শারিফুস সালেকিন-শাহান
স্বাধীনতার পর পর আমার বোঝার, মনে রাখার বয়স হয় -– আমি অনেক কিছুই দেখে মনে রাখতে শুরু করি। সরকারি কলোনিতে থাকতাম, সে সময়ে সাম্প্রদায়িকতা ছিল মৃদুলরা হিন্দু বা নিনা’রা বড়ুয়া (বৌদ্ধ)। আমার বাপ দাদা ভারত থেকে এদেশে এসেছেন সেটার কারণে তীব্র ভাষায় রিফিউজি ডাক শুনে কেঁদেছি -– সেটাই বড় বেদনার ছিল।
কলোনির শত শত বাসার মাঝে এক বা দুইটা বাসায় অতি ধার্মিক কেউ থাকত -– তাদের বাড়ির কোনও মহিলা বাইরে গেলে রিকশাটাকে চাদর বা শাড়ি দিয়ে পেঁচিয়ে দিত। আমরা খুব অবাক হতাম, মজাও করতাম। বোরখা পড়ত শুধু খালেক সাহেবের স্ত্রী -– তাও বাইরে গেলে।
একদিন মৃদুলের বাসায় গেলাম, চলে আসার সময় শুনি মৃদুলের মা চেঁচামেচি করছেন, আমরা যে চেয়ারে বসেছিলাম সেগুলো ধুতে হবে এসব বলছেন। বাসায় ফিরে দাদি আর আম্মাকে বললাম। দাদি -– যিনি আজীবন দেশভাগের জ্বালা নিয়ে আক্ষেপ করতেন, বললেন -– তাহলে আর ওদের বাড়ি যাবি না। আম্মা বললেন -– ওরা এমন কেন? আমরা তো সেনপাড়ায় দিনরাত পড়ে থাকতাম। অনুকুল ভাইয়ের ঘাড়ে চড়ে বেড়িয়েছি, প্যাল্লাত স্যাল্লাত, বর্মণ, থেগারু ডাক্তার… কমলা… নাহ! এরা অন্যরকম। আর যাস নি।
মসজিদটা যেখানে সেই অংশটায় তখন নতুন ক্লাব হয়েছে -– সবুজ সংঘ। তার আগে গোটা এলাকায় একটাই ক্লাব -– ছাত্র যুব শক্তি। এটার ঘর তৈরিতে ইট বয়ে নেয়া থেকে শুরু করে সব কাজ করেছিল অস্ট্রেলিয়ার কিছু তরুণ তরুণী।
ছাত্র যুব শক্তি ক্লাবের পর মুকুল ফৌজ তৈরি হল। আমরা পিটি করা শিখলাম, ডাম্বেল নিয়ে চমৎকার ড্রিল, স্টেডিয়ামে গেলাম বিজয় দিবসের প্যারেড করতে। মুকুল ফৌজের প্রাণ বড় ভাই আমাদের মাঝে যারা বই পড়তে ভালবাসে তাদের নিয়ে সপ্তাহে এক দিন পার্কের এক কোণায় বসতেন। নানা বিষয়ে আলাপ হত, সাধারণ জ্ঞানের প্রতিযোগিতা হত -– আমাদের মাঝে সাধারণ জ্ঞানের তীব্র আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে দিলেন।
কিছুদিন পর যুব শক্তি ক্লাবে বড় ভাইরা তাস খেলা থেকে ক্রমে বিভিন্ন ধরনের জটিলতায় জড়িয়ে পড়লেন। এলাকার কিছু গুরুজন আর বড় ভাই মিলে কিশোর সংঘ তৈরি হল। ছাত্র যুব শক্তি ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকল, হারিয়ে যেতে থাকল শিশু কিশোরদের নিয়ে নানা উদ্যোগ। কিশোর সংঘের উদ্যোক্তাদের কারণে বড় ভাই সহ অনেকের চরিত্রের মৃত্যু হল।
কিশোর সংঘ আর সবুজ সংঘের মাঝে তীব্র রেষারেষি -– ফুটবল খেলাকেন্দ্রিক। ঐ নিয়ে মারামারি হত। সবুজ সংঘের পেছনেও মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন কিন্তু ক্রমেই সবুজ সংঘের ভেতরে শিবিরের উত্থান।
এদিকে মানুষ ক্রমশ মসজিদমুখী হচ্ছে। আমার সব বন্ধুরা সারা সপ্তাহ যাই করুক, শুক্রবার হলে গোসল করে সেজেগুজে জুম্মার নামাজ পড়তে যায়। দাদু বললেন -– তুই যেতে চাইলে যা তবে নামাজের পর সোজা বাসায় আসবি -– কোথাও যাবি না। কারণ নামাজের পর প্রাকাশ্যেই শিবিরের বড় ভাইরা মুর্গি ধরত (কর্মী জোগাড় করত)।
