বৈদূর্য সরকার
বিশ্বাস
সেই একইরকম কানাগলি। সরু মুখটা দিয়ে ঢুকে হড়হড় করে খানিকটা এগোনোর পর বাঁদিকে বাঁক। বাঁকের মুখে অবধারিতভাবে এমন একটা লোক বসে থাকে, দেখলে বিরক্তির ভাব জন্মায়। সবেমাত্র হেমন্ত এলেও একটা ছেঁড়া মাঙ্কি ক্যাপ পরে বসে আছে ভর সন্ধেবেলা। যার রং বাদামি থেকে কালো কিছু একটা হতে পারে। সঙ্গে অবধারিতভাবে নস্যি রঙের একটা চাদর।
শুভমের মনে হল, নস্যি কি আজকাল কেউ নেয়? ছেলেবেলায় দেখেছে, নস্যি নিয়ে বার দশেক হাঁচবার পর থামত বুড়োগুলো। ওর কেমন যেন মনে হল, এ-ও নির্ঘাত নস্যি নেয়। খানিক তফাতে সহাবস্থানের ভঙ্গিতে একটা নেড়িকুকুর গা এলিয়ে বসে আছে। বোঝা যায় আপাতত তারও কোথায় যাওয়ার নেই।
এদের ছেড়ে এগোতে হবে কিছুটা তারপরের বাড়িটা ওর গন্তব্য। দরজা বন্ধ হলেও একটা স্টিলের ছোট গোল বাটি আটকানো। ঠিক বাটি নয়, বাংলা সাইকেলের ঘণ্টির ওপরের জিনিসটার মতো। সেটা ঘোরালে ভেতরের আংটা খুলে লোক ভেতরে ঢুকতে পারে। আগে যখন এসেছিল… ছিল কি? ব্যবস্থাটা যে বেশ হালে হয়েছে বোঝা যায়।
ভেতরে ঢুকে বাঁদিকে ঘুরে একটা সটান সিঁড়ি। লক্ষ করলে বোঝা যায় বাড়িটা পার্টিশানের ফলে এরম বেখাপ্পা চেহারা নিয়েছে। আগে এই অঞ্চলে এমন অনেক ছিল। এখন অধিকাংশ ভেঙে উঁচু ফ্ল্যাট উঠে গেছে। সেখানে অন্যরকম পরিস্থিতি, মানুষও আলাদা। সেটাই কাম্য ছিল সবার, সে-ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবু শিকে তো সবার কপালে ছেঁড়ে না।
সিঁড়ি দিয়ে সন্তর্পণে উঠে চটি খুলে ঢুকতে হয় চেম্বারে। সেও খুব গোছানো কিছু নয়। ছেলেবেলায় মায়ের সঙ্গে এমন জায়গায় গিয়ে শুভম তিতিবিরক্ত করে মারত লোকজনকে। ডাক্তার তার চেহারাছবি চেম্বারের ছিরি কাচের ছোট ছোট শিশি কিংবা গলিপথ সব কেমন যেন একইরকম থেকে গেছে। নাম ধাম পদবি পাল্টানোর পরেও।
বাচ্চার জন্যে ওষুধ নিতে আজ ওকে আসতে হয়েছে। চাইল্ড স্পেশালিস্ট যে সব কারণে ওষুধ দেয় না, সেগুলোর জন্যে এই ব্যবস্থা। শুভমের মনে হল এই তিরিশ চল্লিশ ধরে হোমিওপ্যাথি-বিশ্বাস একইরকম থেকে গেছে হয়তো সামর্থ্যের জন্যেই। আমেরিকা রাশিয়ায় এসব জিনিস ব্যান হয়ে গেলেও এখানে চলছে দিব্য। মন্দির মসজিদ ভাঙাগড়ার মতো বিশ্বাসের এই ব্যাপারটাও চলবে হয়তো বহুদিন।
জলসা
