞাসা করবেন না? ‘মেরে লিয়ে?’ আপনি এক কাজ করুন। মানে আপনারা, এক তো দূষণ শব্দটাকে নিজের জীবন থেকে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টা করুন। রাস্তাঘাট পরিষ্কার রাখুন, শীতকালে শুকনো পাতা মাটি চাপা দিন, পারলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস মেট্রো ইত্যাদি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করুন, আর না পারলে গাড়ি বা দু’চাকা নিয়ে বেরোলে তাতে দূষণ সার্টিফিকেটটা একবার চেক করিয়ে নিন, অথবা সাইকেলও চালাতে পারেন, পায়ের ডিমে দম থাকলে, আর ইয়ে উৎসবে ব্যসনে দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে পারলে শব্দ বা ধোঁয়া-উদ্দীপক বাজিফাজি পোড়াবেন না। মানে পারলে আর মনে হলে। আসলে কী জানেন? আমরা কোনওরকমে ম্যানেজ করে না হয় চালিয়ে দেব। মানে এই যে খোলা হাওয়ায় বেরোলেই চোখ জ্বালা করা, একটু বেশি দৌড়োদৌড়ি করলে হাঁফ ধরে যাওয়া, মাঝেসাঝে সর্দিকাশি হাঁচিটিকটিকি, এসব নিয়ে খান পঞ্চাশেক বছর টেনে দেব।
কিন্তু তারপর? আপনার দশ বছরের সন্তান তখন চাকুরি থেকে রিটায়ার করবে আর নাতি-নাতনিরা সবে হয়তো কলেজে টলেজে ঢুকেছে। ওই যে প্রথম প্যারাগ্রাফে ইয়ার্কি মেরে ২০২০ লিখে দিলাম, সেখান থেকে জাস্ট পরের দুইটা সাত করে দিন। আপনি নেই অথবা আছেন কিন্তু ধুঁকছেন। কিন্তু চোখের সামনে দেখছেন যে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম ধোঁয়ায় মুড়ে যেতে যেতে স্রেফ নেই হয়ে যাচ্ছে। উফ হোয়াট আ ওয়েস্ট! নেই মানুষের পৃথিবীতে আপনাকে স্বাগত জানাতে তখন একটা সবুজ পাতা বা এক ফোঁটা জলকেও খুঁজে পাবেন না! সবকিছু ছাড়িয়ে মানসিক দূষণই তখন দেখবেন আপনাকে পেয়ে বসেছে।
পুঃ দিল্লি পৃথিবীর চতুর্থ দূষিত শহর। পিএম ২.৫ বা পিএম ১০-এর বিপদসীমার কতটা ঊর্ধ্বে ক’দিন ধরে রয়েছি, কবে আবার খোলা আকাশ নির্মল বাতাস দেখতে পাওয়া যাবে বা বৃষ্টি এলেই সব ঠিক হয়ে যাবে — এইসব লিখলে হয়ত লেখাটা প্রপার প্রবন্ধ হিসাবে দাঁড়াত। কিন্তু সত্যি বলতে কি, গত দশদিন ধরে মানুষের কুকর্মের কুঁচিকণা ক্রমাগত নাকে মুখে চোখে ঢুকে গিয়ে ভাবনাচিন্তার পথটাই বন্ধ করে ফেলেছে। আঙুলগুলো খসে পড়ার আগেই কী-বোর্ড বন্ধ করি না হয়!