এলাকায় কার বাবা ঘুষ খায়, কে চোরাচালানির সাথে জড়িত সেসব ক্রমেই অনালোচিত হতে থাকল -– কলোনির বাসিন্দা কেউ কেউ জাপান থেকে গাড়ি আমদানি করল। কোরবানিতে কার গরু কত বড় সেই প্রতিযোগিতা।
তারপর একসময় চতুর্দিকে ঘুষখোর দিয়ে ছেয়ে গেল, মসজিদে তাদেরই আধিপত্য। জুম্মার নামাজে মসজিদে জায়গা হয় না, চমৎকার মসজিদটার সামনের অংশে টিনের চালা দেয়া হল -– হতশ্রী কিম্ভুত চেহারার একটা মসজিদ, তিল ধারণের জায়গা নেই।
কলোনিতে খুব কম বাসায় টিভি ছিল। আমরা টারজান, টম এন্ড জেরি দেখতে যেতাম মালা’দের বাসায়। গোটা পাড়ার টিভি দেখার স্থান -– মালা’র বাবা মা আমাদের যন্ত্রণায় কখনই রাগ হননি। মালাদের পরিবার ব্রাহ্মণ ছিল।
ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার কারণে দাঙ্গা। দেশে তীব্র উত্তেজনা -– ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সামরিক শাসক সেই সুযোগে বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা লাগিয়ে দিল। হঠাত করেই অঞ্জন-রঞ্জনের সাথে আমাদের খানিক দূরত্ব, খানিক অবিশ্বাস!
পঞ্চগড়ে যেতাম খুব কম। সে সময়ে রাস্তাঘাট খুব খারাপ, যমুনা পাড়ি দেয়া খুব কষ্টের ছিল। গ্রামে তীব্র দারিদ্র আর চরম অশিক্ষা। তবুও গ্রামে কোনদিনও হিন্দু মুসলমান ঝামেলা হয়নি। বাবরি মসজিদের পর গ্রামে যেয়ে প্রথম শুনলাম আমার এক আত্মীয় মাদ্রাসায় পড়তে গেছে, আরেকজন বলছে -– নরেন তো হেন্দু!
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ পর্যন্ত একরকম ছিল। ১৯৭৮ সালের দিকে হঠাত কিছু মানুষের টাকা বাড়তে থাকে, রাজনীতি অন্যরকম হয়ে যায় আর হিন্দু মুসলমান ব্যাপারটা বড় আকার ধারণ করে। আওয়ামী নাম নেয়া নিষেধ, হিন্দুরা সব আওয়ামী লিগার, ভারত বিরোধিতা তুঙ্গে (সে সময়ে ফারাক্কা নিয়ে তুমুল হট্টগোল)। হিন্দুরা কোণঠাসা হতে থাকে। পরিচিত কেউ কেউ ভারতে চলে গেল।
১৯৭৫-এর পর এদেশের মানুষ দুবাই সৌদি গেছে -– মফস্বলের মানুষ স্বচ্ছলতার মুখ দেখেছে। সৌদি’র রাস্ট্রদূতের প্রকাশ্য তৎপরতায় জামাত পুনর্গঠিত হয়েছে। মসজিদের ইমামরা আগের মতো হাসিখুশি নেই, রাগী আর খুব জেদি।
যাদের পরিবার মুক্তিযুদ্ধে কোনওভাবেই অংশ নেয়নি, সমর্থন করেনি এবং যারা বিরোধিতা করেছিল তারা দ্রুত অর্থনৈতিক সাফল্য পেয়ে গেল। ফলে সমাজে তারাই নেতা, তারাই সমাজের গতিপথ নির্ধারণ করে।
অপরদিকে জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছি টিভিতে, গল্পে, মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধ বা শুভ অশুভের কোনও ব্যাপার থাকলে সবসময়ে একজন টুপি দাঁড়িওয়ালা মানুষকে সেই খল চরিত্রে দেখানো হবে। যেন খলনায়ক শুধু ধার্মিক মুসলমান হলেই সম্ভব।
শাহরিয়ার কবীর লিখলেন একাত্তরের যিশু। আমরা সেই বই নিয়ে যখন খুব আলাপ করছি তখন একজন মুক্তিযোদ্ধা বাবা বললেন কেন মুক্তিযুদ্ধে কোনও মুসলমান, কোনও ইমাম, কোনও মোল্লা বা কোনও দরবেশের কোনও অবদান নেই?
