কণিষ্ক চৌধুরী
লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু নিমাইকে স্মার্ত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, অধ্যাপনা, সংসার ইত্যাদি সম্বন্ধে আরও মোহহীন করে তোলে। তিনি ভক্তিবাদকে আঁকড়ে ধরেন। নিমাই হয়ে উঠলেন চৈতন্য— ভক্তিই এখানে প্রধান ভূমিকা নিল। ভক্তি কেবলমাত্র নিমাইকে পাল্টাল না, তা চৈতন্যর হাতে পরিণত হল একটি পদ্ধতি হিসেবে। কতটা সচেতন বা অসচেতনভাবে তিনি সমকালীন সমাজে ভক্তিকে প্রয়োগ করলেন— তা বিবেচ্য নয়, বরং তাঁর এই পদ্ধতি প্রয়োগের সামাজিক তাৎপর্যটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
যান্ত্রিক বস্তুবাদী ও বুর্জোয়া নাস্তিকদের সবচেয়ে বড় ভ্রান্তি তাঁরা সামাজিক ঘটনাসমূহকে পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝার চেষ্টা করেন। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি এর সম্পূর্ণ বিপরীত। অতীত ও বর্তমানের ঘটনাসমূহকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সংযুক্ত করার মধ্যে দিয়ে বিচার করলে তা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে। ধর্ম, ধর্মীয় আন্দোলন ও ধর্মপ্রচারক/গুরুদের ক্ষেত্রে অনেকেই যে অনমনীয় মনোভাবের পরিচয় দেন এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত থেকে বিচ্ছিন্ন করে সরল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তা আর যাই হোক ইতিহাসকে বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হয় না। আবার অনেক শাস্ত্রের মধ্যে খুঁজে ফেরেন ধর্ম-আন্দোলনের সমস্যা ও সম্ভাবনাগুলিকে। এঁরা ভুলে যান কালে-কালান্তরে কোনও ধর্মই অপরিবর্তিত অবস্থায় থাকে না। তা পালটায়, অবিরাম পালটিয়ে যায়। পরিবর্তনের নিয়মই শাশ্বত, তাই কোনও কিছুই শাশ্বত নয়। ধর্মপ্রচারক ও ধর্মীয় গুরুদের ক্ষেত্রেও এ-কথা সমানভাবে প্রযোজ্য। ধর্ম একটি সামাজিক ঘটনা। ফলে সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ধর্মেও আসে নানা পরিবর্তন। পরিবর্তন ঘটে অন্তরে-বাহিরে। অন্যান্য ধর্মের মতোই বৈষ্ণব ধর্মেও এ-ঘটনা ঘটেছে, স্বাভাবিকভাবেই। এটাই ভক্তিবাদের সামাজিক ভূমিকাকে প্রাসঙ্গিক করে তোলে।
দুই.
সাহিত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে জানা যায় বৈষ্ণব ধর্ম বেশ প্রাচীন। বিষ্ণুর উপাসনাকে কেন্দ্র করেই বৈষ্ণব ধর্ম। ঋগ্বেদে বিষ্ণুর কথা পাওয়া গেলেও, তার স্থান গৌণ। মাত্র পাঁচটি সূক্তে তার দেখা মেলে।[1] খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে বিষ্ণুর কথা পাওয়া গেলেও তখনও পর্যন্ত ব্রাহ্মণদের দেবতাতত্ত্বে সর্বোচ্চ স্থান ইন্দ্রেরই, বিষ্ণুর নয়।[2] বিষ্ণুর উপাসনা বা বৈষ্ণব ধর্ম বহুমাত্রিক ও বহু উৎস-সম্বলিত হওয়ায় কালাতিক্রমণ দোষ (anachronism)-এর আবির্ভাবের সম্ভাবনা সব সময়েই থাকে। তাই খেয়াল রাখতে হবে যে, বিষ্ণু উপাসনা গোড়ার দিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অধীন ছিল না। ঋগ্বেদে বিষ্ণু ইন্দ্রের বন্ধু হিসেবে যেমন বর্ণনা আছে,[3] তেমনি উভয়ের একাত্মতার কথাও পাওয়া যাবে এখানে।[4] রমেশচন্দ্র দত্ত বিষ্ণুকে ঋতুর নিয়ামক দেবতা হিসেবে দেখেছেন এবং এই দিক থেকে দেখলে বিষ্ণু সূর্যের সমস্থানীয় হয়ে দাঁড়ায়।[5] যাস্কত্বর মতে বিষ্ণু হল আদিত্য।[6] ঋগ্বৈদিক যুগে বিষ্ণু খুব একটা জায়গা না পেলেও পৌরাণিক পর্বে প্রধানতম দেবতা হিসেবে স্থান করে নেয়।[7] এই পর্বেই গড়ে ওঠে বিষ্ণুর অবতার তত্ত্ব। অবতারের সংখ্যা যাই হোক (৭/১০/১২/২০) কৃষ্ণ ও রামের জনপ্রিয়তাই সর্বাধিক। শুধু ধর্ম নয়, রাজনীতির ক্ষেত্রেও আধুনিক পর্বে তাদের অবস্থান যে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, তা বলাই বাহুল্য।
