বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
পরিযায়ী পাখি
দুই.
লোকদুটো রিক্সার সামনে বোধহয় কয়েক সেকেন্ডের জন্যেই দাঁড়িয়েছিল। পরমুহূর্তে ওদের হাতের এক ঝটকায় অ্যাসিডের ফোয়ারা রেখার দিকে ধেয়ে এসেছিল। অ্যাসিড ছুড়তে ছুড়তেই লোকদুটো দৌড়েছিল। গামছায় তখনও ওদের মুখ ঢাকা। না হলেও রেখা কিছু দেখতে পেত না। কারণ ছুড়ে দেওয়া তরল ওর মুখের চামড়া স্পর্শ করতেই শরীরে আগুনের ঝড়। লোকদুটো যখন ওর দিকে এগিয়ে আসছিল, রেখা আত্মরক্ষার তাগিদে রিক্সার সিট ছেড়ে উঠতে শুরু করেছিল। এখন টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড় করে একেবারে রিক্সার সামনের রাস্তায়। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে চিৎকার করে উঠল মেয়েটা। এ কী ভীষণ যন্ত্রণা! অ্যাসিড চামড়া ভেদ করে চোরাস্রোতের মতো মুখের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছিল। নিজের শরীরের মাংসের পোড়া গন্ধে গা গুলিয়ে উঠছিল রেখার। চোখের দৃষ্টি খুব দ্রুত অস্বচ্ছ হয়ে আসছিল। শীতকাল বলে সব বাড়ির জানালা বন্ধ। তার গগনভেদী চিৎকারে সামনের বাড়ির একটা জানালা খুলতেই আলোর ঝটকা এসে পড়ল ওর চোখেমুখে। সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই জানালা বন্ধ হয়ে গেল না কি রেখার চোখের দৃষ্টি হারিয়ে গেল ও সেটা জানে না। শুধু জানে তার যন্ত্রণা এত মর্মান্তিক, এত জান্তব যে মনেপ্রাণে চাইছিল সে যেন তক্ষুনি মরে যায়। কিন্তু যন্ত্রণার তীব্রতায় বন্য জন্তুর আর্তনাদের মতো এক কানফাটা আওয়াজ বেরিয়ে আসছিল ওর বুক চিরে। সে আওয়াজ এত তীক্ষ্ণ, এত ভয়ঙ্কর তা নিশ্চয় এই গলির প্রতিটা বাড়িতে পৌঁছে গেছিল। কিন্তু এখন প্রায় মধ্যরাত্রি, অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুনলেও কি বুঝতে পারছে কিছু? প্রথমের সেই অসম্ভব চিৎকারের পরে এখন রেখার গলা দিয়ে শুধুই গোঙানি যেটা কোন বন্ধ জানালা ভেদ করে যাবে না কোনওদিন।
যন্ত্রণায় সময় স্থির হয়ে যায়। অন্তত নিদারুণ জ্বলন আর ব্যথার গভীরে ডুবে যেতে যেতে রেখার সেরকমই মনে হচ্ছিল। বোধ হচ্ছিল ওই রাস্তার ওপরেই তার শরীরের সব চামড়া মাংস গলে গলে পড়ে যাবে, কেউ আসবে না। জানতেই পারবে না।
কিন্তু এল। রাস্তার কুকুরগুলো। তারস্বরে চিৎকার করতে করতে পাড়ায় যতগুলো কুকুর সব রেখার দিকে ছুটে এল। পথের ধুলোয় পড়ে থাকা রেখার চারপাশে দাঁড়িয়ে গলা তুলে চেঁচাচ্ছিল কুকুরগুলো। সেই নিরবচ্ছিন্ন চিৎকারে কোনও মানুষের পক্ষেই ঘুমিয়ে থাকা সম্ভব নয়। সামনের একটা দোতলা বাড়ির বারান্দা থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল, ভাগ! ভাগ! এই লেড়িগুলোর জ্বালায় রাত্রে ঘুমানোর উপায় নেই! কোনও মানুষের গলার আওয়াজ পেতেই শেষবারের মতো শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল রেখা। হেল্প! হেল্প!
