আলোগ্রাসী সময়। বইমেলার দুলদুলে ঘণ্টা। পুলিশের কামড়। ‘চরকি’ ঘুরছে

সুশীতল

 

 

আতঙ্কের বিষয় এটাই যে, আন্তর্জাতিক বইমেলার পরিসরে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির আধিপত্য বাড়ছে। বছর ছ-সাত আগেও এইসব উনোমুখো বিদ্বেষগেঁড়ে সংগঠন বইমেলায় খাপ খুলতে পারত না। দোকান দিত, বিক্রিবাটাও হত, কিন্তু লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নে এসে চোখ রাঙানোর সাহস পেত না। শাসকের পক্ষে থাকা গিল্ড আর গিল্ডের ধামাধারী দোকানদাররা আগেও ছিল, কিন্তু বইমেলায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্টার-গান-ছবি যথেচ্ছ প্রদর্শিত হত। বিরোধী মতামতকে বরাবরই শাসক ও গিল্ড বাঁকানজরে দেখত, কিন্তু প্রতিরোধী পক্ষের লোকবল এবং মতাদর্শ-সমর্থক অনেক বেশি ছিল। আতঙ্কের এটাই যে, সে-সব ‘অতীত’ হয়ে গেছে

 

এক প্রকাণ্ড আলোগ্রাসী বিচ্ছিরি সময়ের বিশাল হাঁ-মুখের ভেতরে ঢুকে পড়েছে সাহিত্য, শিল্প, প্রযুক্তি, উৎপাদন, শিক্ষা সবকিছুই। অধিকাংশ সাহিত্যিক, শিল্পী, গায়ক, অভিনেতা, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিক্রেতা, ক্রেতা সেই হাঁ-মুখের লালারসে থিতু হয়ে গেছে বা স্বস্তিক্ষেত্র খুঁজে নিয়েছে। কিছুজন প্রতিবাদ জানাতে জানাতে হতাশ হয়ে গেছে। কেউ কেউ ওই আলোগ্রাসী সময়ের প্রতিরোধের তত্ত্ব হাতড়ে গোলোকধাঁধায় ঘুরছে। প্রায় সবারই মগজে ১৪৪ ধারা। মুখে রাষ্ট্রের প্রিয়বাক্য, কবিতায় স্থিতাবস্থা, উপন্যাসে নব্য হেঁদুজাগরণ আর গল্পে রক্ষণশীল জাবর। বিচ্ছিরি একটা সময়ে ঘিনঘিনে উৎসবরাশি আছড়ে পড়ছে একের পর এক। বইমেলাও তেমনই একটা উল্লাস, শাসকের সাজিয়ে দেওয়া মতাদর্শ-নিয়ন্ত্রিত কার্নিভ্যাল। সেই বইমেলাতেই কয়েকটি বালক-বালিকার সারল্য, উদ্দীপনা এবং লেখাপত্র আলো জ্বালানোর অভিমুখ দিল। শাসকের সাজানো রঙ্গমঞ্চে ‘অনুপ্রবেশ’ করা ওই বালক-বালিকাদের হঠিয়ে দিল শাসকদাস পুলিশ আর বশংবদ গিল্ড কর্তৃপক্ষ। পুলিশি জুলুমের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর জন্য ছাত্রছাত্রী আর মানবাধিকার কর্মীদের গ্রেফতার করল পুলিশ। মাথা না-নোয়ানো ছাত্রছাত্রী আর মানবাধিকার কর্মীরা রাজ্য সরকারের স্বৈরাচারী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ফের জড়ো হলেন পরের দিনই। আবার গ্রেফতার। তাঁদের মধ্যে দুজন ছাত্রকে জামিন-অযোগ্য ধারায় গ্রেপ্তার করে আদালতে পেশ করল পুলিশ। আলোগ্রাসী সময়ের বিশাল মুখব্যাদান ভয়ঙ্কর। তবু, ওই যে কেউ কেউ প্রমিথিউস হয়ে উঠল, ওই যে তারা আলো জ্বালার চেষ্টাটুকু জারি রাখল, এটাই আশার।

 

“পাকা দেওয়ালের কঠোর জ্যামিতি ভাঙতে বন্য লতাটা তুলো”

