এস হরিশ
অনুবাদ: ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
পূর্ব-প্রসঙ্গ: গল্পগাছার পাগলামি
রাভনন
চৌকিদারের সঙ্গে ধানমাড়াইয়ের উঠোনে দাঁড়িয়ে পুব থেকে আসা ফসল কাটার ঠিকে লোকদের বেলেল্লাপনা নিয়ে গজগজ করছিল পাভিয়ন। পুভন এসে তাকে খবর দিল, তার ছেলে বাবচন বাড়িতে খুব একটা ঝামেলা পাকিয়ে বসে আছে। পাভিয়ন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে সেই দু-সপ্তাহ আগে। মানিয়ন্থুরুটুগামী একটা খড়ের নৌকোয় বলেকয়ে ঠাঁই নিয়েছিল সে। সেখান থেকে ফসল কাটার কাজ খুঁজতে খুঁজতে সে প্রথমে যায় পেরুন্থুরুটু। তারপর কোডুথুরুটু হয়ে ফেরার পথে এই সংবাদ। পুভনের কথায় মাথা তার এতটাই গরম হয়ে গেল, যে তৎক্ষণাৎ সে পা বাড়াল বাড়ির পথে।
মাস দেড়েক আগের কথা। এই নিন্দুরে গায়ে জামা দেওয়া দুটো লোককে দেখে সকলে একেবারে তাজ্জব বনে গেছে। তখন পর্যন্ত মুডাক্কালিথোডু থেকে মান্ননম থোডু— এই তিন মাইলের মধ্যে গায়ে জামা দেয় এমন একজনকেই তারা চিনত। থারায়িল আভারাচন। সেই আভারাচনও জামা গায়ে দিত কালেভদ্রে। ভাইকোম বা আলাপ্পুড়ার মতন লম্বা যাত্রার সময় একটা পাট করা জামা সে নৌকোর খোলের নিচে রেখে নিত। এই জামা বস্তুটা যে রোজকার ব্যবহার্য একটা জিনিস, সে কথা কেউ— এমনকি আভারাচনও— একেবারেই মনে করত না।
তবে, এই গোলগলা, হাফহাতা, ঢিলেঢালা পরিধেয়টি গায়ে চড়ালে যেন বেশ একটু কেওকেটা লাগছে— দুই আগন্তুকদের দেখে সকলে মনে-মনে ভাবে। দুজনে একটা ঠেলাগাড়িতে বেশ ওজনদার লোহার সিন্দুকের মতন কী যেন একটা নিয়ে চলেছে। যেতে যেতে কথাবার্তা বলছে নিজেদের মধ্যেই। চারপাশের কাউকে পাত্তাই দিচ্ছে না। কাইপুড়া থেকে তাদের পিছু নিল একপাল ছোট ছোট ন্যাংটা ছেলেপিলে। জমিতে মাঠে কাজ করতে থাকা মেয়েছেলেরা তাদের কাজ থামিয়ে হাঁ করে তাকিয়ে দেখে— একবার ওই দুজনকে, আর একবার ওই সিন্দুকটাকে। দেখতে দেখতে অবাক হয়ে ভাবে, জামা গায়ে দিলে নিজেদের অমন জানোয়ার দেহেও না জানি কেমন সুন্দর ভাব আসবে। এরপর ওরা যখন যার যার রান্নাঘরে গল্পটা বলবে, অনেক অলঙ্কার জুড়ে জুড়ে আসল ঘটনা হয়ে যাবে বেশ কিছুটা অন্যরকম। গল্প বলতে বলতে ওরা বিশ্বাসই করতে শুরু করবে— জামা গায়ে আসলে তারা দেখেছে একসঙ্গে অনেকগুলো মানুষকে। তাদের সঙ্গে ছিল ঠেলাগাড়ি আর গরুর গাড়ি ভরা ভরা অনেক লোহার সিন্দুক। মেয়েদের ভাবখানা এমন, যেন দুটোমাত্র লোকের কথা বললে প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে শ্রোতাদের কাছে তাদের কদর কমে যাবে।
বাজারে পৌঁছে ওই জামা-গায়ে মানুষেরা সিধে চলে গেল চেল্লাপ্পন পিল্লার লাইসেন্স করা তামাকের দোকানে। দেখে মনেই হল না যে ওই তল্লাটে তারা নতুন। দুজনের মধ্যে যে বেশি সুদর্শন, সে হল অন্য লোকটার ভাগ্নে। চেল্লাপ্পন পিল্লা তাকে ভেতরে ডেকে নেয়। আর অন্যজনের বসার জন্য বারান্দায় রাখা বেঞ্চিটা ঝেড়েঝুড়ে দেয়।
—নৌকা নিলেন না কেন? পিল্লা জিজ্ঞাসা করে।
—উনি নৌকায় ভয় পান, বারান্দায় অপেক্ষারত অন্যজনের দিকে হাতের ইশারা করে ভাগ্নে দামোদরন বলে। সিন্দুকটা কোডিমাথায় একটা নৌকায় তুলে পর্যন্ত ফেলেছিলাম, কিন্তু উনি রাজি হলেন না। তাই হেঁটেই আসতে হল।
বিস্মিত চেল্লাপ্পন পিল্লা বেঞ্চিতে বসা আগন্তুকের দিকে তাকায়। মনে মনে ভাবে, ওঁর বয়স নিশ্চয়ই বছর পঁয়ত্রিশ হবে। ভদ্রলোকের চেহারায় এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা প্রথম দর্শনেই চোখে পড়ে: কপালে তিনটে স্পষ্ট দাগ, দেহের সঙ্গে বেমানান সরু সরু হাত, আর লম্বা আঙুল। ঝড়ে নুইয়ে পড়া ঘাসের মতন চুলগুলো পাতানো। কানে ফুটো আছে, কিন্তু তাতে কিছু পরা নেই।
—উনি কোন জাতের মানুষ? চেল্লাপ্পন পিল্লা জানতে চায়।
—ওঁর নাম রামানুজন। উনি এড়ুথাচন জাতের। এখানে অবশ্য খুব একটা দেখা যায় না।
—মানে ব্রাহ্মণ?