পৌরাণিক পর্বে (বা পরবর্তী প্রাচীন যুগে) বিষ্ণুকে ভার্গব ব্রাহ্মণরা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অধীনে নিয়ে আসে। এ-বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যায় সুবীরা জায়সবাল-এর গবেষণায়।[8] তিনি দেখিয়েছেন, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রকে সুরক্ষিত ও সংহত করতে এটা ছিল একটি আবিষ্কার।[9] সুতরাং সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুর যেমন পরিবর্তন ঘটেছে, তেমনি এই উপাসনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা ধরনের উপজাতীয় ও দেশীয় উপাদান। বিভিন্ন অঞ্চলগত প্রভাবের কথাও এখানে লক্ষণীয়। তাই বিষ্ণু-উপাসনার সঙ্গে যুক্ত সময়, স্থান ও পাত্র তিনটিই গুরুত্বপূর্ণ। আর এগুলিকে মাথায় রেখেই বর্তমান চর্চাটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
রামকে প্রথমদিকে (খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতক) একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই দেখা হয়েছিল, বিষ্ণুর অবতার রূপে নয়। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের শেষদিকে রামকে দেবতায় রূপান্তরিত করা হয়। মহাভারতের মধ্যেই প্রথম বৈষ্ণব ধর্মের উদ্ভবের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ভৃগু সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণরা এই মহাকাব্যটিকে আত্মসাৎ করে বিষ্ণুকে প্রতিষ্ঠা দেয়। ভাগবত পুরাণের বর্ণনা অনুযায়ী, ঋষিরা ভৃগুর ওপর ভার দিয়েছিলেন দেবতাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম কে তা খুঁজে বের করার। তিনি ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণু— এই তিনজনের প্রত্যেকের সঙ্গেই সাক্ষাৎ করেন এবং নারায়ণ/বিষ্ণুকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করেন।[10] মহাভারতেই বাসুদেব/কৃষ্ণের সঙ্গে নারায়ণ/বিষ্ণুর অভিন্নতা স্থাপিত হয় যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গেই। এখানেই বিষ্ণুর অবতার তত্ত্ব ও দেবতা হিসেবে উপাসনাকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অঙ্গীভূত হতে দেখা যাবে। সুবীরা জায়সবালের পর্যবেক্ষণটি এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন:
এটি [বৈষ্ণব ধর্ম] ছিল এমন একটি ধর্ম, যা একটি সামন্ততান্ত্রিক কৃষিজীবী সমাজের প্রয়োজন মেটাবার সবরকম যোগ্যতাই অর্জন করেছিল এবং ভারতীয় হৃদয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পেরেছিল।[11]
এখানে আরও একটি কথার সংযোজন প্রয়োজন। বিষ্ণু-উপাসনার মধ্যে বৈদিক ও পৌরাণিক উপাদান ছাড়াও দেশজ ও জনজাতীয় বহু উপাদানও ছিল। এবং তা ঘটেছিল ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক আত্তীকরণের মধ্যে দিয়ে। রাজারা ব্রাহ্মণদের ভূদান করতেন। জনজাতীয় অঞ্চলে ব্রাহ্মণগণ জমির অধিকারী হওয়ায় জনজাতীয় উপাসনা পদ্ধতি, দেবদেবী, বিশ্বাস ব্যবস্থাকে আত্মসাৎ করে নিতে শুরু করে। এর মধ্যে দিয়ে তারা তাদের সামাজিক ও নৈতিক মূল্য ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও আধিপত্য নব বলে বলীয়ান হয়ে ওঠে। সুবীরা জায়সবাল লিখেছেন:
…the worship of tribal popular deities, who were identified or linked with the deities of the Vedic pantheon to give them sanction, was open to all and suitably modified to adjust to contemporary needs and the environment. The integration of the non-Vedic deities with Vedic ones ultimately conceptualization of the doctrine of incarnation, a cardinal principle of Vaisnavism as adumbrated in the Bhagavadgita and embedded in the great epic, the Mahabharata.[12]
বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে তাই একই সঙ্গে গ্রেট ট্র্যাডিশন ও লিটল ট্র্যাডিশন— উভয়েরই সন্ধান মেলে।
তিন.