প্রীতিলতা পাঠশালা। আশু-তিমিরের পাঠশালা। ভগৎ সিং পাঠশালা। সভ্যতার কঙ্কাল-বেরোনো লকডাউনের সময়, ১০ মার্চ ২০২১, যাদবপুরে তৈরি হয়েছিল প্রীতিলতা পাঠশালা এবং আশু-তিমিরের পাঠশালা। উদ্যোগ নিয়েছিল যাদবপুর কমিউন। কয়েকদিন পরে ভগৎ সিং পাঠশালা। আশু মজুমদার এবং তিমিরবরণ সিংহ, কমিউনিস্ট নকশালবাড়ি আন্দোলনের দুই শহিদ সেনানীর (দুজনেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন) নামাঙ্কিত এই পাঠশালার পড়ুয়া কারা? যাদবপুর রেলকলোনি, বেঙ্গল ল্যাম্প বস্তি এবং চারুমার্কেট বস্তির বালক-বালিকারা। এরা প্রায় সব্বাই প্রথম-প্রজন্মের পড়ুয়া। প্রীতিলতা পাঠশালা, আশু-তিমিরের পাঠশালা এবং ভগৎ সিং পাঠশালায় শুধু পাঠ্যবই পড়ে না এরা; গান শেখে, গল্প-কবিতা চর্চা করে, ছবি আঁকে। ইশকুলের শিক্ষক কারা? মেহবুব রহমান মোল্লা, অনুষ্কা পাল, সাত্যকি মজুমদার-সহ বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের মুক্তমনা যুক্তিবাদী আদর্শবাদী কয়েকজন তরুণতরুণী। আর, রয়েছেন স্বপ্না, ঝিলম রায়ের মতো অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা। গল্পে, আলোচনায়, হাতেকলমে শিক্ষায় তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের দেশ চিনতে শেখান, ইতিহাস জানতে শেখান এবং সাহিত্যচর্চায় উৎসাহ দেন। এইসব পাঠশালার পড়ুয়ারা ‘চরকি’ নামের লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করে। গল্প, কবিতা, নিজেদের ভাবনা ইত্যাদি তো থাকেই, তার সঙ্গে থাকে সাক্ষাৎকার। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলি কথা বলে সমাজের প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে, ঔৎসুক্য থেকে প্রশ্ন সাজায় নিজেদের মতো, তারপর তা লেখে ‘চরকি’ পত্রিকার পাতায়। পত্রিকা হাতে নিয়ে বইমেলায় আসে। ওদের শিক্ষকরা নিয়ে আসেন। ওরা বইমেলায় ঘোরে, পছন্দমতো এক-দুটো বই কেনে জমানো টাকায়। আর, কিছুক্ষণের জন্য লিটল ম্যাগাজিন চত্বরের পাশের ঘাসে বসে ‘চরকি’ বিক্রি করে। ক্রেতা নেহাৎ কম হয় না। না, ওদের স্টল কেনার সামর্থ্য নেই বা লিটল ম্যাগাজিনের জন্য নির্ধারিত টেবিল নেই। আত্মবিশ্বাস আর লেখার জোর আছে। ২৮ জানুয়ারি ওরা বসেছিল লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের পাশে, কাগজ পেতে, কয়েক কপি ‘চরকি’ সাজিয়ে। মাঝে মাঝে গান গাইছিল। আর, ওদের পেছনে ঝোলানো ছিল গণহত্যাকারী ইজরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি শিশুদের পক্ষে লেখা বয়ান, ব্যানার। গাজার মানুষদের ওপরে বর্বর ইজরায়েলি আক্রমণ থামানোর দাবি ছিল সেই পোস্টারে। এই বালক-বালিকারাও বারবার উচ্ছেদ দেখেছে নিজেদের জীবনে, ভয় পেয়েছে, কলকাতার আগ্রাসী উন্নয়ন এদের প্রান্তিকতর করে দিয়েছে বারবার; তবু, তারা উচ্ছেদ আর অস্থিতির সঙ্গে লড়তে লড়তেই শিক্ষার আলো এবং অস্তিত্বের আকাঙ্খাকে নিভতে দেয়নি। এই বালক-বালিকাদের লেখাতেও তার প্রতিফলন। আর, বইমেলা তো গণতান্ত্রিক পরিসর, মুক্তমনার অনুশীলনকেন্দ্র, জ্ঞানের আদানপ্রদান, যুক্তিবুদ্ধি-মননের ভয়ডরহীন স্বাধীন চর্চার প্রাঙ্গন! তাই কি? সত্যি তাই? পাঠশালার শিক্ষিকা ঝিলম রায় লিখছেন,

