তুহিন
এই মুহূর্তে কংগ্রেসের উচিত আরেকবার নতুন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখবার দিকগুলিকে উপলব্ধি করে, হিন্দুত্ববাদীদের পিচে ক্রিকেট খেলা বন্ধ করা। গরু-গোবর মার্কা নরম হিন্দুত্ব নীতি মেনে কংগ্রেসের কোনও লাভ হবে না
রাষ্ট্রীয় ভূদৃশ্য
২০১৪-র মাঝামাঝি মোদি সরকার ক্ষমতায় আসবার পরে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহৎ ফ্যাসিবাদী সংগঠন আরএসএস ভারতকে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরিত করবার লক্ষ্য নিয়ে সুপরিকল্পিতভাবে অবিরত আক্রমণ করে চলেছে। আরএসএস-এর আদর্শগত ভিত্তি মনুবাদ/ব্রাহ্মণ্যবাদ।
‘মনুস্মৃতি’ সেই আদর্শের ভিত্তিপ্রস্তর, যার উপদেশ অনুযায়ী উৎপীড়িত দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু শ্রেণি, মেহনতি মানুষ এবং মহিলাদের মানুষ হিসেবে নয়, গোলামের পদভুক্ত করা হয়েছে। তাছাড়াও, এতে যে তথাকথিত হিন্দুরাষ্ট্র বর্ণিত আছে, সেই অনুযায়ী মুসলমানদের নাগরিক এবং মানব-অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে আরএসএস।
আসলে, দুনিয়ার সর্ববৃহৎ এবং প্রাচীনতম ফ্যাসিবাদী সংগঠন আরএসএস বাবাসাহেব আম্বেদকর রচিত সংবিধানকে ধ্বংস করে ঘোর মানবতা-বিরোধী ‘মনুস্মৃতি’-র মহাভ্রষ্ট কর্পোরেট ঘরানা অবলম্বন করে আদানি-আম্বানি দ্বারা শাসিত হিন্দুরাষ্টের সংবিধান কার্যকর করতে দৃঢ়বদ্ধ। বিশেষ করে ২০১৯-এ মোদির দ্বিতীয়বার কার্যভার সামলানোর পর থেকে ‘মোদিনমিক্স’-এর ক্রূর স্বরূপ দেখানো শুরু হয়েছে, যা আজ ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের ভারতীয় সংস্করণ এবং যা সর্বভারতীয় স্তরে সম্পূর্ণভাবে গেরুয়া-কর্পোরেট ফ্যাসিবাদের বহুমাত্রিক সংস্করণ ছাড়া আর কিছুই নয়।
আদানি-আম্বানিদের মতো ধনকুবেরদের এই মহাভ্রষ্ট কর্পোরেট ঘরানার লাঠিয়াল রূপে রেখে আরএসএস/বিজেপি ভারতের মানুষদের ঘামরক্তের বিনিময়ে অর্জিত রোজগার লুঠ করে নিজেদের যে প্রভুবৃন্দ, সেই দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের সিন্দুক ভরিয়ে যাচ্ছে।
গেরুয়া নব্য-ফ্যাসিবাদ অনুযায়ী আজ দেশের যাবতীয় সামাজিক সম্পর্কগুলি অতিরিক্ত বিদ্বেষ ও ঘৃণার বিভাজন নীতিসমূহ অনুসরণ এবং সাম্প্রদায়িক উসকানির মাধ্যমে ভয়াবহ অঘটনের সম্মুখীন হয়েছে। এর বীভৎস রূপ আমরা মণিপুর থেকে হরিয়ানার নূহ অবধি দেখেছি।
মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকারের নব্য-ফ্যাসিবাদী আক্রমণে আমরা নিজেদের বহুমাত্রিক অভিব্যক্তিগুলি নিয়ে সদ্য-সমাপ্ত বিধানসভা নির্বাচনগুলি দেখলাম এবং ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রেক্ষিতে যে ভয়াবহ স্তর তৈরি হচ্ছে, তার কাছাকাছি পৌঁছে গেছি, তা-ও প্রত্যক্ষ করলাম। জেদি দক্ষিণপন্থী, নব্য উদারবাদী কর্পোরেটাইজেশন এবং কর্পোরেট সমর্থকদের শ্রম এবং পরিবেশ নীতিসমূহের একটি সেট, কুখ্যাত নোটবন্দি এবং জিএসটি প্রয়োগের আগের মোদি-১ থেকে শুরু করে মোদি-২-তে পৌঁছে আরও ত্বরান্বিত হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে দেশ বিক্রিও সামিল।