—না। কেউ কেউ এই জাতকে কাডুপ্পট্টন বলে।
চেল্লাপ্পন পিল্লার দোকানটা তার কাকার বানানো। সেই দোকানের উল্টোদিকে, রাস্তার ওপারের একটা বাড়ির চিলেকোঠায় একটা ঘর নিলেন রামানুজন এড়ুথাচন। আশপাশের উৎসাহী লোকজন লোহার সিন্দুকটা টেনেটুনে উপরে তুলে দিল। আর দামোদরন গেল তার মায়ের পুরনো বাড়ি। গিয়ে দেখে, আট বছর আগে মদিরাসি যাওয়ার সময় যে-মাদুরটা ফেলে গিয়েছিল, তা এখনও যথাস্থানেই রয়েছে। বৃষ্টির ছাঁট থেকে সুরক্ষিত পুবের বারান্দার কোনাটা, সে যেখানে শুত, এখনও যেন তারই অপেক্ষায় আছে। সন্ধের জলখাবার সেরে আধশোয়া হয়ে দামোদরন বৃষ্টি দেখে, সেই আগেরই মতন। পিছনে ফিরে দেখে, ছাদের তিন নম্বর বরগার কাছে একটা ফুটো দিয়ে সেই আগেরই মতন চুঁইয়ে পড়ছে বৃষ্টির জল। দামোদরনের মনে হয় কখনও এই বাড়ি ছেড়ে সে কোথাও যায়নি। কাজ করতে মদিরাসি যায়নি, কোনওদিন জাহাজ দেখেনি, তামিল সঙ্গিনীর সঙ্গে থাকেনি কোনওদিন। এখানেই থেকেছে সে আজীবন, তার পূর্বপুরুষদের মতো। তারাও যেমন পুবে পামবাডি, পশ্চিমে আলাপ্পুড়া, দক্ষিণে কোট্টায়ম আর উত্তরে ভাইকোম-এর বেশি যায়নি, সে-ও তেমনি এই চৌহদ্দির মধ্যেই থেকে গেছে আশৈশব। হয়তো এই-ই যথেষ্ট, দামোদরন ভাবে। কী দরকার নিজের গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার? আত্মীয়পরিজন, যারা তার মৃত পূর্বপুরুষদের খবর রাখে, তার জন্ম থেকে বড় হয়ে ওঠার প্রতিটা মুহূর্তের সাক্ষী যারা, তাদের ফেলে অন্য কোনওখানে যাওয়ার কী এমন দরকার? নিজের বাড়িটাই বা ছাড়ার দরকার কী— ক্রমে দামোদরনের মনে হতে থাকে।
নতুন বাসায় যাওয়ার দিনই এড়ুথাচন দরজায় একটা বোর্ড ঝুলিয়ে দেয়। তাতে লেখা— ‘মালাবার সঙ্গীত ও নাট্যদল’। সেই সাইনবোর্ড দেখার জন্য দরজার বাইরে একটা ছোটখাটো ভিড় জমে যায়। বুঝতে পারলেও তাদের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে দরজা এঁটে এড়ুথাচন ঘরেই বসে থাকে। দিনে দুবার করে চেল্লাপ্পন পিল্লা তাকে কাঞ্জি পাঠায়। সেই কাঞ্জি খায়। সারাদিনে কেউ তাকে ঘরের বাইরে পা রাখতে দেখে না। এমনকি বাথরুমে যাওয়ার জন্যও না। শুধু সন্ধেবেলা দামোদরন ফিরলে ঘর থেকে খুব হাসি আর জোরে জোরে কথাবার্তার আওয়াজ ভেসে আসে।
হপ্তাখানেকের মধ্যেই চেল্লাপ্পন পিল্লা বুঝতে পারে যে শুধু নৌকোতেই নয়, জলেও এড়ুথাচনের যথেষ্ট ভয়। একদিন একটু সকাল সকাল দোকানে এসে দেখে, রাস্তার ওপারে ভাড়াবাড়ির সামনে কোনও একটা গভীর চিন্তায় ডুবে অন্যমনস্ক হয়ে এড়ুথাচন দাঁড়িয়ে আছে। চোখাচোখি হতে চেল্লা হাসে। এড়ুথাচনের পরনে ধোপদুরস্ত মুন্দুধুতি আর উপরাঙ্গের বস্ত্র। একদম পরিষ্কার করে দাড়ি চাঁছা। নাপিতের কাছে লোকটা গেল কখন? চেল্লাপ্পন পিল্লা অবাক হয়ে ভাবে। তখনই একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হতেই একটা চিৎকার করে এড়ুথাচন দৌড়ে ঘরে ফিরে যায়। পরেরদিন এড়ুথাচন যখন তামাক কিনতে আসে, বৃষ্টি পড়ছে তখনও। তামাক কেনা হয়ে গেলেও সে চুপটি করে দোকানের বারান্দায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে— ততক্ষণ, যতক্ষণ বৃষ্টি একেবারে থেমে না যায়। সন্ধে নেমে গেছে ততক্ষণে। ঝোড়ো হাওয়ায় বৃষ্টির ছাঁট বারান্দায় ঢুকে এলে এড়ুথাচন তাড়াতাড়ি ভিতরে ঢুকে আসে। চোখেমুখে কেমন যেন ভয়। তার এই কাণ্ডকারখানা যারা দেখছিল, ভাবছিল— কোনওক্রমে যদি চালের থেকে একটা জলের ফোঁটা এড়ুথাচনের গায়ে এসে পড়ে, হয়তো সে এমন ছটফট করে উঠবে, গরম তেলের ফোঁটা গায়ে পড়লে লোকে যেমন করে।
দোকানে যে-ই আসে, চেল্লাপ্পন পিল্লা তাদের প্রশ্ন করে, আচ্ছা, পায়খানা করে ও পেছন ধোয়? বলেই ঘেন্নায় মেঝেতে থুথু ফেলে।
ব্যাপারটা শুনতে খুবই ঘিনঘিনে লাগলেও সে যে স্নান-টান করে না, এড়ুথাচনকে দেখে তা বোঝার উপায় একেবারেই ছিল না। প্রতি সকালে আর সন্ধেবেলায় শরীরের বিশেষ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সে মহীশূর থেকে আনা চন্দন কাঠের তেল লাগাত। পোড়ামাটির পাত্রে সুগন্ধী গাছগাছড়া জড়ো করে পুড়িয়ে পোশাক-টোশাক পরে সেই ধোঁয়ার উপরে দাঁড়িয়ে থাকত। সে যেখানেই যেত, তার কটু সুগন্ধে মানুষ তো বটেই, পশুপাখিদেরও নাক খাড়া হয়ে যেত।
—এই গন্ধটা কোত্থেকে আসছে গো? ষোলো বছরের থেইয়াম্মা মায়ের সঙ্গে গয়না সারাই করাতে স্যাঁকরার দোকানে এসে জিজ্ঞাসা করে। স্যাঁকরার নাম কৃষ্ণন থাট্টন। তার দোকান এড়ুথাচনের ভাড়াবাড়ির একতলায়।
—ওই ওপরে একজন আছে, বুঝলে? গায়ে কাপড় দেয়!— পাত্রে জ্বলন্ত তুষের আগুন চোঙা নল দিয়ে খোঁচাতে খোঁচাতে থাট্টন বলে।
—গায়ে কাপড় দেওয়া লোক আমি কক্ষনও দেখিনি!
মায়ের অনুমতি নিয়ে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে থেইয়াম্মা এড়ুথাচনের দরজায় কড়া নাড়ে। দুই আঙুলের ফাঁকে তার গায়ের কাপড়ের একটা কোণা ধরে পরখ করে দেখে কাপড়টা কত নরম।
—এগুলো কি সুগন্ধী সুতো দিয়ে তৈরি?
—হাঁ! জল দিয়ে না ধুয়ে তুলোগুলোকে আতরে ধোয়া হয়, এড়ুথাচন বলে।
‘আতর’ শব্দটা এর আগে থেইয়াম্মা কখনও শোনেনি। এড়ুথাচনের বুকের উপর নাক রেখে দীর্ঘ ঘ্রাণ নেয় সে। ডাগর থেইয়াম্মার রসুনগন্ধী ব্লাউজের উত্থিত অংশটা বুকে আদরের মত ছুঁয়ে গেলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে তামিলনাড়ুর অগণিত নারীর হৃদয়হরণ এড়ুথাচন। তবে এত সহজে গলে যাওয়ার মেয়ে থেইয়াম্মা নয়। সে হাসতে হাসতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে দৌড় লাগায়। এরপর কদিন নিজের অভ্যাস বদল করে ঘর ছেড়ে বাড়ির বাইরে এদিক-সেদিক হাঁটাহাঁটি করে আর সাগুর ক্ষেতে গিয়ে মেয়ের বাপের সঙ্গে খেজুরে আলাপ করে বিড়ির বান্ডিল উপহার দিয়েও থেইয়াম্মার দেখা এড়ুথাচন আর পায় না।
চাষের পর পতিত ফেলে রাখা একটা তিলের ক্ষেত দেখতে যায় এড়ুথাচন। জমির উত্তরদিকের কোণে একটা বাড়ি। বাড়ির সামনের কিছুটা জায়গা তার মনে ধরে নাটকের অভিনয়ের জন্য। জমির মালিক খ্রিস্টধর্মী মাপ্পিলাকে রাজি করাতে খরচ হল কিছুটা খৈনি। মাপ্পিলা রাজি হল। এড়ুথাচন তাকে প্রতিশ্রুতি দিল নাটকের তিনটে দিন একদম সামনের সারিতে বসার ব্যবস্থার।
—আমি জীবনে নাটক দেখিনি, মাপ্পিলা বলে।
—তুমি এট্টুমানুর উৎসবে কুরাথিয়াট্টম দেখেছ তো? দামোদরন মাপ্পিলাকে জিজ্ঞাসা করে। নাটক জিনিসটা কতকটা ওইরকমেরই। গানও থাকবে বেশ কিছু। আলাদা বলতে, কুরাথিয়াট্টম হয় মন্দিরের সামনের জমিতে, আর নাটকের জন্যে মঞ্চ তৈরি করে নেব আমরা নিজেরাই।
—গল্পটাও কি কুরাথিয়াট্টমের?