প্রথমে গিল্ড অফিস থেকে লোক এসে জানাল ইসকনের স্টল থেকে কমপ্লেইন করেছে। উঠে যেতে বলল। স্টলের অনুমতি নেই, বসার জন্য পয়সা দেওয়া হয়নি বলে উঠে যেতে বলা হল। তারপর একদল পুলিশ এসে ঘিরে ধরল। আমরা জানালাম আমরা আর আধঘণ্টায় উঠে যাব। পড়ুয়াদের এমনিও ফেরার সময় হয়ে আসছিল। এরপর অন্যপাশের স্টল ‘শপিজেন বাংলা’ থেকে কিছুজন এসে চেঁচাতে লাগলেন আমরা বাচ্চাদের ব্যবহার করছি, ওদের নিয়ে ব্যবসা করছি বলে। বাচ্চাদের হাত থেকে চরকি কেড়ে নিলেন। বড়দের হুমকিতে ঘাবড়ে না গিয়েও পড়ুয়ারা ঠান্ডা মাথায় জানায় তাদের কেউ কিছু শিখিয়ে দেয়নি। তারা নিজেদের লেখা বই, নিজেরা বিক্রি করছে। এরপর আরও হুমকি বাড়তে থাকে। পড়ুয়ারা প্রতিরোধে গান শুরু করে, ‘আমরা সবাই রাজা’, ‘নবাব হুজুর খাঞ্জা খান’, ‘কারার ওই লৌহ কপাট’। এরপর একজন এগিয়ে এসে ওদের হাতে আঁকা পোস্টার পায়ে মাড়িয়ে দেয়। আর হিংস্রভাবে ঠেলতে থাকে। ততক্ষণে পথচলতি মানুষও জড়ো হতে শুরু করেছে। অনেকেই জানায় তাদের কোনও অসুবিধে হয়নি বাচ্চাদের জন্য। আমরা প্রতিবাদ করলে পুলিশ, বইমেলা কর্তৃপক্ষ এসে আমাদের কিছুজনকে টেনে হেঁচড়ে বাইরে কন্ট্রোল রুমে নিয়ে যান। বাচ্চারা ঘাবড়ে আছে, ওরা কিছু খায়নি, ওরা হারিয়ে গেলে গিল্ড দায়িত্ব নেবে কি না প্রশ্ন করলে আমাদের মধ্যে একজনকে যেতে দেওয়া হয় বাচ্চাদের বের করে আনতে। বাকিদের তখনও আটক রাখা হয়েছিল। এই বছর ওদের জীবনে দ্বিতীয়বার বইমেলা যাওয়া। গতবার এসে শুধু একটা বইয়েরই মেলা যেখানে গান হয়, আঁকা হয়, নানান রকমের বই, নানান মানুষ পুরোটা দেখে এ বছর ওদের শুরু থেকেই উত্তেজনা ছিল। কিন্তু আজ তারা এই নিয়েই বাড়ি ফিরল যে বইমেলা সবার জন্য নয়। সেখানে এক-এক জনের জন্য এক-এক রকম নিয়ম। সেখানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে পোস্টার নিয়ে বসলে বের করে দেওয়া হয়। সেখানে টাকা না থাকলে নিজের কথা বলে বই বিক্রি করা যায় না। সেখানে টাকা থাকলে মানুষ শ্রেণি-ঘৃণা উগরে বলতে পারে বাচ্চাদের ‘ব্যবহার করা হচ্ছে’।

আশ্চর্য এই যে, লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে অরাজনীতি আর বোদামননের চাষ এত বেড়ে গেছে যে, তারা কেউই বাচ্চাদের ওপরে হওয়া এই জুলুমের প্রতিবাদ করেনি। তারা অনেক আঁতেল-জলতেল ‘থিম’ নিয়ে পত্রিকা করেছে, তারা অনেকে লকডাউন নিয়ে পেছন-তাতানো বক্তব্য লিখেছে, তারা অনেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী কবিদের নিয়ে সংখ্যা করেছে। কিন্তু চোখের সামনে ‘চরকি’ পত্রিকার বাচ্চাদের মারতে মারতে হেঁদুবাদী পুলিশ বার করে দিচ্ছে দেখে এরা নির্ভেজাল মজা উপভোগ করেছে। আসলে, ‘চরকি’ পত্রিকার বাচ্চাগুলির সততা আর নিষ্ঠা যে ওইসব ব্রয়লার পত্রিকা-ফত্রিকার ধান্দাবাজিকে দশ গোল দেওয়ার স্পর্ধা রাখে, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে।