পুরোটা সময় জুড়ে সামরিক সরকার পাকিস্তানি হানাদার, রাজাকার, বঙ্গবন্ধু এসব শব্দ রেডিও টিভিতে নিষিদ্ধ করে রেখেছিল। পত্রিকাতেও খুব সামান্যই লেখা হত।
জিয়া’র সামরিক সরকার পাকিস্তান থেকে অশ্লীল নাচিয়েদের এনে যাত্রাপালার মধ্যে সেসব নাচ ঢুকিয়ে দিল। ফলাফল অশ্লীলতার কারণে মানুষ যাত্রাবিমুখ, আবার সেই একই অভিযোগে মোল্লারা ভালো যাত্রাপালাগুলিও বিদায়ের ব্যবস্থা করল।
চলচ্চিত্রে শুরু হল চাকভুম চাকভুম মার্কা গল্প আর যৌন সুড়সড়িতে পূর্ণ নাচগান -– চলচ্চিত্র হয়ে গেল বখাটেদের বিষয়।
অপরদিকে সংস্কৃতির তালুক মুলুকের মালিক যারা তারা সমানে রাজাকার, আল বদর, ধর্ষণ, হত্যা, পাকিস্তান এসবের সাথে ইসলাম ধর্ম আর মুসলমানকে গুলিয়ে দিয়েছেন।
একটা পিছিয়ে থাকা, অশিক্ষিত জনপদের মাঝে নীতি নৈতিকতার বাহন ছিল পল্লীগান। আমাদের মহান শিক্ষাবিদরা সেগুলিকে অক্ষমের সাহিত্যচর্চা বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেন, নজরুল অপাংক্তেয় হয়ে গেল।
ফলাফল হয়েছে ভয়াবহ। সাংস্কৃতিক শূন্যতার মাঝে উদ্ভব হয়েছে মাদক, পর্ণ ছবি, ওয়াজ মাহফিলের নামে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার আর খোদ ইসলাম ধর্মের মৌল শিক্ষা থেকে সরে যেয়ে ওয়াহাবিজমের সূচনা।
এক হুমায়ুন আহমেদের আগে সাহস করে কেউ এদেশের মুসলমানদের জীবনযাপন নিয়ে, তাদের ধর্মপালন নিয়ে লিখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন না। হুমায়ুন আহমেদ গালমন্দ পেলেন।
ক্রমাগত দুই মুখী প্রচারের ফলে একটা প্রজন্মের মধ্যে স্মরণীয় ব্যক্তিত্বের শূন্যস্থান পূর্ণ করতে এগিয়ে এল সাইদি, গোলাম আজম আর কওমি মাদ্রাসার সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নেতারা।
আরেকদল ভাবছে এই দেশের সবাই সাম্প্রদায়িক।
মেধা ও মননের চর্চা চাঙ্গে উঠেছে।
তারপর এরশাদ যুগে ধর্মের বর্মের আড়ালে এরশাদ নিজেই ২২ কিংবা ৩২ জন গার্লফ্রেন্ড নিয়ে মৌজ করে বেড়িয়েছেন। ইসলামকে রাস্ট্রীয় ধর্ম বানিয়ে জন্মাস্টমীতে ছুটি দিয়েছেন।
এরশাদের পেয়ারের দালাল মোল্লাদের ছাপিয়ে তখন শক্তিশালী হতে শুরু করেছে কওমি মাদ্রাসার হুজুরেরা। এই হুজুরদের বেশিরভাগ খুব কষ্টকর এবং সাদাসিধে জীবন যাপন করেন এবং এদের সমস্ত চিন্তাভাবনা ধর্মকেন্দ্রিক। ধর্ম বিষয়ে কোনও প্রশ্ন এলে বড় হুজুর যা বলবেন সেটাই চূড়ান্ত। সেই বড় হুজুরেরা নাস্তিক বা কাফের হিন্দুদের দেশে চিকিৎসা নিলেও সমস্যা নেই। বড় হুজুরেরা আবার করাচি/লাহোর/জেদ্দা/রিয়াধের বড় ভাইদের কথাই চূড়ান্ত মনে করেন।
