নূপুর রায়চৌধুরী
ব্যাপারটা খুব বেশিদিন আগেকার নয়, ২০২৩-এর সেপ্টেম্বর মাসের ১২ তারিখ, কংগ্রেস অফ দ্য ইউনিয়ন মানে মেক্সিকান পার্লামেন্টে চলছে এক গুরুত্বপূর্ণ সরকারি কার্যসূচি— ইউএফও (আন-আইডেন্টিফায়েড ফ্লাইং অবজেক্ট)-এর উপর জনসাধারণের শুনানি। এরই মধ্যে মেক্সিকান বিজ্ঞানীরা কাচের ঢাকনাওয়ালা কফিনের মতো একজোড়া কাঠের বাক্স নিয়ে এসে সোজা সেখানে হাজির। বাক্সের ভিতরে শোয়ানো রয়েছে মমি করা, ধুলোমাখা, দুটো মৃতদেহ। সবাই তো অবাক। তা বিজ্ঞানীরা জানালেন যে, প্রাচীন নাজকা লাইনের কাছে, পেরুর কুসকো শহর থেকে, ২০১৭ সালে উদ্ধার করা হয়েছে ওগুলো। বিজ্ঞানীদের দাবি: এই দুটো মৃতদেহ ওরফে নাজকা মমি, এক হাজার বছরের পুরনো, এবং পৃথিবীর কোনও পরিচিত প্রাণীপ্রজাতির অংশ নয় সেগুলো। তাই শুনে, হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সবাই মমি দুটো দেখার জন্য, যাকে বলে এক্কেবারে ঠেলাঠেলি কাণ্ড। হ্যাঁ, দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব প্রাচীন— সঙ্কুচিত, বিকৃত, কুঁচকে যাওয়া ভারী অদ্ভুত দুটো দেহ, সবাই শিউরে উঠল— জলের পাইপের মতো প্যাঁচানো ঘাড়ে লম্বাটে মাথার খুলি, মানুষের মৃতদেহের থেকে আলাদা, হাতে তাদের পাঁচটির পরিবর্তে তিনটি করে আঙুল, অনেকটা সেই স্পিলবার্গের ইটি-র মতো দেখতে। স্প্যানিশ নিউজ ওয়েবসাইট ‘মার্কা’ বিশ্বের সামনে এই প্রতিবেদনটা সম্প্রচার করা মাত্রই সোশাল মিডিয়ায় তা ভাইরাল হয়ে গেছে। এই সমস্ত উপস্থাপনাটার পুরোভাগে ছিলেন মেক্সিকান সাংবাদিক, টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, ইউএফওলজিস্ট জেমি মৌসান, যিনি কয়েক দশক ধরেই বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা নিয়ে গবেষণা করছেন। মৌসান নমুনাগুলোর উত্স সম্পর্কে হলফ করে বলেছেন যে, সেগুলো ডায়াটম খনিতে জীবাশ্মরূপে পাওয়া গিয়েছে, তারা অ-মানবীয় এবং আমাদের পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে। এ কথা শুনেই সবাই প্রশ্ন করে, কী করে বোঝা গেল যে ওগুলো পৃথিবীর বাইরের বস্তু? এর উত্তরে মৌসান বলেছেন যে, সম্প্রতি ইউএনএএম (ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অফ মেক্সিকো)-এর বিজ্ঞানীরা নমুনাগুলোর রেডিওকার্বন ডেটিং এবং ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করেন। দেখা গেছে যে, সেগুলোর ডিএনএর প্রায় এক-তৃতীয়াংশই অজানা উৎসের। আর তা থেকেই তাঁরা সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, মৃতদেহগুলো “আমাদের পার্থিব বিবর্তনের অংশ” নয়। নড়েচড়ে বসলেন এবার সকলে! তবে কি সত্যি সত্যিই এরা সেই ভিনগ্রহের প্রাণী মানে এলিয়েনদের কেউ, ওই যারা ইউএফও বা উড়ন্ত চাকি চড়ে মাঝেসাঝে আমাদের পৃথিবীতে বেড়াতে আসে? ওহ, পুরো ঝিনচ্যাক আবিষ্কার আর কি!