ওইদিনই সন্ধ্যেয় রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির দাবি, বাক্‌স্বাধীনতার দাবি, দেশজুড়ে মুক্তচিন্তার পরিসর সঙ্কুচিত করার বিরুদ্ধে এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বইমেলায় মিছিলের আয়োজন করে বিপ্লবী ছাত্র ফ্রন্ট (আরএসএফ) ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তি কমিটির সদস্যরা। পোস্টার-লিফলেট-সহ শান্তিপূর্ণ মিছিল শুরু হয়েছিল লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের পাশ থেকে। তাদের মারধর করে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে যায় বিধাননগর (উত্তর) থানার পুলিশ। ২৫ জানুয়ারি ‘মনফকিরা’-র স্টলে হামলা চালিয়ে প্যালেস্তাইনের সমর্থনে টাঙানো পোস্টার ছিঁড়ে দেয় কতিপয় হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডা। ‘মনফকিরা’র অভিযোগ, গিল্ড কর্তৃপক্ষ ও পুলিশ অদূরে নীরবে দাঁড়িয়ে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জোগায় তাতে। ২৯ জানুয়ারি উপর্যুক্ত ঘটনাগুলিকে ধিক্কার জানিয়ে এবং বইমেলার স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রাঙ্গনে বাক্‌স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার চর্চা অব্যহত রাখতে ফের শান্তিপূর্ণ মিছিলের আহ্বান জানায় উপর্যুক্ত পাঠশালাগুলি এবং আরএসএফ, এফআইআরম ডিওয়াইএসএ, পিডিএসএফ, ডব্লিউপিএসইউএফ, নয়া দিশা, এপিডিআর, সিআরপিপি, নারীচেতনা এবং সারা বাংলা কর্পোরেট-বিরোধী উদ্যোগ সহ বিভিন্ন গণসংগঠন ও গণতান্ত্রিক ব্যক্তিবর্গ। ফ্যাসিবাদী ধারা অব্যাহত রেখে এই মিছিলেও দাঁত-নখ-ডাণ্ডা-বন্দুক বের করে ঝাঁপিয়ে পড়ে বিধাননগর থানার পুলিশ। শারীরিক নির্যাতন করা হয় ছাত্রছাত্রী থেকে শুরু করে সত্তরোর্ধ্ব মানবাধিকার কর্মীকেও। রাজ্য সরকার আর গিল্ডের প্রত্যক্ষ নির্দেশেই যে এমন পাশবিক আক্রমণ, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষজনের। গ্রেফতার হন ইন্দ্রানুজ রায়, অভিনব দাস, ঋতম সরকার, রাজা সরখেল, পরমেশ গুহ, অপূর্ব রায়, সৌভিক মুখার্জি, অমিতাভ সেনগুপ্ত, শঙ্খদীপ দাস, শুভাশিস শীট, তন্ময় বিশ্বাস, অরিজিৎ সাহা, সিমরানজিত চক্রবর্তী, রূপম মিস্ত্রি। বিপ্লবী ছাত্র ফ্রন্টের সদস্য অভিনব এবং ডিওয়াইএসএ-র সদস্য শঙ্খদীপকে তিনদিন জেলে বন্ধ রাখে তৃণমূল সরকার। মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয় ৩৫৩ (নিগ্রহ), ১৮৬ (পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া), ৫০৬ (অপরাধমূলক ষড়) এবং ৩৪ (অপরাধী দায়ভার) ইত্যাদি ধারায়। সরকারের লজ্জা নেই। পুলিশ তাদের আজ্ঞাবহ দাস। এ তো সকলে জানে। কিন্তু, সংস্কৃতির ধ্বজাধারী বাবুদের লজ্জা হল? বইমেলায় এবার ২৯ লাখ লোক, ২৭ কোটি টাকার বই বিক্রি। ২৯ লাখ! ১৪ জনকে গ্রেফতার করল পুলিশ— ‘অপরাধ’ বাক্‌-স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার দাবি জানানো। ২৭ কোটি! তার মধ্যে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলোর ‘চরকি’ নেই। বাবুদের তাতে কী এল গেল? তারা এসবে পাত্তা না-দেওয়ার বিলাসিতা অনুশীলন করছে। বাবুরা অবশ্য লজ্জার মাথা না, লজ্জার মাথা-হাত-পা-শরীর সবই খেয়ে ফেলেছে। এ এক কলচরল স্পিরিচুয়ালিজম বটে!

 

লিটল ম্যাগাজিন: অণু-পত্রিকা থেকে হনু-পত্রিকায় বিবর্তন

শোনা গেছে এখন প্যালেস্তাইনের কবিতা, গল্পের খুব কাটতি। স্বঘোষিত প্রগতিশীল শিবিরে ধুম লেগেছে। ধড়াদ্ধড় অনুবাদ নামছে, হুশহাশ গদ্যবিকিরণ চলছে। কত সহমর্মিতা, কত উলুখুলু মরমী গদ্যসৌকর্য, ফিলিস্তিনিদের অধিকারের দাবিতে ক্রোধোত্তপ্ত অনুচ্ছেদ, পংক্তি। সেসব বাজারজাত হয়ে বিক্রিও হয়েছে কম না। দামী বইয়ের মোড়কে কিংবা সুশোভিত বক্তিমেকক্ষে কী উত্তেজনা! অথচ ‘চরকি’ পত্রিকা সাজিয়ে বসা কচি কচি ছেলেমেয়েগুলি যখন প্যালেস্তাইনের পক্ষে পোস্টার লেখার অপরাধে হিন্দুত্ববাদী গুণ্ডা আর পুলিশের মার খাচ্ছে, তখন ওসব প্রকাশক-ধোকাশক লেখক-ফেখকদের টিকিটাও দেখা যায়নি। নিদেনপক্ষে কোনও বিবৃতি? ন্যাঃ! তাঁরা হয়তো সেইসময় ফিলিস্তিনি গল্প-কবিতা-গদ্য বইয়ের বিক্রির মালকড়ি গুছোচ্ছিলেন। অথবা ত্যানা পেঁচিয়ে গরমাগরম বক্তিমে ঝাড়ার স্তাবক জোগাড় করছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় কালেভদ্রে ‘দেশ রসাতলে যাচ্ছে গো’ কিংবা ‘পিতৃতন্ত্র আর ব্রাহ্মণ্যবাদ আমাদের সব্বোনাশ করলে গো’ বলে মড়াকান্না জুড়ে দেয়; কিন্তু প্রকাশ্যে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির জমায়েত হলেই তারা “বইমেলায় এসব হাঙ্গামা ঠিক না” বলে উদাসপাঁচু হয়ে কফি-চা খায়। “ওঃ ইশ্‌ আমরা জানতুম না তো” আউড়ে অ্যাসিড-রিফ্লাক্স সামলানো ঘেঁচুটে অভিব্যক্তি দেয়। যতটুকু স্বস্তিগণ্ডি এঁকে নিলে সেফ্‌ থাকা যায়, বইমেলায় পাঠক গোছানো যায়, তার বেশি রাজনীতির অভিমুখ এদের ইচ্ছাকৃত নেই। মুখে প্রগতিশীল আদতে ফাট্টু এবং লেখায় শাসকবিরোধী আসলে শাসকতোষী অধিকাংশ বেদনামুখো লিখিয়ে-টিখিয়ে সম্পাদক-খম্পাদকের মুখোশ খসে পড়ে এমন পরিস্থিতিতে। বইমেলার গণতান্ত্রিকতা রক্ষা করার দায়বদ্ধতা থেকে কী মসৃণভাবে সরে যায় তারা।

