অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সরকার কী করছে? আন্দোলনরত কৃষকদের দাবিদাওয়া-অধিকারকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, সহানুভূতি দূরে থাক— খোলাখুলি এই সরকার কৃষকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পথে হেঁটেছে। সেই পথে তাদের সঙ্গে থেকেছে প্রশাসন তো বটেই এমনকি বিক্রি হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে বিজেপি-আরএসএস মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল সবাই
ঘর…
গণতন্ত্র হিসেবে আমরা ক্রমশই এক চূড়ান্ত অস্থির সময়ের দিকে এগিয়ে চলেছি। আমার মনে পড়ে না ২০০৪ থেকে ২০১৪, ইউপিএ সরকারের সময় বারংবার এতগুলি গণআন্দোলন দেশব্যাপী গড়ে উঠেছিল কিনা। অথবা সেগুলিতে সাধারণ কৃষক-শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিরাও এমন সংখ্যাতে অংশগ্রহণ করেছিল কিনা। ইউপিএ আমলে রাজধানী অথবা বড় শহরগুলিতে প্রভাব ফেলে দেওয়া সবচেয়ে বড় যে দুটি আন্দোলনের কথা মনে পড়ে, তার মধ্যে একটি নিঃসন্দেহে নির্ভয়া গণধর্ষণ-পরবর্তীতে গড়ে ওঠা নাগরিক আন্দোলন। সেই আন্দোলনের প্রতিক্রিয়াতে তদানীন্তন সরকার বেশ কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নেয়। দ্বিতীয় ঘটনা হিসেবে আজ মনে পড়ছে আন্না হাজারের দুর্নীতি-বিরোধী ‘লোকপাল আন্দোলন’। সেই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও প্রতিফল দুইই আজ যে-কারও কাছে দিনের আলোর চেয়েও পরিষ্কার। যে-কারণে ছদ্মবেশী, স্বঘোষিত ‘গান্ধি’ সে-সময়ের হাজারে-মশাইও, জনতার হাজার আবেদনেও কখনও সাড়া দিয়ে আর জনসমক্ষে মুখ দেখাতে পারেননি। ইতিমধ্যে এনডিএ আমলে আমরা শাহিনবাগ, প্রথম পর্যায়ের কৃষক আন্দোলন, এ দুটিকে পেরিয়ে দ্বিতীয় দফার কৃষক অভ্যুত্থানে এসে পড়েছি। কেন আমি ‘গণতন্ত্র’ ও ‘অস্থির সময়’ এই দুটি শব্দ ও শব্দবন্ধকে উল্লেখ করছি? তার কারণ, গণতন্ত্রে সরকারপক্ষের চেয়েও বিরোধী কণ্ঠস্বরের গুরুত্ব অধিক। সেখানে একের পর এক এমন গণআন্দোলন, অথবা ক্ষোভের এমন চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ (তা রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হলেও আন্দোলনগুলিতে অংশ নেওয়া সাধারণ মানুষ চাইছে বলেই তা সংগঠিত হতে পারছে)— এবং তার প্রতিটির ক্ষেত্রেই সরকারের তরফে এমন চূড়ান্ত স্বৈরাচারী, একনায়কসুলভ, দমনমূলক ব্যবহার, গণতন্ত্রের বিপরীতে কেবল এক অন্ধকার সময়কেই নির্দেশ করছে। কৃষক আন্দোলনের এই দ্বিতীয় পর্যায়কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আমরা বরং তার দাবিদাওয়াগুলিকে নিয়েই দু-চার কথা সাজাই।
প্রায় ২০০টিরও বেশি কৃষক সংগঠনের তরফে শুরু হওয়া দ্বিতীয় পর্যায়ের এই কৃষক আন্দোলনে প্রধানত তিনটি দাবি এই মুহূর্তে সরকারের কাছে রাখা হয়েছে।
- প্রত্যেক শস্যের নূন্যতম সহায়ক মূল্যের যে অধিকার তাকে আইনি অধিকার হিসেবে মান্যতা দিতে হবে
- কৃষকদের সমস্ত ঋণ মকুব করতে হবে ও বয়স্ক কৃষকদের জন্য পেনশন-ব্যবস্থা চালু করতে হবে
- স্বামীনাথন কমিশনের সমস্ত সুপারিশ কার্যকর করতে হবে
