গৌতম চৌধুরী
কবি ফল্গু বসুর অসময়োচিত মৃত্যু, তাঁহার প্রিয় পরিজন ও সুহৃদদের কছে নিঃসন্দেহে এক শোকাবহ দুর্ঘটনা। বাংলা কবিতার পাঠকের কাছেও ইহা এক অপরিমেয় ক্ষতি। কিন্তু বেহুঁশ মানুষ যেমন তাহার অসাড় স্নায়ুতে কোনও বেদনা টের পায় না, ফল্গুকে লইয়া আমাদের, বাঙালি পাঠকদেরও, সেই দশা। আর সেই জন্যই আমাদের তরফে এইই হইল সেই সময়, যখন এক অলুণ্ঠিত রত্নভাণ্ডারের গুহামুখ আবিষ্কারের মায়াবী হাতছানির ডাকে আমরা সাড়া দিতে পারি। এইই হইল সেই সময়, যখন আমরা আর একবার এই কথায় ইমান রাখিতে পারি যে, শারীরিক অন্তকালের পরেই একজন প্রকৃত কবির কবিসত্তার পুনরুত্থান ঘটে। বিশেষত ফল্গু বসুর মতো অনাবিষ্কৃত একজন কবির বেলায় এই কথা আরও নির্মমভাবে সত্য। আবিষ্কৃত কবিদের ক্ষেত্রে, প্রক্রিয়াটি কিছুটা হইলেও, বিড়ম্বিত। ইতোমধ্যেই চর্বিত চর্বণে অপচিত হইবার কারণে, পাঠকতার নতুনতর দৃষ্টিভঙ্গির জন্য তাঁহাদের এন্তেজার করিতেই হইবে। সেই দিক দিয়া ফল্গু বসুর হারাইবার কিছুই নাই, জয় করিবার জন্য পড়িয়া আছে পুরা আগামী সময়।
এখন হইতে ১০/২০ বছর আগে হইলে, এই কথা লইয়া জবরদস্ত বিস্ময় প্রকাশ করিতাম যে, ফল্গুর মতো এমন একজন মৌলিক কণ্ঠস্বরের কবি, বঙ্গীয় পাঠকসমাজের কাছে এহেন বেদিশা রহিলেন কেমনে। সেই সূত্রে এই ঘটনাক্রমের উল্লেখও অবান্তর হইত না যে, কাব্যরুচি নিয়ন্ত্রণের প্রাতিষ্ঠানিক খাঁচাকলটির দৌরাত্ম্য প্রায় আধা শতক ধরিয়া নানা ধুরন্ধরের ব্যবস্থাপনায় এই বাংলায় জম্পেশভাবে সক্রিয় ছিল। ফল্গু সেই পিঁজরাপোলে জবাই হইতে দৌড়ান নাই বা তাহার খোচরদের হাতে ধরাও খান নাই। হয়তো ৫০ বছর পূর্বের বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ সংলগ্ন কর্মকাণ্ডের সহিত কিছু দূর সংসর্গের ফলে, তাঁহার ভিতর এই আত্মরক্ষাপ্রবণতা পয়দা হইয়াছিল। এই মতিচ্ছন্নতার শাস্তি তো কিছুটা পাইতেই হইবে। কিন্তু এই ক্ষীণায়ু জীবনের শেষ পর্বে তিনি যে স্বেচ্ছানির্বাসনের তরিকা বাছিয়া লইয়াছিলেন, তাহাতে বুঝা যায়, স্ব-ভাবের দুশমনি করা কবিসত্তার সাধ্য নহে। ফল্গু বসুর কবিস্বভাবই তাঁহাকে যেন এক কেন্দ্রাভিগ শক্তিতে লোকচক্ষুর আড়ালে বসতি করাইল। নহিলে আখেরি কবিতাবহিটি প্রকাশের পর এতগুলি বছর তাঁহার আর কোনও সাড়াশব্দ নাই। সেও আজি হইতে প্রায় ২৫-১৫ বছর আগে লিখা ২৪টি কবিতার এক সংকলন। আর, সে কবিতাবহির নাম হইল-– করতলে ভাগ্যরেখা নেই (২০০৯)! বস্তুত, ফল্গু নিজেই নিজের কররেখাগুলি আঁকিয়াছেন, বলা বাহুল্য ধারালো কোনও শলাকা এন্তেজাম করিয়া। সেই শলাকাটি হইল, কবিজনোচিত এক পবিত্র ক্রোধ। প্রসঙ্গত মনে পড়িয়া যায়, তাঁহার পহেলা কবিতাবহির নামটি ছিল অবাধ্যের পুঁথি (১৯৮৯)।
