অনির্বাণ ভট্টাচার্য
গোটা পৃথিবীর ৩৬টি হটস্পটের চারটে নিয়ে থাকা হিন্দুকুশে আছে পৃথিবীর ২০০টি ইকো-রিজিয়নের ভেতর ১২টি, এছাড়াও ৫৭৫টি সংরক্ষিত এলাকা ও ৩৩৫টি প্রজাতির পাখি। গত একশো বছরে এই অবিশ্বাস্য হিন্দুকুশ এলাকার হ্যাবিটাট ও জীববৈচিত্র্য হারিয়েছে সত্তর শতাংশ, অথচ হিন্দুকুশের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের ৮৫ শতাংশই খাবার, জল, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্য এই জীববৈচিত্র্যের উপর তীব্রভাবে নির্ভরশীল। এই পর্যায়ের ধ্বংস চললে ২১০০ সালের ভেতর জীববৈচিত্র্য পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব না
২০০৪ সালে রাসেল মেটারমেয়ারের বিখ্যাত বায়োডাইভার্সিটি হটস্পট রিপোর্টে হিন্দুকুশ মাউন্টেন রেঞ্জে পড়েছিল চার চারটে হটস্পট— হিমালয়ান হটস্পট, ইন্দো-বার্মা হটস্পট, দক্ষিণ-পশ্চিম চিনের পর্বতাঞ্চল ও মধ্য এশিয়ার পর্বতাঞ্চল। এবং এই আশ্চর্য প্রাকৃতিক সম্পদশালী হিন্দুকুশ ঘিরেই সাম্প্রতিক ভয়ের বাতাবহ।
গত ফেব্রুয়ারিতে কাঠমান্ডুতে ১৪৫টি দেশ নিয়ে তৈরি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত ইন্টারগভর্নমেন্টাল সায়েন্স-পলিসি প্ল্যাটফর্ম অন বায়োডাইভার্সিটি অ্যান্ড ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস (আইপিবিইএস)-এর থার্ড লিড অথর বৈঠক আয়োজন করেছিল ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্রেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট বা ICIMOD সংস্থা। প্রসঙ্গত এটিই সংস্থার প্রথম বৈঠক, যা আয়োজিত হল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কোনও দেশে। তাৎপর্যপূর্ণ রিপোর্টে এখানে হিন্দুকুশকে সরাসরি ‘বায়োস্ফিয়ার অন দ্য ব্রিঙ্ক অফ কোল্যাপ্স’ বলে ঘোষণা করা হল, আশু প্রচেষ্টা ছাড়া যা সামলানোর কোনও উপায় নেই। খাবার, স্বাস্থ্য, জলসমস্যা, জীববৈচিত্র, ও জলবায়ু পরিবর্তনের মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণের লক্ষ্যে আয়োজিত সম্মেলনটির ১৩০ জন বিশেষজ্ঞের একটি রিপোর্টে হিন্দুকুশের হ্যাবিটাট লসের ছবিকে ‘ক্যাটাস্ট্রফিক’ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। এবং এই ধ্বংসের দিক পশু ও বৃক্ষের থেকে এগিয়ে আসছে মানুষের দিকে। ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ইসাবেলা কোজিয়েল মনে করছেন, ক্ষতি সামলাতে দেরি হয়ে গেছে, অনেকটা দেরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই।
ইসাবেলা আর যা বলেছেন, তার মধ্যে পড়ে সেই হ্যাবিটাট লসের বিশদ তথ্যের দিকগুলি। গোটা পৃথিবীর ৩৬টি হটস্পটের চারটে নিয়ে থাকা হিন্দুকুশে আছে পৃথিবীর ২০০টি ইকো-রিজিয়নের ভেতর ১২টি, এছাড়াও ৫৭৫টি সংরক্ষিত এলাকা ও ৩৩৫টি প্রজাতির পাখি। গত একশো বছরে এই অবিশ্বাস্য হিন্দুকুশ এলাকার হ্যাবিটাট ও জীববৈচিত্র্য হারিয়েছে সত্তর শতাংশ, অথচ হিন্দুকুশের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের ৮৫ শতাংশই খাবার, জল, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের জন্য এই জীববৈচিত্র্যের উপর তীব্রভাবে নির্ভরশীল। সংখ্যার নিরিখে ধরলে ২৪০ মিলিয়ন জনসংখ্যা সরাসরি তাঁদের জীবনধারণের জন্য হিন্দুকুশের উপর নির্ভরশীল এবং ১.৯ বিলিয়ন মানুষ খাদ্য, জল এবং বিদ্যুতের জোগানের জন্য নির্ভরশীল। শতকরা হিসেবে গোটা পৃথিবীর ৩৫ শতাংশের বেশি মানুষ হিন্দুকুশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও বাস্তুতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডের ওপর নির্ভরশীল। এই পর্যায়ের ধ্বংস চললে ২১০০ সালের ভেতর জীববৈচিত্র্য পুরোপুরি শেষ হয়ে যাওয়াও অসম্ভব না।
এছাড়াও এসেছে হাই মাউন্টেন এশিয়ার গুরুত্বের দিকটি ও প্রাসঙ্গিক ওয়াটার টাওয়ার-এর কথা। তিয়ান শান, কুনলান শান, পামির, কারাকোরাম, হিন্দুকুশ, টিবেটান প্ল্যাটো ও হিমালয়— এই মাউন্টেন রেঞ্জগুলির অন্যতম হিন্দুকুশ ভারত-সহ পৃথিবীর আটটি দেশের ৩৫০০ কিলোমিটার অঞ্চলে বিস্তৃত। দুই মেরু ছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বরফের অবস্থান এই হিন্দুকুশেই এবং এখান থেকে বেরিয়ে মোট বারোটি নদী ছড়িয়ে গেছে গোটা এশিয়ায়— যা এককথায় ‘ওয়াটার টাওয়ার’। এই ওয়াটার টাওয়ার পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষের পেয় জলের জোগানদাতা। অথচ এখানেই ক্রাইসিস। হিন্দুকুশ অঞ্চলে থাকা ২৪১ মিলিয়ন জনসংখ্যার ৩১ শতাংশ খাদ্যসঙ্কটে জীর্ণ এবং পঞ্চাশ শতাংশ মানুষ কোনও না কোনওভাবে অপুষ্টির স্বীকার। আর এখানেই ICIMOD সম্মেলনের মূল লক্ষ্য অর্থাৎ জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে খাবার, জল ইত্যাদির পারস্পরিক সম্পর্ক নিরূপণের প্রাসঙ্গিকতা।
এই আশু কর্মকাণ্ডের পেছনে আর্থিক জোগান? কে দেবে? কীভাবে আসবে? রিপোর্ট বলছে সংশ্লিষ্ট দেশের একার পক্ষে মুশকিল। চাই, পরিকল্পিত বাজার বিশ্লেষণ ও নতুন বাজার তৈরি। কোনও মুনাফা ছাড়াই গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডগুলিকে এগিয়ে আসতে হবে। যে-কোনওভাবেই হোক হ্যাবিটাট লস ঠেকাতে আর্থিক প্রচেষ্টা ও জোগান ‘এক্সপোনেনশিয়াল’ পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
সম্মেলন শেষেও ভেসে আসছিল ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল ইসাবেলার উচ্চারণগুলি— ‘ইট ইজ অলমোস্ট টু লেট, অলমোস্ট টু লেট…’। দেখা যাক, কে জেতে? মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রাকৃতিক লুটের লেগ্যাসি, নাকি শুভশক্তির দেরিতে হলেও বিকাশ?