অর্থনৈতিক দিক থেকে ভারতীয় এবং বিদেশিদের কুলীন শ্রেণিরা মিলেজুলে দেশের জনগণের ধমনীতে যতটুকু রক্ত ছিল, তা শুষে নিয়ে ভারতেকে ইতিমধ্যেই এক অভূতপূর্ব ভয়ানক অবস্থায় পতিত করেছে। উৎপাদিত সম্পত্তির আশি শতাংশের বেশি সমাজের শীর্ষে বসে থাকা এক শতাংশ অতি-ধনী শ্রেণির কাছে পৌঁছে যাওয়ার ফলে দুর্নীতিগ্রস্ত কোটিপতিদের ঐশ্বর্য আরও সমৃদ্ধ হচ্ছে। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও মোদির ‘অমৃতকাল’-এ দেশের ধনী এবং দরিদ্রদের মধ্যে যে অসাম্য সৃষ্টি হয়েছে তা বেনজির। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভয়াবহ বেকারত্ব, ক্ষুধা (পৃথিবীর অগ্রগণ্য ক্ষুধার্ত ১২৫টি দেশের মধ্যে ১১১-তম স্থান) এবং অপরিসীম মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি মোদির শাসনে ভারত এখন বৈশ্বিক দারিদ্র্যের নিরিখে অন্যতম কু-গ্রহে পরিণত হয়েছে।
ছত্তিশগড়ের বিধানসভা নির্বাচন
ছত্তিশগড়ে দুটি পর্যায়ে ৯০টি বিধানসভা আসনে নির্বাচন হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে ৭ নভেম্বর ২০টি আসনে এবং ১৭ নভেম্বর ৭০টি আসনে। দুটি পর্যায়ে মোট ৭৫.০৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। ২০১৮ সালে ভোটদান ছিল ৭৬.১৬ শতাংশ। রাজ্যের ৫০টি বিধানসভা আসনে পুরুষদের তুলনায় বেশি সংখ্যক মহিলারা ভোট দিয়েছেন। দুটি পর্যায়ে মোট ভোটদাতার সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৫৫ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৬০। এঁদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ছিলেন ৭৭ লক্ষ ৪৮ হাজার ৬২১ জন এবং ৭৮ লক্ষ ১২ হাজার ৬২১ জন ছিলেন মহিলা। আদিবাসী-বহুল এলাকাগুলিতে মহিলারা তুলনামূলকভাবে বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন। এখানে উল্লেখ্য, ছত্তিশগড় একটি আদিবাসী-প্রধান এবং প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ রাজ্য, যেখানে জল, জঙ্গল, জমি লুঠের জন্যে আদানি, টাটা, জিন্দল, এস্সার-এর দের মতো কর্পোরেট সংস্থাগুলি শকুনির দৃষ্টি নিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে। রাজ্যে মোট পোলিং বুথের সংখ্যা ২,৪১,১৩৭। ৩ ডিসেম্বর ভোটের ১৭২৪ দফা ভোটগণনার পর অন্য চার রাজ্যে অনুষ্ঠিত ভোটের ফলাফলের সঙ্গে ফল ঘোষণা হবে।
সংঘ পরিবারের বিদ্বেষ এবং বিভাজনের রাজনীতি
গত পনেরো বছরে ছত্তিশগড়ের মানুষদের দুরাবস্থা ঘটানোর জন্যে দায়ী ভারতীয় জনতা পার্টি ২০১৮ সালে ক্ষমতা হারায়। এর পরে ২০২৩ সালে যেনতেনপ্রকারেণ ক্ষমতা ফিরে পেতে চেষ্টা করে গেছে। রাজ্যে বস্তারের মতো আদিবাসী-বহুল এলাকায় গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে যখন ফ্যাসিস্ট সংঘ পরিবার সংখ্যালঘু খ্রিস্টানদের উপর তাণ্ডব চালিয়ে গেছে, মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের কংগ্রেস সরকার নিজের নরম হিন্দুত্ব লাইন বজায় রেখে তখন মূক দর্শক হয়ে বসে থেকেছে।