কিন্তু অবাধ্যের পুঁথি-রও আগে, ফল্গুর দোসরা বহি অক্ষরবল্কল-এর (১৯৯১) কিছু কবিতার কথা শুরুতেই আসিয়া যায়। কারণ প্রকাশকালের বিবেচনায় কবিতাগুলি অনুজ হইলেও, জন্মসূত্রে প্রাচীনতর। দেখিতেছি, লেখালেখির সেই আদিপর্বেই ফল্গু এক স্তব্ধ দুর্গমের তালাশে বনান্তরালগামী-–
১. ঘুমের অনন্ত দেহ আমাকে ধীবর করে দাও
ঝুলন্ত আকাশ দেখে জীবন ধারণ করে যাই। –জলস্তম্ভ, ৭.৫.৭৫
২. কথা বলতে পারেন না এমন বীজবপনকারী
একদা এখানে ছিলেন বলে জানা যায়;
ধুলো রঙের ঘোড়ায় চড়ে নীল চক্ষু উড়ে যেতেন
বনের ভেতর
স্তব্ধ দুর্গমের খোঁজে। –সীমানাচিহ্ন, ১০.২.৭৬
৩. শূন্য পথের শূন্য ভেঙে লাঞ্ছনাকে আমি
উড়িয়ে দেব গানের মত। –স্বরলিপি, ১৭.৫.৭৭
লাঞ্ছনাকে গানের মতো উড়াইয়া দিতে গেলে, পথিকতার সঠিক সুলুক জানা প্রয়োজন। পথের সেইসব ইশারা, যাহাতে মুহূর্তের সত্যগুলি জুড়িয়া জীবনের সত্যে পৌঁছানো যায়, ফল্গু কিছুদিনের মধ্যেই সেই অনুধ্যান আমলে নেন–- ‘পথের সন্ধান জানে এমন পথিক আজ শুধু/ ভাঙা ছবি জোড়া দিয়ে নিজের বানানো গান গায়’ (ভাঙাছবি, ১১.৬.৮০)। এবং মাত্র ২৯ বছর বয়সেই তাঁহার কণ্ঠে বাজিয়া উঠে সেই জীবনসংগীতের নিষ্ঠুর নৈর্ব্যক্তিকতা-– ‘লাঙললালিত গ্রাম অপেক্ষায় থাকে আজীবন।/ উদাসীন চোখ বুজে মাটির অস্পষ্ট মূর্তি ভাবে/ ধানের নগরে পূর্ণিমায় একদিন আমাকেও/ অসমাপ্ত খেলাধুলা ফেলে চলে যেতে হবে একা’ (প্রতিমা, ৯.৬.৮৫)।
তবু মানিতেই হয়, সূচনালগ্নের এক দীর্ঘতর কালক্রমের রচনা (১৯৭৫-১৯৮৭) বলিয়াই হয়তো অক্ষরবল্কল অংশত শিথিলবিন্যাস। কিন্তু অবাধ্যের পুঁথি-র (রচনাকাল : মার্চ ১৯৮৭-অক্টোবর ১৯৮৮) পুরা পরিকল্পনাটিই আমাদের চমকিত করে। পিঁপড়া, মাছ, চামচিকা, শুঁয়াপোকা, কেঁচো, উকুন, ফড়িং-– এইরূপ সব নগণ্য প্রাণীরা এইখানে বিভিন্ন কবিতার কথক। ইহাদের বয়ানে, একটি চিরচেনা অথচ আড়ালে-পড়িয়া-থাকা জগত ফল্গু আমাদের সামনে মেলিয়া ধরেন। যেমন-–
মাছের চিকিৎসা হয় জলের ভেতরে
শ্যাওলায়
অস্পষ্ট বুদ্বুদ তুলে শুয়ে থাকে
অসুস্থ মাছেরা।
জলে সূর্য প্রদীপের কাজ করে
স্বপ্নের উত্তাপ পেলে
স্রোতের বিরুদ্ধে মাছ
সহজেই চিনে নেয় পথ।
মাছের অসুখে জল
শব্দ করে না ব’লে মাছেরা নিশ্চিন্তে শোয়
শ্যাওলায়
ওষুধের বিছানায়
অন্ধকার জলে
মাছেরা ঘুমের মধ্যে
আলো দেখতে পায়।
–মাছ
কখনও কখনও আবার সেই অপর দুনিয়ার স্বরে যেন ভাসিয়া উঠে আমাদেরই আপন সমাজবাস্তব-–
১.
