রবীন্দ্র গুহ
মলয়কে দাগী অপরাধীর মতো কোমরে দড়ি দিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হাংরি বুলেটিনের সম্পাদক দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়াকে কলকাতা থেকে বর্ধমানে বদলি করা হল। বিশ্বভারতী থেকে প্রদীপ চৌধুরী রাস্টিকেট হল। উৎপল যোগমায়া দেবী কলেজে অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়। হাংরি বুলেটিনের প্রকাশক হওয়ার কারণে সমীর রায়চৌধুরীও চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়। কফি হাউসের সামনে সুবিমল বসাকের ওপর অতর্কিতে একদল যুবক হামলা চালায়। এছাড়াও হাংরি আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে অভিযোগ করা হয়। মোট কথা, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে হাংরি আন্দোলন সম্ভবত স্বাধীন ভারতের একমাত্র সাহিত্য আন্দোলন যেখানে শুধুমাত্র ভিন্ন রুচির সাহিত্য রচনার কারণে কবি-লেখকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন
মলয়ের সঙ্গে প্রথম আলাপ ও হাংরির জন্ম
মলয় যখন পাটনায় ইমলিতলায় থাকত, সেই সময় আমি থাকতাম ভিলাই কারখানার ইস্পাতনগরে। দুজনেই মাঝেমধ্যে সাহিত্যের টানে শহর কলকাতায় চলে আসতাম। মলয়ের বন্ধুবান্ধবদের আমি সেভাবে চিনতাম না। আমার বন্ধুদের মধ্যে ছিল আলোক সরকার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বরেন গঙ্গোপাধ্যায়। একদিন মলয়ের একখানা পোস্টকার্ড পেলাম— “আপনার উঁচু করা হাত দেখতে পেয়েছি। কলকাতায় এলে দেখা করব। কলকাতায় এলে খবর দেবেন।” মলয়কে আমি কলকাতায় এসে খবর দিলাম। মলয় এল। সঙ্গে ফাল্গুনী রায়। ওরা ঘরে বসল না। বাড়ির সামনেই ট্রায়াঙ্গুলার পার্ক। রাসবিহারি এভিনিউতে। সামান্য দূরে, গড়িয়াহাট মোড়ের কাছেই বুদ্ধদেব বসুর বাড়ি ছিল— ‘কবিতা ভবন’। বললাম, চলো, পার্কে গিয়ে বসি। তখনকার দিনে ওই অঞ্চলে এত ভিড়ভাট্টা ছিল না। মলয় সরাসরি কাজের কথা শুরু করল, একটা নতুন কিছু করার কথা বলল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম— নতুন কিছু মানে কী? মলয় বলল— আন্দোলনের কথা। কীরকম আন্দোলন? এই ধরুন স্থা-শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই, মানে প্রতিষ্ঠানের বিরোধিতা। রীতির বিরুদ্ধে বিপরীত রীতিতে কবিতা লেখা। গল্পে নতুন ভাষা আনা। উপাদানের ভৌগোলিক সীমানা ভেঙে দেওয়া। নতুন ভাষা-ভাবনার কথা বলা। আহ্নিক বদলের কথা। রূঢ় সত্যকে প্রকাশ করার কথা। সব মিলিয়ে সমস্ত পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত ছক ভেঙে ফেলার কথা বলেছিল মলয়। মলয় আমাকে বলেছিল এবং পরবর্তীকালে অনেক জায়গায় লিখেছেও যে জিওফ্রে চসারের একটি কবিতায় ‘in the sowre hungry tyme’ এই পংক্তিটি থেকে ও