গত বিধানসভা নির্বাচনের আগে, ২০১৫ সালে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার তার মার্গনির্দেশক আরএসএস-এর নির্দেশ অনুযায়ী আদিবাসীদের বিরুদ্ধে আদিবাসীদের লেলিয়ে দেওয়ার ধ্বংসাত্মক খেলা চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি বনবাসী কল্যাণ আশ্রম-সহ সংঘ পরিবারের অনুগামী সংগঠনগুলির সাহায্যে আদিবাসীদের হিন্দুকরণে ব্যস্ত ছিল।
২০১৮ সালে ছত্তিশগড়ের মানুষেরা ফ্যাসিস্ট বিজেপি-কে সমূলে বিনাশ করে কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা সঁপে দেন। কিন্তু কংগ্রেসেরও কর্পোরেট-মুখী নীতিসমূহর পাশাপাশি রাম বনগমন পথ, কৌশল্যা মন্দির এবং গরু-গোবরের রাজনীতির মাধ্যমে সংঘ পরিবারের মনুবাদী হিন্দুত্বে সার ও জল জুগিয়ে গেছে।
বস্তারের দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট হিন্দুবাদীদের বিশেষ প্রচার সেদিন থেকে শুরু হয়, যেদিন গত বছরের ২৬ এপ্রিলে আরএসএস-এর তৈরি ‘জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চ’-র উদ্যোগে নারায়ণপুর জেলা সহ বিভিন্ন স্থানে ‘রোকো, টোকো ঔর ঠোকো’ র্যালি এবং সভাগুলি আয়োজন করে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক ভাষণের সাহায্যে গ্রামের মানুষদের প্ররোচিত করা হয়। সেদিন ভোজরাম নাগ, রূপসায় সলাম, নারায়ন মরকাম প্রমুখ বিজেপি নেতারা এলাগুলির ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানদের নাম লিস্টিং করে সরকারি সুবিধাদি থেকে বঞ্চিত করে সামাজিক ও আর্থিক বহিষ্কারের জন্যে দাবি জানায়।
খ্রিস্টান সংখ্যালঘু শ্রেণির মানুষদের তখন থেকেই লাগাতার বিরুদ্ধাচরণ এবং প্ররোচনার শিকার বানানোর পরে গত অক্টোবর মাসে সংঘ পরিবার মাঠে নামে। বস্তারের কাঁকের, কোন্ডাগাঁও এবং নারায়ণপুর জেলার নানান গ্রামে ইতোমধ্যেই বিদ্বেষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে। বিধানসভা নির্বাচনের ভোটগ্রহণ পর্বের পরে এই লেখার সময় অবধি যে সংবাদ আসছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের পাদ্রি এবং চার্চে যাতায়াতকারী মানুষদেরকে, যাঁদের মধ্যে মহিলা ও শিশুরাও আছেন, তাঁদের মারধর করে ভয় দেখানো হচ্ছে এই বলে যে খিস্টান ধর্ম ছেড়ে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ না করলে মারাত্মক পরিণাম হবে।
সম্প্রতি, দুর্গ জেলায় অঁডা-র কাছে বিনায়কপুরে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষেরা যখন প্রার্থনা করছিলেন, তখন বজরং দলের গুণ্ডারা ধর্মান্তরকরণের অভিযোগ তুলে তাঁদের সঙ্গে মারপিট করে। অনেক জায়গায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদেরকে গ্রাম থেকে সামাজিক ও আর্থিক বহিষ্কার করে দেওয়া হচ্ছে এবং তাঁদের গৃহস্থালির জিনিসপত্র গ্রামের বাইরে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে। এই ঘটনাগুলি যে বাস্তবে ঘটছে তা পিইউসিএল এবং অন্য মানবাধিকার সংস্থার ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে স্পষ্ট।