—না না। গল্পটা সাধারণ মানুষকে নিয়ে।
নির্দেশনার সঙ্গে সঙ্গে ‘কুডিয়ান’ নাটকে মুখ্যচরিত্রে অভিনয়ও করে এড়ুথাচন। নাটকের কাহিনি সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে হলেও ঘটনাক্রম সাদামাটা নয় মোটেই। দশ বছর ধরে তামিল গীতিনাট্যের দলগুলোর সঙ্গে গোটা মদিরাসি প্রেসিডেন্সিতে অনেক ঘুরেছে সে। ছোট ছোট চরিত্রে অভিনয় করেছে। মঞ্চসজ্জা আর রূপসজ্জায় হাত পাকিয়েছে। সেইসব পালা ছিল তামিল রাজারাজড়া আর ঠাকুরদেবতার গল্প নিয়ে। এড়ুথাচনের তীব্র ইচ্ছা ছিল যে সে নিজের থেকে এইরকম জাঁকজমকওয়ালা একটা প্রযোজনা নামায়। কিন্তু কিছু কংগ্রেস পার্টির লোকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়ে তার ভেতর একটা ছোটখাটো ভূমিকম্প ঘটে যায়, এবং এই বিষয়ে কিছু কিছু দৃষ্টিভঙ্গিও বদলায়। তবে এইসব নতুন নতুন ভাবনা কীভাবে যে নাটকের মধ্যে ঢোকানো যায় তা নিয়ে তার কোনও ধারণাই ছিল না। এর ফলে নাটকটা হয়ে গেল ভক্তি, নাচগান, রাজাগজার চরিত্র আর সমাজবাদের একটা বিতিকিচ্ছিরি ঘণ্ট— এমন এলোমেলো, যেন নষ্ট হয়ে যাওয়া ঘোলের ওপর ভাসতে থাকা ছানার টুকরো। এই নাটকে এড়ুথাচন চেষ্টা করেছিল মালাবারের একটা মন্দির-সংক্রান্ত লৌকিক উপাখ্যানের সঙ্গে মন্দিরের জমির ভাগচাষি কুডিয়ানের জীবনকাহিনিকে মেলাবার। কিন্তু সে না পারল তার চেতনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে বসে থাকা গীতিনাট্যের চেহারা থেকে বেরিয়ে আসতে, না পারল তার লেখার থেকে নবলব্ধ রাজনৈতিক ভাবনাকে সরিয়ে রাখতে। এর ফলে তৈরি হল একটা আজগুবি খিচুড়ি। এক দৃশ্যে স্বর্গের অপ্সরারা নেচে যায়, তো অন্য দৃশ্যে কুডিয়ান তার বিপ্লবী ভাবনার প্রকাশ ঘটায়। একেবারে প্রথম অভিনয় থেকেই কুডিয়ানের কপালে কারও প্রশংসা জুটল না। গীতিনাট্যে অভ্যস্ত দর্শকেরা কাণ্ডকারখানা দেখে হতবুদ্ধি হয়ে বসে রইল, আর প্রগতিশীল দর্শকেরা এড়ুথাচনের নির্বুদ্ধিতা নিয়ে ব্যঙ্গোক্তির বন্যা বইয়ে দিল। এসব সত্ত্বেও অন্য আর পাঁচজন শিল্পীর মত এড়ুথাচনও ধরে বসল যে তার নাটকটা আদতে একটা মাস্টারপিস। দর্শক অশিক্ষিত বলেই তাদের চোখে সেটা ধরা পড়ছে না। এই গোঁ ত্যাগ করে এড়ুথাচন যদি সত্যি করে কোনও সমাজসচেতন মানুষের সাহায্য নিত, তাহলে তার এই নাটকই হতে পারত প্রথম সার্থক রাজনৈতিক নাটক। আরও অনেক পরে কে দামোদরনের ‘পট্টবাক্কি’-র কপালে এই শিরোপা জুটত না।
কুম্ভম-এর দশম মাসে প্রাইভেট কোম্পানির নৌকা তিনখানা লোহার সিন্দুক এড়ুথাচনের জিম্মায় পৌঁছে দিলে, আর লোকজন স্বেচ্ছায়, লাইন দিয়ে সেই সিন্দুক তার ভাড়ার বাসায় তুলে দিলে সকলে নিশ্চিন্ত হল যে নাটকটা হচ্ছেই। তাদের সজাগ ও উৎসুক দৃষ্টির সামনেই কাঠের সাইনবোর্ডে তারিখ লিখে দিল এড়ুথাচন— ‘মীনম-এর দশম দিবসে’। সেইদিন থেকে শুরু করে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ির নিচে, কৃষ্ণন থাট্টনের দোকানের সামনে লোকজন জমায়েত হতে শুরু করল। এড়ুথাচন অবশ্য তাদের পাত্তা দিল না একটুও। এড়ুথাচনের কাছে যাওয়ার সময় দামোদরন বরং তাদের সঙ্গে অল্পস্বল্প কথা বলে। অবশ্যই খুব কিছু ভেঙে বলে না। ভাবখানা দেখায়, যে সে নিজেও ওই লোকদের মতোই অন্ধকারে।
—নামী অভিনেতারাও থাকছে না কি? একজন জানতে চায়।
—হতে পারে, দামোদরন জবাব দেয়।
—কবে? তাড়াতাড়ি?
—আসলে…
—মন বলছে আসবে। কী বলেন?