অবশ্য, আমেরিকান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা, নাসার বর্তমান প্রশাসক সেনেটর বিল নেলসন এ ব্যাপারে মন্তব্য করেছেন যে, ইউএফও নিয়ে গবেষণা করার জন্য আরও অনেক উন্নত বৈজ্ঞানিক পরিকাঠামো দরকার, স্যাটেলাইট ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের ব্যবহারের প্রয়োজনও রয়েছে। অজ্ঞাত অস্বাভাবিক ঘটনা ওরফে ইউএপিগুলোর বহির্জাগতিক উত্স রয়েছে, অথবা ইউএফও-র সঙ্গে এলিয়েনের যোগ আছে, সে বিষয়ে নাসা কোনও প্রমাণ পায়নি। তবে হ্যাঁ, নেলসন এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, কোটি কোটি গ্যালাক্সি ও তাদের মধ্যকার কোটি কোটি নক্ষত্র রয়েছে, তাদের কোনও একটাতে আরেকটা পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকতেই পারে।
হ্যাঁ, এই যৌক্তিক সম্ভাবনার কথা উড়িয়ে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না কিন্তু, মুশকিল হচ্ছে নাজকা মমির সারা ভিডিও জুড়ে মৌসানের ওই যে জ্বলজ্বলে উপস্থিতি, সেটাই আমাদের ভাবিয়ে তোলে, পুরনো ঘটনাগুলো মাথার ভিতরে কিলবিল করে ওঠে। মমি প্রতারণার বিষয়ে মৌসানের দিকে অতীতে বহুবারই সাংঘাতিক অভিযোগের আঙুল উঠেছে। যেমন ধরুন “আটাকামা হিউম্যানয়েড” বা “আটা” নামে পরিচিত মমির বেলায়। মমিকৃত সেই দেহটার সন্ধান মিলেছিল চিলির আটাকামা মরুভূমিতে। সেবারও মৌসান মমিটিকে বহির্জাগতিক সত্তা হিসাবে ব্যাপক প্রচার ও প্রদর্শন করেছিলেন। মমিটির ছোট আকারের শরীর এবং অস্বাভাবিক চেহারার কারণে প্রথমে সবাই সে-সম্পর্কে দারুণ মনোযোগী এবং কৌতূহলীও হয়ে উঠেছিল, কিন্তু ডিএনএ বিশ্লেষণ এবং অধ্যয়ন-সহ পরবর্তী নানা বৈজ্ঞানিক তদন্ত থেকে বোঝা যায় যে, মমিটি আসলে একজন মানব মেয়ের, যে সম্ভবত জন্মাবার আগেই বা জন্মের পরপরই মারা যায় এবং বিভিন্ন জেনেটিক মিউটেশনের কারণে তার শরীর স্বাভাবিক চেহারা হারায়। মৌসান “মেটেপেক ক্রিয়েচার” নামে একটি অদ্ভুত নমুনারও প্রচার করেছিলেন পরবর্তীতে যেটা একটা ছাল-ছাড়ানো বানর বলে প্রমাণিত হয়।
২০১৫ সালে মৌসান “বি উইটনেস” নামক একটা ইভেন্টের নেতৃত্ব দেন যেখানে “রোজওয়েল স্লাইডস” নাম দিয়ে মমি করা এক দেহের ছবি দেখিয়ে, তা এক এলিয়েন শিশুর বলে দাবি করা হয়েছিল। পরে শনাক্ত হয় যে সেগুলো ২-বছরের এক মানবছেলে ব্যতীত আর কারও নয়। ২০১৬ সালে একটা “দানব পরী” (“ডেমন ফেয়ারি”) আবিষ্কার করার দাবি করেন মৌসান যেটা আসলে একটা বাদুড়, গোটাকতক কাঠের লাঠি, অদৃশ্য ইপোক্সি আঠা এবং জোচ্চুরি করার জন্য ডিজাইন করা অন্যান্য আরও কিছু অজানা উপাদান দিয়ে বানানো বলে ধরা পড়লেও, সেটা কিন্তু ১০,০০০ ডলারে জিনিসটাকে বিক্রি করে দেওয়ার আগে পর্যন্ত নয়। এবার নিশ্চয়ই আর বলে দিতে হবে না, নাজকা মমি নিয়ে লোকেদের কেন এত সংশয়।
