অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
এরই মধ্যে হাঁটছেন রাহুল। যে-সমস্ত বিষয়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ অথবা ‘ন্যায় যাত্রা’র মতো দুটি যাত্রাকে রাহুল তাঁর কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছেন— রাজনীতির চেয়েও সামাজিক পরিসরে তিনি দীর্ঘমেয়াদে অনেক বড় অবদান রেখে চলেছেন। যাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, তিনি বিজেপিকে পরাস্ত করতে পারবেন কিনা সে প্রশ্ন গৌণ। কিন্তু তিনি যে উদ্দেশ্য বা বক্তব্যগুলিকে সামনে রেখে যাত্রায় বেরিয়েছেন, সেগুলির প্রতি সংবিধান-প্রেমী নাগরিক হিসেবেই সমর্থন জানাতে চাই
অস্বীকার করে লাভ নেই ভারত জোড়ো যাত্রার এই দ্বিতীয় পর্বে, কিঞ্চিৎ দীর্ঘায়িত করে যার নতুন নাম দেওয়া হয়েছে ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’— প্রথম পর্বের সঙ্গে তার বেশ কিছু মূলগত পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। প্রথমেই যেটা চোখে পড়ছে, এই দফায় রাহুল আর সবটুকু পায়ে হাঁটার ঝুঁকি নেননি। যেখানে যাত্রা মিটলে পরেই দুয়ারে কড়া নাড়বে লোকসভা নির্বাচন, সেখানে এই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়াই যায়। প্রথম দফার ভারত জোড়ো যাত্রার সময় আবেগ ও ঐক্যের উদযাপন পরিলক্ষিত হয়েছিল। সে সময়ে ‘ইন্ডিয়া’ নামক জোট-বস্তুটি তখনও অবধি জায়মান অবস্থায় থাকার কারণে প্রধানত কংগ্রেস একক শক্তিতে যাত্রার নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল, এবং সেই যাত্রাকে সামনে রেখে পরবর্তীতে তারা কর্নাটক ও তেলেঙ্গানার ক্ষমতা দখলেও সক্ষম হয়েছিল। কাজেই যাত্রার যে সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, দুইই মোটের উপর ফল দিয়েছিল। যদিও এর বিপরীতে আবার, মূর্খের মতোই বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় নামতে গিয়ে শতাব্দীপ্রাচীন এই দল মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানের মতো তিনটি বিধানসভা নির্বাচনেও যথাবিহিত নিয়মে পরাস্ত হয়েছিল। একথা মনে রাখতে হবে বিজেপি-আরএসএস তথা বৃহত্তর সংঘ-পরিবারের যে দীর্ঘ সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস, সেখানে একদিকে সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকেও পুজো করব, অন্যদিকে বিজেপির হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে নিজেদের রাজনৈতিক আদর্শকেও হিন্দুত্বের প্রতি ‘অল্প হলেও সহানুভূতিশীল’, এমন এক ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচার করব— এমনভাবে ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করা অসম্ভব। ধর্মনিরপেক্ষ দেশে হিন্দুত্বের কোনও অস্তিত্ব নেই, এই জমিতেই লড়াইকে নামিয়ে আনতে হবে। এই কাজ করতে গিয়ে, দেশের মানুষকে এই আঙ্গিকে যে এতদিন শিক্ষিত করে তোলা যায়নি, তার মাশুলও প্রয়োজনে নির্বাচনী পরাজয়ের মাধ্যমেই গুনতে হবে। তথাপি, হিন্দু-রাষ্ট্রের ঘোষিত সমর্থক বিজেপির সঙ্গে হিন্দুত্বের প্রতিযোগিতায় যাওয়া একেবারেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। তাই হিন্দুত্ব নয়, কোনও ধর্মের প্রতি আলগা আনুগত্য নয়, প্রথম যাত্রার সময়ে দেশব্যাপী যে সামাজিক ঐক্যের স্লোগানেই সাধারণ জনমত গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছিল— সেই লক্ষ্যেই অবিচল থাকা প্রয়োজন।