লোকটার পিছন পিছন বোধহয় কোনও মহিলাও বেরিয়ে এসেছিল। একটান মেরে লোকটাকে ঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। এত রাতে একদম বাইরে যাবে না। কোথাকার কে কাকে ফেলে রেখে গেছে, দেখতে গিয়ে পুলিশের খাতায় নাম লেখাবে নাকি?
এসব কোনও শব্দই যন্ত্রণার চোরাবালিতে ডুবতে থাকা রেখার কানে কথা হয়ে ঢুকল না। একঝাঁক মৌমাছির সম্মিলিত গুঞ্জনের মতো তার মাথার চারপাশে শুধু বিনবিন করছিল। কতক্ষণ ওইভাবে পড়েছিল সেটাও রেখার জানা নেই। হয়তো পাঁচ মিনিট, কিংবা আরও কম। কিন্তু সময়টা তার জন্য ছিল পাঁচ ঘণ্টার মতো দীর্ঘ।
কিছু মানুষ এখনও আছে যারা নিজেদের কথা ভুলে অন্যের বিপদে ছুটে আসে। পৃথিবী বেঁচে থাকে এদেরই জন্য। তেমনই দুজন হাওয়াই চটি ফটফট করে ছুটে আসছিল রেখার দিকে পাশের কোনও বাড়ি থেকে।
রেখার সামনে এসে ওরা থমকে দাঁড়াল। কী হয়েছে আপনার? কে করল এরকম? লোকটার গলায় কোনও একটা তাগিদ ছিল। যন্ত্রণায় ডুবে যাওয়া রেখা শেষ শক্তি দিয়ে আর্তনাদ করে উঠল। হয়তো বলতে চাইল কোনও কথা, কিন্তু মুখ দিয়ে যে শব্দ বেরোল তার কোনও অর্থ উদ্ধার করতে পারবে না কেউ।
এতক্ষণে একজনের হাতের টর্চ আলোর তীব্রতায় রেখার মুখের উপর আছড়ে পড়েছিল। সেই চোখ ঝলসানো আলো রেখার ঝাপসা হয়ে ওঠা চোখের পর্দা ভেদ করে ভেতরে পৌঁছে যাচ্ছিল।
অন্য লোকটা অস্ফুটে চিৎকার করে উঠল। এই বারীন! কোনও শুয়োরের বাচ্চা অ্যাসিড ছুঁড়েছে মনে হচ্ছে।
বারীন বলে লোকটা নাক উঁচু করে বাতাসে গন্ধ শুঁকে ত্রস্ত হয়ে উঠল। হ্যাঁ অ্যাসিড। মনাদা, মেয়েটাকে বাঁচাতে হলে এখুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, তোমার হন্ডাটা বের করো।
কুকুরগুলো তখনও চেঁচাচ্ছিল তারস্বরে। মনাদা বলে লোকটা ক্যাঁক করে একটার পেটে লাথি কষাতেই কুকুরটা কাঁই কাঁই করতে করতে রাস্তার অন্যদিকে চলে গেল। ওর দেখাদেখি অন্য তিনটেও। মনাদা বলল, মোটরসাইকেলে বসবে কী করে রে? এই যে মেয়ে, তুমি কি উঠে বসতে পারবে?