এই যখন দেশের অবস্থা তখন এর সাথে আছে বৈষয়িক ঝামেলা। পিচ্চি একটা দেশ -– ইউরোপে হলে বড়জোর ৫০ লাখ মানুষের দেশ হত। সেখানে আছে ১৬ কোটির বেশি। ফলে জমির দাম বেড়েছে অবিশ্বাস্য হারে। ১৯৭৮-এ আমাদের গ্রামে ১ বিঘা জমির দাম ছিল ৪০০০ থেকে ৭০০০ টাকা -– সেটা কেনার মানুষ ছিল না। আজ সেই গ্রামে কেনার মতো জমি নেই, পাওয়া গেলে দাম উঠবে ২০ লাখ।
অথচ হিন্দুদের হাতে জমি আছে, বাজারের দোকান আছে, গঞ্জে বা শহরে বাড়ি আছে।
ধনী হিন্দুরা দেশভাগের আগে থেকেই কোলকাতায় সম্পদ জড়ো করত। ১৯৭৫-এর পর থেকে এটা আরও বেড়েছে বলে দেশজুড়ে প্রচলিত ধারণা (ব্যবসা থেকে দুর্দান্ত আয় হলেও গরীবি হালের বাড়ি, শিল্পে বিনিয়োগ না করা), কিছু বড় মাপের জালিয়াতি (ব্যাংকের টাকা নিয়ে ভারত চলে যাওয়া) এসবের কারণে ব্যাংকাররা হিন্দু ব্যবসায়ীদের আর আস্থায় রাখতে পারছেন না -– যদিও ঐ টাকার চেয়ে বহুগুণ বেশি পরিমাণ টাকা ব্যাংক লুটের (হলমার্ক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ, শেয়ার বাজার, বেসিক ব্যাংক) হোতারা মুসলমান।
যেহেতু হিন্দু ধনীদের কোনও বিনিয়োগ নেই, ফলে হিন্দু সমাজের নতুন প্রজন্মের দেখভাল করার কেউ নেই। বরং যাদের সামর্থ্য আছে তারা সন্তানকে ভারতে পড়াচ্ছেন, সেখানেই চাকরি বা ব্যবসা করে থিতু হবে। এই অবস্থায় বাকি রইল গ্রামে গঞ্জে পড়ে থাকা গরীব চাষি হিন্দু। এদের নেতা নেই, শিক্ষা নেই, টাকা নেই। এদের ওপর হামলা হলে কিছু হিন্দু নেতার কপাল খুলে যায় -– টেকাটুকা আসে, টিভিতে বক্তিমা দেয়া যায়!
এই দেশে খ্রিস্টিয়ানদের সংখ্যা বাড়ছে তবে এখনও তারা ১%-এর চেয়ে কম। অথচ তারা খুবই চমৎকারভাবে সংগঠিত, একে অপরের বিপদে, প্রয়োজনে দাঁড়াচ্ছে। হিন্দুদের এক রামকৃষ্ণ মিশন ছাড়া আর কোনও প্রতিষ্ঠানের নাম জানা নেই। হিন্দুদের ওপর হামলা হলে আমরা প্রতিবাদ সমাবেশ করি -– ৫০-১০০ জন। অথচ এক জগন্নাথ হলের ছেলেরা সমাবেশ করলে সরকারের টনক নড়ে যায় -– তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে না।
কাপুরুষ মরে বারবার -– এই সহজ সত্য তারা জানে না।
হামলা হচ্ছে কেন?