গত বছর ১৮ ডিসেম্বর, যা সতনামী সমাজের প্রবক্তা সমাজসংস্কারক এবং জাতিবর্ণ বিলোপ আন্দোলনের অগ্রদূত গুরু ঘাসিদাসের জন্মদিবস, ব্যাপক হিংসা সংঘটিত করে সংঘ পরিবার। এই হিংস্রতার ফলস্বরূপ ঈশ্বরবিশ্বাসী/খ্রিস্টান মানুষেরা গ্রামগুলি ছেড়ে পালিয়ে ফরসগাঁও (কোন্ডাগাঁও)-তে আশ্রয় নেন। সেখানকার প্রশাসন আবার জবরদস্তি করে তাঁদেরকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। এঁদের সঙ্গে চিংনার গ্রামের বাসিন্দাদের মারপিট হয় বলে সংবাদ পাওয়া গেছে।
রাতে পুরুষেরা নিজেদের প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। কিন্তু দ্বিতীয় দিন মহিলাদের সঙ্গে গ্রামবাসীর তুমুল মারপিট হয়। তাঁদের মালপত্র গ্রামের বাইরে ফেলে দেও্যা হয়। পাটোয়ারি এবং পঞ্চায়েত প্রধান আহত মহিলাদের প্রাথমিক চিকিৎসা করতে যান এবং আবার গ্রামে এনে ছেড়ে দেন। পুলিশে রিপোর্ট লেখাতে নিষেধ করা হয়।
এই ঘটনা ব্যতিরেকেও ১৮ ডিসেম্বর থেকে বিভিন্ন এলাকায় মারপিট চলতে থাকে। প্রশ্ন হল, যখন মানুষগুলি নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে নারায়ণপুর/ফরসগাঁও আসেন, এঁদেরকে আবার কেন সেই হিংস্র বাতাবরণে জবরদস্তি পাঠিয়ে দেওয়া হয়? প্রশাসনের কি এই দায়িত্ব ছিল না যে প্রথমে গ্রামগুলিতে চলা ঝামেলায় মধ্যস্থতা করবার? পরিবেশ স্বাভাবিক হওয়ার পরে এঁদের সুরক্ষার ভার নিয়ে গ্রামগুলিতে কি ফেরত পাঠানো যেত না?
নারায়ণপুরে ২০টি গ্রামের ৫০০ জন খ্রিস্টান সংখ্যালঘু মানুষ প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নিতে গেছিলেন। স্থানীয় প্রশাসন প্রথমে এঁদেরকে মুক্ত আকাশের নিচে আটকে রেখে দেয়। প্রতিবাদ জানানোর পরে নারায়ণপুরের ইনডোর স্টেডিয়ামে জায়গা দেওয়া হয়। প্রবল শীতের মধ্যে গরম জামাকাপড়, বিছানা, কম্বল এবং খাওয়াদাওয়া সহ যাবতীয় খরচ খ্রিস্টান সমাজকেই বহন করতে হয়। প্রশাসন নিজের কাঁধ থেকে সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলে দেয়। ২৫ ডিসেম্বর বেতুর থানার অন্তর্গত গ্রামগুলিতে খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ হানা হয়। গত তিন মাসে আরএসএস/বিজেপি-র নেতাদের বিরুদ্ধে ৫০০-র বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে থানাতে। পুলিশ-প্রশাসন মূক দর্শক হয়েই রয়ে গেছে।
এই বছরে ২ জানুয়ারি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের উপরে হিংস্র আক্রমণ আরও তীব্র হয় যখন সশস্ত্র সংঘি অপরাধীরা নারায়ণপুর জেলার বাংলাপাড়ার সেক্রেড হার্ট চার্চে আক্রমণ শানায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট সদানন্দ এবং সাত পুলিশকর্মী আহত হন। ঘটনার পরে পুলিশ কর্তৃপক্ষ একজন বিজেপি নেতা সহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়।
মজার ব্যাপার, ২ জানুয়ারিতেই নারায়ণপুর জেলার বিজেপি সভাপতি রূপসায় সলামের নেতৃত্বে নারায়ণপুরের খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে প্ররোচনামূলক সভা আয়জন করা হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অজিত বসন্ত সাংবাদিকদের জানান যে রূপসায় সলাম এবং অন্য বিজেপি নেতারা শান্তিপূর্ণভাবে র্যালি/সভা পরিচালনা করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু ২,০০০ জন নারায়ণপুরে একত্রিত হয়ে বিশ্বপীঠ স্কুল এবং সেক্রেড হার্ট চার্চ তছনছ করে দেয়।