চৈতন্যর সময় ১৪৮৬ থেকে ১৫৩৩। চৈতন্য-পূর্ব সময়ে বাংলায় অসংখ্য লোকধর্ম উপাসনা ছাড়াও পাঁচটি প্রধান ব্রাহ্মণ্য উপাসনার ধারা প্রচলিত ছিল। এছাড়াও ছিল বৌদ্ধ ধর্ম— যা অত্যন্ত দুর্বল এবং ক্রমহ্রাসমান। পাঁচটি উপাসনার তালিকাভুক্ত ধর্মগুলি এইরকম: শৈব ধর্ম, শাক্ত ধর্ম, সৌর ধর্ম, গাণপত্য ধর্ম এবং বৈষ্ণব ধর্ম। শৈব ও সূর্যের উপাসকদের সঙ্গে বৌদ্ধদের সম্পর্ক মোটেই ভাল ছিল না। শৈব রাজা শশাঙ্ক অসংখ্য বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মানুষকে হত্যা করেছিলেন।[13] আবার নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের কৃতিত্ব রায় তীর্থিক ব্রাহ্মণদের (সূর্যের উপাসক)। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ঘটনাটির বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন:
…ধর্মসগন্ধ অর্থাৎ নালন্দার বৃহৎ লাইব্রেরী তিনটি মন্দিরে রক্ষিত ছিল। তীর্থিক [ব্রাহ্মণ] ভিক্ষুদের দ্বারা অগ্নিসংযোগে তাহা ধ্বংস করা হয়। মগধের রাজমন্ত্রী কুকুতসিদ্ধ নালন্দার একটি মন্দির নির্মাণ করেন। সেখানে ধর্মোপদেশ প্রদানকালে জনকতক তরুণ ভিক্ষু তীর্থিক ভিক্ষুদের গায়ে নোংরা জল নিক্ষেপ করে। তার ফলে তারা ক্রুদ্ধ হয়ে রত্নসাগর, রত্নধনুক আর নয়তলাযুক্ত রত্নদধি নামক তিনটি মন্দির অগ্নিসংযোগে ধ্বংস করে। উক্ত তিনটি মন্দিরেই সমষ্টিগতভাবে ধর্মগ্রন্থ বা গ্রন্থাগার ছিল।[14]
বৈষ্ণবদের সঙ্গে বৌদ্ধদের সম্পর্কটি কিন্তু এমন ছিল না। বৈষ্ণবদের কাছে বুদ্ধ বিষ্ণুর অন্যতম অবতার। বিক্রমপুরের সুপ্রসিদ্ধ গ্রাম বজ্রযোগিনীতে প্রাপ্ত কচ্ছপের খোলের মধ্যে উৎকীর্ণ লেখ-এ বুদ্ধ এবং বিষ্ণু একযোগে বন্দিত হয়েছেন।[15] বৈষ্ণব ধর্মের এই নমনীয়তার দিকটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
চৈতন্য-পূর্ব সময়ে বৈষ্ণব ধর্মের মধ্যে তিনটি প্রধান ধারা দেখতে পাওয়া যাবে। একটি কর্মকাণ্ডমূলক, দ্বিতীয়টি গোপী-প্রেমিক কৃষ্ণের প্রেমকাহিনিমূলক সাহিত্যিক এবং সাঙ্গীতিক ধারা। তৃতীয়টি ভক্তিবাদী ধারা।[16] চৈতন্য-পূর্ব বাংলায় বৈষ্ণব ধর্ম ছিল প্রধানত কর্মকাণ্ডমূলক। যতটুকু ভক্তিবাদী প্রবাহ এ-সময়ে ছিল, তা চৈতন্যর ‘পদ্ধতি হিসেবে ভক্তি’র থেকে ভিন্ন। ‘ভাগবতপুরাণ’, ‘নারদভক্তিসূত্র’, ‘শাণ্ডিল্যসূত্র’ ইত্যাদি ভক্তিবাদী ধারার প্রতিনিধিত্বকারী গ্রন্থ। ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শ এখানে যেমন স্থান পেয়েছে, তেমনি একই সঙ্গে কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ডও সমালোচিত হয়েছে। বর্ণবিচার ভক্তিতত্ত্বে আদৌ প্রাধান্য পায়নি। এখানে পুরোহিত ও পণ্ডিতদের কোনও স্থান নেই ও বর্ণভেদ অবহেলিত— সেই কারণে স্মার্ত ব্রাহ্মণরা ভক্তিতত্ত্বকে মোটেই মেনে নিতে পারেনি। ফলে বৈষ্ণবীয় ভক্তিতত্ত্ব একই সঙ্গে ছিল ব্রাহ্মণ্য মতাদর্শ ও তার বিলয় স্থান।
একাদশ শতাব্দীতে রামানুজের দ্বৈতবাদী বৈষ্ণবীয় ভক্তিবাদ ভক্তিবাদী আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। রামানুজ-প্রচারিত বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান উদ্দেশ্যই এই ভক্তিবাদের প্রতিষ্ঠা। এ-ছাড়া আরও দুটি গৌণ উদ্দেশ্য ছিল— প্রথমত, শঙ্কর-এর মায়াবাদ নিরসন এবং দ্বিতীয়ত, শৈব ধর্মকে দমন করা।[17] রামানুজের এই ‘শ্রী’ সম্প্রদায় ‘নারদভক্তিসূত্র’কে অনুসরণ করত। এছাড়াও ছিল ‘সনক’ সম্প্রদায়। এদের প্রধান পুরুষ নিম্বার্ক। তাঁর অনুসৃত শাস্ত্র ‘শাণ্ডিল্যসূত্র’। বৈষ্ণবদের অন্য একটি সম্প্রদায়ের নাম ‘রুদ্র’। এই সম্প্রদায়ের বিষ্ণুস্বামী ছিলেন বিখ্যাত মানুষ। তাঁরই শিষ্য বল্লভাচার্য চৈতন্যর সঙ্গে পরিচিত হন। ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয় উভয়ের মধ্যে।