—দশজন অভিনেতা আসছে। ওদের কথাবার্তায় শুনলাম, সকলের সন্দেহভঞ্জন করে কৃষ্ণান থাট্টন একদিন ঘোষণা দেয়।
টর্চের আলো জ্বালিয়ে দুই পাহাড়ের ওপারে বাড়ি ফেরার লম্বা রাস্তায় চলতে চলতে সঙ্গীকে জানায়, একটা মহিলাও, মানে একজন অভিনেত্রীও আসবে। কোড়িকোড থেকে।
সেদিন থেকে প্রাইভেট কোম্পানির নৌকা জাহাজঘাটায় এলেই সবাই ভিড় জমায়। একপাল লোক নারকেলগাছের বাঁধের ছায়ায় সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত বসে থাকে। তাদের ধারণা, অভিনেত্রী আসবেন স্পেশাল নৌকায়। মাটিতে একটা চৌকো জায়গা সাফ করে সময় কাটাবার জন্য দিনভর পাকিড়া খেলে। একদিন এক অভিজাত মহিলাকে নৌকা থেকে নামতে দেখে তাঁকেই ওই অভিনেত্রী ঠাউরে পিছু নেয়। পরে জানা যায় উনি পুঞ্জরের মানুষ। গন্তব্য ভাইক্কাঠাপ্পনের মন্দির। এট্টুমানুর পর্যন্ত যাবেন গরুর গাড়ি চেপে।
অভিনয়ের দিন যত এগিয়ে আসতে থাকে, এড়ুথাচনের মধ্যেও বেশ চোখে পড়ার মতন কিছু পরিবর্তন লক্ষ করে সবাই। ওপরের জামা নেই আর। পরনে কেবল একটা গামছা। একখানা নিড়ানি নিয়ে তিলগাছের গোড়া উপড়ে, মাটির ঢেলা ভেঙে একজন মুনিষের সঙ্গে মিলে জমি সাফ করছে। মাটিতে পোঁতা সুপুরিগাছের খুঁটির সঙ্গে আমকাঠের তক্তা পেরেক দিয়ে এঁটে তৈরি হচ্ছে নাটকের স্টেজ। নারকেলপাতার বিনুনি করে তৈরি হয়েছে স্টেজের চালা। এই পাতার বিনুনির চালাটা বানিয়ে দিয়েছে এক চোভতি। সে এমনিই নাটকের দলকে ব্যবহার করতে দিয়েছে, নাটকের শেষে ফেরত নিয়ে যাবে বলে। তার চোভনও নাটকের দলকে যথাসাধ্য সাহায্য করছে। ওই বুনে দেওয়া টুকরোগুলো চালের ওপরে বসে থাকা এড়ুথাচনকে হাতে হাতে দেওয়া, কোণাগুলোকে আঁট করে আটকাতে সাহায্য করা— এইসব। সূর্যের তাপে চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। হাঁটু অবধি কাদায় মাখামাখি। এড়ুথাচন তবু সন্ধেবেলায় ঘরে ফিরে নিজেকে সাফ করে না। গায়ে মাথায় ধুলোকাদা নিয়েই পরদিন কাজে যায়। এড়ুথাচনের আশেপাশে গেলে যাদের নাকে আগে চন্দনের গন্ধ আসত, এখন তারাই এড়ুথাচনকে দেখলে নাকে চাপা দেয়। কাজের বিরতির মধ্যেও এড়ুথাচন গালভর্তি দাড়ি আর মুখেচোখে প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। খাওয়া নেই দাওয়া নেই, নুন আর কালো মরিচ মিশিয়ে তুষছাই দিয়ে দাঁত মাজা নেই। আছে কেবল মাঝে মাঝে গাঁজায় দম দেওয়া। রাতেও তার চোখে ঘুম নেই। বাড়ির সামনে বসে আগুন জ্বালিয়ে কফির ভুষি ফুটিয়ে খায়। চিনি ছাড়াই, ওষুধের মতো। এড়ুথাচনের অবস্থা দেখে তো কারও কারও মনে সন্দেহই জাগল— আদৌ সে নাটকদলের মালিক কি না। এড়ুথাচনের জংলি চেহারা দেখে আর মাঠেঘাটে মুনিষের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাকে কাজ করতে দেখে কেউ কেউ ভেবে বসল, মালিক নয়, এ মনে হয় শ্রমিকই হবে। কাজকর্ম বুঝিয়ে দিয়ে মালিক তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে লোকে যা ভাবুক, মোদ্দা কথা হল এই, যে বিগত চার-পাঁচ বছরে কুডিয়ান যে কবার মঞ্চস্থ হয়েছে, প্রতিবারই এড়ুথাচনের হাল হয়েছে এমনই। নাটক শেষ হলেই আবার সেই সুগন্ধী আর ধবধবে জামাকাপড়ে ফিরে এসেছে সে।
একদিন দামোদরনের সঙ্গে সে পুবের দিকে রওনা দেয় একটা পচাই প্রস্তুতকারকের খোঁজে। যেতে যেতে, রাস্তায়, নিজের মনেই গজরাতে থাকে: হয় না! এভাবে হয় না!
পথচলতি অন্য কেউ এই কথা শুনলে ভাববে, দামোদরনই কোনও একটা গর্হিত কাজ করে ফেলেছে বুঝি। বছর দুয়েক আগে পালাক্কড়ের একটা সুদূর গ্রামে তার নাটকের অভিনয়ের পর এড়ুথাচন ওই নাটক আর না করাই মনস্থ করে ফেলে। প্রথম অভিনয়ের পর আর কেউ সেই নাটক দেখতে আসেনি। টাকাপয়সা না পেয়ে অভিনেতারা এড়ুথাচনকে যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করে চলে যায়। মঞ্চসজ্জা আর মেক-আপের জিনিসপত্র, পোশাকপরিচ্ছদ কোথাও গচ্ছিত রাখার ব্যবস্থা করতে না পেরে কয়েকটা লোহার সিন্দুকে সেগুলো ভরে বৃষ্টির থেকে সেগুলোকে বাঁচাবার জন্য একটা ধানের আড়তের পিছনে রেখে দেয়। তারপর, নাটকদলের মালিকসুলভ শুভ্র পোশাক ত্যাগ করে কোয়েম্বাটোরে ফিরে আসে। কোনওক্রমে আগের নাট্যদলে আগেরই জায়গায় যোগ দেয় আর চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। এমন, যেন কোনও সদ্যবিবাহিতা তার পুরনো প্রেমসম্পর্কগুলোকে অস্বীকার করে মন দিয়ে নতুন সংসার করতে চাইছে। সহকর্মীরা তার নাটকের কথা জানতে চাইলে সে এমন ভাব করে যেন সেসব কোনওদিন ঘটেইনি! এরপর একদিন থামে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছিল এড়ুথাচন। ত্রিতলায় অভিনয়ের সময় মেক-আপ নিয়ে একটা গোলমাল করে ফেলে সে। সে নিয়ে খুব ঝাড় খেয়ে মন খারাপ ছিল তার। এমন সময় এক তরুণ সাজঘরে এসে এড়ুথাচনকে নিজের পরিচয় দেয়। জীবনের মোড় ঘুরে যায় এড়ুথাচনের।
—আপনিই রামানুজন এড়ুথাচন?— তরুণ জিজ্ঞাসা করে। আমি দামোদরন। আমাদের আগে অন্যত্র দেখা হয়েছে। কুডিয়ানের প্রথম অভিনয়ের সময় আমি সেখানে ছিলাম। আপনার পরীক্ষানিরীক্ষা আমার খুবই ভাল লেগেছিল। তবে লোকে তো সমসময় নতুন জিনিস নিতে পারে না।
এর পরদিনই আড়তের পিছন থেকে একটা সিন্দুক বের করে আর বাকিগুলো পাঠাবার বন্দোবস্ত করে ওই তরুণের সঙ্গে এড়ুথাচন বেরিয়ে পড়ে।
যেতে যেতে তার হতাশার কথা শোনায়। নাটকে পুলিশের পার্টটা একেবারেই গোলমাল হয়ে গেছে।
—অচুথনের দ্বারা ওটা এক্কেবারে হয়নি। ব্যাটার গ্যাসের সমস্যা। সবসময় পেট ঢাই হয়ে থাকে।
—তাহলে অন্য কাউকে নিন না। আপনি বলেন তো আমিও চেষ্টা করে দেখতে পারি, দামোদরন বলে।
—না না অত সহজে হবে না ভাই। পুলিশের পার্টটা করার ও-ই একমাত্র যোগ্য লোক।
ঘরে ফিরে দামোদরন সিন্দুক থেকে পুলিশের সাজ বের করে তার থেকে নারকেলের ছোবড়ার সরু সরু সুতো দিয়ে বানানো কুচকুচে কালো গোঁফটা নিয়ে নিজের মুখে লাগায়। এড়ুথাচন তার দিকে ফিরেও তাকায় না।
—ওটা একমাত্র অচুথনের মুখেই মানায়, বুঝলে হে।
—আচ্ছা, মানানসই অন্য কাউকে যদি খুঁজে বের করি?
—কোচি ছাড়ার পর থেকে এমন মুখের কাউকেই আমি খুঁজে পাইনি। আরে এখানে তো কারও গোঁফই নেই! গোঁফ রাখতে গেলে এখানে কোনও আইনে আটকায় কিনা কে জানে বাপু!
একবার দেখলেই একজনের মুখের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্য মনে রাখতে পারে এড়ুথাচন। এই কথাটা যেন খানিকটা বিশ্বাসের থেকেই বলে ফেলে সে। থিরুভিথমকুর আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত একটা মানুষও সে দেখেনি যার বলার মতো একজোড়া গোঁফ আছে। থাকার মধ্যে বড়জোর গোঁফদাড়ির অল্প আভাস, সে-ও নাপিতের দোকানে যেতে দেরি করার কারণে।
—আপনারও তো গোঁফ নেই, দামোদরন এড়ুথাচনকে মনে করিয়ে দেয়।
—তা নেই বটে, এড়ুথাচন বলে, কিন্তু আমি যেখানকার মানুষ সেখানে অনেকেরই বেশ বলার মতো গোঁফ আছে, বুঝলে?