ইয়াব্বড় মুক্তমঞ্চ তৈরি হয়েছিল। একাধিক। এছাড়া প্রেস কর্নার। সরকারি ব্যাঙ্কের নামাঙ্কিত অ্যডিটোরিয়াম। লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের পাশে সমরেশ বসু মুক্তমঞ্চ। জব্বর নাম— ‘মুক্তমঞ্চ’! আদতে গিল্ড ও প্রশাসনের তৈরি মঞ্চ। সে মঞ্চে গান-ফান, নাচ-টাচ, কবিতা-সবিতা থেকে শুরু করে হ্যানো-ত্যানো পত্রিকার দেদার উদ্বোধন হচ্ছে। গলবস্ত্র শাসকধন্য প্রকাশক-চোকাষক, সম্পাদক-টম্পাদক, কবি-লবি, ‘আমাদের পত্রিকা অন্যরকম’ পাঁয়তাড়া-কষা হনু-পত্রিকার মালিক/মালকিন সেই মুক্তমঞ্চের কাঠের পাটাতনে সদাই চাপবৃদ্ধি করছে। কিন্তু, এদের একটাও ২৮ তারিখ ছোট বাচ্চাদের ওপরে হওয়া পুলিশি জুলুম নিয়ে বা ইসকন-ভিএইচপির ঘেঁচুড়েপনা নিয়ে একটা শব্দও খরচ করেনি। ২৯ তারিখ ছাত্রছাত্রীদের মারতে মারতে পুলিশ তুলে নিয়ে যাচ্ছে কিংবা মানবাধিকারকর্মীর হাতে পুলিশ কামড়ে দিয়েছে জানতে পেরেও এরা কোনও রা-কাড়েনি। কানা ল্যাম্পপোস্ট সেজে সেফ্‌ খেলেছে। মুক্তমঞ্চে দাঁড়িয়েও এরা মগজ আর বাক্‌ বদ্ধ করেই রাখল। লিটল্‌ ম্যাগ প্যাভিলিয়নের সারি সারি টেবিল যেন কবরখানার সারি সারি কবর। পেছন ওঠায় না, নড়েচড়ে না, সরকারি জুলুমের বিরুদ্ধে কিসুই বলে না, চোখের সামনে দিয়ে পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের মারতে মারতে নিয়ে গেলেও এরা হরেক দরের বোবাকালা সেজে ঘাপটি মেরে থাকে। নিজেদের মধ্যে আঘাতুমা তোঘাআমা (আমার ঘামাচি তুমি মারো; তোমার ঘামাচি আমি মারি) করে। তারপর সুযোগ পেলেই মঞ্চে টেবিলে নাচনকোঁদন করে আর নিজেদের লেখা-ফেখা, পত্রিকা-মত্রিকার বেওসা বুঝে পেছনদিকে দৌড় মারে।

সে কবেকার কোন জন্মের বইমেলা ছিল। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সদর্পে রাজনৈতিক কবিতা নিয়ে মেলায় দাপিয়ে বেড়াতেন। হাতে থাকত কবিতা-ফোল্ডার। ‘মানুষের অধিকার’ নামের পাতলা পুস্তিকা। বন্দিমুক্তির দাবিতে লেখা কবিতা— তার প্রত্যেক শব্দ সৎ এবং সক্রিয়। নাঃ, কোনও মুক্তমঞ্চের অংঢং আর ঘটা করে স্তাবক-সাজানো ‘আমাকে কিনুন’ ন্যাকামির দরকার পড়েনি তাঁর। ‘আমি প্রগতিশীল’ মার্কা কড়কছাপ দেখনদারির প্রয়োজন হয়নি তাঁর। শুধু বইমেলা না, শহরের অন্যান্য মিছিলেও ছুটে যেতেন, কবিতা-পুস্তিকা বিক্রি করতেন। তারপর সেই রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির মিছিল থেকে উঠে আসা শব্দ-দৃশ্য ছেনে ছেনে কবিতা নির্মাণ করতেন। বন্দিমুক্তির মিছিলে পুলিশ বাধা দিলে কিংবা প্রতিবাদীদের ওপর জুলুম হলে পুলিশের সঙ্গে সরাসরি বিরোধে যেতে তিলমাত্র দ্বিধা করতেন না।

 