চৈতন্য-পূর্ব আরও দুজন ভক্তিবাদীর কথা এখানে বলা দরকার। প্রথমজন হলেন মাধবেন্দ্র পুরী। তাঁর সময়কাল পঞ্চদশ শতাব্দী (১৪০০-১৪৮০)। মাধবেন্দ্র পুরীর উপাধি ছিল ‘ভক্তিচন্দ্রোদয়’। তাঁকে দীনেশচন্দ্র সেন ভক্তিরাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন।[18] তাঁর শিষ্যগণের মধ্যে প্রধান ছিলেন অদ্বৈতাচার্য (কমলাক্ষ ভট্টাচার্য), নিত্যানন্দ, কেশব ভারতী ও ঈশ্বর পুরী। এই ভক্তিবাদীরাই ছিলেন চৈতন্যর আশ্রয়। বাংলায় বৈষ্ণববাদের ইতিহাসে মাধবেন্দ্র পুরীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। জয়দেব, বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাসের রাধাকৃষ্ণতত্ত্ব কাহিনিকে আরও বিশুদ্ধ স্তরে উন্নীত করেন মাধবেন্দ্র পুরী। তাঁর শিষ্য অদ্বৈতাচার্য ছিলেন চৈতন্যর পিতা জগন্নাথ মিশ্রর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ঈশ্বর পুরীর কাছে চৈতন্য মন্ত্র গ্রহণ করেন। আর সন্ন্যাসদীক্ষা গ্রহণ করেন কেশব ভারতীর কাছে। মাধবের অন্য আরেক শিষ্য নিত্যানন্দ ছিলেন চৈতন্যর সহকর্মী।
চৈতন্যর জীবনপঞ্জি এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক।
জন্ম: ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ
পিতার মৃত্যু: ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দ
প্রথম বিবাহ: (লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে; প্রেমজ বিবাহ) ১৫০১-১৫০২ খ্রিস্টাব্দ
অধ্যাপনার শুরু: ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দ (আনুমানিক)
লক্ষ্মীপ্রিয়ার মৃত্যু: ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দ (আনুমানিক)
দ্বিতীয় বিবাহ: (বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে) ১৫০৭ খ্রিস্টাব্দ (আনুমানিক)
ঈশ্বর পুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, দীক্ষা ও শিক্ষাগ্রহণ: ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দ
সঙ্কীর্তনের আয়োজন: ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দ
অধ্যাপনা ত্যাগ: ১৫০৯ খ্রিস্টাব্দ
কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ ও গৃহত্যাগ: ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ
পুরী গমন: ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ
দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ: ১৫১০ খ্রিস্টাব্দ
পুরীতে প্রত্যাবর্তন: ১৫১২ খ্রিস্টাব্দ
বৃন্দাবন গমন: ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দ
এলাহাবাদ গমন: ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ
বারাণসী গমন: ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ
পুরীতে প্রত্যাবর্তন: ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দ
পুরীতে মৃত্যু/হত্যা: ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ
চার.
চৈতন্য তার পারিবারিক পরিবেশের মধ্যে পেয়েছিলেন ভক্তিবাদী ধ্যানধারণা। জীবনের প্রথম পর্বে “ধর্মকর্মের দিকে তাঁর [চৈতন্যর] তেমন বিশেষ কোনও ঝোঁক ছিল না। যে বিনয়নম্রতা পরজীবনে তাঁর চরিত্রের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তা তাঁর মধ্যে তখনও দেখা যায়নি। তিনি তখন একজন অহঙ্কারী উদ্ধত পণ্ডিত— অন্যকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ-উপহাস করেই যাঁর তৃপ্তি।”[19] জগন্নাথ মিশ্রর সন্তান বিশ্বম্ভর/নিমাই (পরে চৈতন্য) জন্মসূত্রে বৈদিক ব্রাহ্মণ হওয়ার কারণেই বোধহয় জীবনের শুরুতে তাঁর আচার-আচরণ এমন খাতে বয়েছিল। কিন্তু এটাই সব নয়। সমসময়কে অতিক্রম করার ক্ষমতা তাঁর বেশ ভালরকমই ছিল। তার প্রথম প্রকাশ দেখা যাবে লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে বিবাহসংক্রান্ত ঘটনায়। ঘটনাটিকে একটু বিশদে দেখে নেওয়া যাক।