বিষ সকলেরই আছে সে বিষ নিজের দিকে অথবা নিজের মতো কারো
প্রতি ঢালা ক্ষতিকর, এই চিন্তা গুটিপোকা বহু কষ্টে আয়ত্ত করেছে
–গুটিপোকা
২.
ছাপোষা ভ্রমর আমি সেই কালোভ্রমর নই গো
কিশোর বয়সে শুধু কিছুকাল ইচ্ছে হয়েছিলো
ঈগলের জাল থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করে যাবো
ইচ্ছে না রোমাঞ্চ তাও ভালো করে বুঝতে পারিনি
–ভ্রমর
৩.
আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরি
থানার দেওয়ালটাকে একবার পাক মেরে দেখি
ফাটলের চারাগাছ কেউ উপড়ে ফেলেছে কি না।
চারাগাছ ভালো আছে দেখে থানার দেওয়াল থেকে
ইচ্ছে করে পড়ে গিয়ে আরো বেশী শক্ত হতে চাই।
–শামুক
আদিপর্বের এইসব কবিতা হইতে সামান্যই ব্যবধানে করতলে ভাগ্যরেখা নেই-এর কবিতাগুলির সূত্রপাত। এবং পুরা একটি দশক ধরিয়া (১৯৯২-২০০২) তাহার বিস্তার। বিভাব কবিতাটি বাদ দিলে ২৩টি কবিতার শীর্ষে বহাল হইয়াছে-– মাটিয়ারি, দেবগ্রাম, ঝামটপুর, সন্দেশখালি, বলাগড় ইত্যাকার বাংলার ২৩টি স্থাননাম। মনে হয়, এইসব জায়গাগুলির আপাত স্থানাঙ্ক অবলম্বন করিয়া কবি সেই আবহমান বাংলার হৃদয়, মনন, স্মৃতি, সংরাগের ছায়ালোকের ভিতর দিয়া আমাদের লইয়া যাইতে চান, যাহা আমাদের যৌথ অবচেতনের ভিতর ঘুমাইয়া আছে, শ্বাস প্রশ্বাস নিতেছে। উপনিবেশের বজ্র-আঁটুনিতেও যাহা মরিতে মরিতে বাঁচিয়া আছে-– ‘ঝামটপুরের করতলে ভাগ্যরেখা/ ছিল না বলেই ক্রমাগত মনে হচ্ছে/ আমি অনুপস্থিত ছিলাম, মনে হচ্ছে কৃষ্ণদাস কবিরাজ/ জানতেন, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলেও/ চৈতন্যের আদেশেই প্রাতঃভ্রমণ গ্রামের অভ্যাস’ (ঝামটপুর)।
তাই বলিয়া কবিতাগুলি কোনও পর্যটক কোম্পানির ঐতিহ্য-সফরের প্রচারণা মাত্র, এমন ভাবিবার কোনও কারণ নাই। আসলে, সময়ের সাথে সময়ান্তরকে সংলগ্ন করিবার এক আকুতিতে কবি এইখানে আপামাথা গ্রস্ত। এই প্রসঙ্গে কবি নিজেই কবুল করিয়াছেন-– ‘…অস্থির রোমাঞ্চ কিছুতেই ভালো বুঝতে পারি না/ যতটা প্রকাশ করি, চতুর্গুণ বাকি থেকে যায়’। এই কবিতার স্ফূরণ হয়তো খানিক অ-জ্যামিতিক দিনলিপির মতো। নিটোল কবিতাপাঠে অভ্যস্ত পাঠককে এই আপাত-অবিন্যাস কিছুটা দিগভ্রান্ত করিতেই পারে। একটু খেয়াল করিলে দেখা যায়-– ঐতিহাসিক অতীত, অব্যবহিত বর্তমান আর কবির বিমূর্ত অনুভাব, এই তিনটি তলের সাথে সম্পর্কিত তিনধরনের বাচন কবিতাগুলিতে আশ্চর্য আসঞ্জনে মিশিয়াছে। এই বহি হইতে একটি কবিতা পড়িয়া লইলে হয়তো ব্যাপারটি আমাদের কাছে কিছুটা স্পষ্ট হইতে পারে-–