এছাড়াও, সংগঠনগুলির তরফে জানানো হয়েছে ২০২০-২১-এর কৃষক আন্দোলনের সময় আন্দোলনরত কৃষকদের বিরুদ্ধে সরকারের তরফে যে সমস্ত মামলা দায়ের করা হয়েছিল সেগুলি তুলে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও কেন্দ্রীয় সরকার আজ অবধি সেই প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। কাজেই সেই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সমস্ত কৃষকের বিরুদ্ধে এখনও চলতে থাকা সমস্ত মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে। প্রসঙ্গত এও উল্লেখ করা উচিত, পূর্বোক্ত স্বামীনাথন কমিশনের রূপকার এমএস স্বামীনাথনকে সম্প্রতি মোদি-শাহের সরকার দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক পুরষ্কার ভারতরত্নের জন্য মনোনীত করেছে। অথচ সেই কমিশনের যাবতীয় সুপারিশকে কার্যকর করতেই যত অনীহা তাদের। এই নিয়ে এমএস স্বামীনাথনের কন্যা সম্প্রতি বৈদ্যূতিন সংবাদমাধ্যমে একটি সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে আন্দোলনকারী কৃষকদের উপর লাগাতার সরকারি অত্যাচারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
সরকার কী করছে? আন্দোলনরত কৃষকদের দাবিদাওয়া-অধিকারকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব না দিয়ে, সহানুভূতি দূরে থাক— খোলাখুলি এই সরকার কৃষক তথা ‘অন্নদাতা’দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পথে হেঁটেছে। সেই পথে তাদের সঙ্গে থেকেছে প্রশাসন তো বটেই এমনকি বিক্রি হয়ে যাওয়া সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে বিজেপি-আরএসএস মতাদর্শের প্রতি সহানুভূতিশীল সবাই। কেমন সেই যুদ্ধ-প্রস্তুতির বিবরণ? একেকটি সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম লক্ষ করবেন। লেখা হচ্ছে, “কৃষকদের রুখতে তৈরি রাজধানীর পুলিশ ও প্রশাসন”, “সোনিক অস্ত্র থেকে শুরু করে উড়ুক্কু ড্রোন, কৃষকদের ঠেকাতে প্রস্তুতি সারা”, অথবা “কোনওভাবেই রাজধানীতে গলতে পারবেন না কৃষকেরা, দিল্লির সীমানায় তৈরি ব্যারিকেড, জলকামান”। অন্নদাতাদের লাঙলের বিরুদ্ধে সরাসরি এমন যুদ্ধের বার্তা? সত্যিই রাজধানী দিল্লির প্রতিটি প্রবেশপথ এখন কার্যত পুলিশ ও নিরাপত্তা আধিকারিকদের দখলে চলে গিয়েছে। এখানেই শেষ নয়, জলকামান অথবা বাঁশের লাঠি, ঢাল, টিয়ার গ্যাসের ব্যবস্থা তো রয়েইছে, তারও সঙ্গে যোগ হয়েছে সারি সারি পাকা কংক্রিটের ব্যারিকেড। সিঙ্ঘু সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকায় বেশ অনেকটা অংশ জুড়ে হাইওয়ে খুঁড়ে ফেলা হয়েছে। কংক্রিটের সারি সারি ব্যারিকেডের পিছনে আবার ধারালো গজাল বিছানো হয়েছে। সেই গজাল যাতে সরিয়ে ফেলা না যায়, মাটি খুঁড়ে তাতে সিমেন্ট-কংক্রিট ঢেলে তবে সেখানে সেই গজাল পোঁতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আন্দোলন শেষ হয়ে গেলে এই যুদ্ধক্ষেত্রকে কী করে আবারও আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে তা মোদি-শাহের আধিকারিকেরাই জানেন। সীমান্তে নজরদারির জন্য উদ্ভাবিত বিশেষ এক ধরনের ড্রোন প্রযুক্তিকেও এই মুহূর্তে কাজে লাগানো হচ্ছে। সেই ড্রোনগুলি আকাশপথে উড়ন্ত অবস্থাতেই দেশের সীমান্তে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের আটকাতে নজরদারি ও টিয়ারগ্যাস ছড়ানোর কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে বরং অন্নদাতা আন্দোলনকারীদেরই উপর সেগুলির ব্যবহার করা হবে। যদিও আন্দোলনকারী কৃষকেরাও এক্ষেত্রে অভিনব পন্থার আশ্রয় নিয়েছেন। তাঁরা ঘুড়ি উড়িয়ে সেই ড্রোনগুলিকে বিভ্রান্ত করার, ও মাটিতে আছড়ে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছেন। কংক্রিটের ব্যারিকেড সরাতে ট্রাক্টর ব্যবহার করছেন। কিন্তু এরই পাশাপাশি দিল্লির সবকটি প্রবেশপথ এভাবে রুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় আরও বেশি করে অসুবিধায় পড়েছেন সাধারণ মানুষ। প্রতিদিনই তাঁদের দীর্ঘ যানজটের কবলে পড়তে হচ্ছে। সরকারি মদতপুষ্ট সংবাদমাধ্যম নিয়মিত সাধারণ মানুষের এই হেনস্থার কথা উচ্চৈঃস্বরে প্রচার করে চলেছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা সাধারণ জনমতকে কৃষকদের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কাজেই প্রকাশ্যে নিরাপত্তার নামে দমনপীড়নের আশ্রয় নিয়ে ও পরোক্ষে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে জনমানসে লাগাতার কুৎসা প্রচারের মাধ্যমে, এই সরকার সরাসরি দেশের অন্নদাতাদের বিরুদ্ধে আপসহীন যুদ্ধে নামারই প্রস্তুতি সেরে ফেলেছে। নতুন ভারতবর্ষে এই ব্যবহারই বোধহয় অন্নদাতাদের উদ্দেশ্যে প্রত্যাশিত ছিল। তবুও এই লেখা পাঠানোর সময় অবধি, লাগাতার অত্যাচার ও মিথ্যা কুৎসা প্রচার এই সমস্ত কিছুকে উপেক্ষা করে তাঁদের ন্যায্য দাবিগুলিকে বুকে করে নিয়ে দ্বিতীয় পর্যায়ের কৃষক আন্দোলন জারি হয়ে রয়েছে।
…ও বাহির
এভাবে দুটি অংশতেই আজকের নিবন্ধকে ভাঙতে চেয়েছিলাম। পৃথিবী জুড়ে দক্ষিণপন্থার উত্থান আজ কোনও নতুন বিষয় নয়। ট্রাম্প অথবা বলসানেরোর নির্বাচনী পরাজয় বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র। বিশ্বজুড়ে বৃহৎ পুঁজিই যে আজ ক্রমশ সর্ব-নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে সে আর আলাদা করে বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই যে সমস্ত বিষয়ে বৃহৎ পুঁজির সংস্থাগুলির বিরুদ্ধে জনমত অথবা গণআন্দোলন গড়ে উঠছে, অথবা গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে— তখনই সেই বৃহৎ পুঁজির দালাল প্রতিনিধিরা চমৎকার কোনও উপায়ে সেই আন্দোলনের অভিমুখ একেবারে ভিন্নদিকে চালিত করার অথবা তাদের নির্মূল করে দেওয়ার রাস্তা খুঁজে নিচ্ছেন। সেই থেকেই জন্ম নিচ্ছে একের পর এক আন্দোলন। কৃষক আন্দোলন।
যেমন ধরা যাক পরিবেশ পরিবর্তন ও তৎসম্পর্কিত আয়ারল্যান্ডের কৃষক আন্দোলন। জীবাশ্ম জ্বালানির পাশাপাশি কৃষিকাজের কারণেও একাধিক গ্রিনহাউজ গ্যাস উৎপন্ন হয় ও বিশ্ব-উষ্ণায়নের ক্ষেত্রে তারও অবদান থাকে। কেবল এটুকু বৈজ্ঞানিক তথ্যই বোধহয় উদ্যোগপতিদের দরকার ছিল। একের পর এক পরিবেশ-সম্মেলনের পর যখন বিশ্বউষ্ণায়নের ক্ষেত্রে অন্তত কার্বন-নিঃসরণের বিষয়টিকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রতিষ্ঠা করা গেছে, তখন কার্বন-নিঃসরণ কমাতে যদি বা সকলে নিমরাজি হলেন, জীবাশ্ম-জ্বালানির বিষয়টি ছাপিয়ে সর্বাগ্রে তাদের নজর গিয়ে পড়ল কৃষিক্ষেত্রেরই উপর। তথ্য দিয়ে তাঁরা দেখালেন, গবাদি পশুপালনের প্রয়োজনে