নিমাই/বিশ্বম্ভর (পরে চৈতন্য) ছাত্রাবস্থাতেই প্রেমে পড়েছিলেন লক্ষ্মীপ্রিয়ার। সমকালীন সামন্ততান্ত্রিক সমাজে বিবাহকে কোনও ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে দেখা হত না। এটি ছিল দুটি পরিবারের ও কুলগত সম্পর্কের বিষয়। তা কিন্তু মিছুটা পরিমাণে বিপন্ন হয়ে পড়ল নিমাই ও লক্ষ্মীপ্রিয়ার মধ্যেকার সম্পর্ক স্থাপনের মধ্যে দিয়ে। কারণ উভয়ের বিবাহ ছিল প্রেমজ। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী লিখেছেন:
দৈবে একদিন প্রত [নিমাই] পড়িয়া আসিতে।
বল্লভাচার্য্যের কন্যা দেখে গঙ্গাপথে।।
পূর্ব্ব সিদ্ধভাব দুঁহার উদয় করিল।[20]
টোল থেকে ফেরবার পথে ঘটনাচক্রে বল্লভাচার্যের কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে নিমাইয়ের দেখা হয়। একেবারে প্রথম দর্শনেই প্রেম। একে অপরের প্রতি আকর্ষিত হলেন। বৃন্দাবন দাসের ভাষায় “নিজ লক্ষ্মী চিনিয়া হাসিল গৌরচন্দ্র।”[21] শচীদেবীর প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বিবাহটি সম্পন্ন হয়। তবে শচীদেবীর সঙ্গে লক্ষ্মীর সম্পর্ক নানা কারণে ভাল ছিল না। প্রথমত, নিমাই পারিবারিক দিক থেকে স্মার্ত বৈদিক ব্রাহ্মণ, আর অন্যদিকে বল্লভাচার্য বর্ণগত দিক থেকে ব্রাহ্মণ হলেও বৈষ্ণব নেতা। সুতরাং ধর্মীয় বিশ্বাসগত পার্থক্য এখানে আপত্তির একটি কারণ হওয়ার সম্ভাবনা। এর সঙ্গে যুক্ত আরও একটি দিক। বল্লভাচার্য হলেন গুর্জর-দেশীয়। শচীদেবীর সন্দেহ হওয়াই স্বাভাবিক যে— গুর্জরদেশীয় বৈষ্ণব পরিবারের কন্যা লক্ষ্মীপ্রিয়ার আচরণের সঙ্গে এক বাঙালি গোঁড়া স্মার্ত ব্রাহ্মণ পরিবারের রীতিনীতি কতখানি সঙ্গতিপূর্ণ হবে।[22] তাছাড়া লক্ষ্মীপ্রিয়া ও নিমাইয়ের এই স্বাধীন সিদ্ধান্ত পারিবারিক কর্তৃত্বের পক্ষে মেনে নেওয়াটা মোটেই সহজ নয়। শচীদেবীর আপত্তির আরও একটি কারণ নিহিত থাকতে পারে বল্লভাচার্য্যের আর্থিক দুর্বলতায়। লক্ষ্মীপ্রিয়ার সঙ্গে নিমাইয়ের বিবাহে তিনি প্রায় কোনও যৌতুকই দেননি। মাত্র পাঁচটি হরিতকী দিয়ে পুষ্প-অলঙ্কারে সাজিয়ে বল্লভাচার্য মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে দেন।[23] যদিও জয়ানন্দ তাঁর চৈতন্যমঙ্গল (নদিয়া খণ্ড)-এ লিখেছেন:
আচার্য পুরন্দর লক্ষ্মী সম্প্রদান করি।
নানাবিধ দান সংখ্যা করিতে না পারি।।
জত লোক গিয়াছিল বিভা দেখিবারে।
রজত কাঞ্চনে জতুক দিল বিশ্বম্ভরে।।
এখানে লক্ষ করতে হবে জয়ানন্দ আচার্যর অসংখ্য যৌতুকের কথা বললেও তার মধ্যে সোনা-জহরত কত ছিল তা বলেননি। বরং নিমন্ত্রিতরা যে প্রচুর সোনা-রুপো দিয়েছিল, তার উল্লেখ করেছেন।
সুতরাং চৈতন্যর গার্হস্থ্যজীবন কণ্টকশূন্য ছিল না। লক্ষ্মীপ্রিয়ার প্রতি গভীর প্রেম তার মধ্যে নিঃসন্দেহে একটি বড় পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। আর তা হল স্মার্ত ব্রাহ্মণ থেকে ভক্তিবাদী নিমাইয়ের আবির্ভাব। আরও স্পষ্ট করে বলা যায়— ভক্তিবাদী বল্লভাচার্যের কন্যা যে ভক্তিবাদী হবে, এটা আর বড় কথা কী! আর লক্ষ্মীপ্রিয়ার প্রতি গভীর প্রেম নিমাইকে ভক্তিবাদের পথে নিয়ে যাবে, সেটাও অস্বাভাবিক নয়। শচীদেবীর কাছে এই পরিবর্তন খারাপ না লেগে পারেনি। পরবর্তীকালে লক্ষ্মীর মৃত্যু নিমাইকে স্মার্ত ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র, অধ্যাপনা, সংসার ইত্যাদি সম্বন্ধে আরও মোহহীন করে তোলে। তিনি ভক্তিবাদকে আঁকড়ে ধরেন। নিমাই হয়ে উঠলেন চৈতন্য— ভক্তিই এখানে প্রধান ভূমিকা নিল। ভক্তি কেবলমাত্র নিমাইকে পাল্টাল না, তা চৈতন্যর হাতে পরিণত হল একটি পদ্ধতি হিসেবে। কতটা সচেতন বা অসচেতনভাবে তিনি সমকালীন সমাজে ভক্তিকে প্রয়োগ করলেন— তা বিবেচ্য নয়, বরং তাঁর এই পদ্ধতি প্রয়োগের সামাজিক তাৎপর্যটিই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেটাই দেখবার বিষয়।
পাঁচ.