এবারে যে কথা বলার, প্রথম দফার যাত্রার সময় বৃহত্তর যে এক সামাজিক-রাজনৈতিক ঐক্য সুন্দরভাবে উঠে আসতে পেরেছিল তার একটা বড় কারণ হল ‘ইন্ডিয়া’ নামক জোট-বস্তুটি তখনও অবধি সাকার হয়ে উঠতে পারেনি। পাঠক মার্জনা করবেন, ‘জোট’ শব্দটির পরিবর্তে আমি সচেতনভাবে তাচ্ছিল্য-সহকারে যে ‘জোট-বস্তু’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছি, তারই সপক্ষে এখন দু-চার কথা বলার। একথা স্বীকার করতে বাধা নেই, প্রথম যখন ‘ইন্ডিয়া’ জোট-ধারণাটি সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল, অন্য অনেক সংবিধান-প্রেমী, সদর্থে দেশপ্রেমী সাধারণ নাগরিকের মতোই আমিও একই আনন্দে আনন্দিত হয়েছিলাম। কারণ ইতিহাস আমাদের শিখিয়েছে, প্রবলতর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একক লড়াইয়ের চেয়ে জোটবদ্ধ লড়াইয়েই সাফল্যের সম্ভাবনা। ১৯৭৭-এর জরুরি অবস্থার পর, সেই মুহূর্তে একনায়ক ইন্দিরাকেও জোটবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমেই পরাস্ত করা গিয়েছিল। কিন্তু এমন একেকটি রাজনৈতিক-সাংগঠনিক জোট-শক্তিকে সার্থকভাবে ব্যবহার করতে গেলে কিছু ন্যূনতম বোঝাপড়া ও নিয়মানুবর্তিতার অভ্যাস থাকা প্রয়োজন। আশি-ঊর্ধ্ব জয়প্রকাশের সামান্যতম রাজনৈতিক ক্ষমতা ছিল না ইন্দিরার কংগ্রেস সরকারকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করার, যদি না একদিকে বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি তাঁদের সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে সেই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়াতেন, অথবা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বে নানাজি দেশমুখের নেতৃত্বে আরএসএস তথা সংঘ-পরিবারের অমন কঠোর নিয়মানুবর্তিতার অনুশীলনে অভ্যস্ত একেকটি সংগঠন তাঁকে সমর্থন করতেন। শেষ অবধি কি হয়েছিল আমাদের সকলেরই জানা। যথারীতি আশি-ঊর্ধ্ব জয়প্রকাশ ক্ষমতালাভের পর (পড়ুন, ইন্দিরাকে ‘হঠিয়ে’ ব্যক্তিগত অহং চরিতার্থ করার পর) প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন এবং সেই নির্বাচনী ফলাফলের প্রেক্ষিতে কার্যত ভারতীয় রাজনীতিতে সংঘ-পরিবারের পুনর্জন্মে সহায়তা করেন। যদিও, তারও পরবর্তীতে রাজীব গান্ধি সরকারের একাধিক ভুল সিদ্ধান্ত আরোই ভারতীয় রাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদী সংঘ-পরিবারের উত্থানকে ত্বরান্বিত করে। সে এক অন্য আলোচনার বিষয়। কিন্তু বর্তমান প্রসঙ্গে জোট-রাজনীতির গুরুত্ব ও কৌশলকে মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন মনে হল।
চলতি ন্যায় যাত্রার প্রধান স্লোগান হল, ‘ন্যায় কা হক— মিলনে তক’। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেশব্যাপী অচলাবস্থা, বেকারত্ব, যুবসমাজের নানাবিধ সমস্যা, মণিপুর তথা দেশে উত্তর-পূর্বাংশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চূড়ান্ত অবনতি— এই সমস্ত বিষয়গুলিই রাহুল এই প্রচার-যাত্রার মাধ্যমে তুলে আনার কথা বলেছেন। এছাড়াও যাত্রার প্রথম পর্বে সার্বিক সহিষ্ণুতা, ধর্মীয় ক্ষেত্রে তো বটেই, এমনকি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিসরেও ঐক্যের উদযাপন, সংবিধানের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বিশেষভাবে সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যটির কথা উল্লেখ করে আম্বানি-আদানি প্রমুখের সঙ্গে সরকারের যে গোপন আঁতাত ও তারই মাধ্যমে ‘গুণ্ডা-পুঁজিবাদ’ বা Crony Capitalism-এর যে আসল তত্ত্ব, তাকে সামনে নিয়ে আসা, এই সমস্ত বিষয়কেই কিন্তু প্রচারের ক্ষেত্রে রাহুল তথা কংগ্রেস নেতৃত্ব গুরুত্ব দিয়েছিলেন। খতিয়ে দেখলে পরে দেখা যাবে, এই প্রতিটি বিষয়ই কিন্তু বিজেপি তথা এনডিএ সরকারের বিরুদ্ধে নির্বাচনী লড়াইয়ের মঞ্চে, বিরোধী দলগুলির ক্ষেত্রেও অনায়াসেই ন্যূনতম বোঝাপড়ার জায়গা বা Common Minimum Programme-এর বিষয় হয়ে উঠতে পারত। সংশ্লিষ্ট দলগুলিরও কিন্তু সেগুলির বিষয়ে বিরাট কোনওরকম আপত্তি থাকার কারণ ছিল না। তবুও ন্যায় যাত্রার সময়েই যে পরিমাণে জোটভুক্ত দলগুলির মধ্যে কাদা ছোড়াছুড়ি দেখা যাচ্ছে, তাতে ‘জোট’-এর পরিবর্তে একে ‘জোট-বস্তু’ হিসেবে চিহ্নিত করে কটাক্ষ নিক্ষেপ ভিন্ন আমাদের আর কোনও কিছুরই অবকাশ থাকছে না।
