তাপস কুমার দাস
অর্থনৈতিক দৈন্য এবং বেকারির এই পরিস্থিতিতে, কঙ্কালসার ভুখা ভারতীয়দের সামনে রামমন্দিরের বারো ফিট লম্বা আট ফিট চওড়া বিয়াল্লিশটি সোনার দরজা করোটির দাঁতের মতো মুখব্যাদান করে থাকবে না কি? পরিষ্কার সত্যটা হল, সাধারণ লোকসভা নির্বাচনের আগে রামমন্দির নিয়ে আরোপিত এই মাতামাতি ধর্মাচরণ নয়, ধর্মের অপরিচ্ছন্ন পণ্যায়ন মাত্র। ধর্মের নামে, রামের নামে, ঘৃণার বেসাতি। বিভাজনের রাজনীতি, ক্ষমতার এবং পেশিশক্তির দম্ভ প্রদর্শন, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারগুলি টাকা ছড়িয়ে কিনে নেওয়ার এক নোংরা প্রচেষ্টা
গত পয়লা নভেম্বর রাত্রে, বারাণসীর ইন্ডিয়ান ইন্সটিট্যুট অফ টেকনোলজির এক ছাত্রী ক্যাম্পাসের মধ্যে গণধর্ষিতা হন। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় এবং আইআইটির চৌহদ্দির মধ্যে করমন বীর বাবা মন্দিরের সামনে এই ঘটনা ঘটে। মন্দিরটি একটি হিন্দু দেবস্থল, ভিতরে শিবলিঙ্গ এবং হনুমানের মূর্তি আছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দু-বছর বাদে মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল। মন্দিরের কাছে এক ঝোপের মধ্যে ছাত্রীটিকে টেনে নিয়ে গিয়ে তিন যুবক তাঁকে বন্দুক দেখিয়ে উলঙ্গ করে ছবি এবং ভিডিও তোলে, এবং তারপর ধর্ষণ করে। সেই খবর সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। মোটরসাইকেল চড়ে আসা সেই তিন যুবকের ছবিও ক্যাম্পাসের সিসিটিভি থেকে পাওয়া যায়। এবং এত কিছুর পরেও অপরাধীরা তৎক্ষণাৎ গ্রেফতার হয়নি। ঘটনায় ক্ষুব্ধ আইআইটির ছাত্ররা দিনের পর দিন বিশাল মিছিল এবং অবস্থানবিক্ষোভ চালিয়ে যান, ক্লাস বয়কট করেন, ধরনা দেন বেনারস হিন্দু ইউনিভার্সিটি ও আইআইটির কর্তৃপক্ষের অফিসের সামনে, এবং স্থানীয় থানাতেও, কিন্তু অপরাধীরা অধরাই থেকে যায়। মাঝখান থেকে প্রতিবাদী ছাত্রছাত্রীদের ওপরে আক্রমণের অভিযোগ ওঠে। খবরে প্রকাশ— বিজেপির ছাত্র সংগঠন এবিভিপি সেই হামলা চালায়। সংবাদে আরও প্রকাশ, অপরাধী কারা তা জানা থাকা সত্ত্বেও, এবং প্রতিনিয়ত সম্ভাব্য অপরাধীদের থেকে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেখা সত্ত্বেও আইনরক্ষকরা তাদের ধরার ব্যাপারে গা করেননি, কারণ বিজেপির ওপরমহল থেকে আগলে রাখা হয়েছিল সেই তিন যুবককে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, বিজেপির আইটি সেলের উঁচুতলার সক্রিয় কর্মী সেই তিন যুবকের সঙ্গে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী, এবং ভারতের নারী ও শিশুসুরক্ষা বিভাগের মন্ত্রী শ্রীমতি স্মৃতি ইরানির একাধিক ঘনিষ্ঠ ফটোগ্রাফ সামাজিক মাধ্যমে দেখতে পাওয়া যায়। উত্তরপ্রদেশে নারীধর্ষণের পরেও, এবং সম্ভাব্য ধর্ষণকারীদের সঙ্গে তাঁদের ছবি থাকা সত্ত্বেও, রাজ্যের প্রধান এবং দেশের নারী সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী এই বিষয়ে কোনও রা কাড়েননি। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, সেই তিন যুবককে বিজেপি নেতৃবৃন্দ মধ্যপ্রদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। একাধিক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচনের আগে তাদের গ্রেফতার করা হলে, নারী নির্যাতনের এত বড় খবর সংবাদমাধ্যমে আসবে এবং তা নির্বাচনের ফলাফলকে প্রভাবিত করবে, সেই কারণেই তাদের গ্রেফতার ঠেকিয়ে রাখতে মরিয়া ছিল বিজেপি। অভিযুক্ত তিন যুবক, মধ্যপ্রদেশে পালিয়ে যাওয়ার পর, সেখানকার বিধানসভা নির্বাচনেও বিজেপির হয়ে সক্রিয় ছিল এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে খবর করেছে সংবাদমাধ্যম। মধ্যপ্রদেশে বিজেপির জয়ের পিছনে, অতএব, কিছু অবদান নারী ধর্ষণকারীদের থেকেও এসেছে।
নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর, এবং বহু টালবাহানার পর, ধর্ষণের দু মাসের মাথায় তিন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়। তিন যুবক অপরাধ স্বীকার করে, এবং তাদের জেরা করে জানা যায় বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এর আগেও একাধিক নারীহেনস্থার সঙ্গে তারা যুক্ত। বিজেপি নেতৃত্ব তাদেরকে পার্টি থেকে বহিষ্কার করে। রাজ্যে রাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন মিটে গেছে, ফলত এই মুহূর্তে লোকদেখানো গ্রেফতার এবং বহিষ্কারে কোনও রাজনৈতিক ক্ষতির সম্ভাবনা নেই, বরং নিজেদের ‘সৎ ও নীতিবান’ হিসেবে একটু বুক বাজিয়ে নেওয়ার এই সুযোগ, লোকসভা নির্বাচনের আগে, ছাড়ে কোন মূর্খ? ফলত এই গ্রেফতার, এবং বহিস্কার— ‘প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা’। যদিও প্রশ্ন তোলাই যায় ‘দ্রুত ও ফলপ্রসূ সমাধানের জন্য’ বুলডোজার জাস্টিস চালু করার ব্যাপারে অগ্রগামী ভদ্রলোক তাঁর নিজেরই শাসনাধীন রাজ্যে এই ঘটনা ঘটার দু-মাস পরেও নড়ে বসেননি কেন? এই হিন্দুকূলতিলক সদ্য সদ্য সেপ্টেম্বর মাসেই নিজের নির্বাচনী কেন্দ্র গোরখপুরে নিদান হেঁকেছিলেন এই বলে, যে, উত্তরপ্রদেশে কোনও মহিলাকে হেনস্থা যে করবে তার সঙ্গে অনতিবিলম্বে যমরাজের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হবে। সেই বাহ্বাস্ফোটের মাস আড়াইয়ের মাথাতেই আইআইটির এই ঘটনায় অপরাধীকে গ্রেফতার করতে দু-মাসেরও বেশি সময় লেগে গেল (গ্রেফতারের আগের দিনও অপরাধীরা সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় ছিল, ফলে তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না এই অজুহাত হাস্যকর)— এই লজ্জা রাখার জায়গা নেই। এ ভারতের নাগরিকদের সংবিধানস্বীকৃত সুরক্ষার অধিকারের ওপর এক মস্ত বড় কোপ।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রে বসে, পৃথিবীর বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের এই অপূর্ব কর্মকাণ্ডে, একজন ভারতীয় নাগরিক হিসেবে আপ্লুত হতে হয় বৈকি! ডাবল ইঞ্জিন রামরাজ্যে বসে, প্রস্তাবিত অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রে বসে, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নিজের নির্বাচন কেন্দ্রে বসে, ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ রমরমে প্রচারের আবহে, হিন্দু দেবতার মন্দিরের সামনে সনাতনী হিন্দু ভীর-রা অবাধে ধর্ষণ করে চলে যাচ্ছে পড়াশুনায় নিবেদিতপ্রাণ এক বেটিকে, এই দৃশ্য দেখে, প্রতিটি ভারতীয়ের যদি ‘গায়ে আমার পুলক লাগে,.. চোখে ঘনায় ঘোর’ এই অনুভূতি না-ই হল, তাহলে সে কিসের সাচ্চা দেশভক্ত? কিসের গর্বিত হিন্দু?