এছাড়াও, ফ্যাসিস্ট সংঘ পরিবারের উদ্যোগে এবং ক্ষমতাসীন কংগ্রেস দলের বিভিন্ন নেতাদের সাহায্যে রায়পুর সহ অনেকগুলি শহরে তথাকথিত ‘ধর্মসংসদ’ আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানগুলিতে অপরাধীমনস্ক ঠগবাজ সাধু ধীরেন্দ্র শাস্ত্রী ঘোষণা করে গডসে যে গান্ধিজিকে হত্যা করে, তা ন্যায়সঙ্গত ছিল। ঘটনাটির প্রতিবাদে ব্যাপক নিন্দা এবং সমালোচনা হওয়ার পরে কংগ্রেস সরকার যতক্ষণে সেই ঠগবাজকে গ্রেফতারের আদেশ দেয়, ততক্ষণে সে ছত্তিশগড় ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
এখন এই মুহূর্তে কংগ্রেসের উচিত আরেকবার নতুন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বজায় রাখবার দিকগুলিকে উপলব্ধি করে, হিন্দুত্ববাদীদের পিচে ক্রিকেট খেলা বন্ধ করা। গরু-গোবর মার্কা নরম হিন্দুত্ব নীতি মেনে কংগ্রেসের কোনও লাভ হবে না। কারণ, লাভ যা হবে তার সবটাই ফ্যাসিস্ট সংঘ পরিবারেরই হয়েছে। যারা জল-জঙ্গল-জমি থেকে আদিবাসীদের অধিকার বিচ্যুত করে কর্পোরেট সংস্থাগুলির লুঠ করবার পথ সুগম রাখবার জন্যে মনুবাদী হিন্দুত্বের বিষ আদিবাসী সমাজে মিশিয়ে দিয়েছে।
কংগ্রেস সরকার যদি জনগণের হৃদয় জয় করতে চায় তাহলে কংগ্রেসের ভিতরে এবং পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে লুকিয়ে মনুবাদী হিন্দুত্বের হয়ে খোলা সওয়াল করা মানুষগুলির সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। কিন্তু নিজের শ্রেণিচরিত্র অনুযায়ী চলা কংগ্রেস এই ফ্যাসিবাদ বিরোধী অবস্থান নেবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েই যায়।
সর্ব আদিবাসী সমাজ এবং অন্যান্য আদিবাসী সংগঠনগুলিকেও বুঝতে হবে আরএসএস-এর এই তথাকথিত হিন্দুরাষ্ট্র অভিযান কী। এর থেকে দূরত্ব তৈরি করে আদিবাসী সমাজের মধ্যে এই চেতনা তৈরি করতে হবে যে আদিবাসীরা কোনওকালেই হিন্দু ছিলেন না। আরএসএস-এর ঘোষিত সংবিধান যে মনুস্মৃতি, তাতে বলা হয়েছে আদিবাসী, দলিত, মহিলা ইত্যাদিরা সবাই শূদ্র। তারা কেউই মনুষ্য পর্যায়ে পৌঁছায়নি। জল-জঙ্গল-জমির উপরে অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। বেঁচে থাকবার স্বাধীনতার জন্যে লড়তে থাকা আদিবাসীদের মনোযোগকে অন্যদিকে চালিত করাটাই হল আদিবাসীদের শত্রু কর্পোরেট সংস্থাগুলির দালাল মনুবাদী ফ্যাসিস্ট শক্তির একটি চাল। ধর্মান্তরিত খ্রিস্টানেরা আদিবাসীদের আপনজন। কর্পোরেট সংস্থা এবং তাদের দালাল আরএসএস নব্যফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের লড়াইটাই মূল লড়াই।
বামপন্থী গণতান্ত্রিক সংঘর্ষকারী সংগঠনগুলির উচিত সমগ্র দেশ তথা ছত্তিশগড়ে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে এখনই ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে এক ব্যাপকতা তৈরি করা। আগামীকাল বড্ড দেরি হয়ে যাবে।