হাংরি শব্দটা তুলে নিয়েছিল। এছাড়াও আন্দোলনের তত্ত্বকাঠামো তৈরি করতে মলয় Oswald Spenger-এর বিখ্যাত বই ‘The Decline of the West’-এর সাহায্য নিয়েছিল। এমএ পড়ার সময় মলয় পুঁজি নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখা তৈরি করেছিল, তখন সে প্রথমবার এই বইটির সংস্পর্শে আসে। পরবর্তীকালে হাংরি শব্দটি ও আন্দোলনের পিতৃত্ব নিয়ে অনেক বিতর্ক তোলার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু একথা সন্দেহতীতভাবে বলা যায় যে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বা উদ্গাতা যদি কাউকে বলতে হয়, তাহলে সে মলয় রায়চৌধুরী স্বয়ং, অন্যেরা তাঁকে সাহায্য করেছিল।
কবি হিসেবে মলয় তখনও তেমন প্রসার লাভ করেনি। কেউ কেউ আড়ালে মলয়ের নিন্দাও করত। বলত, ও বিহারি, বাংলা জানে না। যাই হোক, ওরা ফিরে যাওয়ার পরে আমার হাতে একটি বুলেটিন আসে। হাংরি ইস্তাহার— প্রথম বুলেটিন। ইংরেজিতে লেখা। স্রষ্টা মলয়। সেখানে বলা ছিল, মলয় নিজে, দেবী রায়, সমীর রায়চৌধুরী এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়— এই চারজনই হাংরি আন্দোলনের নিউক্লিয়াস। এরকম মোট একশো সাতটা বুলেটিন বেরিয়েছিল হাংরি আন্দোলনের সময়কালে। মলয়ই প্রথম বুলেটিনটা আমাকে পাটনা থেকে ডাকে পাঠিয়েছিল। ওই সময় এরকম অনেক বইপত্র মলয় আমাকে পাঠাত। আমিও পাঠাতাম। অবশ্য তখনও আমার খুব বেশি বই বেরোয়নি। সেটা ষাটের দশকের প্রথম দিক। ‘রবীন্দ্র গুহের কবিতা’ বইটি প্রকাশ পেয়েছিল। খুবই পাতলা কাগজে ছাপা, বইটি প্রকাশ করেছিল মৃণাল বসু চৌধুরী। আমার মনে আছে, মলয় সেই পুস্তিকাটা পড়ে লাল কালির কুরুক্ষেত্র করে দিয়েছিল। প্রচুর কলম চালিয়ে বইটি আবার আমাকে ফেরত দিয়েছিল। বলেছিল, এইসব ভাষা, এইসব শব্দ বদলে দিন। অবশ্য তার পরে আর আমার বইটির দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়নি, সুতরাং সেসব আর বদলানোও হয়নি।
মলয়ের বন্ধুরা: দেশে-বিদেশে
সেসব অন্য ইতিহাস। হাংরির প্রথম ইস্তেহারের পুরোটাই ছিল কবিতা বিষয়ক। প্রথম বুলেটিনে মাত্র চারজন ব্যক্তির নামের উল্লেখ ছিল, মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায় এবং মলয় রায়চৌধুরী নিজে। পরবর্তীকালে অবশ্য আরও অনেকে হাংরির সঙ্গে যোগদান করেন, যেমন উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সুবিমল বসাক, প্রদীপ চৌধুরী, ফাল্গুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র, সুবো আচার্য। শৈলেশ্বর ঘোষও তখনই আসে, সঙ্গে তার বন্ধু সুভাষ ঘোষকে নিয়ে। আমি তখনও ভিলাইতেই ছিলাম, কিন্তু খুব ঘন ঘন কলকাতায় যাতায়াত করতাম। ওই সময় আমার লেখাপত্রও হাংরির বুলেটিনে প্রকাশ পেতে শুরু করে। এছাড়াও মলয়ের অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল, যাঁরা হাংরির বুলেটিনে লেখালেখি করেনি, কিন্তু আন্দোলনের সঙ্গে ছিলেন, সহানুভূতিশীল ছিলেন। অথবা তাঁরা বুলেটিনে ছবি আঁকতেন, যেমন করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, আলো মিত্র। এঁরা ছাড়াও সতীন্দ্র ভৌমিক, নীহার গুহ, শচীন বিশ্বাস, শঙ্কর সেন— এঁদের নাম মনে পড়ছে যারা লেখালেখি না করলেও মলয়ের সহযোগী ছিল, তাকে ভালবাসত, মলয়ের কবিতা পছন্দ করত।
অনেকেই জিজ্ঞাসা করেন, অ্যালেন গিনসবার্গ হাংরি জেনারেশনকে কতখানি প্রভাবিত করেছিলেন বা আদৌ প্রভাবিত করেছিলেন কিনা। কথাটা সত্য নয়। হাংরি আন্দোলন শুরু হওয়ার পরবর্তীকালে অ্যালেনের সঙ্গে মলয়ের ঘনিষ্ঠতা হয়, তার আগে নয়। গিনসবার্গের সঙ্গে প্রথমে বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরীর। সমীর অ্যালেনকে পাটনায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। গিনসবার্গ পাটনায় আসেন। অতি সাধারণ তাঁর পোশাক, পরনে ধুতি-কুর্তা, কপালে লাল টিপ। যতদূর মনে পড়ছে, মলয় বলেছিল গিনসবার্গের কাঁধে ঝোলা ছিল, তাতে থাকত গামছা। সেই গামছা পরে গিনসবার্গ চাতালের কুয়োর জলে ঘটিতে করে চান করতেন। তারপর মাটিতে আসন পেতে বসে মলয়ের বাড়িতে খাওয়াদাওয়া করতেন। রাতে গিনসবার্গ মশারির মধ্যে বসে বসে কবিতা লিখতেন, তারপর শুয়ে পড়তেন। অ্যালেনের ভারতে দিন কাটানোর ঘটনাগুলি নিয়ে খোঁজখবর করতে ওঁরই সহযোগী দুই বন্ধু, বব রোজেনথাল এবং বিল মর্গান পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে আসেন, কলকাতা, বেনারস, পাটনা ইত্যাদি জায়গা হয়ে শেষমেশ দিল্লি হয়ে ফিরে যান। এই দুজনের লেখাপত্র থেকেও গিনসবার্গ ও মলয়ের সখ্য ও কবিতাযাপনের কথা জানা যায়।
যখন মলয়ের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ ওঠে এবং হাংরি আন্দোলন নিয়ে আইনগত মামলা হয়, তখন এইসব বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ছিটকে সরে যায়, এমনকি শক্তিও মুচলেকা দিয়ে আন্দোলন থেকে সরে যায়। সন্দীপন সরে যায়। সুবো আচার্য সরে যায়। সঙ্গে ছিল ত্রিদিব মিত্র, সুবিমল বসাক প্রমুখ। তাঁরা শুধু মলয়ের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল তাই-ই নয়, তাঁরা বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থসংগ্রহ করে এনে মলয়কে সাহায্য করত, তাঁকে উৎসাহ দিত। তখন কলকাতা শহরে নিজস্ব কোনও আশ্রয় ছিল না, ও এর-ওর বাড়িতে থাকত, এমনও হয়েছে যে তাঁকে রেলস্টেশনে রাত কাটাতে হয়েছে, শেয়ালদা স্টেশনে প্রাতঃকৃত্য সারত, ফুটপাথে স্নান করত। যতদিন মামলা চলে, ততদিন বেশিরভাগ বন্ধুরাই দূরে দূরে ছিল, দীর্ঘ সময় ধরে অবস্থাটা এমনই ছিল। অবশ্য বলে রাখা দরকার, মলয় সে-সময়ে ভাল চাকরি করত, স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ায়।