নানান কারণ আছে তবে স্রেফ ধর্মের কারণে হামলা হচ্ছে এটা এক্কেবারে মিথ্যা। এরকম কোথাও ঘটেছে বলে আমি অন্তত জানি না। রামুতে বৌদ্ধদের ওপর হামলার পেছনে স্থানীয় সর্বদলীয় নেতারা জড়িত ছিল। যদ্দুর জানি সেটাও আওয়ামী সরকারকে বিপদে ফেলা এবং জমিজমা সংক্রান্ত।
নাসিরনগরে বর্তমান সাংসদকে বিপদে ফেলতে আওয়ামি’র আরেক পক্ষ হামলার নাটক সাজিয়েছে, টেকাটুকা দিয়ে সাহায্য করেছে স্থানীয় এক শিল্পপতি যিনি বিরোধীদল থেকে মনোনয়ন নিয়ে বারবার হেরেছেন।
রংপুরে যা ঘটেছে সেটার পেছনে মূল কারণ ধর্ম নাকি জমিজমা নাকি জামাতের ক্ষমতা প্রদর্শন সেটা এখনও নিশ্চিত নই। যে কোনও একটা বা সবকয়টা মিলিতভাবে কার্যকর ছিল -– এমন হতে পারে।
এখানে দেখার বিষয় হচ্ছে এইসব ঘটনার সাথে সাথেই একদল হিন্দুদের গালিগালাজ করতে থাকে, আরেকদল গালিগালাজ করে মুসলমান এবং ইসলাম ধর্মকে।
অধিকাংশ মানুষ নীরব এবং তাদের মাঝে এসবের বিরুদ্ধে ঘৃণা আছে বলেই ধারণা করি।
প্রশাসন ব্যর্থ হচ্ছে কেন?
৫ই জানুয়ারির নির্বাচন ও তারপরের আগুন সন্ত্রাসের কবল থেকে দেশকে বের করে এনেছেন শেখ হাসিনা। কিন্তু ঐ সময়ে উনার পেছনে সবচেয়ে শক্ত অবস্থানে ছিল পুলিশ আর প্রশাসন। সেই সন্ধিক্ষণে পুলিশ ঢালাও গ্রেপ্তার করেছে, গ্রেপ্তার বাণিজ্য করেছে। এখন কোথাও হামলা হলেই হাজার হাজার অজ্ঞাতনামার নামে মামলা দিয়ে চলে গ্রেপ্তার বাণিজ্য। প্রশাসন তার সমস্ত দুর্নীতি লুটপাট অবাধে করে চলে। যেমন তেল দিয়েছি তেমনি মালিশ কর আর কি!
সেই কঠিন সময়ে ভারত প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার পক্ষে দাঁড়িয়ে যায়। আজও জামাত সেই ক্ষোভে ফুঁসছে -– সেই সময়ে আওয়ামী সরকার উৎখাত হয়ে গেলে জামাতের শীর্ষ নেতাদের বেশিরভাগকেই ফাঁসি’র হাত থেকে বাঁচাতে পারত। জামাত সেই রাগ ঝাড়ছে, কোনও কারণে ২০১৮-তে আওয়ামীর পরাজয় ঘটলে দেশে রক্তগঙ্গা বয়ে যেতে পারে।
তাহলে উপায়?
