বর্ণালী মুখার্জী
কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি বিজেপির মতাদর্শ বা অ্যাজেন্ডা নয়। কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি, কৃষির শিল্পায়ন তাদের মতাদর্শের ঠিক বিপরীত। আধুনিক কৃষিসমাজ তারা কল্পনাও করে না। কৃষককে কৃষি উৎপাদন থেকে সরিয়ে দাঙ্গাকারী, অগ্নিবীর সেনা, ইজরায়েলে যুদ্ধে পাঠাতেই তাদের আগ্রহ বেশি। তারা কৃষির সঙ্গে যুক্ত আজকের ভারতের ৫০-৫৫ শতাংশ মানুষকে ফ্যাসিবাদের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। কৃষিলবি যদি তাদের পক্ষে না দাঁড়ায় তবে তাদের যুগ ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য। আর বর্তমান ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষিলবি তাদের দিকে নেই। চৌধুরী চরণ সিংকে ভারতরত্ন দিলেও নেই। তাই দেশের হরিয়ানা পাঞ্জাবের কৃষিলবির বদলে নতুন লবি গড়ে তুলতে হবে। যারা আদানির ভৃত্য হতে রাজি। যারা মোদি-সার্টিফায়েড হিন্দুত্বের ফর্মুলায় কৃষিকাজে রাজি। তাই উচ্চফলনশীল প্রক্রিয়ায় যুক্ত স্বাধীনচেতা কৃষকদের কোনঠাসা করতে হবে তাদের
একুশ বছরের শুভকরণ সিং। যে ছিল তার পরিবারের একমাত্র রোজগেরে। আড়াই একর জমি তাদের, বাড়িতে মানসিক ভারসাম্যহীন বাবা, ঠাকুমা, দুই বোন, একজন উচ্চমাধ্যমিক ছাত্রী। স্বাধীনচেতা কৃষক। যার উদ্দেশ্য ছিল যেটুকু জমি আছে সেটাতেই লাভজনক কৃষি উৎপাদন করা। উৎপাদন বাড়ানো। কিন্তু এমন কৃষকসমাজ বিজেপি চায় না। পুলিশের গুলিতে শহিদ হল সে।
বিজেপি একটি ফ্যাসিস্ট দল। অর্থাৎ ওদের ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখে ফসলের দর পাওয়ার কথা মনে আনাও পাপ। কেউ কেউ হয়তো বলবেন যে বিজেপি সরকার কৃষক আন্দোলনের চাপে মাথা নত করে কৃষি বিল প্রত্যাহার করেছিল। ফলে জোরকদমে আন্দোলন হলে এমনকি মোদি সরকারও মানতে বাধ্য। ফলে সরকার বদল কৃষকের স্বার্থে অপরিহার্য নয়, যদি এমন ভাবনা মনে স্থান পায় তবে সেটা ভয়ানক বিপদের।
সরকার ২৩টা ফসলের দাম ঘোষণা করবে নাকি ৫০টা ফসলের? সরকার ২৩টা ফসলের পুরো উৎপাদন ক্রয় করবে নাকি স্রেফ দাম নিয়ন্ত্রণ করবে? সরকার কি দর খুব পড়ে গেলে কিছুটা কিনে আবার দর তুলে দেবে? সরকার ৪০ শতাংশ উৎপাদিত ধান ক্রয় করবে নাকি ৮০ শতাংশ? গম ২০ শতাংশ ক্রয় করবে নাকি ৪০ শতাংশ? বাদাম, মশলা, ফল, ডিম, দুধ সরকার কি ক্রয় করবে? করলে কতটা? কোল্ড স্টোরেজ কতগুলি বানাবে। কৃষিমান্ডিতে যাতে কৃষক ইচ্ছেমতন ফসল বিক্রি করতে পারে তার জন্য আমলাতান্ত্রিক বিধিনিষেধ সহজ সরল করা যাবে কি? সরকার সি২ মূল্যের উপর দেড়গুণ দাম দেবে নাকি এ২+এফএল মূল্যের উপর? সরকার কৃষকের কথা ভাববে নাকি চাল আটা যারা কেনে অর্থাৎ ভোক্তাদের কথা ভাববে? কৃষকদের