অভীক ভট্টাচার্য
ঝুপড়ির দাওয়ায় বসে কথা হচ্ছিল সরস্বতী-র সঙ্গে। সরস্বতী লোহার। জামশেদপুরের বাচ্চা সিং বস্তির একেবারে শেষ প্রান্তে যেখানে সরস্বতীর ঘর, তার ঠিক পেছন থেকেই শুরু হয়েছে পেল্লায় গর্ত। গর্ত না-বলে সেটাকে ছোটখাট একটা খাদ বলাই ভাল। ওখানে আগে ইটভাটা ছিল। এখন চুল্লির মস্ত হাঁ-মুখটা শুধু পড়ে রয়েছে। বর্ষার জল জমে আপাতত সেটা রীতিমত একটা পুকুর।
সরস্বতী জানাচ্ছিল, ছেলেবেলায় ওই ইটভাটায় কাজ করতে যেত বস্তির ছেলেমেয়েরা। ও-ও ছিল সেই দলে। ঘুম থেকে উঠেই লেগে পড়তে হত কাজে। রোজ। শনি-রবির বালাই ছিল না। দুপুরে খাওয়ার জন্য পনেরো মিনিট, তার পর ছুটি হতে সেই সন্ধেবেলা। ঘরে ফিরতে আঁধার নেমে যেত। টাটা কারখানার পেছনের আকাশটা ততক্ষণে লাল হয়ে উঠত ব্লাস্ট ফার্নেসের ধোঁয়ায়। এভাবেই চলত মাসের পর মাস।
“কী করতিস তোরা ইটভাটায়?”
“ইট বইতাম। পাঁজা সাজাতাম। খানিক পর-পর পা দিয়ে দিয়ে ইট উলটে দিতে হত।”
“আর?”
“আর কী? সারাদিন ধরে এই একই কাজ। কেবল বর্ষাকালে কাজ বন্ধ থাকত।”
“স্কুলে যেতিস না?”
“নাহ। কী হবে স্কুলে গিয়ে?”
“তার পর?”
“তার পর তো বড় হয়ে গেলাম। শাদি হয়ে গেল।” বড় হওয়াটার ওপর খানিক বেশি জোর দিয়ে, ফিক করে হেসে ফেলে সরস্বতী।
“তাই? বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দিল?”
“না। নিজেই বিয়ে করে ফেললাম। পালিয়ে।” এখন আর একটুও লজ্জা নেই ওর গলায়।
“তা, তোর আদমি কী করে?”
“ট্রাক লোডিং-আনলোডিংয়ের কাজ।”
“আরেব্বাস! লোডিং-আনলোডিং কথাটার মানে জানিস তুই?”
“ওই তো, কুলির কাজ। ডাম্পারে রাবিশ বোঝাই করে সুবর্ণরেখার পাড়ে গিয়ে ফেলে আসা।”
চড়চড়ে রোদে উঠোনে খেলা করছে একদল বাচ্চা। বিলকুল উদোম। নাক দিয়ে সর্দি। কোমরে ঘুনসি। সারা গায়ে ধুলো।
“এর মধ্যে কোনটা তোর?”
“আমারগুলো তো নেই এখানে”, স্মার্ট উত্তর সরস্বতীর।
“কোথায় তোর বাচ্চারা? স্কুলে পাঠিয়েছিস?”
“আমারগুলো তো মরে গেল। আর ওই বড়টা আমার আদমির আগের পক্ষের।” একটা বছর-ছয়েকের মেয়েকে দেখিয়ে জানায় সরস্বতী।
কথায়-কথায় জানা যায়, পর-পর তিনটি সন্তান মারা গিয়েছে সরস্বতীর। চতুর্থটির সবে একমাস, এখনও একেবারে কোলের।
“সুঁই লাগিয়েছিস ছোটটাকে?”
“না।”
বোঝা গেল, বিসিজি হয়নি। ট্রিপল অ্যান্টিজেন তো অনেক পরের কথা। প্রশ্ন করায় সরস্বতী জানাল, আগের তিনটি মারা গিয়েছে জ্বর আর কাশিতে। নিউমোনিয়া কাকে বলে, সরস্বতী জানে না। ডাক্তার দেখিয়েছিল, কিন্তু কিছু হয়নি। সরকারি রিপোর্ট বলছে ভারতবর্ষে সবচেয়ে বেশি সদ্যোজাত শিশু মারা যায় নিউমোনিয়া আর শ্বাসনালীর সংক্রমণে। সদ্যোজাত শিশুমৃত্যুর মোট সংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। দেশজোড়া ওই অনন্ত হিসেবের পেল্লায় এক্সেল শিটের মধ্যে কোনওখানে স্রেফ সংখ্যা হয়ে ঘুমিয়ে আছে ওর বাচ্চারাও। কেন, তা জামশেদপুরের বাচ্চা সিং বস্তির সরস্বতী লোহারকে কোনওদিন জানানোর প্রয়োজনও মনে করেনি কেউ।
১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল সরস্বতীর। বছর ঘুরতে না-ঘুরতে মাতৃত্ব। তার পর প্রতিবছর একবার করে। একটাও থাকেনি। এখন সে ১৮। বাচ্চাগুলোর আর দোষ কী?
“ছোটটাকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছিস?”
ফিসফিস করে সরস্বতী যা বলে তার মানে দাঁড়ায়, বুকে দুধ আসেনি।
“কী খাস তুই?”
“ভাত আর মুংগা শাক। আর কী খাব?”
বুকের আর দোষ কী?
আইসিডিএস সেন্টার কাকে বলে, সরস্বতী জানে না। সেখানে যে শিশু ও প্রসূতি মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের বিলিব্যবস্থা রয়েছে, সেসব কেউ বলে দেয়নি ওকে। ফলে সরস্বতীর জানা হয়ে ওঠেনি যে, আমাদের দেশ ছ’বছর বয়স পর্যন্ত সব শিশুকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসতে বদ্ধপরিকর, অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন উচ্চ ক্যালোরি ও প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার দেওয়া হয় শিশু ও আসন্নপ্রসবা মায়েদের, প্রতিমাসে শিশুর ওজন নেওয়া হয়, বাড়বৃদ্ধি কম হলে তাদের নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। আফশোস, এই বিপুল সদিচ্ছা ও আয়োজনের সুদীর্ঘ হাত সরস্বতী লোহারের ঝুপড়ি পর্যন্ত পৌঁছয়নি।
সরস্বতী-র ছেলেমেয়েরা
দীর্ঘ প্রায় ন’বছর পর, সবে বছরখানেক হল হাতে এসে পৌঁছেছে জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার চতুর্থ পর্যায়ের ফলাফল। সেই রিপোর্টে দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যর যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা ঠিক কতটা সন্তোষজনক, সে বিষয়ে আলোচনায় ঢোকার আগে প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন প্রায় এক দশক লেগে গেল এই তথ্যভাণ্ডার প্রকাশ করতে? প্রসঙ্গত, এনএফএইচএস-এর তৃতীয় পর্যায়ের সমীক্ষা হয়েছিল ২০০৫-০৬ সালে, এবং তার পর প্রায় ১০ বছর ধরে সেই পুরনো তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই নারী ও শিশুকল্যাণমুখী যাবতীয় উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয়ে এসেছে। প্রশ্ন হল, যে তথ্যভাণ্ডারের ওপর ভিত্তি করে উন্নয়নের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তা যদি হয় ১০ বছরের পুরনো, তা হলে সে উন্নয়নের পরিকল্পনা কী আদৌ যথাযথ হতে পারে? নাকি তার রূপায়ণ হতে পারে ফলপ্রসূ?
কিন্তু সে প্রশ্ন আপাতত থাক। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক, কী বলছে সাম্প্রতিক সেই রিপোর্ট। রিপোর্ট বলছে, এখনও সারাদেশের প্রতি এক হাজার নবজাতকের মধ্যে ৪০টি শিশু তাদের এক বছরের জন্মদিনের মুখ দেখতে পায় না। দেশের ৪৭ কোটি শিশুর মধ্যে প্রায় সাড়ে ন’কোটি, স্বাধীনতার এই ৭০ বছর পরেও, ভোগে রক্তাল্পতা ও অপুষ্টিজনিত নানা অসুখে। সারা দেশে পাঁচ বছরের কমবয়সি শিশুদের প্রায় ৪০ শতাংশ আক্রান্ত স্টান্টিং-এ (বয়সের তুলনায় কম উচ্চতাজনিত সমস্যা), প্রায় ৪২ শতাংশ আক্রান্ত বয়সের তুলনায় কম ওজনজনিত সমস্যায় এবং প্রায় ২০ শতাংশ ওয়েস্টিং-এর (বয়সের তুলনায় কম ওজন ও উচ্চতা) শিকার। এবং, সকলেই জানেন, যে শিশু-অপুষ্টি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের দেশের স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় সমস্যাগুলির একটি, তার সূচনা কিন্তু ঘটে যায় শিশুর জন্মের আগে থেকেই – তাদের মায়েদের অপুষ্টির হাত ধরে। এবং এখানেই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এই তথ্যও যে, সারা পৃথিবীতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মাতৃত্বের মোট সংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই এ-দেশের। শুধু তাই নয়, ২০১১-র জনগণনা রিপোর্টের তথ্য মোতাবেক, আমাদের দেশের ১৪ বছরের কমবয়সি বিবাহিত মেয়েদের মধ্যে প্রায় সাড়ে চার লক্ষ সন্তানধারণ করে প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার আগেই।