এ-কথা আমাদের মানতেই হবে ৭৭-এর ইন্দিরা-কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি সাংগঠনিক ক্ষমতার দিক দিয়েও আরএসএস-বিজেপি সরকারের তুলনা চলে না। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে দেশের প্রশাসনিক আমলাতন্ত্রের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তরে (অ)রাজনৈতিক সংগঠন আরএসএস তাঁদের সমমনস্ক এমনকি তাঁদের শিক্ষায় ‘দীক্ষিত’ ব্যক্তিদের বসাতে সক্ষম হয়েছে। সচেতনভাবে আমি আরএসএস-বিজেপি সরকার এবং শিক্ষায় ‘দীক্ষিত’ শব্দবন্ধগুলিকে ব্যবহার করেছি। সে-হেন ইন্দিরাকে হটাতেই যদি দেশব্যাপী একের বিরুদ্ধে এক লড়াইয়ের প্রয়োজন হয়ে থাকে, এমতাবস্থায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে প্রশাসন এমনকি বিচারব্যবস্থারও বিবিধ-স্তরে হিন্দুত্ব-রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের উপস্থিতি— তেমন পরিস্থিতিতে আরএসএস-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে ঠিক কতখানি ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের প্রয়োজন, আশা করি তা আলাদা করে বলে দেওয়ার দরকার পড়ে না। তদুপরি ‘ইন্ডিয়া’ জোট ও তার পূর্ববর্তী-পরবর্তী সময়ে আমরা কেমনতরো ‘বোঝাপড়া’র উদাহরণ দেখেছি?
বিগত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়েও আমরা দেখলাম তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে মনোনীত প্রার্থী যশবন্ত সিং সমস্ত বিরোধী দলেরই সমর্থন পেলেন। অথচ, ভোট-প্রক্রিয়া চলার সময়েই তৃণমূল-সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করে বসলেন, দ্রৌপদী মুর্মুর নামের বিষয়ে যদি তাঁকে আগে থেকে জানানো হত তাহলে হয়তো তিনি ‘বিবেচনা’ করে দেখতেন। ‘বিবেচনা’র কী বিষয় থাকতে পারে তিনি কিন্তু খোলসা করলেন না। তদুপরি, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পরে-পরেই বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেত্রী মার্গারেট আলভাকে উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ বিরোধী প্রার্থী হিসেবে সমর্থনের প্রশ্নে কিন্তু পিছিয়ে এল তৃণমূল। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও সৌজন্যের সামান্যতম উদাহরণ না রেখে, তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়ে দিলেন ‘আগে থেকে তাঁদের কিছু না জানানোর কারণে’ তাঁরা মার্গারেট আলভাকে সমর্থন করবেন না। উপ-রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে পরোক্ষে কিন্তু বিজেপি প্রার্থী জগদীপ ধনখড়েরই সুবিধা করে দেয় তৃণমূল। যদিও, তখনও ‘ইন্ডিয়া’ জোট তৈরির কোনও সুদূরের সম্ভাবনাটুকুও রাজনীতির আকাশে প্রতিভাত হয়নি।