কাছ থেকে ফসল কিনে রেশনের মধ্য দিয়ে বিলি করা কি অত্যাবশ্যক? সরকার ফসল কিনতে ৪ লাখ কোটি খরচ করবে নাকি ৪০ হাজার কোটি? ৪ লাখ কোটি খরচ করলে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার ১০০ লাখ কোটি হতে কত বছর লাগবে? পাঁচ নাকি দশ? এই সব প্রশ্ন, বিতর্ক বিজেপির ক্ষেত্রে অর্থহীন। বিজেপি গত বছর পিছু হঠেছে ঠিকই। কিন্তু ২০২৪ সালে ক্ষমতায় ফিরলে বিলটি শুধু তারা ফেরত আনবে না, সঙ্গে সবকটা কৃষক নেতাকে জেলে পুরবে। গুম খুন করে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি বিজেপির মতাদর্শ বা অ্যাজেন্ডা নয়। কৃষি উৎপাদনে বৃদ্ধি, কৃষির শিল্পায়ন তাদের মতাদর্শের ঠিক বিপরীত। আধুনিক কৃষিসমাজ তারা কল্পনাও করে না। কৃষককে কৃষি উৎপাদন থেকে সরিয়ে দাঙ্গাকারী, অগ্নিবীর সেনা, ইজরায়েলে যুদ্ধে পাঠাতে আগ্রহী হতেই পারেন মোদি।
কৃষির সঙ্গে যুক্ত আজকের ভারতের ৫০-৫৫ শতাংশ মানুষকে ফ্যাসিবাদের ভিত্তি হিসেবে গড়ে তুলতে চান মোদি। কৃষিলবি যদি তাদের পক্ষে না দাঁড়ায় তবে তাদের যুগ ক্ষণস্থায়ী হতে বাধ্য। আর বর্তমান ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের কৃষিলবি তাদের দিকে নেই। চৌধুরী চরণ সিংকে ভারতরত্ন দিলেও নেই। তাই দেশের হরিয়ানা পাঞ্জাবের কৃষিলবির বদলে নতুন লবি গড়ে তুলতে হবে। যারা আদানির ভৃত্য হতে রাজি। যারা মোদি-সার্টিফায়েড হিন্দুত্বের ফর্মুলায় কৃষিকাজে রাজি। উচ্চফলনশীল প্রক্রিয়ায় যুক্ত স্বাধীনচেতা কৃষকদের কোনঠাসা করতে হবে মোদিকে। এককথায় বললে এক নব্য জমিদার-জোতদারশ্রেণি গড়ে তোলা বিজেপির মূল উদ্দেশ্য। অন্যের জমি দখল করে জমিদারি সাম্রাজ্য গড়ে তোলাই যাদের কাজ, এবং যে কাজে বর্তমানে সর্বস্বান্ত গরিব প্রান্তিক চাষিদের লোভ দেখিয়ে বিভ্রান্ত করার সুযোগ পাবে এই নব্য জমিদারেরা।
পাঞ্জাবের কৃষকদের খালিস্তানি আখ্যা দিয়ে যদি তাদের জমি কেড়ে নেওয়া যায়, যদি তাদের উচ্ছেদ করা যায়, তবে উত্তরপ্রদেশের চামচা জমিদার হতে চাওয়া কৃষকলবিকে ওই জমি দেওয়া যাবে, জলের দরে বা একদম ফ্রি।
এই কাজে তারা বিভ্রান্ত করতে চাইবে সাধারণ কৃষকদের। জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিজেপি বিশ্বাসী নয়। কৃষকের রোজগার বাড়ানোর বা অন্তত স্থিতিশীল রাখার ফ্যাসিস্ট মন্ত্র হল জমি বাড়াও বা দখল করো। পাশের রাজ্যের, জেলার, গ্রামের কৃষকদের উচ্ছেদ করে সেই জমি দখল করো। প্রান্তিক চাষি হয়তো দিবাস্বপ্ন দেখবে যে এই সুযোগে সেও ভাগ পাবে!! পশ্চিমবঙ্গে মাথাপিছু জমির পরিমাণ অনেক কম? তাহলে ফ্যাসিস্ট সমাধান হল, বাঙালি মুসলিমদের যাদের ওরা বাংলাদেশি বলে, তাদের জমি কেড়ে নাও। আগামীতে যুদ্ধ-অর্থনীতির উপর নির্ভর করে যদি বাংলাদেশের জমিও দখল করা যায় তবে তো কথাই নেই, যুদ্ধ হবে, অস্ত্র কেনাবেচা হবে। গড়ে উঠবে নব্য জমিদারশ্রেণি, যারা নিজেরা আদানি-আম্বানি নয় কিন্তু আদানির সাগরেদ হওয়াই যাদের জীবনের লক্ষ্য। স্বাধীনচেতা কৃষকসমাজের পতন হবে।