১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে মলয়সহ এগারোজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। সেই সময়ে মলয়ের বেশ কিছু বন্ধু পাশ থেকে সরে গেলেও সারা বিশ্ব থেকে বহু বিদগ্ধ মানুষ হাংরির পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, যাঁদের মধ্যে অক্টাভিও পাজ, ফাদার এরনেস্তো কার্দেনাল অন্যতম। ভারতের অন্য ভাষার প্রতিষ্ঠিত কবিরাও হাংরি আন্দোলনকে সমীহ ও প্রশংসার চোখে দেখতেন। মলয়ের প্রতিও তাঁদের আন্তরিক সমর্থন ছিল। এঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ফণীশ্বরনাথ রেণু, বিকাশ ত্রিবেদী, কৃষ্ণ সবতি, ওম নিশ্চল প্রমুখ। দিল্লির প্রত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘Beating the Beats’ নামে লেখা বেরোত। জুন ৩০, ১৯৬৩-তে সেখানে হাংরি আন্দোলনকে নিয়ে লেখা হল The Hungryalist শিরোনামে। ডিসেম্বর ও পরের বছর জানুয়ারিতে লেখা বেরোল, Poetry and Contraceptives। ঠিক এই সময়ই লিসবন থেকে লেখা হল Erratic Lives and Loves of Hungry Generation। ধর্মযুগ-এ রাজকমল চৌধুরী লিখলেন, “লেকিন ইয়ে ভুখি পিড়িহ কেয়া হ্যায়?”
কবি মলয় রায়চৌধুরী নাকি গদ্যকার মলয় রায়চৌধুরী?
কবি মলয় রায়চৌধুরীকে আমি এগিয়ে রাখব? নাকি গদ্যকার ও ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরীকে? প্রশ্নটা শুনতে গুরুগম্ভীর মনে হলেও এর উত্তর দেওয়া মোটেই কঠিন নয়। মলয় প্রথমত এবং প্রধানত একজন কবি। একটা সহজ ব্যাখ্যা হল এই যে, মলয়ের কবিতার বইয়ের সংখ্যা তাঁর গদ্য, গল্প বা উপন্যাসের তুলনায় অনেক বেশি। মলয়ের কবি জীবনকে দুটো পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে, প্রথমটি হল হাংরির আগে ও হাংরি আন্দোলনের সময়কার কবিতা। আর দ্বিতীয় পর্যায় হাংরি-পরবর্তী কবিতা। প্রথম পর্যায়ে মলয় কোনও উপন্যাস লেখেনি। একটি প্রবন্ধের বই রয়েছে, ‘মার্ক্সবাদের উত্তরাধিকার’, এই সেই পাণ্ডুলিপি যা মলয় এমএ পড়াকালীন তৈরি করেছিল। এই প্রবন্ধগ্রন্থ প্রকাশ করে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, ১৯৬২ সালে। পরের বই মলয়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ, নাম ‘শয়তানের মুখ’। কৃত্তিবাস প্রকাশনা থেকে বইটি প্রকাশ করে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ১৯৬৩ সালে। এর পরের বইটি আবার প্রবন্ধের, নাম ‘আমার জেনারেশনের কাব্যদর্শন ও মৃত্যুমেধী শাস্ত্র’। ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত বইটির প্রকাশক ছিল জেব্রা প্রকাশনী। এর পরে আবার কবিতা। একটি দীর্ঘ কবিতার বই প্রকাশিত হয় আবারও জেব্রা প্রকাশনী থেকে, নাম ‘জখম’। মলয়ের পরের বইটি আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব পছন্দের কবিতার বই, বহুল পঠিত কিন্তু বহুল বিক্রিত নয়, ‘অমীমাংসিত শুভা’। এরপর বেরোয় দীর্ঘ কবিতার বই— ‘তুলকালাম আত্মহত্যা’। এগুলো সবই মলয়ের কবিজীবনের প্রথম পর্যায়ের লেখা। দ্বিতীয় পর্যায়ে মলয়ের কিছু কবিতার বইয়ের নাম ‘কবিতা সংকলন’, ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’, ‘হাততালি’, ‘মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা’, ‘চিৎকার সমগ্র’, ‘ছত্রখান’, ‘যা লাগবে বলবেন’। মলয় দ্বিতীয় পর্যায়ে ও শেষের দিকে বেশ কিছু উপন্যাস লিখলেও সে ধারাবাহিকভাবে কবিতাই লিখে গেছে। আমার কাছে মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম পরিচয়, সে আগাপাশতলা একজন কবি।
তবে গদ্যকার হিসেবে সে অসফল, একথাও আমি বলব না। খুব বিতর্কিত গদ্যের বই মলয় লিখেছে। আমার ভাল লেগেছে, খুব সাম্প্রতিক কালের উপন্যাস, ‘উপন্যাসের নাম নেই’। এছাড়াও ‘নামগন্ধ’, ‘জলাঞ্জলি, ‘নখদন্ত’— এগুলোর নাম করতে পারি। ওঁর আত্মকাহিনি ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ খুব ভাল লেগেছে আমার। শেষের দিকে মলয়ের বেশ কিছু বই নানা ছোট ও মাঝারি প্রকাশক প্রকাশ করেছেন, সেগুলি অবশ্য কেমন বিক্রি হয়েছে তা আমি জানি না।
হাংরি— প্রভাব ও প্রতিক্রিয়া
অভিযোগ যে মলয়ের সঙ্গীসাথীরা পুলিশি আক্রমণ ও আইনি সমস্যার সময়ে মলয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। কথাটা সত্যি, তবে সর্বাংশে সত্যি নয়। মলয় বা তার সঙ্গে যেসব বন্ধুবান্ধব এসেছিল, তারা সকলেই ছিল সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, প্রত্যেকেরই কমবেশি খ্যাতির লোভ ছিল, উচ্চাভিলাষী, আবেগপ্রবণ, এমনকি অসহিষ্ণুও ছিল কিন্তু কেউই আইনি হুজ্জুতের জন্য মানসিক ও সামাজিকভাবে প্রস্তুত ছিল না। আর মলয় যেহেতু হাংরির জন্মদাতা, ঘটনার ভাল-মন্দের মূল দায় তো তাকে নিতেই হত। তার বন্ধুরা সঙ্কটের সময়ে একেকজন একেকভাবে রিয়্যাক্ট করেছিল। আগেই বলেছি, কেউ কেউ মলয়ের পাশে ছিল। শৈলেশ্বর ও সুভাষের মতো কেউ কেউ মুচলেকা দিয়ে ও রাজসাক্ষী হয়ে ছাড়া পেয়ে যায়। কেউ কেউ আলাদাভাবে পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করার কাজে মন দেয়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ— এরা নিজের মতো করে গদ্য লেখালেখির দিকে চলে যায়। সেই চলে যাওয়া কিন্তু মলয়কে বা হাংরিকে অস্বীকার করে অন্যপথে চলে যাওয়া ছিল না। শুধু মলয় একা নয়, হাংরি গোষ্ঠীর প্রায় প্রত্যেকেই মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেসনে ভুগছিল। কেউ কেউ মার্কসবাদের আশ্রয় নেয়, যেমন ত্রিদিব