কিভাবে পশুখাদ্য চাষের নামে অরণ্যধ্বংস করা হচ্ছে। তাঁরা জানালেন, বিভিন্ন জৈবিক ক্রিয়ার মাধ্যমে এমনকি তাদের রেচনপদার্থ থেকেও কিভাবে গবাদিপশুরা মিথেন-সহ অন্যান্য কার্বনজাতীয় গ্যাস উৎপাদনে সহায়ক হয়। অথচ তাঁরা একথা বললেন না, কৃষিজাত মিথেন গ্যাস দশ বছরের রাসায়নিক জীবনকালের ভিতরে আবারও বিশ্লিষ্ট হয়ে কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পরিণত হয়, যা কিনা আবারও উদ্ভিদ-বৃক্ষ-বনাঞ্চলের দ্বারা শোষিত হতে পারে। তাঁরা বললেন না, জীবাশ্ম-জ্বালানি-জাত মিথেনের ক্ষেত্রে কিন্তু এই বৃত্তীয় জীবনচক্রটি কিন্তু পরিলক্ষিত হয় না। বললেন না যে এই মুহূর্তে পৃথিবীতে উৎপন্ন মিথেনের মাত্র ৩২ শতাংশ আসে কৃষিকাজ অথবা তজ্জনিত উৎস থেকে। বাকি ৬৩ শতাংশেরই উৎপাদন জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহারের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এদিকে কপ ২৭-এর আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে বাবুরা যে সব ভালমানুষটি সেজে কার্বন নিঃসরণ কমানোর প্রতিশ্রুতি জাহির করেছেন। তাই প্রথম কোপ এল কৃষিক্ষেত্রেরই উপর।
সম্প্রতি ইউরোপিয়ান কমিশনের একটি রিপোর্টে মন্তব্য করা হয়েছে, আন্তর্জাতিক পরিবেশ সম্মেলনের প্রতিশ্রুতি অনুসারে কার্বন-নিঃসরণ কমানোর যে লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে তা পূরণ করতে গেলে মহাদেশ জুড়ে মাংস উৎপাদন অন্তত ১৪ শতাংশ ও কাঁচা দুধের উৎপাদন অন্তত ১০ শতাংশ যত শীঘ্র সম্ভব হ্রাস করতে হবে। এর পরেপরেই একাধিক দেশের তরফে ঠিক কি কি সিদ্ধান্ত বা সুপারিশ জানানো হল একটু দেখে নেওয়া যাক।
- কার্বন-নিঃসরণ কমাতে ডেনমার্ক সাততাড়াতাড়ি গোমাংস উৎপাদনের উপর শুল্ক বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে।
- কানাডা কৃষিক্ষেত্রে নাইট্রোজেন সারের ব্যবহার অন্তত ৩০ শতাংশ কমাতে চলেছে।
- আয়ারল্যান্ড সরকার আগামী তিন বছরের মধ্যে অন্তত দুই লক্ষ গরুকে মেরে ফেলার সুপারিশ করেছে, এরফলে ক্ষতিপূরণ স্বরূপ সরকারের তরফে প্রায় ২০ কোটি ইউরোর অর্থসাহায্য কৃষকদের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে।
- নেদারল্যান্ডস সরকারও একাধিক কৃষি ও কৃষকবিরোধী পদক্ষেপের রাস্তায় হেঁটেছে।
- নিউজিল্যান্ড সরকার গরুর পাচনক্রিয়ার মাধ্যমে যে কার্বন-নিঃসরণের ঘটনা, তাকে মাথায় রেখে গরু-পিছু ফার্মহাউজগুলির উপরে ট্যাক্স বসাতে চলেছে।
- বেলজিয়াম সরকার ২০২৫ সালের মধ্যে সে-দেশের শূকর-প্রতিপালন কেন্দ্রগুলি বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবনাচিন্তা করতে শুরু করেছে।
অর্থাৎ জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহার কমানো, অথবা পুনর্নবীকরণ-যোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানো— ইত্যাদি কোনও সদর্থক ও প্রয়োজনীয় বিষয়েই গুরুত্ব না দিয়ে অযাচিতভাবে মূলত কৃষিক্ষেত্রেরই উপর সরকারি দমনমূলক পদক্ষেপ নামিয়ে আনা শুরু হয়েছে। স্বভাবতই আয়ারল্যান্ড-নেদারল্যান্ড সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দেশেই শুরু হয়েছে কৃষক আন্দোলন। তাহলে কেবল কি পরিবেশ-সংক্রান্ত কারণ দেখিয়েই কৃষিক্ষেত্রে আক্রমণ?