তিমিরলোভী বনাম তিমিরবিনাশী

আলোগ্রাসী সময়। হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ নিজের সংস্কৃতি, দাবিদাওয়া প্রতিষ্ঠা করেই ফেলেছে। তাদেরই দাপ এখন। বইমেলাতেও যে তার প্রতিফলন হবে, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তাদের স্টলে ভিড়, তাদের প্রচার-পুস্তিকার বাড়াবাড়ি এবং পরধর্মবিদ্বেষী কুযুক্তির বইপত্র রমরমিয়ে বিকোবে এটা অস্বাভাবিক না। তাদের পক্ষ পাকা হয়েই আছে। এর বিপরীতে ওই পাঠশালার পড়ুয়ারা আছে, কতিপয় ছাত্র-যুব সংগঠন আছে, অল্প কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন আছে এবং অত্যল্প লিটল ম্যাগাজিন আর আরও অত্যল্প প্রকাশনী সংস্থা আছে। তারা দ্রোহের অস্তিত্ব, ‘না’ বলার জেদ বাঁচিয়ে রেখেছে। তারাও পক্ষ বেছে নিয়েছে। কিন্তু বিপজ্জনক দোদুল্যমান তারাই, যারা নিরপেক্ষতার ভান আঁকড়ে রয়েছে। শাসকের নামে দু-একটা সস্তার টিপ্পনি ছুড়ে তারপর নিজের ধান্দা গুছিয়ে খরগোশের মতো গর্তে ফিরে ওয়ানাবি ‘অন্যরকম’ সাজছে! মুখে মারিতং মতাদর্শ (কারণ বিতর্ক আর বিক্কিরি বিশাল) আর শব্দ-বাতেলায় ‘আমিই সেরা কবি/লেখক/সম্পাদক’ বাদ দিলে ভেতরে ভেতরে তাদের অন্তঃসারশূন্যতা বড্ড প্রকট। চূড়ান্ত সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সঙ্কটের সময় স্বস্তিবৃত্ত খুঁজে ছদ্ম-প্রগতিশীল সাজার এই সেলফি/গ্রুপফিগর্বী আকুলিবিকুলি বইমেলার বাজারে বেড়ে যায়। আর কতদিন এই ছদ্মবেশ? এই নির্লিপ্ত ময়ালঘুম?

ওহে হেজেমজে যাওয়া রিচভিখারি কবি-ফবি, ওহে খ্যাতিপ্রত্যাশী অরাজনৈতিক সাহিত্যিক-টাহিত্যিক, আপনাদের বকরমবাজির ন্যাকাবৃত্ত আর চলছে না। নিজের ছায়ার সঙ্গে কসরৎ করে স্ববৃত্তে-তৃপ্তিদায়ক লেখা-ফেখা দেখে রাষ্ট্র খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে টেবিল বাগানো সম্পাদক-ফম্পাদকের ছবিছাবা আর ঠোঁট-ফোলানো ঘ্যানঘ্যানানির ওপরে প্রতিষ্ঠান সিকনি ঝেড়ে আর গয়ের থুকে চলে যাচ্ছে। রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের একটি কেশাগ্রেও আপনাদের উপন্যাস-টুপন্যাস, কবিতা-ফবিতার সুড়সুড়ি লাগছে না। রাষ্ট্রেরই এঁচে দেওয়া সুখপুকুরে নিশ্চিন্তে সাহিত্যকেলি করে দু-একটা বুড়বুড়ি কেটে খুব সরকার-বিরোধিতা করে ফেললেন বলে বগল বাজাচ্ছেন তো? সরকার যে এইসব ভদ্দরলোকদের ‘কী লিখনু, কী বননু’ গোছের খলবলানি প্রচারকে জাঙ্গিয়ার বুকপকেটসম গুরুত্বও দেয় না, তা প্রত্যেক বছর বইমেলায় আরও প্রমাণ হচ্ছে। কিন্তু, রাষ্ট্র কাদের গুরুত্ব দেয়? ক্ষমতা কাদের ভয় পায়? কাদের মনে করে বিপজ্জনক? কাদের স্বরকে ভয় পায়? ওই চারুমার্কেট, বেঙ্গল ল্যাম্প বস্তির বাচ্চাদের, যারা গাজায় আহত-নিহত শিশুদের যন্ত্রণা ছুঁতে চেয়েছিল ছবিতে পোস্টারে। ওই ছাত্রছাত্রী সংগঠনকে, যারা রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির অত্যাবশ্যকীয় দাবিতে সর্বদা সোচ্চার থাকে। ওই ছাত্রছাত্রী ও কতিপয় নাগরিকগণ, যারা গ্রেফতারির পরেরদিন আবারও একই স্থান থেকে প্রতিবাদী মিছিল করার ধক দেখাল, তাদের। যে ছাত্রছাত্রীরা বইমেলায় পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক পরিসরের দাবি জানাল, তাদের। এপিডিআরের সত্তরোর্ধ্ব যে বৃদ্ধ মারমুখী পুলিশবাহিনির চোখে চোখ রেখে মানবাধিকার স্মরণ করিয়ে দেন, তাঁকে।