মনুবাদী সংঘি শক্তিগুলি বস্তার থেকে বীরনপুর অবধি সংখ্যালঘু খ্রিস্টান সম্প্রদায়, মুসলমান সম্প্রদায়, আদিবাসী এবং দলিতদের উপরে নিজের উগ্রবাদী রূপের প্রচারের অভিমুখ তৈরি করে শুধুমাত্র ক্রূর সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ভিত্তিতেই বিধানসভা নির্বাচন জিততে চেয়েছে। কারণ, দেশে এখন তো আরএসএস/বিজেপির অতি সক্রিয়তায় আদানির মতো দুর্নীতিগ্রস্ত কর্পোরেট সংস্থাগুলির অমৃতকাল চলছে।
এবং স্বাধীনোত্তর ভারতে যে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, বেকারত্ব এবং মূল্যবৃদ্ধি সবচেয়ে বেশি ব্যাপক হয়েছে, তার অন্যতম কারণ আরএসএস/বিজেপি-র জনবিরোধী নীতিসমূহ। সেই জন্যেই বিজেপি-র পক্ষ থেকে বীরনপুরে প্রতিবেশী গ্রামের মানুষদের সঙ্গে বিবাদে (যা কোনও অর্থেই সাম্প্রদায়িক বিষয় নয়) মৃত যুবকের পিতা ঈশ্বর সাহুকে বিধানসভা আসনে প্রার্থী বানানো হয়েছে। এবং ‘হিন্দু খতরে মেঁ হ্যায়’ রাগের আলাপেই নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার ফিকিরে রয়েছে।
নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্যে কৌশল
ছত্তিশগড়ে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঠিক আগে কংগ্রেস সরকার এবং পার্টির সদস্যদের বাড়িতে অবিরাম হানা দিয়েছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেকটরেট (ইডি)। মুখ্যমন্ত্রী ভূপেশ বাঘেলের বিরুদ্ধে মহাদেব অ্যাপ মামলায় ৫০০ কোটির বেশি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ দায়ের করেছে ইডি। অবশ্য যে ব্যক্তির নাম নিয়ে কেন্দ্রীয় আর্থিক অপরাধ নির্দেশালয় ভূপেশ বাঘেলের উপর অভিযোগ দায়ের করেছে, সেই ব্যক্তি নিজমুখেই বলেছে যে কোনও রাজনীতিবিদকে সে ঘুষ দেয়নি।
প্রধানমন্ত্রী মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপি-র তামাম দিগ্গজ এবং সংস্কারী নেতারা রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে এসে শুধুমাত্র বিদ্বেষ এবং বিভাজনের বিষ উগড়ে গেছে আর বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে অশ্লীল ভাষা প্রয়োগের পারস্পরিক প্রতিযোগিতায় মত্ত থেকেছে। এই মামলায় ভারতের নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা বরাবরের মতোই ফ্যাসিস্ট শক্তির মর্জি অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়েছে।
ব্যয়বহুল নির্বাচন এবং বেনামী টাকা
নির্বাচন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ছত্তিশগড়ে ২০২৩ বিধানসভা নির্বাচন চলাকালীন ৭৬.৯ কোটি টাকার অবৈধ মালপত্র যেমন, নগদ টাকা, ড্রাগস, মদ এবং মূল্যবান ধাতুর বস্তু আটক করা হয়েছে। গতবার বিধানসভা নির্বাচন চলাকালীন প্রায় ৬.২ কোটি টাকার মুল্যের জিনিসপত্র আটক হয়েছিল। তার মানে, নির্বাচন ক্রমশই ব্যয়বহুল হচ্ছে এবং নির্বাচনে বেনামী খরচা বাড়ছে। বোঝাই যাচ্ছে, এই বেনামী টাকা আসলে কর্পোরেট সংস্থা/ধন্না শেঠদের দেওয়া কালো টাকা, যা নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে দেশের প্রত্যেক সাধারণ মানুষকে ১৫ লাখ টাকা করে বিতরণের প্রতিশ্রুতি (জুমলা) দেন। এমন পরিবেশে গরিব প্রার্থীরা যতই সৎ, লড়াকু এবং জনগণের প্রতি সমর্পিত হন না কেন, বা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী ছোটখাটো দলগুলি যতই জনদরদি হোক এবং জনগণের সমস্যা সমাধানে যতই লড়াই করুক না কেন, নির্বাচনে অবতীর্ণ হওয়াটা ক্রমশ কঠিনতর হয়ে উঠছে।