ভক্তির সামাজিক প্রয়োগ এবং তার সাফল্য-ব্যর্থতার প্রসঙ্গটি উত্থাপনের আগে সমকালীন অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক চালচিত্রটি বুঝে নেওয়ার প্রয়োজন আছে। চতুর্দশ শতাব্দীর তৃতীয়-চতুর্থ দশক থেকে বাংলার রাজনীতি-অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন শুরু হয়। কারণ এই সময় থেকেই বাংলায় দিল্লির অধীনতা থেকে ছিন্ন হয়ে স্বাধীনভাবে দুশো বছর ধরে (১৩৩৮-১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ) স্বাধীন সুলতানি শাসনের সূত্রপাত ঘটে। এখানে দুটি তালিকা প্রস্তুত করতে হবে, যার থেকে দেখা যাবে দিল্লি ও বাংলার সুলতানি শাসকদের কালপর্বটিকে।
দিল্লি
- তুঘলক বংশ – ১৩২০-৮৮ খ্রিস্টাব্দ
- সৈয়দ বংশ – ১৩৯৯-১৪৫১ খ্রিস্টাব্দ
- লোদি বংশ – ১৪৫১-১৫২৬ খ্রিস্টাব্দ
বাংলা
- ইলিয়াস শাহী আমল – ১৩৪২-১৪১৩ খ্রিস্টাব্দ
- গণেশ, যদু বা জালালউদ্দিন, আহমদ শাহ – ১৪১৪-৩৩ খ্রিস্টাব্দ
- মাহমুদ শাহী আমল – ১৪৩৩-১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দ
- হাবসী গোলাম আমল – ১৪৮৭-৯৩ খ্রিস্টাব্দ
- হোসেন শাহী আমল – ১৪৯৩-১৫৫৮ খ্রিস্টাব্দ
এই দুশো বছরে বিদ্রোহের সংখ্যা কমতে শুরু করে। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক কারণে দিল্লির সুলতানি শাসন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। পরিণতিতে বাংলার উপর দিল্লির নিয়ন্ত্রণ একেবারে চলে যায়। বাংলা থেকে দিল্লিতে সম্পদ নিঃসরণের অবসান ঘটে। বাংলায় বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র অনেক বেশি স্থিতিশীল ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। গড়ে উঠতে শুরু করে বাংলার নিজস্ব সুসংবদ্ধ আমলাতন্ত্র বা স্থায়ী প্রশাসক ব্যবস্থা। ইলিয়াস শাহী সুলতানেরাই রাজতন্ত্রের স্থায়িত্বের স্বার্থে প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে সুসংহত ও সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে প্রথম উদ্যোগ নেয়। এই সময় থেকেই অর্থনৈতিক ব্যবস্থার স্তম্ভস্বরূপ ভূমিরাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যে ব্যাপক বন্দোবস্ত অবলম্বনের প্রয়োজন অনুভূত হল। কারণ বাংলার সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় ততদিনে ঘটতে শুরু করেছে নানা পরিবর্তন।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইসলাম ধর্মাবলম্বী নয় এমন দুই ধরনের ভূস্বামী শ্রেণির উপস্থিতি দেখা গেছে। এক, বৃহৎ ভূস্বামী— যারা রাজা, রাণা, রায় ইত্যাদি নামে পরিচিত হত। দুই, গাজি কিংবদন্তিগুলিতে বর্ণিত ক্ষুদ্র ভূস্বামীরা। এই বড় ভূস্বামীরা প্রথমদিকে ছিল প্রায় স্বাধীন বা অর্ধ-স্বাধীন স্থানীয় শাসককুল। এরা ইসলাম ধর্মাবলম্বী শাসকদের কাছে পরাজিত হয়ে বশ্যতা কর দেওয়ার শর্তে নিজ নিজ এলাকার উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে পারত। দিল্লির কেন্দ্রীয় সুলতানি শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার সুলতানরা যখন বিদ্রোহ ঘোষণা করত, তখন এই রাজা-রাণা-রায়রা সেই বিদ্রোহে সামরিক সাহায্য সমেত অংশ নিত।[24] এই বড় ভূস্বামীরা অধিকাংশই ছিল উচ্চবর্ণভুক্ত, যাদের মধ্যে একটা বড় অংশ বর্ণগত দিক থেকে ব্রাহ্মণ। তাম্রফলক থেকে জানা যায় সেন রাজত্বের শেষ পর্বে (দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরু) সেন রাজাদের ভূমিদানের ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণরা ভূমির স্বত্বভোগী হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পরবর্তীকালে (পঞ্চদশ শতাব্দী ও ষোড়শ শতাব্দী) সমুদ্রগড়ের রাজা মুকুট রায়, ভাতুড়িয়ার রাজা গণেশ, গৌড়ের অধিকারী সুবুদ্ধি রায় প্রমুখ জমিদারদের ব্রাহ্মণ বলে চিহ্নিত করা হয়।[25] স্মার্ত ব্রাহ্মণদের কাছে এইসব ব্রাহ্মণ ও অন্যান্যরা ম্লেচ্ছ-সংযোগের কারণে পাতিত্য দোষযুক্ত বলে চিহ্নিত হত। অর্থাৎ ইসলামি শাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকায় তাদের সামাজিক মর্যাদা যথেষ্ট ক্ষুণ্ণ হয়েছিল। আর তা হয়েছিল স্মার্ত ব্রাহ্মণদের বিধান অনুযায়ী। ফলে তারা ধর্মান্তরিত না হয়েও কীভাবে সামাজিক মর্যাদা অর্জন করা যায় তারই বিকল্প রাস্তা খুঁজছিল। অবশেষে চৈতন্যর ভক্তি আন্দোলনে তারা খুঁজে পেল তাদের আশ্রয়। এখানে তারা তাদের ঐতিহ্যগত ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে যেমন রক্ষা করতে পারল, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রেও পেল মর্যাদা ও স্বীকৃতি। তাই দেখা যায় চৈতন্যর ৪৯৯ জন পরিকর-এর মধ্যে ২৩৯ জন ছিলেন ব্রাহ্মণ।