—কোনও আইনে মোটেই আটকায় না। এমনিই এখানে কেউ গোঁফ-টোফ বিশেষ একটা রাখে না। থিরুভিথমকুরের মহারাজার অবশ্য ছিল। মার্তণ্ড বর্মা আর রাম বর্মার বিরাট রাজকীয় গোঁফ ছিল। আর ছিল প্রধানমন্ত্রীদের। রাজা কেসাভাদাসন আর ভেলু থাম্বির মতন দালাওয়া-রাও মস্ত গোঁফ রাখতেন। ফলে লোকেরা তাঁদের নকল করত। লোক বলতে বিশেষ করে উচ্চবর্ণের নায়ার-রা। তারপর, মহারাজা স্বাতী থিরুনাল গোঁফ কামালেন। কেউ কেউ বলে, ব্রিটিশদের সঙ্গে খটামটি লেগেই থাকত বলে স্রেফ বিরক্তিতে তিনি ওই কর্ম করেন। অথবা, হয়তো তিনি ভেবেছিলেন, গোঁফ ব্যাপারটা তাঁর মতন একজন শিল্পীর পক্ষে মোটেই মানানসই নয়। এরপর যাঁরা রাজা হলেন, তাঁরাও গোঁফ রাখলেন না। এখনকার রাজারও তো গোঁফ নেই। ফলে, এখনকার দালাওয়া, নায়ার আর অন্য রাজকর্মচারীরাও কেউ গোঁফ রাখে না।
—কিন্তু মাদুরাইতে আমার সঙ্গে থিরুভিথমকুরের এক মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাঁর নাম রামন পিল্লা। রামনের কিন্তু বেশ পুরুষ্টু আর ছুঁচোলো একজোড়া গোঁফ ছিল, এড়ুথাচন বলে।
—তার কারণ উনি রাজাগজাদের নিয়ে গল্পকাহিনি আর নাটক লিখতেন। আমি শুনেছি কিং লিয়ারে এডগার করার পর থেকে নাকি উনি গোঁফ রাখতে শুরু করেন।
—কিং লিয়ার মানে?
এড়ুথাচন এ-কথা বলতেই দামোদরন তার দিকে একটা অবজ্ঞাসূচক দৃষ্টি নিয়ে তাকায়। এমনিতে শিল্পী-অভিনেতাদের সে যথেষ্ট সম্মান করে। কিন্তু একটু খোঁচালেই বেরিয়ে আসে তাঁদের অপরিসীম অজ্ঞতা। দামোদরন হতাশ হয়।
কুম্ভম মাসের শেষের দিকে কৃষ্ণান থাট্টন যার আসার কথা বলেছিল— কোড়িকোড়ের সেই অভিনেত্রী ছাড়া বাকি সব অভিনেতারাই এসে পড়ে। কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ নৌকায়। এদের মধ্যে দুজন একেবারে লাল টুকটুকে চেহারার ছোকরা। এরা ফিমেল রোল করে। এরা সকলে ঠাঁই নেয় বাড়ির ছাদের ঘরে। সারাদিন উদলো মেঝেয় পড়ে পড়ে ঘুমোয়। সন্ধে হলে কাঁঠাল গাছের থেকে কাঁঠাল পেড়ে, তার কাঁটাওয়ালা চামড়া ছাড়িয়ে সেদ্ধ করে গোটাটাই খায়। এই গাছগুলোর নির্দিষ্ট কোনও মালিক আছে বলে কেউ জানে না। ওরা এঁচোড়ের মধ্যে একটা অদ্ভুত কায়দায় গর্ত করে তার মধ্যে নুন ভরে দেয়, যাতে এক রাতেই সেই এঁচোড় পেকে ওঠে। রিহার্সালের সময় উদরস্থ সেই পক্ব এঁচোড়, বা অকালপক্ব কাঁঠাল তার স্বমূর্তি ধারণ করে, আর তাদের দৌড় করিয়ে নিয়ে যায় বাড়ির পিছনের দিকে। অবস্থা এমনই হয় যে লোকের মুখে মুখে ওই জায়গার ‘পাইখানা’ নামটা চলতেই থাকে। নাটকের কথা, এড়ুথাচনের কথা লোকে ভুলে গেলেও পাইখানার কথা তাদের মনে থেকে যায়। পুঞ্জেরি থাম্পুরনের ক্ষেতের পাহারাদারকে হাত করে বাড়িতে দশ পারা ধান আনার ব্যবস্থা করে দামোদরন। সেই ধান রাতে ফুটিয়ে, তারপর জল ঝরিয়ে নিয়ে দুটো মাদুরের ওপর বিছিয়ে দিয়ে সূর্যের আলোর নিচে রেখে দেয় ওরা। দোকান থেকে পেচ্ছাপ করার জন্য বেরোলে অত ধান একসঙ্গে শুকোতে দেখে কৃষ্ণান থাট্টন মনমরা হয়ে যায়। সারা জীবনে একসঙ্গে অত ধান সে চোখেই দেখেনি।
—চারদিকে যুদ্ধ চলছে। খাওয়ার জন্যে লোকের কাঞ্জির জলও জুটছে না। আর এদিকে ভগবানের কেমন খেলা! মনে মনে শাপ দেয় কৃষ্ণান।
কয়েকটা দানা তুলে নিয়ে মুখে দেয়। সেদ্ধ ধানের মিষ্টি রসের সঙ্গে কয়েকটা খোসাও চলে যায় তার গলায়। গলার কাছটায় আটকে দিনভর অস্বস্তি হতে থাকে।
অচুথনের পরিবর্ত অভিনেতার খোঁজার তাগিদে এড়ুথাচন আর দামোদরন চারদিক চষে ফেলে। গোঁফের সঙ্গে মানানসই একটা মুখ চাই। এরই মধ্যে খবর আসে, চেল্লাপ্পন পিল্লার জমির পাশে কাঁচা কলার কাঁদিশুদ্ধ একটা গাছ ভেঙে পড়েছে। চাপাতি হাতে দৌড়ে যায় সেখানেও। কলার সঙ্গে সঙ্গে কিছু গাঁটি কচু যদি পাওয়া যায়, সেটাও দেখে নেওয়া যাবে।
—এ অঞ্চলের আসল পুলিশের তো গোঁফ দেখি না। নাটকে পুলিশের গোঁফ না দিলে ক্ষতি কিসের? দামোদরন জানতে চায়।
—পুলিশের গোঁফ দিতে না পারলে নাটক নামাবই না।
এড়ুথাচনের উত্তর শুনে এক লাথিতে তাকে খালে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছে হয় দামোদরনের। এক্কেবারে মার্কামারা মাল, দামোদরন ভাবে। এমনিতে হাজারটা ব্যাপারে আপস করে চলেছে, আর যত একগুঁয়েমি এই তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে। এরা কত মহান লেখক আর শিল্পী, তা প্রমাণ করার এটাই যেন রাস্তা!