দয়ারাম এক পুরুষের বড়লোক। লোকে তার আগামুড়ো বিশেষ জানে না বলে গল্প বানায়। নাওয়াদার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে খুব অল্পবয়সে কাজের খোঁজে হুগলি শিল্পাঞ্চলে এসে পৌঁছোয়। নানা ছোটখাটো কাজকর্ম দিয়ে জীবন শুরু করে নেপালে নানারকম ধান্দা করে অনেক সম্পত্তি করেছে। রাজনৈতিক দলের মাতব্বর হয়েছে। ফরসা পাঞ্জাবি পরে স্টেজে ইদানীং বক্তৃতা পর্যন্ত করতে শুরু করেছে। পড়াশোনা বেশিদূর না করলেও সে হাওয়া বোঝে ভাল। আর ডিগ্রি নিয়েও তো চাকরির জন্যে ধর্নায় বসে লোকে।
আগের পার্টিতে ভিড়ে সে এখানে গুছিয়ে বসেছিল। এখন লাল গিয়ে নীল পার্টিতেও ঢুকে গেছে ঝোপ বুঝে। আগে অশিক্ষিত পয়সাওলা লোককে খানিকটা লাগাম পরানো হত, এখন সেসবের বালাই নেই। এলাকার পুরনো লোকেরা জানে, তখনকার এক নেতাকে মেরে তার চামচা এলাকা থেকে গোটা রাজ্যের মাথায় চড়েছিল। সেই খুনের সম্বন্ধে সবটা জানার জন্যেই দয়া সুযোগমতো কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। আগের ভোটে উল্টোদিকে খানিক হাওয়া থাকলেও দয়ারাম ঠিক দলেই থেকে গেছিল। ফলে সে এখন নিষ্কণ্টক সুবিধায় আছে। তবে লোকের মন জিততে আজকাল খুব দানধ্যান করছে। পাড়ার দুর্গাপুজোয় খাওয়াদাওয়া জলসা থেকে সরকারি টাকাপয়সার বিলিব্যবস্থা সব করেছে ভালভাবেই।
দয়া বুঝেছিল, এ দেশে দুটো জিনিস চলে। ক্রিকেট আর বলিউড। সেজন্যেই তার বড়ছেলের নাম রেখেছিল শচিন, ছোটছেলে হওয়ার পর সৌরভ এসে গেছে মার্কেটে। শচিন তার ব্যবসায় ঢুকেছে ছোট বয়সে। তাকে বিয়ে দিয়ে থিতু করে দিয়েছে দয়া। তবে তার যাবতীয় স্বপ্ন ছোট সৌরভকে নিয়ে। ছেলেটা ছোট থেকেই সুরতাল নিয়ে মেতে থাকে। তার জন্যে নিজের গেস্টহাউসে রিহার্সাল রুম থেকে আশপাশে হওয়া সব অনুষ্ঠানে গাওয়ার ব্যবস্থা করে আসছে দয়া। বোম্বেতে যোগাযোগ করলেও সেখানে ঠিক পাত্তা করতে পারেনি তাই কলকাতার বড় একটা ইন্সটিটিউটে সৌরভকে ঢুকিয়েছে। শুনেছে রিয়েলিটি শোতে এখান থেকে অনেকে চান্স পায়।
সৌরভের সেই ইন্সটিটিউটের শহুরে মধ্যবিত্ত বন্ধুরা পুজোয় এসেছে আমন্ত্রিত হয়ে। ওদের মাতব্বর সুন্দরম। সঙ্গে এসেছে রূপম পিকু শুভ্রাংশু পিঙ্কি শুভশ্রী। ওদের জোরাজুরিতেই এসেছে অবন্তিকা। তাদের জন্যে এলাহি বন্দোবস্ত হয়েছে। অবন্তিকার সঙ্গে সৌরভ একবার একটা অনুষ্ঠানে ডুয়েট গেয়েছিল। নাইন্টিজের প্রেমের গান। সেটায় একরকম উতরে গেলেও সৌরভ বাংলা গান গাইলে হেসে ফেলে অবন্তিকা। সে বিশেষ গুরুত্ব না দিলেও সৌরভ বেশ মুগ্ধ হয়েছিল তার সঙ্গে স্টেজ শেয়ার করে। আন্দাজ করে অন্যরা যথারীতি হাসিঠাট্টা করত। এখানে তেমন কিছু হবে কি?