–কথা বলে সময় নষ্ট করো না মনাদা। যে করেই হোক আমি বসিয়ে দিয়ে পিছন থেকে ধরে থাকব। জেনারেল হাসপাতাল পাঁচ মিনিটের পথ, ঠিক পৌঁছে যাব।
মনাদা এবার চটি ফটফট করতে করতে পিছনে দৌড় দিল। তুই দাঁড়া, আমি এক মিনিটে আসছি।
বারীন ছেলেটার খেয়াল হল রাস্তার পাশেই একটা চাপাকল। ও দৌড়ে গিয়ে এক আঁজলা জল নিয়ে এসে ছিটিয়ে দিল রেখার মুখে। আনতে আনতেই আঙুলে ফাঁক গলে জল পড়ে যাচ্ছিল। ছেলেটা বারবার দৌড়ে গিয়ে তবু যতটা পারে জল ছেটানোর চেষ্টা করছিল। ছেলেটার দৌড়ে যাওয়ার মধ্যে একটা সহৃদয় চেষ্টা ছিল, যেটা রেখাকে অচেতনের মধ্যে পুরোপুরি ডুবে যেতে দিচ্ছিল না। জল ছড়ানোয় ওর ব্যাথা যে কমে যাচ্ছিল তাও নয়। বৃষ্টির ফোঁটার মতো গড়িয়ে পড়া জলের সঙ্গে সঙ্গে ছুঁচ ফোটানোর মতো আর একটা ব্যথার আস্তরণ ছড়িয়ে পড়ছিল রেখার শরীরে। এর মধ্যেই গুমগুম করতে করতে মনাদা মোটরসাইকেল নিয়ে চলে এল। রেখার পাশ ঘেঁষে দাঁড় করিয়ে বলল, পাড়ার লোকগুলো কি খচ্চর দেখেছিস? ইঁদুরের মতো গর্তে সেঁধিয়ে আছে, একটারও টিকি দেখা যাচ্ছে না।
—ছাড়ো মনাদা। আমরা তো আছি।
—কিন্তু তুই পারবি একা ধরে তুলতে?
—কিছু করার নেই, পারতেই হবে। বারীন নিচু হয়ে রেখার কাঁধ ধরে তোলার চেষ্টা করল। আপনাকেও একটু চেষ্টা করতে হবে, না হলে আমি তুলতে পারব না।
রেখার শরীর ছেড়ে দিচ্ছিল। তবু প্রাণপণ চেষ্টায় মাথা তুলল। ছেলেটা এক ঝটকায় একটা হাত ওর ঘাড়ের নিচ দিয়ে ঢুকিয়ে দিল। অন্য হাত হাঁটুর নিচে রেখে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল রেখাকে। হাঁফাচ্ছিল বারীন।
—মনাদা, তুমি একটু সামনে এগিয়ে ট্যাঙ্কের উপর উঠে বসো। আমি এইভাবেই কোলে নিয়ে বসব।
—পারবি?
—ওসব ভাবার সময় নেই।
বারীন মোটরসাইকেলের পিছন দিয়ে হ্যাঁচরপ্যাঁচর করতে করতে পিছনের সিটে নিজেকে সেঁধিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় রেখার মাথাটা একবার ঠুকে গেল মোটরসাইকেলে। কিন্তু শরীরের যন্ত্রণা এত তীব্র, যে এই ব্যথা তার বোধের সীমানা অতিক্রম করল না। যদিও বারীন খুব লজ্জিত বোধ করল। ভাল করে দেখে নিল আর কোনওভাবে মেয়েটার আঘাত লাগার সম্ভাবনা আছে কিনা। রেখার লম্বা চুল খোঁপা খুলে সাপের মতো ঝুলছিল। বারীন চুলের গোছা টেনে তুলে পাকিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বলল, এবার চালাও মনাদা। কিন্তু বেশি জোরে যাওয়ার দরকার নেই, আমি সামলাতে পারব না।
—এই বারীন, হাসপাতালে নিয়ে গেলে আমাদেরই আবার পাকড়াও করবে না তো রে। মনার সঙ্গে পুলিশের কিছু লেনদেন হয়েছে আগে, তাই ভয় পায় না। কিন্তু এড়িয়ে থাকতেই পছন্দ করে।
—এখন সেসব ভাবার সময় নেই।
রেখার শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া অ্যাসিড ছেলেটার হাত পুড়িয়ে দিচ্ছিল। মেয়েটার যন্ত্রণার তুলনায় নিশ্চয় সামান্য সেটা। বারীন সেটাকে পাত্তা দেবে না ঠিক করল, যা হবে পরে দেখা যাবে। রেখার দিকে মাথা ঝুঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার নামটা বলতে পারবে? হাসপাতালে ভর্তি করতে গেলে তো নাম বলতে হবে। রেখা কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু মোটরসাইকেলের দমফাটানো আওয়াজ ভেদ করে কারও কানে পৌছাল না। নীল আলোয় লেখা এমার্জেন্সির দরজায় এসে দাঁড় করাল মনাদা। বারীন, তুই ওকে নিয়ে ভেতরে ঢোক, আমি বাইকটা দাঁড় করিয়েই আসছি।
বারীন ওই অবস্থায় রেখাকে কোলে করে রিসেপশনের দিকে ছুটল। একটা লোক কাউন্টার বসে ঢুলছিল। বারীন ব্যাস্ত হয়ে বলল, দাদা শিগগির করুন, অ্যাসিড ভিক্টিম।
লোকটা বারীনের ব্যাস্ততাকে পাত্তাই দিল না। হাই তুলে দেশলাইকাঠি দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে বলল, কে হয় আপনার?