পিল্লার ক্ষেতে তাদের পৌঁছে ওঠার আগেই বাবচন, অর্থাৎ পাভিয়ন পুলয়নের তৃতীয় পুত্র, একেবারে কাঁচা অবস্থাতেই ছালসমেত কাঁদির সবকটা কলা সাবাড় করে দিয়ে বসে আছে। পড়ে আছে শুধু মাঝের দণ্ডটা। গত তিনদিনে কয়েকটা শুকনো নারকেল আর জল ছাড়া কিছুই তার পেটে পড়েনি। বাপ ধানকাটার কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরার আগে এমনকি কাঞ্জির জলও পেটে পড়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল না। বাবচনের বাপের বাপ ওড়িবিদ্যা জানত। ওড়িবিদ্যা এমন এক যাদুবিদ্যা, যেটা প্রচণ্ড ক্ষিদের মুখে কাজে লাগাত বাবচনের দাদু। মন্ত্রবলে একটা কচ্ছপ বা শোলমাছ বনে যেত, তারপর কাদার নিচে ঢুকে পরের ধানকাটার মরশুম পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকত। বাবচন তার দাদু কঙ্কালি-র মতনই হয়েছিল। পুলয়নদের গড় উচ্চতার থেকে বেশি লম্বা। কিন্তু ওই ইচ্ছেমতন কায়া বদলানোর কায়দাটা তার জানা ছিল না।
—শালা শুয়ারের শু…
বাবচনের ঠোঁটে আর দাঁতে লেগে থাকা কাঁচা কলার আঠা দেখে মুঠি বাগিয়ে মারতে যায় দামোদরন।
—শালার চোয়ালই ভেঙে দেব।
দামোদরনের কোমর জড়িয়ে টেনে ধরে এড়ুথাচন সামাল দেয়।
—দাঁড়াও! দাঁড়াও! মনে হচ্ছে আমার পুলিশ পেয়ে গেছি ভাই!
জীবনের অপ্রত্যাশিত সমাপতনের কথা ভেবে অবাক হয়ে দামোদরন তার রাগকে দমন করে। নিঃশ্বাস শান্ত হলে বাবচনের দিকে মন দেয়। পুলয়ন জাতের আর পাঁচটা লোকের মতই বাবচনও একেবারে কয়লা-কালো বর্ণের। নদীতে নামলে নদীর জলও বুঝি কালো হয়ে যায়, এমন। একটা তামসিক আত্মার মতো সে যদি লাফিয়ে উঠে আকাশ স্পর্শ করে, দেখো হয়তো কালো বৃষ্টি ঝরে পড়বে। লোকটার মুখের চামড়ার রংটা হয়তো একটু ফিকে হয়েছে, কিন্তু গাল, থুতনি আর ঠোঁটের চারপাশে ঘন দাড়ির জঙ্গল, যা কিনা ঠিক পুলয়নসুলভ নয়, সেই অভাব ঢেকে দিচ্ছে। পুলয়নদের দাড়ি-গোঁফের তেমন বালাই নেই, আর হলেও তা পথ্রোজ পুলয়নের কাছে গিয়ে কামিয়ে আসে। যারা যায় না, পথ্রোজ তাদের ধরে তার পাথরে শানানো ক্ষুর দিয়ে তাদের হাজামত জোরপূর্বক সম্পন্ন করে।
—পুলয়নকে পুলিশ বানালে পাবলিক আওয়াজ দেবে কিন্তু, দামোদরন না বলে পারে না।
—আরে একটা পুলিশের মতো পুলিশকে দেখলে এসব কথা কারও মাথাতেই আসবে না। ভয় খেয়ে যাবে সব।
বাবচনকে নিয়ে তারা এড়ুথাচনের ঘরে আসে। আগে আগে দামোদরন আর পিছে এড়ুথাচন নিজে। সেইখানে জীবনে প্রথমবার সাদা এনামেলের থালায় কাঞ্জি খায় বাবচন। প্লেটের মাঝখানে সেদ্ধ রাঙা আলু, যেন একটা অর্ধমগ্ন দ্বীপ। ফিমেল রোলের যে দুই অভিনেতা ছিল, তাদের একজন সকলকে হাসিয়ে বলে ওঠে, বাবচনের পাশে কাঞ্জি যেন স্বাভাবিকের থেকে বেশি সাদা দেখাচ্ছে। বাবচনের দাড়িতে হাত বোলায়।
—কী অদ্ভুত! বলে সে। কী ঘন, আর শক্ত, যেন হাতির চুল।
নাপিত গোবিন্দনকে খবর দেয় দামোদরন। কিন্তু বাবচনের দাড়ি স্পর্শ করতে গোবিন্দন রাজি হয় না।
—আমরা ভেলাক্কিতলা নায়ার, বাবু, গোবিন্দন বলে, আমরা শুধু নায়ার আর তারও উঁচু জাতের কাজ করি। আপনি চাইলে বরং অথিরামপুড়ার থেকে ভাতি নাপিতদের ডেকে নিন। ওরা পুলয়নদের কাজ করে।
—তাই ডাকব, এড়ুথাচন বলে, কিন্তু কাজটা ভাল করে হওয়া দরকার।
দিনের শেষ অবধি বসে থাকার ধৈর্য না থাকায় এড়ুথাচন তখনই একটা নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, আর পথ্রোজ পুলয়নকে ধরে নিয়ে আসে। এদিকে পাভিয়নের ব্যাটা তার নজর এড়িয়ে পালিয়েছে জেনে পথ্রোজ খুবই বিরক্ত।
—তোকে খুন করে ফেলব, শালা খানকির ছেলে।
বাবচনের কান ধরে টানতে টানতে এনে উঠোনের মাঝে বসায় পথ্রোজ।
—ঠিক যেখানটায় বলব সেইখানটাতেই কামাবে, হাতে একটা কাঁচি নিয়ে এসে এড়ুথাচন বলে। কাঁচি ব্যবহার করার কায়দা আবার পথ্রোজের জানা নেই।
—গোঁফটা যেমন আছে ঠিক তেমন থাকবে, এড়ুথাচন পথ্রোজকে বলে দেয়। দুই গাল অবধি যেন গোঁফটা ছড়িয়ে থাকে। দাড়ি আর আশাপাশের চুল সবটা কেটে ফেলবে।
—গোঁফকে দাঁতাল শুয়োরের দাঁত বানানো আমার কম্মো নয় বাবু, পথ্রোজ বেঁকে বসে। আমি পুরোটাই কেটে সাফ করে দিচ্ছি।
এবার আসরে নামে দামোদরন। কিছু ধান দেওয়ার প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে একটা রফা হয়। নিমরাজি হয়ে পথ্রোজ তার ক্ষুরে শান দিতে আরম্ভ করে। সামনেই কাঁচি হাতে বসে এড়ুথাচন। পথ্রোজের ওপর কড়া নজর রেখে। তবে পথ্রোজের কাজটা যে একেবারেই সহজ নয়, তা অচিরেই বোঝা গেল। বাবচনের প্রতিটা দাড়ি যেন পাথরের গায়ে শ্যাওলার মতো। পথ্রোজের কেটে ফেলার চেষ্টাকে যেন প্রতিহত করতে চাইছে। বাপের জন্মে এমন নাছোড় দাড়ি দেখেনি পথ্রোজ। অল্প একটু জল দিয়ে দাড়ির ওপর ক্ষুর বসিয়ে টানতে গেলেই বাবচন চেঁচিয়ে ওঠে।
—চুপ করে থাক হারামজাদা। তোর বাপকেও ধরে নিয়ে আসব এবার। পথ্রোজ শাসায়।