মিত্র বা বাসুদেব দাশগুপ্ত। কেউ কেউ অতিবামপন্থার দিকে চলে যায়। যেমন করুণানিধান মুখোপাধ্যায়। এমনকি ফাল্গুনী রায়ও মৃত্যুর আগে নকশালপন্থী হয়ে গেছিল। একমাত্র সুবো আচার্য দীক্ষা নিয়েছিল অনুকূল ঠাকুরের। যাই হোক, হাংরি প্রজন্মের গোষ্ঠীবদ্ধতা ভেঙে যায় ঠিকই, কিন্তু হাংরির যে চেতনা সেটা কেউই হারিয়ে ফেলেনি। পরবর্তীকালের শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলন বা ওই ধরনের প্রথাবিরোধী লেখালেখির পূর্বসূরি হিসেবে নিঃসন্দেহে হাংরিকেই চিহ্নিত করা যায়। যদিও মলয় আদালতের নির্দেশে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে বলেছিল যে হাংরির স্রষ্টা আমি, আর এই আন্দোলন বন্ধও করলাম আমি। এ-সমস্ত ঘটনার কথাই তখন আমাদের দেশের প্রতিটি সংবাদপত্রে এমনকি টাইমস ম্যাগাজিনেও লেখা হয়েছে। তারপর দীর্ঘদিন মলয় নিজে লেখালেখি থেকে দূরে থাকে, চাকরি ও পড়াশুনোয় মন দেয়। মামলায় ও আইনি সমস্যায় শুধু যে মলয়কে নিগৃহীত হতে হয়েছিল তা নয়, মলয় ছাড়াও আরও অনেককে শাস্তি পেতে হয়েছিল। মলয়কে তো দাগী অপরাধীর মতো কোমরে দড়ি দিয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হাংরি বুলেটিনের সম্পাদক দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়াকে কলকাতা থেকে বর্ধমানে বদলি করা হল। বিশ্বভারতী থেকে প্রদীপ চৌধুরী রাস্টিকেট হল। উৎপল যোগমায়া দেবী কলেজে অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়। উৎপল পরে অবশ্য লন্ডনে চাকরি নিয়ে চলে যায়। অন্যদিকে, হাংরি বুলেটিনের প্রকাশক হওয়ার কারণে সমীর রায়চৌধুরীও চাকরি থেকে বরখাস্ত হয়। কফি হাউসের সামনে সুবিমল বসাকের ওপর অতর্কিতে একদল যুবক হামলা চালায়। এমনকি সুনীল আমেরিকা থেকে চিঠি লিখে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রবল উষ্মা প্রকাশ করেছিল। কেন করেছিল, সে-ব্যাপারে একটু পরে আসছি। এছাড়াও হাংরি আন্দোলনকারীরা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বলে অভিযোগ করা হয়। মোট কথা, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে হাংরি আন্দোলন সম্ভবত স্বাধীন ভারতের একমাত্র সাহিত্য আন্দোলন যেখানে শুধুমাত্র ভিন্ন রুচির সাহিত্য রচনার কারণে কবি-লেখকরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ফলে তাঁদের পক্ষে পরবর্তীকালে আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সাহস না পাওয়ার প্রেক্ষিতটা বোঝা যায়।