—কেউ না, আমি চিনি না। রাস্তায় পড়েছিল, আমি নিয়ে এসেছি।
—ওভাবে বললে কি হয় মশাই? আপনি নিজেই যে অ্যাসিড ছোড়েননি তার কি প্রমাণ?
মনা এসে গেছিল। কী মাজাকি মারছেন মশাই? আমরা অ্যাসিড ছুড়ে আবার আমরাই এখানে নিয়ে আসব? দেব নাকি তাহলে আরেক বোতল অ্যাসিড আপনার মুখে?
—আস্তে মনাদা। চাপাস্বরে মনাদাকে সংযত করতে চাইল বারীন।
—এখানে রোয়াব দেখিয়ে কোনও লাভ নেই। যা নিয়ম, তা নিয়ম। আগে পুলিশে ডাইরি করান, তারপরে এখানে ভর্তি হবে। এসব কেস আমরা এমনি এমনি নিতে পারি না।
এবার ফেটে পড়ল বারীন। এমনিতেই অ্যাসিড চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে তার হাত জ্বলিয়ে দিচ্ছিল। এখানে আলোয় এসে মেয়েটার গুটিয়ে আসা মুখ দেখে কেমন অস্থির লাগছিল ভিতর থেকে। নিজেকে আর সামলাতে পারল না। সমস্ত জ্বলন গলায় ঢেলে চিৎকার করে উঠল। আপনি মানুষ না কী? আপনার সামনে একটা জলজ্যান্ত মেয়ে মরে যাচ্ছে, আপনি নড়েচড়ে বসতে পারছেন না? কোন নিয়মে লেখা আছে পুলিশের খাতায় নাম না তুললে হাসপাতালে চিকিৎসা করা যাবে না।
লোকটা নির্লিপ্ত। এরকম দেখে অভ্যস্ত বলেই গায়ের চামড়া পুরু হয়ে গেছে। আছে বলেই বলছি। আমি এখানে রোজ বসি তো। পুলিশ পরে আমাকেই হুড়কো দেবে। তাই ফালতু এখানে রোয়াবি করে সময় বরবাদ করবেন না।
বারীনের চিৎকারের জন্যেই হয়তো, ওখান দিয়ে সাদা কোট পরে এক কমবয়সি ডাক্তার যাচ্ছিলেন, দ্রুতপায়ে ওদের দিকে এগিয়ে আসলেন। কী হয়েছে? এত চ্যাঁচামেচি কিসের? বলতে বলতেই বারীনের কোলে রেখাকে দেখে থমকে গেলেন। আরে, এতো অ্যাসিড বার্ন দেখছি। দেখো ভাই, ওকে ওই চেয়ারের উপর শুইয়ে দাও। কাউন্টারের লোকটাকে বললেন, সতীশ এমার্জেন্সিতে সিস্টার রুমা আছেন নাইটডিউটিতে, ওকে ফোন করে স্যালাইন ওয়াটারের দুটো বোতল নিয়ে আসতে বলো।
—স্যার, এফআইআর না করলে আমরা ভর্তি করতে পারি না, আপনি নতুন হয়তো জানেন না।
ডাক্তার বোধহয় সদ্য পাশ করা, বয়সে কচি। হয়তো রেসিডেন্সি করছে। কিন্তু সতীশের কথায় একটুও না টসকে বলল, আমি জানি, ভর্তি করতে বলছি না। কিন্তু এখুনি জল ঢেলে না দিলে মুখে অ্যাসিড আরও ছড়িয়ে যাবে, চোখটাও বাঁচানো যাবে না। বারীনদের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি দু-এক বোতল স্যালাইন ওয়াটার ঢেলে একটু পরিষ্কার করে দেওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু আপনাদের পুলিশে আগে এফআইআর করতেই হবে।
রেখার এখন এই ডাক্তারটাকে দেবদূতের মতো মনে হচ্ছিল। হয়তো এইজন্যেই শরীরে জোর পেল। গলা যত সম্ভব তুলে বলল, আমার নাম চিত্ররেখা ঘোষ, বাড়ি সতেরোর বি অরবিন্দ সরণী। বাড়িতে একবার খবর দিন।