উপায় ঐ সাধারণ মানুষ! তাদের কাছে যেতে হবে, জানাতে হবে প্রত্যেকটি ঘটনার ইতিহাস। তাহলে মানুষের চোখ খুলবে -– তারা রুখে দাঁড়াবে।
বর্তমানে এদেশের প্রগতিশীল নামধারীরা ব্যাংক লোন, প্রজেক্ট, বিদেশ ভ্রমণ এইসব নিয়ে এত ব্যস্ত যে প্রতিবাদ করা বা মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করা -– এসব আর সম্ভব নয়। তা ছাড়া এসি গাড়ি, এসি বাড়ি, তেল মাখন খেয়ে শরীর ভারি হয়ে গেছে — এইসব ফইন্নিদের পাশে দাঁড়ানো আর পোষাবে না।
মানুষও এদের আর বিশ্বাস করে না।
একটা নতুন প্রজন্মের চিন্তাবিদ, কর্মীদের এগিয়ে আসতে হবে। যারা তাদের লেখনী, গান, অভিনয় আর কাজের মাধ্যমে মানুষের মন জয় করে নেবে -– মানুষকে জাগাবে।
বর্তমানে দেশের কিছু কিছু মাদ্রাসা, ইসলামি গবেষণা কেন্দ্র এত বেশি গবেষণামূলক কাজ করছে, তাদের গ্রন্থাগারগুলি এতটাই পূর্ণ, তাদের গবেষকরা এতটাই মেধাবী যে দেশের প্রগতিশীল নামধারীদের তারা স্রেফ উড়িয়ে দিতে পারবে -– যে কোনও বিতর্কসভায় (ব্যতিক্রম আছে)। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ইতিমধ্যে তাদের দখলে চলে গেছে (শিক্ষক এবং ছাত্র দুই দিক থেকেই)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যলায়ে হিজাবি ছাত্রীর সংখ্যা প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনগুলির সমাবেশকে লজ্জা দিতে পারে।
আর চোখের সামনে আছে ভারতের উদাহরণ। কংগ্রেসের বিকল্প বানাতে যেয়ে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে কীভাবে বিজেপি’র উত্থান ঘটেছে সেটা জানা আছে সবার। সেই তরিকা এখানেও চালু হতে পারে।
কাজেই ফেসবুকে বিপ্লবী এই প্রজন্ম বরং নীরব থেকে জামাতি হেফাজতিদের সমর্থন দেবে।
সুতরাং ভবিষ্যতে এই দেশে আরও কিছু নাসিরনগর ঘটে গেলে অবাক হব না। একবার সাংসদ হতে পারলেই গাড়ি বাড়ি, মালয়েশিয়া আমেরিকায় বাড়ি, কোটি কোটি টাকা -– সেই মহৎ কাণ্ডে কিছু গরীব হিন্দুর ঘর পোড়া গেলে সমস্যা কী বলুন তো? মুসলমানের ঘর পোড়া গেলে হাউ কাউ তো হয় না।
তবে এইদেশে গোরক্ষকদের মতো পিটিয়ে মানুষ হত্যার উৎসব ঘটবে না বলে দৃঢ় বিশ্বাস আছে। সেটাই একমাত্র আশার আলো।
এখানে বলে রাখা ভালো, ঢাকার ঠিক লাগোয়া এলাকাগুলিতে চলছে জমি দখলের উৎসব। দখলদাররা প্রভাবশালী এবং কোটি কোটি টাকার মালিক। তারা দেদারসে জমি দখল করছে, বাধা দিলেই মামলা হামলা গুম। সেইসব জমি মূলত মুসলমানের -– কাজেই সেই নিয়ে হৈ চৈ হচ্ছে না। এইদিক দিয়ে দেখলে গরীব হিন্দু’র কপাল ভালো -– তার জমি দখল হলে অন্তত শোরগোল হয়।
সুতরাং আপাতত টিটু রায় রিমান্ডে থাকুক, রসরাজ আদালতে দৌড়ে বেড়াক – ২০১৮-র ভোটের আগে পরে আরও কিছু ফইন্নির পোলা রসরাজ বা টিটু এইরকম মাইঙ্কা চিপায় পড়বে সেটা নিশ্চিত।
বহু বছর পরে গ্রামে গিয়েছি। সেনপাড়ায় আগে মাত্র দুই ঘর মুসলমান ছিল (আমার বড় মামি’র দুই ভাই) -– এখন সেখানে অনেক মুসলমান ঘর করেছে। খগের হাট এখন পাকা দোকান পাট, বিজলি বাতি, পাকা রাস্তা নিয়ে জমজমাট। বটগাছটা কেটে ছোট করে ফেলেছে তবুও এখনও বিশাল, একটা পাকা মসজিদ হয়েছে।
সেনপাড়া ছেড়ে আমার ভাইয়ের ঘরের পাশে ঘর তুলেছে বর্মণ।
–কী ব্যাপার হে? সোগে এন্ডিয়া যাবার নাগছে, তোমরা হামার এতি কেনে?
–ভাইয়ে ভাইয়ে বাজাবাজি, মুই এগিলা কামে না যাং, তাহে তোমার এটে আসিছু।
–এন্ডিয়া যাবার নন?
–নাহ! অটে হামার কাঁই আছে? মুই কামলা দেং, গরীব। এটেও গরীব, অটেও গরীব। গরীব মাইন্সের আবার দ্যাশ কি বাহে? গরীব মাইন্সের দ্যাশ নাই।