এখানে একটা মজার ব্যাপার উল্লেখ করা যেতে পারে। হাংরি আন্দোলন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে হাংরির কিছু কিছু সদস্য সুনীলের কাছে গিয়েছিল। সুনীলের কিন্তু বরাবর হাংরির উপর একটা রাগ ছিল। রাগ ছিল এই কারণে যে ওরা শক্তিকে হাংরি আন্দোলনের একজন নেতা বলে ঘোষণা করেছিল। অথচ সুনীল কোনও কারণে আশা করেছিল যে ওকেই হাংরির ছেলেরা মধ্যমণি করবে। কিন্তু তা না হওয়ায় সুনীল ক্রুদ্ধ হয়। মলয় পরবর্তীকালে অরুণেশের একটা প্রশ্নের উত্তরে বলছিল যে শক্তির নামে নেতা যোগ করার জন্য সুনীল দমদমে একদিন সকালে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করেছিল। সুনীল্ সে-সময়ে দমদমে থাকত। সুনীল সেদিন বলেছিল, ‘আমি কি শক্তির থুথু চাটব?’ মলয় পরে স্বীকার করে যে পাটনায় বসে শহর কলকাতার তৎকালীন সাহিত্য-রাজনীতি তাঁর জানা ছিল না। মলয় লিখেছে, ‘সুনীল যে ভুলটা করেছিলেন তা হল হাংরি ছিল আন্দোলন, আর কৃত্তিবাস একটা পত্রিকা। শক্তির জায়গায় সুনীল থাকলে এই আন্দোলন কী চেহারা নিত বলা যায় না, কারণ তা হলে একদল ভিন্ন চরিত্রের তরুণ আসতেন তাঁর পেছনে পেছনে।’
যাই হোক, হাংরি আন্দোলন বন্ধ হয়ে গেলেও, হাংরির চেতনা হাংরির সদস্যদের মধ্যে ক্রিয়াশীল ছিল। প্রাথমিকভাবে হাংরির এক অংশের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হলেও, তা পরবর্তীকালে একরকম থাকেনি। মলয়ের সঙ্গে তার বন্ধুদের যোগাযোগ আগের মতো নিবিড় না থাকলেও, একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। মলয়ের কাছে তারা লেখাপত্র চেয়েছে, মলয়ও লেখা পাঠিয়েছে, চিঠিপত্র ঘাঁটলে এমন অনেক দৃষ্টান্ত বেরিয়ে আসবে।
ফিরে আসার পর
সময়টা নিছক কম নয়। প্রায় দেড় দশক পরে মলয় সক্রিয়ভাবে আবার লেখালেখিতে ফিরে এল। অনেক বিশ্বাস নিয়ে ও জীবনের অনেক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এল। আগেকার জোড়াতালি দেওয়া অস্তিত্বটা প্রায় নেই বললেই চলে। আশির দশকের শুরুর দিকে কথা বলছি। অবশ্য মলয়ের এই ফিরে আসার পেছনে প্রাথমিক প্ররোচনা ছিল তার বিশিষ্ট বন্ধু, গদ্যকার, কৌরব সম্পাদক কমল চক্রবর্তীর। কমল একনাগাড়ে মলয়কে তাগাদা দিত কৌরব পত্রিকায় কিছু লেখবার জন্য। যতদূর মনে আছে, মলয় কমলকে প্রথমবার একগুচ্ছ কবিতা পাঠিয়েছিল কৌরবে প্রকাশের জন্য। বেশ হইচই করেই পাঠিয়েছিল। মলয়ের মধ্যে নিশ্চয়ই আগের দাপট অনেকখানি ছিল, এটা অস্বীকার করা যায় না। উৎসাহ ছিল। জেদ ছিল। পুরনো খিদেটা সম্পূর্ণ না হলেও বেশ খানিকটা ছিল। তবে মলয়ের সেই সময়ের কবিতা পড়লে মনে হয় স্বতঃস্ফূর্ত ভাবটা কিঞ্চিৎ কম। মলয় একেকটি কবিতা লিখত, লিখত ঠিক বলা যায় না, সে একেকটি কবিতা গড়ে তুলত। বা আরেকটু কর্কশভাবে যদি বলা যায়, মলয় কবিতা বানাত, এবং যথেষ্ট সচেতনভাবে একেকটা কবিতা তৈরি করত। একটা আইডিয়া নিয়ে কিছুদিন বসে থাকত। তারপরে কবিতাটি লেখা হত। কোথাও আমি মলয়ের কোনও লেখায় পড়েছি, অথবা মলয়ের মুখেই শুনেছি, মলয় সবসময় একটা ডায়েরি মেনটেইন করত যেখানে ও ওর