অবশেষে শিশুর জন্ম হল। প্রথমেই শুরু হল ‘ইন্ডিয়া’ নামকরণের কৃতিত্ব নিয়ে বিবাদ। তাকে কোনওমতে বালখিল্যতার অজুহাত দিয়ে যদিও-বা দূরে সরিয়ে রাখা গেল, একেকটি দল নির্বিবাদে দাবি করতে শুরু করল— এককভাবে তারা যে যে রাজ্যে শক্তিশালী, সেই সব রাজ্যে তারা এককভাবেই লড়াই করতে চায়। ফলস্বরূপ দাঁড়াল, তৃণমূল ও সিপিএম উভয় পক্ষই জানিয়ে দিল বাংলায় জোটের কোনও সম্ভাবনা নেই। কংগ্রেস ও সিপিএমের তরফে জানানো হল কেরলে ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ লড়াইয়ের মঞ্চ প্রস্তুত। ‘আপ’-এর তরফে জানানো হল দিল্লি-পঞ্জাবে তারাও কিন্তু কংগ্রেসকে জমি ছাড়তে অপারগ। শতবর্ষের বৃদ্ধ কংগ্রেস হ্যাঁ-ও হয় না-ও হয় এমন কিছু কিছু বিবৃতি প্রকাশের মাধ্যমে আসন-সমঝোতার বিষয়টি সুকৌশলে দূরে সরিয়ে রাখতে শুরু করল। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেসের তরফে সিপিএমের বিরুদ্ধে তীব্র বিষোদ্গার শুরু হল। একথা মাননীয়া বুঝতে চাইলেন না, বাংলায় কোনওভাবে এই জোট কার্যকরী হলে, ২০২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনেও কিন্তু তিনিই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে ফ্রন্টফুটে থেকে ‘খেলা’ শুরু করতে পারবেন। উলটে জোট না হলে পরে, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়ায় বিজেপিরই লাভের গুড় খেয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। অপরদিকে বাম-কংগ্রেসের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের কথা মাথায় রাখলে সত্যিই বাংলায় তৃণমূলের সঙ্গে সমঝোতায় যাওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। কেরলে ধরে নেওয়া হচ্ছে সমস্ত আসনই, ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ লড়াই হলেও কংগ্রেস-সিপিএমের ভিতরেই আখেরে ভাগাভাগি হতে পারে। কিন্তু শেষ অবধি লোকসভা নির্বাচন, মোদি-ম্যাজিক ও আরএসএস-বিজেপির কূটকৌশলে পারদর্শিতার বিষয়গুলিকে সামনে রেখে সত্যিই কি জোটবদ্ধভাবে লড়াই করা যেত না?
এরই মধ্যে একদিকে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা ৩০০ আসনে কংগ্রেস ও অন্যান্য দলের ভিতরে আসন সমঝোতার কথা বলে বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেন। আবার একই সময়ে সকলকে অবাক করে দিয়ে মমতা ও অরবিন্দ কেজরিওয়াল, মল্লিকার্জুন খাড়্গের নাম প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য প্রস্তাব করে জোট-অন্দরমহলে নতুনতর বিতর্কের সৃষ্টি করলেন। যে-সময়ে বাংলায় রাহুলের ন্যায় যাত্রা চলছে, সেই একই সময়ে একদিকে বামেরা সরাসরি সেই যাত্রাকে সমর্থন জানালেন। অন্যদিকে ‘জোটসঙ্গী’ মমতা কিন্তু বেছে বেছে সেই একই সময়ে রাহুলের যাত্রাপথ বরাবর নিজের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্মসূচি সাজালেন। ন্যায় যাত্রায় তিনি গেলেন না তো বটেই, এবং রাহুলের পথ ধরে একই জায়গাগুলিতে তিনি রাজনৈতিক সভা করলেন— তদুপরি, সেই সমস্ত সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বিজেপির চেয়েও বেশি কংগ্রেসকে, এবং কংগ্রেসের চেয়েও বেশি সিপিএমকে আক্রমণ শানালেন। ‘নিন্দুক’ সিপিএম যদি এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চায়, যেখানে একই সময়ে পাশের রাজ্য বিহার ও ঝাড়খণ্ডে ‘অপারেশন ইডি’র রুদ্ধশ্বাস চিত্রনাট্য লেখা হচ্ছে, বর্ষীয়ান-অসুস্থ নেতা লালুপ্রসাদ যাদবকে অবধি ৯ ঘণ্টা জেরার সুমুখে পড়তে হচ্ছে, ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেনকে ‘দুর্নীতি’র অভিযোগে গ্রেফতার করে হেফাজতে নেওয়া হচ্ছে— সেই সময়েই কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে ইডি-সিবিআই কর্তারা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় তো দূর অস্ত, এমনকি শেখ শাহজাহান-সহ রাজ্যের বিবিধ নিয়োগ-দুর্নীতির বিষয়ে হিরন্ময় নীরবতায় মুখ লুকিয়েছেন— সবটাই কি নিছকই কাকতালীয় বলে ভাবা উচিত? নাকি যুক্তি-তক্কো-আর-গপ্পের নীলকণ্ঠের মতোই স্বগতোক্তিকে বলতে চাই, আমি কনফিউজড— আটারলি কনফিউজড আমি এখন!