আত্মনির্ভরতার অর্থ হল কৃষকরা সৈন্য হবে, আর বাকি কৃষকদের হবে যাযাবরের জীবন। নব্য জমিদারশ্রেণি বিদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা কতটা করতে পারবে সন্দেহ, তারা হবে জাতীয়তার বুলি আওড়ানো পরজীবী শ্রেণি। এর জমি তার জমি দখল এবং সেখানে অভিবাসী কৃষক হিসেবে লোক খাটানো। জাতীয় সাজতে তাদের হিন্দু ধর্মের মুখোশ পড়তে হবে। আবার পরিবেশবান্ধবও সাজতে হবে। তারা হয়তো সার কেমিক্যালস দিয়ে উৎপাদন বাড়াতে দেবে না। অর্গানিক চাষের শিরোনামে তারা হয়তো জ্যোতিষভিত্তিক চাষের কথা শুধু প্রচার করবে না এমনকি আইনও বানাবে। কৃষির এই ফ্যাসিস্ট দর্শন যেখানে গ্রাম্য চাষিকে এক মহৎ রূপ দিয়ে পুজো করা হবে, আর তার ফলে সে যাতে কৃষির শিল্প করে তুলতে না পারে তা খেয়াল রাখা হবে। মিড ডে মিল, রেশন যদি তুলে দেওয়া হয় তবে শিশুদের পুষ্টির জন্য, এমনকি প্রতিটি নাগরিকের পুষ্টির জন্য নতুন আইন বানাতেও তারা পিছপা হবে না। ধরা যাক সপ্তাহে তিন দিন সাবু, বাজরা খাওয়ার বাধ্যতা। ফলে মুর্গি চাষ, ডিম, গম, ধান চাষের ফলন না বাড়ালেও চলবে। এমএসপি ফসল ক্রয়ের চাপ নেই। কেমিক্যাল সার ব্যবহার করা নিষিদ্ধ করে অর্গানিক ফার্মিং-এর নামে পরিবেশপ্রেমীদের মধ্যেও সহজেই বিভ্রান্তি ছড়ানো যাবে। বহুজাতিক কেমিক্যাল সার-ব্যবসায় যদি আদানি হাত দেয় তবে অবশ্য অন্য ব্যবস্থা হবে। সুতরাং উৎপাদন বৃদ্ধি নয়, জমি দখল করো আর মোদি-সার্টিফায়েড হিন্দুত্বের ছাপ দেওয়া নব্য জমিদারদের হয়ে অভিবাসী কৃষক হও, এটাই ভারতের কৃষকের ভবিষ্যৎ।
উৎপাদন বৃদ্ধির বদলে জমি বৃদ্ধি— এই হল ওদের কৃষিসংক্রান্ত মতাদর্শ। নব্য জমিদারশ্রেণি বানানোর মূল মন্ত্র। কৃষিকে, কৃষককে মহান করে তাকেই আবার গুলি করার মন্ত্র।
যেমন, শ্রী স্বামীনাথনকে তারা ভারতরত্ন দেয় আর তার প্রস্তাবকে কার্যকর করার কথা যারা বলে তাদের খালিস্তানি বলে গাল দেয়। যেমন তারা মহাত্মা গান্ধির প্রশংসা করে বিদেশ গিয়ে আর এদেশে এসে নাথুরাম গডসের মন্দির বানায়। যেমন হিন্দু সংস্কার আন্দলোনের পুরোধা চৈতন্যকে স্বার্থান্বেষী ব্রাহ্মণরা হত্যা করে অথচ চৈতন্যকেই হিন্দু ধর্মের পান্ডার স্থান দেয় ওই খুনিরাই। বা যেমন বৌদ্ধদের গণহত্যা করে দশ অবতারের মধ্যে এক অবতার হিসেবে বুদ্ধকে রেখে দিয়েছেন ক্ষমতার আশেপাশে থাকা ব্রাহ্মণরা। যেমন হিটলার ধুমধাম করে পয়লা মে পালন করেই রাতের বেলা সমস্ত ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করে গ্রেফতার করা শুরু করেছিল। যেমন ব্রাউন শার্টসের প্রধানদের এক নেমন্তন্নে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাদের ধরপাকড় করে হত্যা করেছিল হিটলার। গত বছর কৃষক আন্দলোনের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হওয়া মোদি সেই হিংস্র ব্রাহ্মণ্যবাদীদের, হিংস্র হিটলারেরই উত্তরসূরি।