পছন্দের শব্দগুলো লিখে রাখত। এবং কবিতা লেখা হওয়ার পরে সেই সেই শব্দ জুতসইভাবে গুঁজে দিত। যেমন, দেয়ালে ঠুক ঠুক করে পেরেক ঠোকা হয়, মলয় কবিতায় শব্দ ঠুকে দিত। এটা মলয় বহুদিন ধরে সচেতনভাবেই করে এসেছে এবং কোনওদিন একথা অস্বীকারও করেনি। খুব নিবিষ্টভাবে পড়লে ও বিচার-বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, তাঁর ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’ কবিতা বা ‘চিৎকার সমগ্র’ বা ‘যা লাগবে বলবেন’ এই শিরোনামগুলোই প্রকাশ করে যে কথাগুলো প্রচলিত অর্থে কাব্যিক নয়। যেন তৈরি করা, সচেতনভাবে গড়ে তোলা। মলয়ের এই সময়কার গদ্যও ঠিক তেমনিই ছিল। সে-কথা আপাতত আনছি না। কবিতার কথাই বলছি। পবিত্র মুখোপাধ্যায়, বাসুদেব প্রভৃতি মলয়ের ‘অমীমাংসিত শুভা’, ‘জখম’ এইসব কবিতা গ্রন্থ নিয়ে আলোচনা করেছে বিভিন্ন জায়গায়, এবং তুলনামূলকভাবের সেই সময়কার কবিতার কথাও এনেছে, তাতে বারবার সমালোচকরা এ-কথা উল্লেখ করেছেন। যাই হোক, এসব বিতর্কের ব্যাপার। তবে কিছু কিছু কবিতা, যেমন কবিতা পাক্ষিক পত্রিকা থেকে প্রকাশিত ‘চিৎকার সমগ্র’, বা কবিতীর্থ থেকে প্রকাশিত ‘ছত্রখান’, এগুলো একটু ভিন্ন ধরনের বলেই আমার মনে হয়েছে।
শেষের কথা
আমার নিজস্ব লেখালেখির ভৌগোলিক পরিসর হাংরির চেয়ে বিস্তৃত ছিল, আমি কোনও ধরনের সঙ্কীর্ণতায় নিজেকে বাঁধতে চাইনি, কিন্তু মলয়ের সঙ্গে আমার যোগাযোগ কখনও ছিন্ন হয়নি। মলয় ও তার স্ত্রী ২০০৯-এ মুম্বাই চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত ওর নাকতলার বাড়িতে আমি নিয়মিত যেতাম। ওর ঘরটা আমার খুব ভাল লাগত। একটু হাওয়া দিলেই ওদের বাড়ির বাইরে নারকেলগাছ, সরু সরু সুপারিগাছ মাথা দোলাত আর আমার সে-সব দেখতে খুব ভাল লাগত। মলয় পা তুলে বাবু হয়ে বসে আমার সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করত। ওর স্ত্রী আমাকে ঘুঘনি ও নানা জিনিস তৈরি করে খাওয়াত। তারপর ওরা মুম্বাইয়ে আগে থেকে কিনে রাখা একটা ফ্ল্যাটে চলে গেল। এর পেছনে একটা যুক্তি ছিল যে মলয় ভিড়ভাট্টা থেকে দূরে নির্জনে লেখালেখি করতে চেয়েছিল। সেটা যে সে করতে পেরেছিল তা কিন্তু তার শেষজীবনে লেখালেখির পরিমাণ থেকেই বোঝা যায়।
তথ্যসূত্র:
- হাংরি বুলেটিন।
- মলয় রায়চৌধুরীর হাংরি সাক্ষাৎমালা। সম্পাদক – অজিত রায়। প্রকাশক – মহাদিগন্ত। প্রথম প্রকাশ – বৈশাখ ১৪০৬, এপ্রিল ১৯৯৯।
- হাংরি আন্দোলন ও দ্রোহপুরুষকথা। লেখক- অধ্যাপক কুমারবিষ্ণু দে। প্রকাশক – সুকুমার দে। সহযাত্রী প্রকাশনা। প্রথম প্রকাশ – জুন ২০১৩।
*সমস্ত ছবিই লেখকের সৌজন্যে প্রাপ্ত
রবীন্দ্র গুহ-র সঙ্গে যোগাযোগের জন্য ওনার ফোন নম্বর, ই-মেইল, ঠিকানা পাওয়া যেতে পারে কি? পেলে খুবই উপকৃত হতাম।
আপনার মেল আইডি দিন।