রাজা দেবপাল প্রতিষ্ঠিত জনপদ আজ দেবগ্রাম নামে
পরিচিত। মৃৎপাত্রে চক্রের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ
কীভাবে গড়ের জন্ম, কুম্ভকার সে রহস্য প্রকাশ করেনি।
সতর্কগড় যেন বা দুর্গ, ঝড় এলে উচ্চাশার দীর্ঘ চাপে
কাহিনি গল্পের মতো। রানাঘাট সদর থানার অধীনস্থ
এই গ্রামের শিশুরা; ধবধবে সাদা চুল, কপালে তিলক
হাতে হুঁকো, মাথা নাড়া বৃদ্ধ পুতুলের জন্য কেন আকর্ষণ
অনুভব করে সে সম্পর্কে কোনও লিখিত প্রমাণ কাছে নেই।
প্রাসাদের নিরীক্ষণচূড়াগুলি বহু কাল টিকে ছিল বলে
স্থানীয় লোকেরা বেশ কিছু ঢিবির তলায় রাজকোষাগার
আছে ধরে নেয়। যেকোনও কারণে বাংলার সব গ্রাম দেবগ্রাম
শুধু শিশুদের সঙ্গে যদি মাথা নাড়া বুড়োও সম্মতি জানায়।
–দেবগ্রাম
আমাদের মনে হইতেই পারে, এই কবিতার প্রথম বাক্যটি যেন কোনও প্রবন্ধ হইতে ঝরিয়া পড়িয়াছে। অথচ ছেদচিহ্নের পরেই পাইতেছি এমন একটি আপ্তবাক্যসুলভ উক্তি—‘মৃৎপাত্রে চক্রের ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ’! যাহার সহিত রাজা দেবপাল বা দেবগ্রাম পত্তনের ইতিহাসের কোনও আশু সম্পর্কই নাই। আরও রহস্যময়ভাবে একলপ্তেই পরের পঙ্ক্তিতে কবি শুনাইলেন-– ‘কীভাবে গড়ের জন্ম, কুম্ভকার সে রহস্য প্রকাশ করেনি’। কেমনে কী! ইহার পর আবার আসিয়াছে, গ্রামের শিশুদের কথা, মাথা-নাড়া বৃদ্ধ পুতুলের কথা, ঢিবির তলায় রাজকোষাগারের সম্ভাবনার কথা। এবং শেষ পর্যন্ত এমন এক উপপত্তি, যে, বাংলার সব গ্রাম দেবগ্রাম।
প্রায় একই ভাবে নারিকেলবেড়িয়া নামের কবিতাটিতে জানিতেছি, ‘বিশ্বাস বা কিংবদন্তী তিতুমীর এখানে ছিলেন, ছিল বাঁশের কেল্লাও’। বিবৃতিসুলভ এই ঐতিহাসিক প্রসঙ্গের উল্লেখের পাশাপাশি ফের একই নিশ্বাসে হাজির এই অপ্রাসঙ্গিক বয়ান– ‘সলতে জ্বালিয়ে সন্ধে দিলে ঈশ্বরের চিঠি আসে পাশের বাড়িতে’ আমাদের হতচকিত করে। কিন্তু আমাদের বিস্ময়ের আরও বাকি থাকে, যখন তাহার পরেই পড়ি-– ‘ও বাড়ির তরুণেরা এত ভালো/ সকলেরই ফুটবলের নেশা। কখনও বা ইচ্ছে হলে ঘুড়িও ওড়ায়’। ইহাই হইল ফল্গু বসুর জাদু!