মাঝে মাঝে একখাবলা চুল একেবারে গোড়া থেকে উঠে আসে, আর বাবচনের গালে রক্তবিন্দু জমতে দেখে পথ্রোজ কিছুটা সন্তোষ পায়। এরপর এড়ুথাচন কিছু কাটছাঁট করলে পরে গোঁফের ডানা মেলা চেহারাটা খোলতাই হয়ে ফুটে ওঠে। কিছুটা নারকেল তেল নিয়ে ভাল করে গোঁফে লাগায় এড়ুথাচন। ধারগুলো মুচড়ে দেয় ভাল করে। কালো ষাঁড়ের পিঠের মতন চকচকে হয়ে না ওঠা পর্যন্ত গোঁফের পরিচর্যা চলতে থাকে। পরিচর্যা যতক্ষণে শেষ, ততক্ষণে সকলে শুতে চলে গেছে। এড়ুথাচন এবার বাবচনকে ওপরে নিয়ে যায়। একটা নিচু টুলের ওপর বসিয়ে হ্যারিকেনের সলতেটা একটু বাড়িয়ে দেয়। বারবার সামনে থেকে, পাশ থেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। এড়ুথাচনের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ফলাফলে খুশি হয় সে। এসবের মধ্যে দামোদরনের ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে চোখের সামনে যে কাণ্ডকারখানা সে প্রচণ্ড ঘাবড়ে যায় সে। এইরকম ভয় সে পেয়েছিল অনেক ছোটবেলায়। একটা তালগাছের নিচে এক্কেবারে একা দাঁড়িয়ে সে দেখতে পেয়েছিল মদিরাসি প্রেসিডেন্সির পিশাচিনী মন্দিরের হাতে তরোয়াল আর চোখে ভ্রূকুটিধারি দ্বাররক্ষীকে।
—তোমায় আমি মারতে চাইনি, হাত তোলার জন্য ক্ষমা চেয়ে বাবচনকে দামোদরন বলে। হঠাৎ মাথাগরম হয়ে গেলে যা হয় আর কী…
পুলিশ তার আগাপাশতলা মেপে নিয়ে একটা বিরক্তিসূচক আওয়াজ করে। আর কালক্ষয় না করে তার মাদুরে ফিরে যায় দামোদরন, যদিও বাকি রাতটা তার ঘুম আর আসে না।
পরের দিনটা ছিল তুলম মাসের নবম দিন। প্রথম অভিনয়ের আর মাত্র দু’দিন বাকি।
পুলিশের ভূমিকায় বাবচনের মতো একজনকে খুঁজে পাওয়ার জন্য যে কাণ্ডটা এড়ুথাচন করল, রোলটা তেমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছিলই না। ওই চরিত্রটা আসে নাটকের দ্বিতীয় অংশে, আর মাত্র দুটো দৃশ্যে। প্রথম দৃশ্যে মঞ্চে সারাক্ষণ থাকলেও কোনও সংলাপ নেই। থাকার মধ্যে শুধু কয়েকটা বিরক্তিসূচক শব্দ করা, আর মাঝেমধ্যে দু-একটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টি হানা। দ্বিতীয় দৃশ্যে মঞ্চে উপস্থিতি মাত্রই কয়েক মিনিটের, তবে দর্শকের দিকে চেয়ে গর্জন-টর্জন কিছু আছে।
নিন্দুরে এড়ুথাচনের নাটক দেখতে ভিড় যা হয়েছে, অত সে জীবনে আর কোথাও দেখেনি। যারা ক্যাশ পয়সা দিয়ে টিকিট কেটেছে, বা যে বিশেষ অতিথিরা নানান প্রয়োজনের জিনিসপত্র জুগিয়ে সাহায্য করেছে, বসেছে সামনের সারিতে, কাঠের তক্তার ওপর। সংলাপ তারাই শুধু পরিষ্কারভাবে শুনতে পাবে। এদের পিছনে লোকে বসে বা দাঁড়িয়ে আছে জমিতেই, গোটা মাঠটা ভরিয়ে। মহিলা বলতে একমাত্র এক উৎসব থেকে আরেক উৎসবে ঘুরে বেড়ানো কাকতীরা, আর একজন মাত্র বুড়ি উল্লাদাতি। পাভিয়নের ছেলের অভিনয় দেখতে একজন পুলয়নও আসেনি। আসলে, নাটকে এমন একটা চরিত্র যে আদৌ আছে, সে-কথাই দর্শকদের মধ্যে খুব বেশি কারও জানা ছিল না।
মালাবারের বাচনভঙ্গি বুঝতে যারপরনাই অসুবিধা হলেও দর্শক হাফটাইম পর্যন্ত নাটক খুবই উপভোগ করল। মঞ্চের পিছনের পর্দায় মন্দির আর নাম্বুথিরিদের বাড়ি মানা-র একদম বাস্তবসম্মত উপস্থাপনা দর্শকদের চমকে দিল একেবারে। ওভারসিয়রের চরিত্র, যা কি না ছিল নাটকের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্র, তাকে দর্শকেরা একেবারে ভালবেসে ফেলল। সে যখন নিজের কাঁধের কাপড়টা রাগ করে প্রথমে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে, আবার তারপর সেটা ফের একটা ‘ছপ’ শব্দ করে কাঁধে রাখে, সে দেখে দর্শকেরা হেসে একেবারে খুন হয়ে গেল।
বিরতির পরের প্রথম দৃশ্যে মঞ্চে এল পুলিশ। ওদিকে ওভারসিয়র কুডিয়ানের পরিবারকে ভয় দেখাচ্ছে, যে জমি তক্ষুনি খালি না করলে গ্রেফতার করিয়ে দেওয়া হবে। ওই ভয় দেখানো আর মঞ্চে পুলিশের আগমনের ঠিক মাঝখানের অল্প সময়টাতে দর্শকের মধ্যে থেকে এক মাঝবয়সি হতগরিব নায়ার চেঁচিয়ে উঠল— পুলয়ন পুলিশ। এর মানে তক্ষুনি খুব একটা না বুঝলেও দর্শক হেসে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই তাগড়াই গোঁফওয়ালা পুলিশের দৃপ্তপদে মঞ্চে আগমন ঘটতেই সব চুপ করে গেল। পুলিশের ডাকনাম ‘দাঁতাল’! ঘটনার আকস্মিকতায় ওভারসিয়রও একটু যেন ঝুঁকে অভিবাদন জানাল, যদিও তেমন কিছু মোটেই স্ক্রিপ্টে ছিল না। মঞ্চের পাশ থেকে স্ক্রিপ্টমাফিক অভিনয় করার জন্য এড়ুথাচনের অঙ্গভঙ্গি আর ইশারা কেউ নজর করেই দেখল না। শুরুতে যেমন করেছিল, দৃশ্যের বাকি অংশে ওভারসিয়র তেমন বেশ একটু সম্ভ্রম দেখিয়েই অভিনয় চালিয়ে গেল। সামনের সারিতে বসে থাকা দর্শকদের মনে হল যেন রাক্ষস বা মাক্কানের মতো বহুযুগ আগের অন্ধকার জগতের পৌরাণিক অশরীরী চরিত্রেরা শরীর ধরে তাদের সামনে নেমে এসেছে। মঞ্চের পিছনের পর্দা জুড়ে তৈরি হওয়া বিশাল ছায়া আরও বাড়িয়ে দিল দর্শকদের মনের চাপা ভয়। তার পদশব্দের প্রতিধ্বনি শুনে মনে হল যেন রাতের অন্ধকারে কোনও লৌকিক দেবতার পদচারণা। খাকি প্যান্টশার্ট আর কোমরের চওড়া বেল্ট এতটাই জাঁকালো, যেন কৌরব যুবরাজ দুঃশাসনের পরিচ্ছদ। জলে ভেজানো নির্বল্কল আবলুস কাঠের মত ঝলমল করছে তার উন্মুক্ত জঙ্ঘা। তার মুখের দিকে, রক্তচক্ষুর দিকে চোখ রেখে দেখার সাহস হচ্ছে না কারও। মঞ্চের চারপাশে ঝোলানো অনেক এলোপাথাড়ি আলোয় দশ-দশটা ছায়া পড়েছে তার, যেন লঙ্কারাজ দশানন রাভনন। তার ছোট ছোট শব্দও লাগছে যেন গর্জন, গমগম করছে মৃত্যুর কথা আগাম বলতে পারা কোল্লিক্কোরাভন প্যাঁচার স্বরের মতো। স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে একেবারে শেষের সারি থেকেও।