আতঙ্কের বিষয় এটাই যে, আন্তর্জাতিক বইমেলার পরিসরে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলির আধিপত্য বাড়ছে। বছর ছ-সাত আগেও এইসব উনোমুখো বিদ্বেষগেঁড়ে সংগঠন বইমেলায় খাপ খুলতে পারত না। দোকান দিত, বিক্রিবাটাও হত, কিন্তু লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নে এসে চোখ রাঙানোর সাহস পেত না। লেখকের টাকা শুষে বেনিয়াগিরি করা উটকো-ছুটকো প্রকাশন-দোকান ছাত্রছাত্রীদের সু-রাজনৈতিক বক্তব্য-পোস্টার পায়ে মাড়িয়ে দেওয়ার কথা ভুলেও ভাবত না। শাসকের পক্ষে থাকা গিল্ড আর গিল্ডের ধামাধারী দোকানদাররা আগেও ছিল, কিন্তু বইমেলায় রাষ্ট্রবিরোধী পোস্টার-গান-ছবি যথেচ্ছ প্রদর্শিত হত। বিরোধী মতামতকে বরাবরই শাসক ও গিল্ড বাঁকানজরে দেখত, কিন্তু প্রতিরোধী পক্ষের লোকবল এবং মতাদর্শ-সমর্থক অনেক বেশি ছিল। ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলা পিপলস্‌ মার্চ পত্রিকার সম্পাদক কমিউনিস্ট স্বপন দাশগুপ্ত জেলের ভেতরে খুন হওয়ার পরে বইমেলা প্রাঙ্গনে বিশাল মিছিল হয়েছিল। অনেক লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক স্পর্ধা নিয়ে মিছিলে হেঁটেছিলেন। বেশ কয়েকটি প্রকাশনা সংস্থা, বহু পাঠক এবং বহু মাথা-উঁচু লেখক সেই মিছিলে হেঁটেছিলেন। ২০১৭ সালে বইমেলায় বামপন্থী ছাত্রছাত্রীদের দেওয়া স্লোগানে গোটা-দুই হেঁদুবাদী প্রকাশন সংস্থার কেটলি-গরম দুষ্কৃতিরা তেড়ে আসার পরে রাজনৈতিক মতাদর্শ সম্বলিত অনেক পাঠক ও লেখক পাল্টা তেড়ে গিয়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলার ধক দেখিয়েছিলেন। আতঙ্কের এটাই যে, এগুলি ‘অতীত’ হয়ে গেছে। ২০২০ সালের বইমেলায় এনআরসি-সিএএ বিরোধী মিছিল সংঘটিত হয়েছিল বইমেলায়। কয়েকজন প্রকাশক, কিছু লিটল ম্যাগাজিন চর্চাকারী, বহু পাঠক, অনেক ছাত্রছাত্রী এবং মানবাধিকার কর্মী সেই মিছিলে হাঁটতে শুরু করেছিলেন বইমেলা প্রাঙ্গনে। লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের পাশ থেকেই। সেই মিছিলেও বাধা দেয় সরকারি বেতনভুক পুলিশ। ধরপাকড় করা হয় মিছিলে কাঁধ-মেলানো শুভবুদ্ধির মানুষদের। গ্রাউন্ডজিরো পত্রিকায় নন্দিনী ধর লিখেছেন,

কোনও একটি মেলায় ১৪৪ ধারা জারি? এইভাবেই কি যুক্তির প্রহসন সাজায় ক্ষমতা? অন্যদিকে, পৃথিবীতে কোথাও তো প্রতিবাদজনিত মিছিল আর যাই হোক কর্তৃপক্ষের “অনুমতি” নিয়ে হয় না! কাজেই, এটা বুঝতে বাকি থাকে না বোধহয় যে আজ এক ধরনের সার্বিক জো-হুজুরি, সার্বিক অবদমনের পরিবেশেই আজ আমরা বাঁচি। বাঁচে আমাদের সাংস্কৃতিক জগৎ, সাহিত্য জগৎ, আমাদের জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রগুলি। গত কয়েক বছরে বইমেলার ভেতরে সার্বিকভাবে জমি ছেড়ে দিয়েছি আমরা অনেক। তাতে অবশ্য ব্যতিক্রমী কিছু নেই। বইমেলার ভিতরে জমি ছেড়ে দেওয়া তো আসলে বাকি বৃহত্তর সমাজে রাজনৈতিক-সামাজিক স্থান সঙ্কোচনেরই প্রতীক।