বাংলার সুদূর বা নিকট ইতিহাসের এইরকম বেশ কিছু কীর্ণ কণিকা এই বহিতে ছড়াইয়া আছে। উপরে যেমন দেখিলাম, বিচ্ছিন্নভাবে তাহাদের কিছুটা ব্যঞ্জনাহীন সংবাদের মতো লাগিতেই পারে। যেমন-–
১. যেতে যেতে খুঁজে পাই প্রতিবেশী ঈশা খাঁর বাড়ি। (বিভাব কবিতা)
২. নিকটস্থ চাঁদবিলে চাঁদ সওদাগরের নৌকাডুবি হয়েছিল বলে শোনা যায় (মাটিয়ারি)
৩.ওলন্দাজ পর্তুগিজ ফরাসি ইংরেজ সকলের চোখই বলাগড় শোনামাত্র লোভে চকচক করত একদা। (বলাগড়)
৪. হরিশ মুখুজ্যেও নীলকুঠির অত্যাচার এবং বিক্ষোভ আন্দোলনের খবর পেতেন খোদ দীনবন্ধু মিত্রের কলমে, সংযোজনসহ (পানপাড়া)
৫. শোনা যায়, করুণানিধান কিছুকাল কাছাকাছি খুব একাকী ছিলেন (বিরহী)
৬. শুনেছি অতীশ দীপঙ্কর করোটি গুহার পাশে বৌদ্ধ উপাসনাস্থল প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী ছিলেন। (জয়ন্তী)
৭. মনোনীত স্থানটিতে এসে জানলাম, এখানেও কামিনী রায়ের নামে স্কুল আছে। (উষাগ্রাম)
৮. এখনও সন্ধ্যার দিকে জলে মন দিলে রামপ্রসাদের গান ধীরে, আত্মার ছায়ায় পরিষ্কার টের পাওয়া যায়। (হাভেলি শহর)
৯. তিতাস লেখার আগে অদ্বৈত মল্লবর্মণ এই গ্রামে নির্জনে ছিলেন কিছুদিন (কলমবাগান)
বিবৃতিমূলক এই বাক্যগুলি যেন সুস্বাদু কোমল পানীয়ের উপর ভাসমান কঠিন বরফটুকরার মতো। আপাতভাবে মনে হইতে পারে যেন কবিতার সাথে কুটুম্বিতাহীন তথ্যখণ্ডের মতো উহারা কাব্যশরীরে উপর উপর ভাসিতেছে। কিন্তু কবিতাটি আস্বাদনের অবসরে উহারা পাঠবস্তুতে পুরাই বিলীন হইবে। এবং আমরা পাইতে থাকিব এমন সব বৈদ্যুতিন উচ্চারণ-–
১. আজ্ঞা করো বাহুবল, সুতো ছেড়ে অসুস্থ আলাদা হয়ে যাক।
ভিজে যাচ্ছে দিন
বালকবেলার গভীর বন্ধুত্ব মনে রাখা বিরল ঘটনা
অথচ সন্দেশখালি এই ক্ষেত্রে অনেকের চেয়েই আলাদা।
–সন্দেশখালি
২. গত রাত্রে আমি খুব আস্তে আস্তে নিজের শরীরে
নিশিগঞ্জের আত্মাকে ঢুকিয়ে দিয়েছি। ব্যাপারটা
করা যত শক্ত তার চেয়ে বলা অনেক সহজ।
–নিশিগঞ্জ
৩. নখচিহ্ন প্রান্তর পাল্টাচ্ছে
দূর থেকে দেখে মনে হবে অভিভাবক তালগাছ নিজ দায়িত্বে
গ্রাম পাহারা দিচ্ছেন।
–কানসোনা
৪. লাঙললালিত গ্রাম, অন্ধ চলে দিক্চিহ্নহীন
বায়ুশূন্য মেঘশূন্য পানিশূন্য মনের গহনে
আমিও দেখেছি তাকে, লোকে যাকে দ্যাখা যায় বলে।