বারীন রেখাকে তিনটে চেয়ার জুড়ে শুইয়ে দিয়েছিল। ঠিকানা শুনে বলল, অরবিন্দ সরণী? মনাদা ওটা তো বেনাচিতি মোড়ের কাছেই। তুমি চট করে বাইক নিয়ে ওর বাড়ির লোককে নিয়ে এসো। পুলিশের কাছে বাড়ির লোক সঙ্গে নিয়ে গেলে বেটার হবে।
মনাদা আবার চটি ফটফট করে ছুটল। ততক্ষণে সিস্টার রুমা স্যালাইনের বোতল নিয়ে এসে গেছে।
—ডক্টর রায়, আপনি কি এখানেই—
—তা ছাড়া আর উপায় কী বলুন? রেজিস্ট্রেশন না করিয়ে তো ভেতরে নিয়ে যেতে পারছি না। অন্তত একটু জল ছড়িয়ে দিতে পারলে অ্যাসিডের তেজ কিছুটা কমবে। আপনি একটা স্টেরিলাইজড সিজার নিয়ে আসুন তো। এর শাড়ির আঁচলটা কানের উপর দিয়ে আটকে লেপটে গেছে একেবারে। কেটে বাদ দিয়ে না দিলে ফ্লেশের সঙ্গে একেবারে মোল্ডেড হয়ে যাবে।
রেখা চেতন-অচেতনের মধ্যে ঘোরাফেরা করছিল। ডাক্তার রেখার মুখে জল ঢেলে ঢেলে কিছুটা পরিষ্কার করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল রেখা। হয়তো ওর মন অন্যদিকে সরানোর চেষ্টাতেই ডাক্তার কথা বলে যাচ্ছিল। এমনি জলে নোংরা থাকলে ইনফেকশন হতে পারে। কিন্তু স্যালাইন ওয়াটারে কোন ব্যাক্টিরিয়া থাকে না। চোখের জলের মতো, কোনও ইনফেকশন হয় না।
চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল রেখার। ডাক্তার ওর মুখে স্যালাইন ওয়াটার ছড়িয়ে দিচ্ছিল আর রেখা তারস্বরে চিৎকার করছিল, খুব জ্বালা করছে। ডাক্তারবাবু আমার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ কিছু করুন।
—সরি, আমি ভর্তি না হওয়া অবধি কোনও পেনকিলার দিতে পারব না। আপনাকে আরও কিছুক্ষণ ধৈর্য ধরতেই হবে।
ঠিক সেই সময়ে মনার পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে এসে ঢুকল রতন, মাধুরী আর লেখা।
দূর থেকেই শুনতে পাওয়া যাচ্ছে মাধুরীর হাহাকার। এ কী শুনলাম রেখা, এ কী শুনলাম! কী বলছে এরা? এ সত্যি হতে পারে না। বলতে বলতেই এসে প্রায় রেখার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল মাধুরী। ডাক্তার দুহাত দিয়ে আটকাল। একদম এরকম করবেন না। এতে আপনি মেয়ের আরও ক্ষতি করবেন।
—আর কী ক্ষতি হবে আমাদের? সব শেষ হয়ে গেল, সব নষ্ট হয়ে গেল। হে ভগবান! আমাদের সঙ্গেই এমন কেন? রতনের আর্তনাদ হাসপাতালের বারান্দায় গুমড়ে উঠল।
কিন্তু মাধুরী ডাক্তারের কথায় নিজেকে পিছিয়ে নিয়েছে। রতনকেও আটকাল। কান্না ভেজা গলায় জোর আনার চেষ্টা করতে করতে বলল, শান্ত হও। উনি কি বলছেন আগে শুনি। রেখার যাতে ভাল হয়— কথা মাঝপথেই শুকিয়ে গেল মাধুরীর। এরপর আর কী ভাল হবে মেয়ের?