রাজনৈতিক অনেক বিষয়েই তাঁর সঙ্গে একমত না হলেও, জোট-রাজনীতির বিষয়ে জ্যোতি বসুর মতো বিচক্ষণতা বর্তমান সময়ে একজনও রাজনীতিক দেখাতে পারছেন না। খাতায় কলমে পশ্চিমবঙ্গে সমাজবাদী পার্টির প্রায় কোনও অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও জোট-সৌজন্যের কারণে বামফ্রন্ট তাদের দীর্ঘ শাসনকালে নিয়মিতভাবে কিরণময় নন্দকে বিধানসভা নির্বাচনের সময় অন্তত একটি আসনে প্রার্থী করে এসেছে। এমনকি তাঁকে নিয়মিত মন্ত্রিত্ব দিতেও কুণ্ঠিত হয়নি। জোট রাজনীতিতে সকলকে নিয়ে চলার মন্ত্রই এমন। ছোটস্য-ছোট দল হলেও, জোটসঙ্গী হিসেবে তাকে মর্যাদা দেওয়া, তদুপরি জোটের সুবিধা তার ভাগেও দেওয়া— এই নীতি-ব্যতীত জোট টেকে না। এরজন্য বড় বা শক্তিশালী দলগুলিকেই ‘ত্যাগ স্বীকার’ করতে হয়। যেখানে ‘ইন্ডিয়া’ জোট নিজেদের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে, দেশ এমনকি সংবিধান বাঁচানোর কথাও বুক বাজিয়ে প্রচার করছে— সেখানে নিজ নিজ ক্ষেত্রে শক্তিশালী দলগুলির একজনও কি সেই ‘ত্যাগ স্বীকার’এর জন্য সদিচ্ছা দেখিয়েছে? তেমন কোনও কিছুই চোখে পড়ছে না কোনওভাবেই।
এরই মধ্যে কিন্তু হাঁটছেন রাহুল। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কষ্টকল্পনা যতই আমাদের আশাহত করুক না কেন, যে ধারণা বা যে সমস্ত বিষয়কে গুরুত্ব দিতে গিয়ে ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ অথবা ‘ন্যায় যাত্রা’র মতো দুটি যাত্রাকে রাহুল তাঁর কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছেন— রাজনীতির চেয়েও সামাজিক পরিসরে তিনি দীর্ঘমেয়াদে অনেক বড় অবদান রেখে চলেছেন। গণতন্ত্র হিসেবে নিজেদের দাবি করতে হলে, সেই দেশের নির্বাচক জনসংখ্যাকেও কিন্তু সেই ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে হয়। ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে নিজেদের দাবি করতে হলেও কিন্তু দেশের নির্বাচক জনসংখ্যাকেও সেই ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে হয়। এই শিক্ষাপ্রসারের উদ্দেশ্য নিয়েই হয়তো হাঁটছেন রাহুল। যাত্রার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে, তিনি বিজেপিকে পরাস্ত করতে পারবেন কিনা সে প্রশ্ন গৌণ। দল হিসেবে কংগ্রেস জোটকে কতখানি সার্থকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারছে সেই প্রশ্ন গৌণ। বাকি দলগুলির ‘অবদান’-এর কথা আর নাই বা বললাম। তবু ব্যক্তি রাহুল যে উদ্দেশ্য বা বক্তব্যগুলিকে সামনে রেখে যাত্রায় বেরিয়েছেন, সেগুলির প্রতি সংবিধান-প্রেমী নাগরিক হিসেবেই সমর্থন জানাতে চাই।
আর সত্যিই যদি বিজেপি-আরএসএসের সরকার এই যাত্রার প্রসঙ্গে এতটুকুও ভীত না হয়ে থাকে, তাহলে এই যাত্রার সময়েই কি হিমন্ত বিশ্বশর্মার বিশেষ করে প্রয়োজন পড়ল অসমে যাত্রা চলাকালীন পায়ে পা লাগিয়ে গণ্ডগোল বাঁধানোর চেষ্টা করা? নাকি এই যাত্রার সময়েই বিশেষ করে প্রয়োজন পড়ল বিহার-ঝাড়খণ্ডের রাজনীতিতে নতুন করে রাজনৈতিক গণ্ডগোল সৃষ্টি করা? রাজনীতিক রাহুলের বিচার ভোটবাক্সে করবে দেশ, কিন্তু দ্বেষমুক্ত স্বদেশের লক্ষ্যে তাঁর এই প্রচেষ্টার সাধুবাদ পাওয়া উচিত।
*মতামত ব্যক্তিগত