তবে ইতিহাসে হিটলার এখন কোথায় তা সকলেই জানেন। তাকে যারা অনুসরণ করে চলতে চাইবে, তারাও যে তার পেছন পেছন অবশেষে সেখানেই পৌঁছবে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় এখনই। পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা থেকে আগত কৃষকরা ইতিমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা সহজে পিছু হঠবার পাত্র নন। রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে গণশক্তির পাঞ্জালড়াই হলে তাঁরাও যে কিছু কিছু অমোঘ হাতিয়ার সঙ্গে করে আনতে ভুলে যাচ্ছেন না, তা তাঁরা ইতিমধ্যেই অতীব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রদর্শন করেছেন। তাঁদের মাথার উপরে ড্রোন চালিয়ে দিয়ে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপণের আর্য অস্ত্রকে তাঁরা স্রেফ ঘুড়ির সাহায্যে অকেজো করে দিয়েছেন। প্রধান প্রধান সড়কে বালি সিমেন্টের বাম্প বসিয়ে তাতে মোটা তারকাঁটা লাগিয়ে ট্র্যাক্টর চলাকে বিঘ্নিত করার অপচেষ্টাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে তাঁরা রাস্তা বদল করে মাঠঘাটের উপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে এসেছেন। হরিয়ানা পুলিশ যখন বন্দুকের গুলি চালিয়ে ভয় দেখাচ্ছে, হত্যা করে মনোবল ভাঙতে চাইছে, তাঁরা সঙ্গে বিশাল বিশাল দঙ্গল গরু নিয়ে পথ হাঁটছেন, দেখা যাক “গোমাতা”-র সন্তানরা এবার গুলি চালাতে পারে কিনা! আন্দোলনের এই সৃজনশীল কায়দাগুলিই বুঝিয়ে দিচ্ছে, শাহ-মোদি গ্যাং চাইলেও সহজে এর প্রত্যাঘাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারবে না। ২০২৪-এর নির্বাচনের যত সন্নিকটে গিয়ে এই লড়াইতে মোদি সরকারের পরাজয় হবে, লোকসভা নির্বাচনেও তার ততই দীর্ঘায়িত ছায়া পড়তে থাকবে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো-বিরোধী মোদিদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তি সার্বিক বিরোধী জোট। আঞ্চলিক দলের গুরুত্ব ও নেতৃত্ব মেনে যে জাতীয় জোট যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রকৃত বহিঃপ্রকাশ। তেভাগা তেলেঙ্গানা-সহ জমিদারতন্ত্র বিরোধী ভারতের সমস্ত ঐতিহ্যশালী কৃষক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আজ আমাদের লক্ষ্য তাই মোদি হঠাও, দেশ এবং রাজ্য বাঁচাও।
*মতামত ব্যক্তিগত