ভারতমাতার হৃদয় কি কেঁপে উঠেছিল এই ভয়ঙ্কর ঘটনায়? অশ্রুসজল হয়েছিল চক্ষুদ্বয়? কে জানে। হয়তো তাঁর চোখের জল শুকিয়ে গেছে উপর্যুপরি ঘটে চলা অধর্ম প্রত্যক্ষ করার বেদনায়। আইআইটি ঘটনার দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তারের দু-দিনের মাথাতেই উত্তরপ্রদেশের বাগপতে বছর আঠারো বয়সের এক দলিত তরুণীকে ফুটন্ত তেলের কড়ায় ফেলে দেওয়া হয়। তরুণীর অপরাধ ছিল খুবই নিন্দনীয়! কিছুই না, তাকে গণধর্ষণ করতে আসা তিন যুবককে সাদর অভ্যর্থনা জানায়নি সে, তার বদলে ধর্ষণে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছিল। নিম্নবর্ণের মানুষের এই আস্পর্ধা কি সহ্য করা উচিত? স্বাভাবিকভাবেই ফুটন্ত তেলের কড়াইতে ভেজে সবক শেখানো হল সেই তরুণীকে। দলিত যুবকের গায়ে প্রস্রাবরত এক বর্ণহিন্দুর যে ছবি কিছুদিন আগে ছড়িয়ে পড়েছিল সমাজমাধ্যমে, তা ভুলে যেতে বিকারহীন ভারতবাসীর সম্ভবত খুব বেশিদিন লাগেনি।
সনাতনীরা উত্তরপ্রদেশকে ইতিমধ্যেই রামরাজত্ব বলে ডাকতে শুরু করেছেন ভালবেসে। সেই রামরাজত্বে, এবং প্রস্তাবিত অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রেই, অহিন্দু তো দূরের কথা, নিচুবর্ণের হিন্দুরাই কতখানি হেনস্থার সম্মুখীন হবে প্রতিমুহূর্তে, সে বিষয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করতে, অতএব, খুব কিছু একটা জটিল উপপ্রমেয়র আশ্রয় নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। রামলালার কি কোনও ভূমিকা থাকবে নিম্নবর্ণের হিন্দুর সামাজিক অবস্থান সুগম করতে? বাইশে জানুয়ারি প্রাণপ্রতিষ্ঠার পর, রামলালা কি তুলে নেবেন বর্ণবিভেদ ও জাতপাতের বিভাজনের ফলশ্রুতিতে ঘটা অনভিপ্রেত পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যারা, সেই অপরাধীদের বিচারের ভার?
ফুলহিঁ ফরহিঁ সদা তরু কারন।
রহহিঁ এক সোঁগ গজ পঞ্চানন।।
খগ মৃগ সহজ বয়রু বিসরাই।
সবহ্নি পরস্পর প্রীতি বড়াই।।
এই যে রামচরিতমানসের উত্তরকাণ্ডের চৌপাই বলছে রামরাজ্যে সিংহ, হাতি, হরিণ পাখি সবাই একসঙ্গে প্রেমে থাকে— অপ্রেমে থাকে কি তাহলে দলিত শুধু? এই যে দক্ষিণপন্থীরা হুঙ্কার দিয়ে বলে বেড়াচ্ছেন ‘ঘর ঘর বিজেপি ছায়েগা, রামরাজ্য ফির আয়েগা’, এই যে লক্ষ-কোটি টাকা খরচ করে গান বানিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘হর ঘর মে আব এক হি নাম, এক হি নারা গুঞ্জেগা— ভারত কে বাচ্চা বাচ্চা জয় জয় শ্রীরাম বোলে গা’, এই যে গুজরাটের ইস্কুলে নাম ডাকার সময় ইয়েস স্যার/ম্যাডাম বা প্রেজেন্ট প্লিজ-এর বদলে বলতে শেখানো হচ্ছে জয় শ্রীরাম— সেই আগতপ্রায় রামরাজ্যে দলিত তরুণীকে কড়াইতে ভাজা হচ্ছে, পঢ়াই করতে যাওয়া বেটিকে গণধর্ষণ করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো যাচ্ছে, এ কি তাহলে শুধুই মোহমায়া? নাকি এ শুধু বাইশ তারিখ রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হওয়ার ওয়াস্তা? তারপরেই সবাই মিলেমিশে সুখে শান্তিতে থাকবে?