নির্বাচনী অবস্থা এবং অভিমুখ
ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস এবং বিজেপি ছাড়া নির্বাচনী ক্ষেত্রে জনতা কংগ্রেস (যোগি), আম আদমি পার্টি (আআপ) স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) এবং গোন্ডোয়ানা গণতন্ত্র পার্টির মধ্যে নির্বাচনী জোট রয়েছে। বামপন্থী দলগুলির মধ্যে ভাকপা (মালে) রেড স্টার ১টি সিটে নির্বাচন লড়ছে।
অন্য এক ধরনের প্রয়োগ
এমন অন্ধকারাবৃত সময়ে ২০২২-এর ডিসেম্বর মাসে দুর্গ ও ছত্তিশগড়ে সমভাবাপন্ন সংগঠনগুলিকে নিয়ে রাজ্য স্তরে একটি ফ্যাসিবাদ বিরোধী ‘জন সংঘর্ষ মোর্চা, ছত্তিশগড়’ গঠিত হয়। পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, তামিলনাডু, উত্তরপ্রদেশ এবং কর্নাটকে চলমান Defeat Fascist RSS/BJP, Save Democracy Campaign থেকে অনুপ্রেরিত হয়ে প্রায় দুই বছর আগে জন সংঘর্ষ মোর্চা, ছত্তিশগড় গঠিত হয়েছে। একমাত্র উত্তরপ্রদেশ (যা ব্রাহ্মণবাদী/মনুবাদী হিন্দুত্বের প্রয়োগশালা হয়ে বর্তমান) ছাড়া, অন্য রাজ্যগুলিতে এই ধরনের অভিযান সংঘটিত হয়েছে এবং নিশ্চিত করা হয়েছে ফ্যাসিস্ট সংঘ/বিজেপি-র পরাজয়। গণতান্ত্রিক, আম্বেদকরবাদী এবং সংঘর্ষকারী সংগঠনের তরফ থেকে এই ধরনের উদ্যোগ মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং তেলেঙ্গানাতেও নেওয়া হয়েছে।
অভিযানের উদ্দেশ্য
ছত্তিশগড়ে নভেম্বর ২০২৩ বিধানসভা নির্বাচনে জনগণের প্রধানতম শত্রু ফ্যাসিস্ট সংঘ/বিজেপি-কে পরাস্ত করবার উদ্দেশ্যে বিজেপি-বিরোধী ভোটের বাঁটোয়ারা থামানো এবং বিধানসভার প্রতিটি নির্বাচনী ক্ষেত্রে যে প্রার্থী বিজেপি-কে হারাতে পারবে, তাঁকে সমর্থন জোগানোই এই প্রচার-অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি অভিযানের উদ্দেশ্য এটাও যে সাধারণ মানুষদের একটি অংশের মনের গভীরে এই কথাটি জমাটভাবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে যে ফ্যাসিবাদী মনুবাদী হিন্দুত্বের থেকে জন্ম নেওয়া বিদ্বেষ এবং বিভাজনের মনোবৃত্তিকে ধ্বংস করতে হবে এবং স্বাধীনতার লড়াই চলাকালীন ‘যৌথ শহিদত্ব, যৌথ ঐতিহ্য’-র পরম্পরাকে পুনর্জীবিত করতে হবে। যে কোনও মূল্যে গণতন্ত্র, সংবিধান এবং ধর্মনিরপেক্ষতা রক্ষা করতে হবে।
আগামী ৩ ডিসেম্বরে যখন বিধানসভার নির্বাচনগুলির ফল জানা যাবে, তখন আশা এটাই যে রাজ্যগুলির সমস্ত বামপন্থী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্রছাত্রী, দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল মানুষেরা আরএসএস-এর নব্য ফ্যাসিবাদ, যার রাজনৈতিক দল বিজেপি, তার বিরুদ্ধে নিজেদের রায় দেবে। এবং আদানি, আম্বানির হিতে নিবেদিত হিন্দুরাষ্ট্র এবং তার তথাকথিত সংবিধান মনুস্মৃতিকে কার্যকর করবার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুখের মতো জবাব দেবে।
*মতামত ব্যক্তিগত। মূল লেখাটি হিন্দি থেকে অনুবাদ করে দিয়েছেন সত্যব্রত ঘোষ