সেই সঙ্কোচনের বৃহত্তর প্রতীক হয়েই হাজির হয় বারবার পুলিশ অফিসারদের মুখে একটি কথা— “বইমেলা ডেমনস্ট্রেশনের জায়গা নয়।” তাই, কপালে তিলক কাটা আইপিএস অফিসার যখন বলেন, “কলকাতা বইমেলা ইন্টারন্যাশনাল প্রচার পায়। সেখানে ডেমনস্ট্রেশন করে আপনারা ইমেজ খারাপ করছেন,” তখন তাকে পাল্টা জিজ্ঞাসা করা হয়, “এই যে বাচ্চাগুলো এসেছিল, তারা যে বইমেলা সম্পর্কে অত্যন্ত খারাপ ইমেজ নিয়ে ফিরল তার বেলা?” অফিসার মহোদয় অবুঝ মুখ করে তাকিয়ে থাকেন। এই জাতীয় যুক্তিজাল তার মননের বাইরে। যে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে তিনি পুলিশ অফিসার হয়েছেন, শিখেছেন রাষ্ট্র ও ক্ষমতার সেবা— থুড়ি, পদলেহন করতে— সেখানে এই যুক্তিজালের কোনও স্থান নেই। কিন্তু, এই যে ছোট্ট বাকবিতণ্ডা, বিতর্ক— যা দিয়েই আসলে তৈরি হয় মিছিল ও তৎসান্নিধ্য পুলিশি সংঘর্ষের অন্তরীণ জীবন— খুলে দিল একটি বিপুল তত্ত্ববিশ্ব।

সেই তত্ত্ববিশ্ব জানাল আমাদের যে, বইমেলা আসলে একটি স্পেক্টাকেল। পুঁজির স্পেক্টাকেল, ক্ষমতার স্পেক্টাকেল। সেই স্পেক্টাকেলে বিদ্রোহের জায়গা নেই। এবং, পুঁজির সুচারু স্পেক্টাকেলে যে বিদ্রোহের জায়গা থাকে না, থাকে কেবলি ঝাঁ-চকচকে, জ্বলজ্বলে অন্ধকার, তা তো আমাদের অজানা নয়। কিন্তু, আমরা জানলাম এইবার, কলকাতা বইমেলা ২০২৪-এর মেলা প্রাঙ্গনে দাঁড়িয়ে, যে এই স্পেক্টাকেলে সহমর্মিতারও কোনও জায়গা নেই।

নন্দিনী ধরের এই লেখাটি সোশ্যাল মিডিয়ার মালিকদের চক্ষুশূল হয়েছে। তাদের হাতেই জগতের ভার, তাই এ লেখা তারা মুছে দিচ্ছে বারবার। লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নের ভেতর দিয়ে সারি সারি পুলিশ রুট-মার্চ করছে, যেন চিরুনি তল্লাশি। এই দৃশ্য ত্রস্ত করে না আপনাকে? সেফ্‌ খেলার ছক আর ছদ্ম-প্রগতিশীল অরাজনীতির নিরাপত্তা ফুরিয়ে আসছে। হরর্‌ বাস্তবের আঁচ পাচ্ছেন না?

খাতায় ফেসবুকে বুকনিবাজির লহর তোলা বইমেলাজীবীরা, আপনারা সেফ-খেলার শব্দ হাতড়ান। তারপরে হিসেব করুন কত মালকড়ি কামানো গেল প্রগতিশীল মুখোশ পরে। পরের বইমেলার বাজার বুঝে আবার মুখোশ বানাতে হবে তো! ন্যাকাকান্না কেঁদে আর ছবি-ছাবা ফেসবুকে পোস্টিয়ে কবিতা-লবিতা, গদ্য-চদ্য, গল্প-টল্প বেচতে হবে তো! তবে, আর কেউ না জানুক, রাষ্ট্র ভালই জানে যে, ওসব ব্রয়লারি প্রোডাকশনে বারোয়ারি ডাস্টবিনে ফুলে ওঠা ছানার গন্ধ ম-ম করছে। আন্তর্জাতিক বইমেলা ক্রমশ হিন্দুত্ববাদীদের আখড়া, রাজ্য পুলিশের মাস্তানির ঠেক এবং শাসকের ‘আঃ তুতু তু, লেঃ উৎসব কর্‌’ প্রোপাগান্ডায় পরিণত হয়েছে। এই আলোগ্রাসী সময়ে, এই ফ্যাসিস্তমুখর দেশে সরকার (রাজ্য হোক বা কেন্দ্রীয়) যে সাহিত্য যে শিল্পের ওপরে রাজনৈতিক দমন নামাচ্ছে, সেই শিল্প-সাহিত্যই আগুনে ঝলসানো ইস্পাত। ওই যে শিশুগুলোর ড্রয়িং, ছেঁড়া কাগজের ওপর সযত্ন লেখা আর অনেক অনেক সৎ-প্রত্যাশা নিয়ে করা পত্রিকাটি আপনারা মাড়িয়ে গেলেন আর ওদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়ার সময় মুচকি হাসলেন, সেই শিশুগুলোই একদিন বড় হবে। ওরা আরও লিখবে। নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেবে প্রতিবাদে, প্রতিরোধে, সাহিত্যে। আপনাদের ওইসব ভ্যাদভ্যাদে টোকোগন্ধ লেখা-ফেখা, ল্যাও-সুড়সুড়ি নাচ-গান-কবিতা আর প্রগতিশীল ভড়ংয়ের মুখোমুখি দাঁড়াবে। জবাব খুঁজে নেবে। খুব সাবধান!


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...