তপস্বী বলেন আমি হই শূদ্রজাতি।
শম্বুক নাম ধরি আমি শুন মহামতি।।
করিব কঠোর তপ দুর্লভ সংসারে।
তপস্যার ফলে যাব বৈকুন্ঠ নগরে
তপস্বীর বাক্যে কোপে কাঁপে রামতুণ্ড।
খড়্গ হাতে কাটিলেন তপস্বীর মুণ্ড।।—কৃত্তিবাসী রামায়ণ, উত্তরকাণ্ড, অক্ষয় লাইব্রেরি
মহাজ্ঞানী শম্বুক, শূদ্র শম্বুক কি তাহলে সিংহ, হাতি, হরিণ, পাখিরও অধম ছিলেন? নিম্নবর্ণ কি তাহলে জানোয়ারেরও অধম? গলদ কি তাহলে রামরাজ্যের তত্ত্বীয় অভিক্ষেপের গোড়াতেই? বাইশে জানুয়ারি প্রাণপ্রতিষ্ঠায় কোন সার্বিক উন্নতি হবে তাহলে ভারতীয় নাগরিকের?
প্রকৃতপক্ষে এই প্রশ্ন সখেদে, সবিনয়ে পেশ করা যেতেই পারে, যে, বাইশে জানুয়ারির আগে এবং পরে ভারতবর্ষের মানুষের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে ঠিক কী পার্থক্য থাকবে? মন্দির উদ্বোধন হবে, রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা হবে, ভারতীয় হিন্দুর ধর্মীয় আবেগ উদ্বেলিত হবে— সমস্তই খুব ভাল কথা, কিন্তু রাষ্ট্রের তরফ থেকে ঢক্কানিনাদ সহকারে মেরুকৃত ধর্মাচরণের এই যে বাহ্যিক আড়ম্বর, তা সাধারণ ভারতবাসীকে খেতে পরতে দিতে, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং আইনি নিরাপত্তা দিতে কতটা কাজে লাগবে?
ভারত সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীন ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর তথ্য বলছে, ২০২১ সালে গড়ে দৈনিক পনেরোজন কৃষক এবং পনেরোজন ক্ষেতমজুর আত্মহত্যা করেছেন ঋণের চাপ এবং পেশার অনিশ্চয়তার কারণে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০২০ সালে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০২৩ সালের মধ্যে দেশের কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা হবে। মোদির আমলের বেশিরভাগ সরকারি প্রতিশ্রুতির মতোই, এই প্রতিশ্রুতিও কেবল বাগাড়ম্বর হিসেবেই রয়ে গিয়েছে। শুধু কৃষিক্ষেত্রেই নয়, কাজ না পেয়ে তরুণ এবং যুবকদের মধ্যে আত্মহত্যা বেড়েছে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রেও, বিভিন্ন সরকারি রিপোর্ট থেকে সেটি জানা যাচ্ছে। অর্ধসত্য এবং পোস্ট ট্রুথের এই কুয়াশাচ্ছন্ন দক্ষিণপন্থী রাজনীতিতে, হয়তো ভবিষ্যতে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর উপাত্ত পাল্টে দেওয়া হবে বা নিয়ন্ত্রণ করা হবে— কর্মহীনতার কারণে আত্মহত্যাজনিত তথ্য ঢাকার জন্য— সম্প্রতি এই আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন জয়রাম রমেশ। বৈদেশিক ঋণের পরিস্থিতিও মোটেই ভাল নয়— সম্প্রতি বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড মাসখানেক আগে ভারতকে সতর্ক করেছে এই বলে, যে, ভারত সরকারের ঋণের পরিমাণ অদূর ভবিষ্যতে দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন অর্থাৎ জিডিপিকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে— যা অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে একশো পঁচিশটি দেশের মধ্যে এই মুহূর্তে ভারতের স্থান একশো এগারো, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে এমনকি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল এবং শ্রীলঙ্কার স্থানও ভারতের থেকে অনেকটাই ওপরে। বিজেপি সরকারে আসার আগে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্সে ভারতের স্থান ছিল পঞ্চান্ন নম্বরে।
অর্থনৈতিক দৈন্য এবং বেকারির এই পরিস্থিতিতে, কঙ্কালসার ভুখা ভারতীয়দের সামনে রামমন্দিরের বারো ফিট লম্বা আট ফিট চওড়া বিয়াল্লিশটি সোনার দরজা করোটির দাঁতের মতো মুখব্যাদান করে থাকবে না কি? কোটি কোটি টাকার এই অভ্রংলিহ ধর্মীয় গঠনের আবহে ভারতমাতার ক্ষুধার্ত সন্তানদের— যারা এমনকি নির্মীয়মান রামমন্দিরের সামনে দীপাবলিতে জ্বালানো লক্ষ দিয়ার ঔজ্বল্যে আলোকিত হওয়ার বদলে তেল চুরি করে নিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে আলো জ্বালানোর জন্য এবং রান্নার তেল নেই বলে— দেখলে মনে হবে না কি:
তুমি তো প্রহর গোনো,
তারা মুদ্রা গোনে কোটি কোটি,
তাদের ভাণ্ডার পূর্ণ; শূন্য মাঠে কঙ্কাল-করোটি
তোমাকে বিদ্রূপ করে, হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকে—
কুজ্ঝটি তোমার চোখে, তুমি ঘুরে ফেরো দুর্বিপাকে।—বোধন, সুকান্ত ভট্ট্যাচার্য্য
রামমন্দির তৈরি হচ্ছে ধর্মপ্রাণ ভারতীয়দের ব্যক্তিগত দানের টাকায়— এই কুযুক্তি অর্ধসত্য। রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রী এবং ক্ষমতাশালী আমলারা রামমন্দির সংক্রান্ত কাজে অনেক সময়েই যাতায়াত করছেন সরকারি যানবাহনে, যার রক্ষণাবেক্ষণ হয় জনগণের করের টাকায়, বিভিন্ন সরকারি পরিষেবার ব্যবহার করছেন, সেগুলিও চলে করদাতার টাকাতেই। রামমন্দির উপলক্ষ্যে নতুন করে সেজে উঠেছে অযোধ্যা। অযোধ্যার সেই সৌন্দর্যায়নের জন্য বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। অযোধ্যা ডেভেলপমেন্ট অথরিটি থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত থেকে দেখা যাচ্ছে উত্তরপ্রদেশ সরকার মোট একশো সাতাশিটি প্রজেক্ট নিয়েছে অযোধ্যার সৌন্দর্যায়নের জন্য, প্রজেক্টগুলির মোট খরচ তিরিশ হাজার পাঁচশো সত্তর কোটি টাকা। উত্তরপ্রদেশ পাবলিক ওয়ার্কস ডিপার্টমেন্ট, ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, ভারত সরকারের ইরিগেশন অ্যান্ড ওয়াটার রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্ট, ডিপার্টমেন্ট অফ হাউজিং অ্যান্ড আরবান প্ল্যানিং, এবং ডিপার্টমেন্ট অফ আরবান ডেভেলপমেন্ট এই প্রোজেক্টগুলির মধ্যে বেশ কিছুর বাস্তবায়নে ক্রিয়াশীল। এই প্রোজেক্টগুলির অর্থ আসছে সরকারের ঘর থেকেই। এবং কে না জানে সরকারি অর্থ মানেই দেশের মানুষের করের টাকা। সেই করদাতার মধ্যে হিন্দু ছাড়া অন্য ধর্মের মানুষও রয়েছেন, যাঁরা হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসবের খরচের জন্য নিজের করের টাকা দিতে কোনওভাবেই বাধ্য নন। প্রকৃতপক্ষে কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেকুলার দেশের সরকারের প্রত্যক্ষ ইনভল্ভমেন্ট একান্তই অন্যায্য— ক্ষেত্রবিশেষে অসাংবিধানিকও বটে।