সে-কথাও বলা চলে না একেবারেই। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাস থেকে আজ অবধি পৃথিবীর ৬৫টি দেশে নানা কারণে কৃষক অভ্যুত্থান ঘটেছে। আফ্রিকা মহাদেশের ১২টি দেশ, এশিয়ার ১১টি, ইউরোপের ২৪টি, উত্তর আমেরিকার ৮টি, দক্ষিণ আমেরিকার ৮টি ও ওশেনিয়ার ২টি দেশ এখনও অবধি নানা কারণে কৃষক আন্দোলন প্রত্যক্ষ করেছে। ফ্রান্সের কৃষকেরা অতিরিক্ত ভর্তুকির দাবিতে ও উৎপাদন-মূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন। মেক্সিকোর কৃষক সম্প্রদায় ভুট্টা ও গম চাষের পর সেই ফসলের দামবৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করেছেন। কোস্টারিকার কৃষকেরা ঋণ মকুবের দাবিতে সরব হয়েছেন। এছাড়াও, খরাক্লিষ্ট মেক্সিকোর চিহুয়াহুয়া প্রদেশের বাসিন্দারা এলাকার চাষের জল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। ফসলের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে কৃষকবিক্ষোভে কেনিয়া উত্তাল হয়েছে। বেনিনের কৃষকেরা তাদের কৃষিজমির মালিকানা স্বল্পদামে পাশ্চাত্য কোম্পানিগুলির কাছে বেচে দেওয়ার ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামিল হয়েছেন। কেনিয়ার কৃষক আন্দোলনে বিশেষ করে মহিলাদের ব্যাপক উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়েছে। আন্দোলন হয়েছে জিন-প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরীক্ষিত অথচ উন্নত বলে দাবি করা বীজের কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগের বিরুদ্ধেও।
উপসংহার
আদতে, আমাদের জন্মজন্মান্তরের প্রবৃত্তিই চাষিকে ‘চাষা’ বলে, অথবা চাষিকে ‘ছোট’ বলে ভাবতে শিখিয়েছে। তাচ্ছিল্য করতে শিখিয়েছে। ‘অন্নদাতা’, ‘অন্নপূর্ণা’ ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার কেবলই বাংলা রচনার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থেকেছে। ‘চাষাভুষো মানুষ’ বলে অপমান করতে পেরেছি বলেই না আমরা আধুনিক ভদ্দরলোক হলাম। এখনও তাই দেশ-দুনিয়ার এই ছড়িয়ে পড়তে থাকা যে কৃষক-অভ্যুত্থান, কাঠবেড়ালি হয়েও আমরা সেই আন্দোলনের সেতুবন্ধনে সামিল হতে পারব না। কেবল গলাবাজি করে কলম চালাতে পারব। তলিয়ে ভাবব না, ৮০০ কোটি মানুষের গলাবাজির প্রয়োজনে যাঁরা অন্নের জোগান দেন, বিশেষ করে এদেশেরও ১৪০ কোটি মানুষের পেটে যাঁরা রোজকার ভাতের জোগান দেন, তাঁদের প্রয়োজনেও যদি আমরা তাঁদের পাশে এসে না দাঁড়াই, অথবা সরকারে থেকেও যদি আমরা নির্লজ্জভাবে সেই অন্নদাতাদেরই অপমান করে চলি, আঘাত করে চলি— তবে সেই সমাজ বা সভ্যতার ‘সভ্য’ বলে পরিচয় দেওয়ারও আর কোনও অধিকার অবশিষ্ট থাকে না। সে তখন ক্রমশই আত্মধ্বংসী, নির্ধারিত পতনের অভিমুখেই স্বপ্নের ঘোরে হেঁটে চলতে থাকে।
*মতামত ব্যক্তিগত