সৌরভ বুঝেছিল, তার মতো খোলা স্টেজে যেমনতেমন করে বাকিরা গান গাইতে অভ্যস্ত নয়। তাই সামান্য অনুরোধ করলেও তাদের বেশি জোর করেনি দয়া। তবে তারা সন্ধেয় সৌরভের অনুষ্ঠানের সময় থাকবে। তবে জলসা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরে তারা এমন হাঁ করে তাকিয়ে আছে দেখে যেন সব তাল সুর তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল সৌরভের।
বরাবরের মতো অনুষ্ঠান শুরু হলে কিছুক্ষণ পর এখানকার লোকেরা গায়কের সামনে আশীর্বাদস্বরূপ টাকা ঘুরিয়ে সামনে রেখে দেয়। সেটা বরাবর শুরু করে বড় ভাই শচিন। তারপর একে একে বাবার বন্ধুস্থানীয় এবং পরিচিত লোকেরা, শেষপর্যন্ত এলাকার কিছু লোক যারা দয়ারামের সঙ্গে অদরকারে হেঁহেঁ করে। সব মিলিয়ে নাচ গান পানাহার নিয়ে হইহই কাণ্ড।
সেদিন রাতে কলকাতার ছেলেমেয়েগুলো বুঝে গেল তাদের সঙ্গে ছদ্মবেশী এক রাজকুমার গান শেখে। শুধু বিহারি রাজকুমার বুঝতে পারল এরপর হয়তো কোনওদিন অবন্তিকার সঙ্গে গান গাইতে পারবে না।
পথের পাঁচালি
অপূর্ব রঙ্গারুনে এসেছে। ছোট্ট গ্রাম, পেছনে পাইনের জঙ্গল আর সামনে বিস্তীর্ণ চা-বাগান। দুটো হোমস্টে আছে। মার্চের শুরুতে ভালই ঠান্ডা আছে। টুরিস্টরা এখানে পৌঁছোয় না বড় একটা। সবসময় ট্রেক করার সঙ্গী পাওয়া যায় না বলে অপূর্ব একাই দু-একদিন ছুটি নিয়ে এসব জায়গায় চলে আসে। চল্লিশে পা দেওয়া ব্যাচেলার অপূর্ব নিজেকে মাঝেমধ্যে এসব ট্রিট দেয়।
চেহারা বেশ সুঠাম, উচ্চতা চোখে পড়ার মতো। কথাবার্তাতেও বেশ পালিশ। তবে সমবয়সিরা আওয়াজ দেয়, এই বয়সেও ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে বলে। ওর মতে, যথেষ্ট প্রতিষ্ঠিত না হতে পারলে পাকাপাকি সম্পর্কে কোনও মেয়ে জড়াতে চায় না। অপূর্ব কাজ একটা করে বটে, তবে পনেরো বছর পর সেখানে আলাদা কোনও মোটিভেশান নেই।
হুগলির গ্রামের ছেলে অপূর্ব কলেজের সময় থেকে মামার কাছে মানিকতলায় থাকে। স্কুলজীবনে পড়াশোনায় ভালই ছিল। অবস্থাপন্ন ঘরের বন্ধুরা ব্যাঙ্গালোরে গেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। অপূর্ব ঢুকল গ্রাজুয়েশানে। পরে কম্পিউটারের সার্টিফিকেশান করে কাজকর্ম জোগাড় করেছে। ভাবতে ভাবতে চোখে পড়ল অদ্ভুত একটা দৃশ্য। একটা মেয়ে হোমস্টেতে একা ঢুকছে লাগেজ ব্যাগ নিয়ে।
একা ঘোরার ব্যাপারটা বেশ সুবিধের, কোনও ব্যাগেজ নেই… যেমন খুশি চলাফেরা যায়। কিন্তু এমন কোনও মেয়েকে আগে দেখেনি অপূর্ব। ট্রেকিং রুটে বিদেশি মেয়েদেরও দেখেছে, হয় দল বেঁধে অথবা ছেলেবন্ধুর সঙ্গে।
এমনিতে হোমস্টে এখন ফাঁকা, অপূর্ব আর মেয়েটা। লাঞ্চের সময় আলাপ হল। কলকাতার বাইরে এলে দুজন বাঙালির ফর্মালিটি না করলেও চলে।
—একা ঘোরার অভ্যেস আছে?