বলা হচ্ছে রামমন্দির কর্মসংস্থান ঘটাবে। এটি অতি হাস্যকর যুক্তি। যেকোনও প্রতিষ্ঠান তৈরি হলেই, সে হাসপাতাল হোক বা গণ-প্রস্রাবাগার, কিছু মানুষের কর্মসংস্থান সবসময়ই হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলি চালাতে। সেখানে রামমন্দির তৈরি করেই রোজগার আনতে হবে কেন? এত বছরেও কি বিজেপি সরকার কিছুই করে উঠতে পারেনি যাতে করে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হয়? কী হল তাহলে দু-হাজার বাইশের অক্টোবরে চালু হওয়া রোজগার মেলা যোজনা, এবং সেই ধরনের, বিজেপি এবং মোদি জমানায় চালু হওয়া আরও অনেক সরকারি প্রোজেক্টের, যদি শেষে মন্দির বানিয়েই কর্মসংস্থান করতে হয়?
রাষ্ট্রের, সরকারের কাজ নাগরিকদের সংবিধানস্বীকৃত নিরাপত্তাগুলি প্রদান করা, কোনও একটি বিশেষ ধর্মের ধর্মাচরণকারীদের পরিতোষণ নয়। ব্যক্তিমানুষ ধর্মাচরণ করলে তা নিয়ে আপত্তির কোনও প্রশ্নই ওঠে না, কারণ ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী ইচ্ছামতো ধর্মাচরণ করা (বা না করা) প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র যখন ঢেঁড়া পিটে বিশেষ একটি ধর্মের পরিপোষণে নেমে পড়ে ‘মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান দেওয়া’র নাম করে, তখন অবশ্যই তা সিঁদুরে মেঘ দেখায়। প্রকৃতপক্ষে রামমন্দির প্রতিষ্ঠা কোনও ধর্মাচরণই নয়, তা ক্ষমতার অলিন্দে রাজনীতির খেলা মাত্র— চার শঙ্করাচার্যের রামলালার প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান বয়কট করার বার্তা এই ধারণাকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। হিন্দুত্ববাদের সমর্থক শঙ্করাচার্যরা যখন হিন্দুত্ববাদী বিজেপির সর্বময় কর্তা এবং সেই দলেরই নির্বাচিত দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিষোদ্গারে মেতে ওঠেন, তখন আর বুঝতে বাকি থাকে না যে রামলালা আর হিন্দুদের হারানিধি নন, আসলে তাকে নিয়ে টানাহেঁচড়া চলছে দুই হিন্দুত্ববাদী ক্ষমতার কেন্দ্রের মধ্যে, এবং তা চলছে সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, ব্যক্তিগত ধর্মাচরণ বা উন্নয়নমূলক সার্বিক ধর্মপালনের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্কই নেই— পুরোটাই ক্ষমতা এবং অর্থের অধিকার প্রতিষ্ঠার কাজিয়া। সাধারণ মানুষকে এই ব্যাপারটা খুব পরিষ্কারভাবে বুঝে নিতে হবে। ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার এই নির্লজ্জ প্রচেষ্টা নজরুলকে মনে পড়ায়—
হায় রে ভজনালয়