শারীরবিদ্যার গবেষণায় এ-কথা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণিত যে, সুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়ার জন্য অত্যন্ত জরুরি মায়ের সুস্থতা ও পুষ্টি। যেহেতু শিশু তার প্রাথমিক পুষ্টি ও রোগপ্রতিরোধক্ষমতার পুরোটাই অর্জন করে তার মায়ের কাছ থেকে, তাই নবজাতকের স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও সুস্থতার জন্য মাকে সুস্থ রাখা প্রাথমিকতম কাজ। এবং এ-কথাও প্রমাণিত সত্য যে, ১৮ বছরের আগে সন্তানধারণের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠা কোনও মেয়ের পক্ষেই সম্ভব নয়। সে-কারণেই বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ আইনে (চাইল্ড ম্যারেজ প্রহিবিশন অ্যাক্ট) ১৮ বছরের নীচে মেয়েদের বিবাহের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ করা হয়েছে। কিন্তু সে আইনের রূপায়ণ যে যথাযথ হয়নি তার প্রমাণ জেলাওয়াড়ি স্বাস্থ্য সমীক্ষার তৃতীয় দফার রিপোর্ট। যে রিপোর্ট বলছে, ২০০৭-০৮ সালে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সি মেয়েদের মধ্যে ৪৩ শতাংশেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে ১৮-য় পা রাখার আগেই। ১৯৯২-৯৩ সালে শতাংশের হিসেবে বাল্যবিবাহের হার যেখানে ছিল ৫৪ শতাংশ সেখানে ২০০৭-০৮ সালে তা ৪৩ শতাংশে নেমে আসার অর্থ ১৫ বছরে বাল্যবিবাহের হার সারা দেশে কমেছে ১১ শতাংশ। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া যায় যে পরবর্তী বছরগুলিতে এই হারই বজায় থেকেছে ও থাকবে, তা হলে ২০২০ সাল নাগাদ দেশে বাল্যবিবাহের হার নেমে আসা উচিত ৩২ শতাংশে। এক অর্থে এ তো সাফল্য নিশ্চয়ই। কিন্তু প্রশ্ন হল, বাল্যবিবাহ হ্রাসের এই সূচককে কি আমরা সত্যিকারের সাফল্য হিসেবে দেখব, নাকি দেখব আপাত-সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ব্যর্থতা হিসেবে? চলতি দশকের শেষে যদি আমাদের দেশের প্রতি ১০জন কিশোরীর মধ্যে তিনজনের বিয়ে হয়ে যায় বালিকা অবস্থাতেই, তা কি ভারতবর্ষের সামাজিক উন্নয়নের পক্ষে খুব গৌরবজনক বিজ্ঞাপন হবে?
এবং বাবা-মায়েরা
শিশু-অপুষ্টির শারীরবৃত্তীয় দিকগুলির ওপর বাল্যবিবাহের যে প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে, তা তো অনস্বীকার্য বটেই। কিন্তু বিষয়টিকে একটু অন্য দিক থেকেও দেখা যেতে পারে। বাল্যবিবাহের সঙ্গে শিক্ষার কি কোনও অপ্রত্যক্ষ যোগাযোগ থাকা সম্ভব? সমীক্ষা বলছে, যেসব শিশুদের মায়েরা শিক্ষার আওতায় আসেনি, তাদের শিশুদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা শিক্ষিত মায়েদের সন্তানদের তুলনায় তিনগুণ বেশি। বিষয়টা আপাতদৃষ্টিতে অবাক করার মতো হলেও, একটু তলিয়ে দেখলে এর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সম্পর্কসূত্রটি সহজেই ধরা পড়ে। শুধু তা-ই নয়, ওই একই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পাঁচ বছরের কমবয়সি অপুষ্টি-আক্রান্ত শিশুদের ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে তাদের