—অভ্যেস নেই, সেজন্যেই…
—হঠাৎ পোকা নড়ল!
—ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন…
ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত। অনেকদিনের স্টেডি সম্পর্কের পর সামনের মাসে বিয়ে। মুশকিল যেটা, হলিউডের সিনেমার মতো সোলো ট্রিপের আইডিয়াটা নিয়ে। বাড়িতে অশান্তি করে এই একবগগা পাহাড়ি রাস্তায় এসে ততটা আত্মবিশ্বাস অবশিষ্ট ছিল না অপর্ণার। অপূর্বর সঙ্গে আলাপ হওয়াতে খানিকটা স্বস্তি পেল যেন।
হবু বরের ইগোতে খানিকটা আঘাত লেগেছে, সেও একা রওনা হয়েছে দার্জিলিং। ভেবেছে একসঙ্গে ফেরা যাবে। কথাটা শুনে হেসে ফেলল অপূর্ব।
পরের দিন এক্সপিডিশানের প্ল্যান হল। এখান থেকে বেশ খানিকটা জঙ্গলের পথে হেঁটে গেলে দার্জিলিং পর্যন্ত যাওয়া যায়। শুনে বেশ উৎসাহিত হল অপর্ণা। অপর্ণার বিরহী যক্ষটির কথাও মনে করাতে অপূর্ব ভুলল না।
সকালবেলা চারপাশের জমাট নিস্তব্ধতার মধ্যে শুকনো পাতায় দুজনের পায়ের শব্দ শোনা যেতে লাগল। পায়ে চলা পথ ধরে দুজন হাঁটছিল। ক-ঘন্টা নির্জন রাস্তায় চুপ করে হাঁটা যায় না। দুজনে জীবনের বহু কথা বলে ফেলল। যা এতদিন বলার দরকার হয়নি। চেনা পরিবেশের বাইরে বেরোলে সাধারণ কথাগুলো গল্পের মতো হয়ে যায়, বলল অপূর্ব। অপর্ণা হেসে বলল, তাহলে নিজেদের গল্পগুলো এই পাইনের জঙ্গলে রাখা থাক।
গাইড না থাকলেও চলাটা যে ঠিক পথে হচ্ছে বুঝতে পেরেছে অপূর্ব। হোমস্টের মালিকের থেকে মোটামুটি পথের আন্দাজ যা পেয়েছিল, সেই হিসেবমতো ছোট নদীটার ধারে এসে পড়ল ওরা। এর আগে অবশ্য অপর্ণা একবার পা ফসকে পড়ে গেছিল, তাকে বীরপুরুষের মতো তুললেও কিছুদূরে একটা গর্তে পা পড়ে মুচকে গেছে অপূর্বের পা। এখন বেশ টনটন করছে।
গাছের তলায় একটা পাথরে সিঁদুর লেপা দেবতা। দেখে দুজন দাঁড়িয়ে পড়ল। অপর্ণার মনে হচ্ছে, নদী পেরিয়ে আরও হেঁটে দার্জিলিং পৌঁছে লাভ কী! অপূর্ব ভাবল, পথটা না ফুরোলেই ভাল হত। ঠিক সেই সময়েই শুকনো পাতায় অসময়ের বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে জঙ্গলে একটা অদ্ভুত গন্ধ উঠতে শুরু করেছে।