তোমার মিনারে চড়িয়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়—মানুষ, কাজী নজরুল ইসলাম
সাধারণ লোকসভা নির্বাচনের আগে রামমন্দির নিয়ে আরোপিত এই মাতামাতি ধর্মাচরণ নয়, ধর্মের অপরিচ্ছন্ন পণ্যায়ন মাত্র। ধর্মের নামে, রামের নামে, ঘৃণার বেসাতি। বিভাজনের রাজনীতি, ক্ষমতার এবং পেশিশক্তির দম্ভ প্রদর্শন, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকারগুলি টাকা ছড়িয়ে কিনে নেওয়ার এক নোংরা প্রচেষ্টা। রামায়ণ, সন্দেহাতীতভাবে একটি অতুলনীয় সাহিত্যকীর্তি। তার সাহিত্যরস এবং জীবনদর্শন দেশকালের গণ্ডি ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে আপ্লুত করেছে। ভারতবর্ষের সাধারণ মানুষের কাছে রামায়ণের, অতএব সেইসূত্রে রামের, আবেগঘন আবেদন অনস্বীকার্য। মানুষের সেই ভালবাসা এবং আবেগপ্রধান উন্মাদনাকে বিভেদমূলক কাজে বহুকাল ধরেই অপব্যবহার করে আসছে বিজেপি এবং সঙ্ঘপরিবার। অন্য ধর্মের প্রতি হিংসার বেসাতি করে, সাধারণ মানুষের রামভক্তিকে পুঁজি করে ক্ষমতার অলিন্দে ঘোরাফেরা করার এই ঘৃণ্য প্রচেষ্টা, বিভাজনের সওদাগর দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির বরাবরের বৈশিষ্ট্য। ভারতবর্ষের সরল আমজনতার ঈশ্বরবিশ্বাসকে ভাঙিয়ে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে যে রাজনীতিকরা পথে নেমেছেন রামমন্দির গড়ে ‘দেশের মুখোজ্জ্বল করতে’, তাঁরা নিজেরা মোটেই ঈশ্বরগত ধর্মপ্রাণ নন, তাঁরা অতি উচ্চস্তরের কূটকৌশলী, অশুভ উদ্দেশ্যের মানুষ। রামমন্দির গড়ে উঠেছে হিংসা, বিভেদ, বিদ্বেষ, অশান্তি এবং ধ্বংসের ওপরে ভর করে। তার প্রতিটি ইটে রক্তের দাগ, প্রতিটি ইটে দাঙ্গাবাজ স্বার্থান্বেষী রাজনৈতিক নেতাদের কলুষিত আঙুলের ছাপ। সংবিধানস্বীকৃত অন্যতম মৌলিক অধিকার ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের পবিত্র স্থল নয়, এই মন্দির রাষ্ট্রের অধর্মাচরণের প্রতিভূ। পুরাণপুরুষ রাম বহুকাল ধরেই মর্যাদাপুরুষোত্তম হিসেবে মান্যতা পেয়ে এসেছেন অসংখ্য সাধারণ মানুষের কাছে, মনুষ্যকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ এক চরিত্র বলে পরিচিত হয়েছেন— প্রক্ষিপ্ত হয়েছেন উদার, সহিষ্ণু, পরমতশ্রদ্ধাশীল বলে। তাঁরই নামে জিগির তুলে, পরমত অসহিষ্ণু, ধর্মীয় বিভেদকামী ভারতের সূচনা করতে চলেছে দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদীরা রামমন্দির প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে। এই বিশুদ্ধ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যমূলক দ্বিচারিতা চূড়ান্ত নিন্দনীয়, এবং ঘৃণ্য— সে-বিষয়ে সামান্যতম সন্দেহেরও অবকাশ থাকতে পারে না।
ঋণস্বীকার: বর্তমান নিবন্ধের শিরোনাম, আনন্দ পটবর্ধনের ‘রাম কে নাম— ইন দ্য নেম অফ গড‘ শীর্ষক তথ্যচিত্রর থেকে ধার করা
*মতামত ব্যক্তিগত
অত্যন্ত শক্তিশালী লেখা, অনেক তথ্য। পড়তে পড়তে রাগ হয় শেষ অবধি হতাশায় স্তব্ধ হয়ে যাই।