বড় ভূস্বামীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র ভুস্বামীদের উপরেও কিছু আলো ফেলা প্রয়োজন। গাজি কিংবদন্তিগুলিতে দেখা পাওয়া যায় এই ক্ষুদ্র ভূস্বামীদের। এই ক্ষুদ্র ভূস্বামীরা বৃহৎ এলাকার প্রায় বা অর্ধস্বাধীন স্থানীয় শাসক ছিল না। এরা গ্রামীণ ক্ষুদ্র ভৌমিক শ্রেণি। বলবন বংশ (১২৮২-১৩০১) ও মামলুক বংশের শাসনকালে (১৩০১-১৩২২) গ্রামবাংলায় সুফিদের আবির্ভাব ঘটতে দেখা যায়। এদের একটি বড় অংশই ধ্রুপদী ইসলামের প্রচার না করে আরও উদার আরও মানবিক ভাবনার প্রচার করত। দরবেশ গাজিদের কথাও উঠে আসবে এই প্রসঙ্গেই। এদের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষুদ্র ভৌমিকদের সংঘাত ঘটত। কারণ এরা সুলতানদের কাছে খানকা বা ধর্মস্থান গড়ার অধিকার যেমন পেত, তেমনি আবাদি বা অনাবাদি জমির কর্তৃত্বও লাভ করত। ফলে ক্ষুদ্র ভূস্বামীদের সঙ্গে সংঘাতের একটি স্বাভাবিক ক্ষেত্র তৈরি হয়। কিন্তু একটি পর্বে তাদের মধ্যে আপস মীমাংসা হয়। কারণ এই আপস উভয়ের অস্তিত্বের পক্ষেই প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, তার পিছনে অবশ্যই বস্তুগত ও সাংস্কৃতিক স্বার্থের ভূমিকাই প্রাধান্য পায়। বিশেষ করে সুফিদের কৃষিকার্যে অংশগ্রহণ এবং বিবর্তনমূলক পদ্ধতিতে ইসলাম ধর্মের বিকাশ উল্লেখযোগ্য। রিচার্ড ইটন (১৯৯৪)-এর গবেষণাটি এই প্রসঙ্গে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছে। ইটনের মতে, বাংলায়, বিশেষ করে এর পূর্ব অংশে, ইসলামের বিকাশ ঘটেছে ধীরে ধীরে কৃষিবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে। সুফি সাধকরা জমিজমার অধিকারী হওয়ায় তারা কৃষিকাজের বিকাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই কৃষিকর্মের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে পড়ে অসংস্কৃতায়িত বা অর্ধসংস্কৃতায়িত শ্রমজীবী মানুষ। তারা এই সুফি-সংস্পর্শে ধীরে ধীরে ইসলামীয় আচার-আচরণ, নাম, বিশ্বাস গ্রহণ করতে শুরু করে। আর এর ফলেই বিশাল সংখ্যক মানুষ এই ধরনের বিবর্তনমূলক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে উদার ও মানবিক ইসলামের ছত্রছায়ায় চলে আসে। ধ্রুপদী ইসলামের থেকে তা কিন্তু বেশ কিছুটা ভিন্ন। এখানে বলা দরকার ইটন কেবল মুঘল আমলে ঘটা এই প্রক্রিয়ার ওপরে জোর দিয়েছেন। কিন্তু এ-ঘটনা তার বহু পূর্ব থেকেই শুরু হয়েছে। অর্থাৎ সুলতানি যুগ থেকেই এই বিবর্তনমূলক পদ্ধতিতে ইসলাম ধর্মের বিকাশ হয়েছে বলে দাবি করা যায়, কারণ শর্তগুলি তখনও ছিল।
ছয়.
আধুনিক রাষ্ট্রের প্রধান দুটি স্তম্ভ স্থায়ী আমলাতন্ত্র ও স্থায়ী সৈন্যবাহিনি। সামন্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রে বস্তুগত কারণেই তা সম্ভব ছিল না। সুলতানি আমলে বাংলায় ক্ষুদ্র আকারে হলেও আমলাতন্ত্র গড়ে উঠতে শুরু করে। বিশেষ করে ইলিয়াস আমলে। দিল্লির নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা তৈরি হল। এই বিচ্ছিন্নতা আবার বহিরাগত ও উত্তর ভারত থেকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী অভিজাতদের বাংলায় আগমন হ্রাস করল। এই সময়ে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি ছিল কৃষি-অর্থনীতি। তাই ভূমিরাজস্ব সংগ্রহের জন্য সুসংবদ্ধ ব্যবস্থার প্রয়োজন অনুভূত হল। অথচ এই ভূমিরাজস্ব সংক্রান্ত কাজের উপযুক্ত লোকের ছিল একান্ত অভাব। নগরবাসী, বহিরাগত অভিজাত ও শাসকরা, উলেমা