হ্যাঁ, এবারও ব্যাপারটা ওদিকেই গড়িয়েছে। ইউএনএএম-এর ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমির বিজ্ঞানী জুলিয়েটা ফিয়েরো বলেছেন যে মৌসানের পাঠানো নমুনাগুলোর পরীক্ষানিরীক্ষা থেকে রহস্যজনক এমন কিছুই পাওয়া যায়নি, যা নির্দেশ করতে পারে যে, পৃথিবীতে বিদ্যমান নেই তেমন কোনও জীবন-যৌগ সেগুলোতে আছে। তিনি আরও বলেন যে ইউনিভার্সিটির কার্বন-১৪ গবেষণা থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, আলাদা আলাদা সময়ে মারা যাওয়া ভিন্ন ভিন্ন মমির মস্তিষ্ক এবং ত্বকের টিস্যুর সঙ্গে মৌসানের নমুনাগুলোর মিল পাওয়া গিয়েছে। মৌসানের নমুনাগুলোর বহির্জাগতিক উৎসের দাবিকে বিশ্ববিদ্যালয় কখনওই সমর্থন করেনি। আর মৃতদেহগুলো পেরু থেকে কীভাবে মেক্সিকোতে এল সেই প্রশ্নেরও কোনও সদুত্তর তাঁরা জানেন না। সব ব্যাপারস্যাপার দেখেশুনে এটা বুঝতে কষ্ট হয় না যে, মৌসানের উপস্থাপিত মমিগুলো মোটেই ভিনগ্রহের প্রাণ নয়, সম্ভবত প্রাক-কলম্বিয়ান মানুষের দেহাবশেষ ও পশুর হাড়গোড় মিলিয়েমিশিয়ে একত্রিত করে তারপর কোনও এক ধরনের প্লাস্টার দিয়ে জোড়া লাগিয়ে তৈরি করা এক বিস্তৃত প্রতারণা। মেক্সিকোর বাক্সবন্দি এলিয়েনদের পিছনে আসলে লুকিয়ে রয়েছে মানুষের লোভ, জালিয়াতি, কয়েক শতাব্দীর বর্ণবাদ, এবং কিছু ক্ষয়প্রাপ্ত কঙ্কাল। মনে প্রশ্ন আসে: মানুষ কেন এরকম বিশাল জালিয়াতির সাহায্য নেয়? একটা অদ্ভুত বিস্ময়কর জিনিস দেখিয়ে সকলকে চমকে দেওয়ার জন্য? কিন্তু কী হবে যখন চমকের খোঁজে নির্লজ্জ সুবিধাবাদ এবং ভুল তথ্যের পাহাড়কে কাজে লাগানো হয়? এই পুরো ব্যাপারটার একটাই অর্থ দাঁড়ায়— ইচ্ছাকৃতভাবে, অতীতকে অসম্মান করা, বিকৃত করা। খুবই চিন্তার কথা যে, পেরু এবং দক্ষিণ আমেরিকায় এরকম ভেজাল দিয়ে তৈরি করা নকল মমি রমরমিয়ে হাতে হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইসব বেআইনি খনন এবং জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের অপব্যবহার বন্ধ হওয়া আশু প্রয়োজনীয়।
তথ্যসূত্র:
- Garrison, Cassandra. ‘Alien bodies’ presented in Mexican Congress panned as ‘stunt’. Reuters. September 15, 2023.
- Romano, Aja. The true story of the fake unboxed aliens is wilder than actual aliens. Vox. September 16, 2023.