ওই দৃশ্য শেষ যখন হল, ভয়ের আবহ থেকে মুক্তি পেয়ে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল দর্শকেরা। ওই পুলিশের কোনও সংলাপ না থাকলেও তার জন্যই যে নাটকটা ওই উচ্চতায় পৌঁছেছে, সেটা বুঝতে দামোদরনের কোনও অসুবিধা হল না। ওদিকে এড়ুথাচনও ভালই বুঝতে পারছিল যে নাটকের আখ্যান অন্য পথে হাঁটা লাগাচ্ছে। পুলিশ চরিত্রের মুখে কয়েকটা সংলাপ বসাতে পারলেই মনে হয় ভাল হত, তার মনে হয়। কিন্তু সবথেকে সাংঘাতিক ঘটনাটা ঘটা তখনও বাকি ছিল। নাটকের গল্প এমনভাবে সাজানো হয়েছিল, যাতে দর্শকদের মনে হয়েছিল যে ওই দৃশ্যের পরে পুলিশের আর পার্ট নেই। কিন্তু একেবারে শেষের আগের দৃশ্যে স্বল্প সময়ের জন্য পুলিশের একটা অপ্রত্যাশিত প্রবেশ ঘটল। সকলে যখন কাহিনির একটা ভাবগম্ভীর পরিণতির অপেক্ষায় বসে, তখনই ভারী পদক্ষেপে তার মঞ্চে পুনঃপ্রবেশ। যেন তার শিকার দর্শকদের মধ্যেই কোথাও লুকিয়ে আছে, এমনভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে সে একটা হুঙ্কার দিল— দা…! তার লাল টকটকে জিভ আর ধারালো দাঁতের সারি দেখে দর্শক ভাবল সত্যিসত্যিই এবারে ভয়াল ভয়ঙ্কর রাজা রাভনন বুঝি সম্মুখে উপস্থিত! দর্শকের প্রতিক্রিয়া এড়ুথাচনের সমস্ত প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেল। চরম আতঙ্কের ঢেউ বয়ে গেল দর্শকদের মধ্যে। একদম সামনের সারিতে বসে থাকা লোকজন তো পালিয়েই গেল। থাকল শুধু এক বয়স্ক ব্রাহ্মণ। লোকটা এতই বৃদ্ধ যে তার চোখের পাতাগুলোও পেকে গেছে। দর্শকদের মধ্যে একমাত্র সে-ই একটা চেয়ারে বসেছিল— আশপাশের দর্শকদের দৃষ্টি আটকে। স্থাণু হয়ে বসে ছিল ওই অতিবৃদ্ধ মানুষটা, তার পা বেয়ে জমে থাকা হলুদ পেচ্ছাপের স্রোত আর চারপাশ ঘিরে পেচ্ছাপের উষ্ণ দুর্গন্ধের মধ্যে। এসব কাণ্ডকারখানার মধ্যে শেষ দৃশ্য দেখার, বা শেষতক কী হচ্ছে তা জানার ধৈর্য আর কারও মধ্যেই ছিল না। পড়ি কি মরি করে যে যার বাড়ির দিকে দৌড়ে পালাল। মনে অবশ্য একটা চাপা তৃপ্তির ভাব, যেন মুখে বসন্তের দাগওয়ালা ভীষণদর্শনা দেবী কালী আর যোদ্ধা দারিকনের মধ্যে একটা ধুন্ধুমার মুডিয়েট্টু দেখে ফিরছে।
নাটকটা অভিনীত হয়েছিল আরও দুটো রাত। দেখতে লোক এসেছিল আরপুকারা আর কাল্লারা থেকে, নৌকো নিয়ে খাল পেরিয়ে। তাদেরও কেউ শেষ দৃশ্য পর্যন্ত টিকতে পারল না। তৃতীয় রাত্রিতে নাটক শেষ হলে এড়ুথাচন ঘোষণা দিল এখানে এই নাটকের অদ্যই শেষ রজনী। এরপর নাটকের দল ফিরে যাবে মালাবার। নাটকের এই বিপুল সাফল্যের জন্য দর্শকদেরও ধন্যবাদ দিতে ভুলল না এড়ুথাচন। নাটক শেষ হবার পর কিছু লোক মাঠের চারপাশে ঘুরঘুর করছিল। এমন সময় মঞ্চের পাশ থেকে বেরিয়ে এল দাঁতাল। তাকে দেখেই সকলে একেবারে পগারপার। পালানোর তাড়ায়, ধাক্কাধাক্কিতে কয়েকজন জখমও হল।
চিলেকোঠার ঘরে ফিরে পোশাক বদলে তার কাঞ্জি নিয়ে বসল বাবচন। এড়ুথাচন বাবচনকে আগেই বলে রেখেছিল যে সামনের শোয়ের ব্যাপারে দামোদরনই তাকে যা জানাবার জানাবে। খুব আদরে গোঁফে পূর্ণিমার চাঁদের মতন লেগে থাকা একটা ভাতের দানাকে তুলে নিল সে।
পরদিন সকালে পথ্রোজ পুলয়ন এল পাভিয়নের কুঁড়েয়। হাতে তার ধারালো ক্ষুর।
—ওকে পাঠিয়ে দে রে মাগী, চেল্লার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে সে বলে। আমি আজ ভেচুর চলে যাচ্ছি। এই হপ্তাটা আমাকে আর পাবি না।
বাবচন গেছিল মাঠে পায়খানা করতে। সে উঠোনে ঢুকতেই তাকে দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়ে পথ্রোজ পিছু হটে।
—কামিয়ে দেব নাকি? জিজ্ঞেস করে পথ্রোজ, একটু কাঁপা গলায়।
—কেন? আছে থাক না। তুমি যাও।
বাবচনের কণ্ঠে এমন একটা নতুন রকমের পরিপক্বতা ছিল, যে চেল্লা পর্যন্ত তার ঘরগেরস্থালির কাজ ফেলে বাবচনকে দেখে। গত রাতে সে কখন ফিরেছে তা চেল্লা জানে না। নাটকে অভিনয়ের পর এই প্রথমবার ছেলেকে দেখল সে। ছেলের এই নতুন মূর্তি দেখে চেল্লা ভয়ে ডাক ছাড়ার আগেই পালাতে পালাতে দুটো ক্ষেত পেরিয়ে গেল পথ্রোজ পুলয়ন।
[আবার আগামী সংখ্যায়]
যেমন আশ্চর্য গল্প তেমনি তার জাদুকরী ভাষান্তর। স্বদেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক অচেনা বিদেশ যা এই ধরনের কাজগুলো আমাদের সামনে উপস্থিত করে। স্তম্ভিত হই।
অনুবাদকের গদ্য দ্বিধাহীন বহতা নদী: একাধারে ঋজু, সমৃদ্ধ এবং জড়তাবিহীন। কিন্তু এর পটভূমি যেহেতু পদ্মাপার নয় সেক্ষেত্রে লেখক ‘ঘোষণা দেয়’ জাতীয় বাক্যবন্ধ, বা এক বিশেহ ধরনের অস্ত্র বোঝাতে ‘চাপাতি’ শব্দের প্রয়োগ করছেন কেন? আর ‘স্যাঁকরার’ মস্তকে ওই চন্দবিন্দুটিই বা ‘কিস লিয়ে’?
//চন্দবিন্দু// নয়, অবশ্যই //চন্দ্রবিন্দু//! যেহেতু সংশোধনের অন্য রাস্তা নেই তাই এভাবেই লিখলাম!
এবং ‘চক্রব্রতী’ নয় …।!
যেমন আশ্চর্য গল্প আর তেমনি তার জাদুকরী ভাষান্তর। স্বদেশের মধ্যে লুকিয়ে থাকে অনেক অচেনা বিদেশ যা এই ধরনের কাজগুলো আমাদের সামনে উপস্থিত করে। স্তম্ভিত হই।
অনুবাদকের গদ্য দ্বিধাহীন বহতা নদী: একাধারে ঋজু, সমৃদ্ধ এবং জড়তাবিহীন। কিন্তু এর পটভূমি যেহেতু পদ্মাপার নয় সেক্ষেত্রে লেখক ‘ঘোষণা দেয়’ জাতীয় বাক্যবন্ধ, বা এক বিশেষ ধরনের অস্ত্র বোঝাতে ‘চাপাতি’ শব্দের প্রয়োগ করছেন কেন? আর ‘স্যাঁকরার’ মস্তকে ওই চন্দ্রবিন্দুটিই বা ‘কিস লিয়ে’?