সম্প্রদায়, সৈনিক-সামরিক কর্মচারী— এরা কেউই গ্রামবাংলা সম্বন্ধে কিছুই জানত না এবং ভূমিরাজস্ব সংগ্রহ করবার মতো এদের যোগ্যতাও ছিল না। ফলে সুলতানগণ একরকম বাধ্য হন স্থানীয় ও ইসলাম ধর্মাবলম্বী নয় এমন ব্যক্তিদের এই কাজে নিয়োগ করতে। আরও একটি কারণ এখানে উল্লেখযোগ্য। এই সময়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী অভিজাতরা নিজেদের মধ্যে নানা ক্ষেত্রে ক্ষমতা, প্রতিপত্তি ও সম্মান-মর্যাদার কারণে অভ্যন্তরীণ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ত। কখনও বা তারা শাসক সুলতানের বিরুদ্ধে চক্রান্তমূলক কাজে যুক্ত হয়ে পড়ত। তাই তাদের এই অভ্যন্তরীণ সংঘাত ও ষড়যন্ত্র থেকে দূরে রেখে তাদের দুর্বল করার পরিকল্পনা সুলতানরা দেশীয় মানুষদের অন্তর্ভুক্তিকরণের মধ্যে দিয়ে গ্রহণ করে।
ব্রাহ্মণরা নানা বিদ্যাশিক্ষার সুযোগ পেলেও অধিকাংশই ‘ম্লেচ্ছ’ শাসন থেকে দূরে থাকত। কারণ এই ‘ম্লেচ্’’ শাসনের সঙ্গে যুক্ত থাকলে সমাজে পতিত হবে, পাতিত্য দোষ দেখা যাবে। ফলে ব্রাহ্মণদের মধ্যে খুব সামান্য সংখ্যক মানুষই সুলতানি প্রশাসনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছিল। এর ফলে স্থানীয় ভাষা-ভাষী, রীতি-নীতি বিষয়ে অভিজ্ঞ, হিসাবশাস্ত্রে দক্ষ রাজস্ব আদায়কারী হিসেবে অ-ব্রাহ্মণদের নিয়োগ অপরিহার্য হয়ে পড়ল। রীনা ভাদুড়ি লিখেছেন:
এই অবস্থায় রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও প্রশাসনিক সম্প্রসারণের সর্বাপেক্ষা সুযোগ গ্রহণ করলেন কায়স্থ ও বৈদ্যরা। বিশেষ [করে], কায়স্থদের মধ্যে রাজস্ব আদায় ও হিসাবরক্ষার কাজে দক্ষতার বংশানুক্রমিক ঐতিহ্য ছিল। লক্ষণীয় যে এই সময়ে কায়স্থ ও বৈদ্যরা যে শুধু শিক্ষিত ছিলেন তাই নয়, একমাত্র তারাই প্রশাসনিক কর্মের অনুকূল অ-ধমীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। শাস্ত্রীয় শিক্ষায় শিক্ষিত ব্রাহ্মণদের নিকট ম্লেচ্ছ শাসকের অধীনস্থ কর্ম যদিচ গ্রহণীয় ছিল না, তবু অর্থনৈতিক কারণে ১৫শ শতকের দ্বিতীয় দশক থেকে এই মানসিকতার পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়।… রাজস্ব আদায়কারী, হিসাবরক্ষক, পরিদর্শক, ভূমি আইন বিশেষজ্ঞ, প্রমুখ, যাঁরা অধিকাংশই ছিলেন কায়স্থ, তাঁরা এই সুযোগে মুসলিম প্রশাসন ও কৃষকদের মধ্যে যোগসূত্র হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন এবং বহুক্ষেত্রে সরকারি পদগুলি বংশানুক্রমিক পেশায় পরিণত ক’রে ও অন্যান্য উপায়ে লব্ধ জাগীরগুলির সুযোগে জমিদারি অধিকার অর্জনে সক্ষম ছিলেন।[26]
এভাবেই বাংলা একটি প্রতিপত্তিশালী অ-ব্রাহ্মণ (কায়স্থ ও বৈদ্য) মধ্যস্বত্বভোগীশ্রেণির উদ্ভব ঘটে। চৈতন্য-প্রভাবিত ভক্তি আন্দোলনে এদের সমর্থন-সহযোগিতা একটা বিরাট ভূমিকা নিয়েছিল। এদের হাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা থাকলেও মর্যাদা-কাঠামোতে খুব একটা উঁচুতে স্থান পেত না। কারণ স্মার্ত ব্রাহ্মণ্য বিধানে এরা ছিল শূদ্র। ফলে এরা মর্যাদা-কাঠামোতে ওপরে ওঠার জন্য ভক্তিবাদকে পথ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
[এরপর আগামী সংখ্যায়]
[1] Bhattacharji, Sukumari. 2016 : 284.
[2] জায়সবাল, সুবীরা। ১৯৯৩ : ৯।
[3] ১/২২/১৯।
[4] ১/১৫৪/৪।
[5] ১৯৭৬ : ১ : ৫৯।
[6] ভট্টাচার্য্য, হংসনারায়ণ। ১৯৯৫ : ২ : ২০৬-৭।
[7] পূর্বোক্ত: ২১৮।
[8] ১৯৯৩; Jaiswal, 2016.
[9] Jaiswal. 2016 : 139.
[10] জায়সবাল, সুবীরা। ১৯৯৩ : ১১।
[11] পূর্বোক্ত: ৩৭।
[12] Jaiswal. 2016 : 139.
[13] দত্ত, ভূপেন্দ্রনাথ। ২০১৪ : ১৬, ৩৪, ৩৫।
[14] পূর্বোক্ত: ৮৬।
[15] চক্রবর্তী, রমাকান্ত। ২০১৫ : ১০।
[16] চক্রবর্তী, রমাকান্ত। ২০০২ : ৩০।
[17] সেন, দীনেশচন্দ্র। বাংলা ১৪২২ : ১০।
[18] পূর্বোক্ত: ৪৪।
[19] মুখার্জী, দিলীপকুমার। ২০১৬ : ৪।
[20] গোস্বামী, কবিরাজ। ১৯৭৯ : ৪২।
[21] চৈতন্য ভাগবত: ৪৮।
[22] ধর, নিরঞ্জন। ২০১৩ : ১৬।
[23] পূর্বোক্ত।
[24] ভাদুড়ী, রীনা। ১৯৮৮ : ১৩৭-৮।
[25] পূর্বোক্ত: ১৩৮।
[26] পূর্বোক্ত: ১৪০-১।