–ব্রহ্মশাসন
৫. আজ অব্দি অক্ষরের জখম সারেনি; শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে
অভিযুক্ত পথ চলছে একা।
–পলাশী
৬. একা একা
হেঁটে চললে ভেতরে আশ্চর্য আলো জ্বলে ওঠে। কখনওসখনও
নিজেকেও পথের অতিথি ভেবে খুশি হই।
–উষাগ্রাম
৭. খেলাচ্ছলে ভুলে যাচ্ছি অন্তর্জগতে বিকল্প খোঁজবার
এক্তিয়ার শুধুমাত্র গ্রীষ্মবাতাসের।
…
জ্যামিতিকে জব্দ করা আগুনের কাজ
–কামারপুকুর
৮. তদ্ভব আবেগে উৎসারিত বিস্ময়কে
অক্ষর বানানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।
–কলমবাগান
নমুনা আর না বাড়াই। তাহা ছাড়া এইরকম ঠুকরানো উপাদান দিয়া কবিতাকে আমলে লইবার কোশেশ করা কবির প্রতি এক ঘোর অবিচার। এ বিষয়ে কবির নিজেরই একটি হুঁশিয়ারি আমরা স্মরণে রাখিতে পারি—
… শুধু জেনে রেখো
মনোযোগ চট ক’রে নোঙর ফ্যালে না। সহ্য হচ্ছে
ব্যবহারবিধি; আমি কেন, জন্মদিনও দ্যাখেনি নিজেকে
সম্পূর্ণ চেহারা যার সে আসলে বোধের অতীত।
–ব্যান্ডেল
মনে হয় ফল্গু জানিতেন তাঁহার প্রতি আমাদের মনোযোগ চট করিয়া নোঙর ফেলিবে না। তাই তিনি অত্যন্ত গোপনে এক অনন্ত ভাষা, অবিভক্ত ভাষার দিকে তাকাইয়া নিজেকে বিস্তারিত করিয়াছিলেন। চামটার বিলের ধারে গাছতলায় বসিয়া একদিন তাঁহার মনে হইয়াছিল– ‘আমাকে বাংলায় উজবুক বলো ক্ষতি নেই, কিন্তু/ …দেশ ভাগ হলেও অনন্ত ভাষার কল্যাণে/ সম্পূর্ণ বুদ্বুদ এই ছায়াচোখ এবং মাথা আকাশ অবধি’। বা, অন্য কখনও ভাবিয়াছেন-– ‘জাগরণ কথা বলে অবিভক্ত পুরানো ভাষায়’। আজ দেখিতে পাই, আমরা আমাদের নীরবতা দিয়া প্রকারান্তরে তাঁহাকে ‘উজবুক’ বলিলেও, বাংলাদেশের তরুণ কবি এবং কবিতাপাঠকেরা আন্তর্জালের বদৌলতে ফল্গুকে বরণ করিয়া নিয়াছেন। মনে পড়িতেছে, বাংলাভাষার একজন প্রধান কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ সেই কবেই (১৯৯৩) ‘চির বন্ধু, চির নির্ভর’ সম্বোধনে ফল্গুকে উদ্দেশ্য করিয়া কবিতা লিখিয়াছিলেন।
আজ আমাদেরও সময় হইল, এই চিরবন্ধু চিরনির্ভর কবিটিকে চিনিয়া লইবার। তাঁহার সমস্ত প্রকাশিত এবং অগ্রন্থিত কবিতাকে এক মলাটে বাঁধিবার দায়িত্বটি কাঁধে তুলিয়া লইবার। তাঁহার সমসময় যাহা হারাইয়াছে হারাইছে, তরুণ প্রজন্ম যেন বাংলা কবিতার এই সম্পদ হইতে বঞ্চিত না হয়।