মায়েরা কখনও বিদ্যালয়ের গণ্ডীতে পা রাখেনি, এবং মাত্র ন’শতাংশ ক্ষেত্রে তাদের মায়েরা ১২ বছর স্কুলের পড়াশোনার পাঠ সাঙ্গ করেছে। দৈনন্দিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকেও তো আমরা জানি, সন্তানকে সুস্থ শৈশব দিতে গেলে, তাকে সুস্থভাবে বড় করে তুলতে গেলে মায়ের শিক্ষা কতটা জরুরি। খুব সহজ একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। শিশুকে সময়মতো টীকাকরণ করানো হল কি না, রোগ-প্রতিরোধক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় সবক’টি ভ্যাক্সিন তারা পেল কিনা, এবং এই টীকাকরণের প্রয়োজনীয়তা আসলে কতটা, এটা একটি লেখাপড়া-জানা মেয়েকে বোঝানো যতটা সহজ, কখনও স্কুলের চৌহদ্দিতে পা না-রাখা মেয়েদের বোঝানো আদৌ ততটা সহজ নয়। সত্যি বলতে কী, এই যে আমাদের দেশে প্রসূতিদের স্বাস্থ্য সচেতনতা বৃদ্ধি নিয়ে এত সরকারি-অসরকারি প্রচার-অভিযান চালানো হয়, এর সুফল অনেক বেশি সহজলভ্য হত প্রসূতিদের মধ্যে অন্তত প্রাথমিক স্বাস্থ্য-বিষয়ক শিক্ষাটুকু থাকলে। মায়েদের বোঝানো অনেক বেশি সহজ হত, কেন সন্তানকে নিয়ে নির্দিষ্ট দিনে পালস পোলিও কর্মসূচিতে যোগ দেওয়াটা প্রায় ভোট দিতে যাওয়ার মতোই জরুরি। আগের চেয়ে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে এ-কথা মেনে নিলেও, এখনও যে গ্রামে-গঞ্জে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না-গিয়ে বাড়িতে সন্তানপ্রসবের ঘটনা আখছার ঘটে সে-কথাও তো দিনের আলোর মতোই সত্যি। ঠিক তেমনই, জন্মের পর মায়ের প্রথম দুধ (যাকে বলে ‘কোলোস্ট্রাম’) যে সন্তানের পক্ষে প্রায় জীবনদায়ী ওষুধের মতোই জরুরি, সে-কথা বোঝাতে গিয়েও যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। এখনও গ্রামে-গঞ্জে অনেক মহিলাই বিশ্বাস করেন, ঈষৎ হলদেটে রঙের সেই প্রথম দুধ নাকি সন্তানের পক্ষে ভাল নয়। অথচ সারা বিশ্ব জুড়ে গবেষক ও পুষ্টি-বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, জন্মের পর প্রথম ঘন্টার মধ্যেই সন্তানকে মায়ের দুধ দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলে, তার চেয়ে ভাল কিছু আর হতেই পারে না। কিন্তু বাস্তব হল, অপ্রাপ্তবয়স্ক মায়েদের ক্ষেত্রে শারীরবৃত্তীয় কারণেই বুকের দুধ তৈরি হয় কম, প্রসূতির অপুষ্টিজনিত কারণে তার পরিমাণ যায় আরও কমে, এবং তার পরেও স্রেফ কুসংস্কারের বাধায় প্রথম সেই দুধ অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানের মুখে পৌঁছয় না। ঠিক তেমনই, অপ্রাপ্তবয়স্ক প্রসূতিদের ক্ষেত্রে সন্তানধারণের ক্ষেত্রেও যে সমস্যা হতে পারে, এবং তার যে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়তে পারে সন্তানের স্বাস্থ্যেও, সে-কথাও বুঝিয়ে বলা সমস্যার হয়ে ওঠে। অথচ স্কুলের পড়া শেষ করে আসা মেয়েদের এই বিষয়গুলি বুঝিয়ে বলা অনেক বেশি সহজ হয়ে উঠতে পারত।
রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় শিশুদের নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, ১৮-র আগে বিয়ে করা কেন উচিত নয় সেটা ঠিকঠাক মেয়েদের বুঝিয়ে ওঠা কতটা কঠিন। স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের যদি বা তা বোঝানো যায়, যদি বা তারা উপলব্ধি করতে পারে আগে পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে তারপর বিয়ে করা তাদের নিজেদের ও সন্তানের ভবিষ্যতের পক্ষে কতটা জরুরি, তাদের বাবা-মায়েদের সে-কথা বোঝানো প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা-মায়েদের বলতে শুনেছি, বয়স বেশি হয়ে গেলে পাত্র জোটাতে অসুবিধে হবে, তাই আগেভাগেই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়া ভাল। বেশি বয়সি (এবং বেশি পড়াশোনা করা) মেয়েদের জন্য পাত্র জোটানো যে কঠিন, এবং তার জন্য যে পণের চাহিদাও বেড়ে যায়, সে-কথাও অনেকেই বলেছেন। অথচ বাবা-মায়েদের চোখ এড়িয়ে, কখনও বা বাবা-মায়েদের সামনেই, মেয়েরা কিন্তু জানিয়েছে, স্কুলের গণ্ডী না-পেরিয়ে তারা বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চায় না। অনেকে আবার এ-কথাও জানিয়েছে, চাকরি না-পেয়ে বিয়ে তারা করবেই না। এ-কথা বলার সময় তাদের চোখে-মুখে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখেছি, সত্যি বলতে কী, গর্বে বুক ভরে উঠেছে। কিন্তু এ-কথাও তো ঠিক যে, সাহসি আর লড়াকু এইসব মেয়েদের সংখ্যা এখনও হাতে গোনা। খবরের কাগজে এমন মেয়েদের কথা মাঝেমধ্যেই উঠে আসে, যারা মা-বাবার অমতে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছে, কিংবা সহপাঠিনীদের সঙ্গে নিয়ে লুকিয়ে স্থানীয় থানায় গিয়ে পুলিশকে বলে নিজেদের বিয়ে আটকে দিয়েছে। কিন্তু এ-কথাও তো ঠিক যে, এখনও সারা দেশে, এমনকী এ-রাজ্যেও বাল্যবিবাহ একটা বড় সমস্যা। এমনকী পুলিশ গিয়ে বিয়ে রুখে দেওয়ার কয়েক মাস পর, মেয়েকে অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে জোর-জবরদস্তি বিয়ে দেওয়ার ঘটনাও তো একাধিক নজরে এসেছে।
এবং শিশুদিবস
এমন অসংখ্য সরস্বতী লোহার ও তাদের আরও অসংখ্য সন্তানসন্ততি আজ সকাল থেকে এক আনন্দযজ্ঞে জড়ো হয়েছে। তাদের গায়ে-গায়ে নতুন জামা, হাতে-হাতে বেলুন ও চকোলেট। তাদের অবাক চোখের সামনে একধার ঘেঁষে মঞ্চ বাঁধা হয়েছে, কিন্তু পেছনের ওই হাঁ-করা গর্তটাকে অনেক চেষ্টা করেও আড়াল করা যাচ্ছে না। সেখানে অনেক লোক দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। অনেক লোক মঞ্চের ওপরেও। তারা উঁচু থেকে নেমে এসে কেউ বাচ্চাদের গাল টিপে দিয়ে যাচ্ছে, কেউ আবার সে ছবি ক্যামেরায় ধরে রাখছে। সব মিলিয়ে বাচ্চাগুলো বুঝতে পারছে, আজ এমন একটা কিছু ঘটতে চলেছে যেখানে সকলের মনোযোগের কেন্দ্রে তারাই। এতে তারা কতটা স্বস্তিবোধ করছে তা ঠিক বোঝা না-গেলেও, খুব যে আনন্দ পাচ্ছে দেখে তেমন মনে হচ্ছে না। ওরা কি কোনওভাবে টের পেয়ে গেছে যে, ওদের নিয়ে একটা মজার খেলা চলছে এখানে? কুমিরডাঙা বা চুকিতকিতের মতো একটা খেলা। কিংবা এলাটিং বেলাটিং। যেখানে রাজামশাই এসে একটা বালিকা চেয়ে নিয়ে যান। আর যারা সে খেলাটা খেলে, তারা মনে-মনে বিশ্বাস করতে শুরু করে যে, তারা সত্যি-সত্যিই রাজা – হলই বা একদিনের জন্য। কিন্তু তারপর একটা সময় খেলাটা শেষ হয়ে যায়। ডেকরেটরের লোক এসে মঞ্চ-মাইক সব খুলে নিয়ে যায়। সরস্বতীর ছেলেমেয়েরা ফিরে যায় বাচ্চা সিং বস্তির অন্ধকার ঝুপড়িতে। পরদিন সকালে, বা তার পরদিন সকালে, বা তারও পরের কোনও একদিন সকালে গিয়ে দেখা যায় বিশাল ওই হাঁ-মুখ খাদের ধারে ধুলো মেখে খেলছে সরস্বতীর ছেলেমেয়েরা। আশ্চর্য, সেই খেলাটা কিন্তু ফুরোয় না। চলতে থাকে। চলতেই থাকে। গ্রীষ্ম আসে, বর্ষা আসে, সরস্বতীদের কোল ভরে উঠতে থাকে বছর-বছর… দেখতে-দেখতে স্বাধীনতার পর সত্তর বছর কেটে যায় – সে খেলাটা চলতেই থাকে…