এখন রেখার পায়ের কাছে লেখা। ফুঁপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছিল। কান্নার হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল, দিদি শুনতে পাচ্ছিস, আমরা এসে গেছি। আমরা এসে গেছি দিদি।
ডাক্তার রতনকে বললেন, এখন একদম সময় নষ্ট করবেন না। পুলিশে গিয়ে একটা ডাইরি করান, তারপর আমি ট্রিটমেন্ট শুরু করতে পারব। এই দুজন ভদ্রলোক নিয়ে এসেছিলেন, তাই আপনার মেয়ের ক্ষতি কিছুটা আটকানো গেছে। দেখবেন পুলিশ এদের আবার হেনস্থা না করে। আমি স্যালাইন ওয়াটার দিয়ে কিছুটা পরিষ্কার করে দিয়েছি। কিন্তু যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফুল ট্রিটমেন্ট চালু করতে হবে।
বারীন অবাক হয়ে ডাক্তারের দিকে তাকিয়েছিল। সব ডাক্তারই তাহলে চশমখোর নয়, এর মত কিছু দরদিও আছে। পৃথিবীটা একেবারে বিষাক্ত হয়ে যায়নি।
—মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে নাকি?
—না, তার কোনও দরকার নেই। এঁরা উইটনেস, এফআইআরের জন্যে সেটাই যথেষ্ট। যত তাড়াতাড়ি পারেন, এটা করিয়ে আসুন।
মনা বারীনকে বলেছিল, আমাদের কাজ তো হয়ে গেছে, খামোকা আর থানা পুলিসে জড়ানো কেন? কিন্তু বারীন রাজি হয়নি। হাসপাতালে ভর্তি করেই যাব মনাদা। আমরা যখন কিছু করিনি তাহলে ভয় পাব কেন? রতনকে বলল, আপনি আসুন। মনাদার বাইকে চেপে চলে যাচ্ছি।
রতন একসময় রাজনীতি করেছে। নিজেও একদিন গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়েছিল। তাই থানায় একটু চেনা পরিচিত আছে। সেই পুরনো সম্পর্কের জোরে এফআইআর করতে পারল তাড়াতাড়ি। হয়তো ঘন্টাখানেক লেগে থাকবে। রেখার জন্য সেটাই যেন অনন্তকাল। রতন কাগজ নিয়ে ফিরে আসতেই খুব তাড়াতাড়ি রেখাকে এমার্জেন্সিতে ঢুকিয়ে নিল। এবার অন্য একজন ডাক্তার। উনি এসেই একটা কাঁচি নিয়ে গায়ের সঙ্গে সেটে যাওয়া শাড়ি আর ব্লাউজ কাটতে শুরু করলেন। ডাক্তার কানে আর গালের পাশের শাড়ির টুকরো কেটে বের করেছিলেন। কিন্তু অ্যাসিড ছড়িয়ে পড়েছিল গলায়, কাঁধে, বুকে, পেটে। একটু একটু করে কেটে গায়ে বসে যাওয়া শাড়ির আঁচল, ব্লাউজ আর ব্রায়ের টুকরো বের করে আনছিলেন। এক অপরিচিত লোকের চোখের সামনে নগ্ন হতে হতে রেখার মনে হচ্ছিল যেন সে আর একটা জ্যান্ত মানুষ নেই। তার লজ্জা, ভয় সব লোপ পেতে পেতে সে শুধুই এক অ্যাসিড ভিক্টিম। কিন্তু এই চিন্তাটা বোধহয় শুধু বাইরে কোথাও ঘোরাফেরা করছিল, যন্ত্রণার আস্তরণ সরিয়ে ঢুকছিল না মনের গভীরে। সেখানে শুধুই শূন্যতা, এক শব্দবোধহীন হাহাকার।
[আবার আগামী সংখ্যায়]