অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
…প্রথম উপকথা এখানে
হাল্বা – যোদ্ধা জাতি হিসেবে অভিমানী এই হাল্বা সমাজের সাথে দণ্ডকারণ্যের প্রধান আদিবাসী সম্প্রদায় গোণ্ড সমাজের কিছু ইন্টার্নাল কনফ্লিক্ট চোখে পড়ার মতো। অনেক জায়গায় এঁরা উপবীত ধারণ করেছে, এবং সামাজিকভাবে গোণ্ড আদিবাসীদেরকে কিছু ক্ষেত্রে নীচু চোখে দেখার কূটাভাস, হিন্দুবাদ মারফৎ প্রবেশেচ্ছু এই সমাজে। আসলে, ইতিহাসের পিণ্ডারিদের মতোই, এঁরাও নানান রাজারাজড়ার সেপাই-সামন্ত ছিল, এবং, রাজ্যপাট বিস্তারের লড়াইয়ের ইতিহাসি হাত ধরে বস্তারে পৌঁছে গিয়েছিল এরা সেই কোন অতীতের ভুলে যাওয়া কালে। পৌঁছে, বস্তারের আদিবাসীদের সাথে পরিণয়-সহ নানান সামাজিক সম্পর্কে লিপ্ত হন, মারাঠি আর গোণ্ড ভাষা মিলিয়ে ক্রমে তৈরি হয় এঁদের স্বতন্ত্র ভাষা – যে ভাষাভাষীর সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে গোণ্ড ভাষার ব্যাপকতায় ভাগ বসায়। ১৯৬০-৬১ সালে নারায়ণ সান্যাল যখন দণ্ডকারণ্যে যাচ্ছেন, তখন এই হাল্বা-ভাষার বিস্তার দেখে তিনি ঠাউর করছেন যে এই ভাষাই বুঝি বস্তারের মাতৃভাষা। মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলি জেলা আর ছত্তিসগড়ের নারায়ণপুর জেলা যেইখানে মিশে গেল, সেইখানে ছোটে ও বড়ে ডোঙ্গর পাহাড়-জুড়ে এঁদের রাজ্যপাট ছিল, সেইখানে আজও সম্বৎসর মেলা লাগে নারায়ণপুরের বড়-মেলার সময়তেই। সেই রাজ্যপাটে কোম্পানি ও মারাঠা-হিন্দু অপশাসনের ছায়া পড়লে, ১৭৭৪ সালে সংঘটিত হয় হাল্বা বিদ্রোহ। সেই প্রসঙ্গে যথাসময়ে উপনীত হব।
হয়তো খানিকটা মারাঠা রক্তগৌরবের কারণেই এদের মধ্যে হিন্দু-আয়ণকে বাকি গোণ্ড আদিবাসীদের আগের থেকেই গ্রহণ করার তাগিদ দেখা গিয়েছিল – যার ছায়া আজও পড়ে এই গোণ্ডি-হাল্বা বিবাদ-বিভেদের জেরে। সেইজন্যই সেই ছোটে-ডোঙর বড়ে-ডোঙরের পূজ্যস্থল তথা মেলা-প্রাঙ্গণে দেখা যায় সংঘ পরিবারের ‘গায়েত্রীপীঠ’-এর গৈরিকধারী বাবাজিদের উপস্থিতি লক্ষণীয়ভাবে ক্রমবর্ধমান। বস্তার দেশের মধ্যভাগে কোণ্ডাগাঁও অঞ্চলের গ্রামে গ্রামেও হাল্বা আদিবাসীদের ব্যপক বিস্তার লক্ষণীয়। সেইরকমই এক গ্রামের এক ছোট্ট অল্টার্নেটিভ ইস্কুল ‘ইমলি-মহুয়া’র মাস্টারমশাই শ্রী প্রয়াগ যোশী জানালেন বস্তারিয়া ভাষাদের সোশাল পিরামিড – সকলের নীচে গোণ্ডি, তার উপরে হাল্বি, তার উপরে হিন্দী, আর, যথারীতি, সবচেয়ে ‘প্রেস্টিজাস’ ইংরেজি। তথাকথিত প্রগতির কুচকাওয়াজের ফলে এই উৎকট অথচ ঘোরবাস্তব পিরামিড নির্মিত হয়েছে। তথ্য-তত্ত্বের কচকচানি অনেক হল, এইবার হাল্বা আদিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত একটা লোককথা শোনা যাক -–
চালাক শিষ্যের গল্প
এক বাপের দুই মা-মরা ছেলে ছিল। বাবার জীবিকা ছিল মজদুরি। সংসারে ছিল ঘোর অভাব অনটন। একদিন তাদের ঘরে এক সাধু এল। এসে বলল,
‘তোমার তো অভাবী সংসার, আমার কাছে তোমার ছেলেদুটোকে দিয়ে দাও, আমি ওদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করব, তারপর ওরা ফিরে এলে তোমার দারিদ্র ঘুচবে।’
যেমন বলা তেমনি কাজ। চলল সাধুবাবা সেই দুই ভাইকে নিয়ে। তার আস্তানায় নিয়ে গিয়ে পড়াশুনো শেখাতে লাগল ওদের। বড় ভাই ছিল হাবাগোবা, বিদ্যাভ্যাসে বিন্দুমাত্র মন ছিল না তার। এ’দিকে ছোট ভাই চালাক-চতুর। অচিরেই সে নানান বিদ্যা অর্জন করতে সক্ষম হল। অর্জিত বিভিন্ন বিদ্যা ও গুণের মধ্যে সে পেল ইচ্ছামতো যে কোনও প্রাণী বা বস্তুর রূপ ধারণ করার ক্ষমতা। এইভাবে দুই-তিন বছর কেটে গেল। সেই দুই ভাইয়ের বাবার সাধ জাগল, গিয়ে দেখে আসে তার ছেলেদের বিদ্যাচর্চা কেমন চলছে। বিদ্যাবলে বাবার মন দূর থেকেই বুঝতে পারল সেই ছোট ভাই। সে তখন পাখি হয়ে তার বাবার কাছে গেল আর বলল,
‘বাবা, কাল যখন আমাদের দেখতে আসবে, সাধুবাবাকে বলে আমাকে ও’খান থেকে তোমার কাছে ফেরৎ নিয়ে এসো।’
কথামতো পরের দিন সেই বাবা হাজির হল সাধুর কাছে, বলল,
‘আমার শরীরটা আজকাল আর ঠিক যাচ্ছে না, আমি তাই আমার ছোট ছেলেটাকে সঙ্গে করে ফেরৎ নিয়ে যাব।’
কথামতো, বাপ-বেটায় চলল বাড়ি। বাড়ি পৌঁছে ছেলে বাবাকে বলল,
‘বাবা, তুমি বাজার থেকে একটা খাঁচা নিয়ে এসো, আমি তোতা হয়ে সেই খাঁচায় ঢুকে যাব; তারপর আমাকে খাঁচাশুদ্ধু নিয়ে চলো বাজারে, পছন্দমতো খরিদ্দারের কাছে আমাকে বেচে দিও, আমি নিজেই আমার দাম ঠিক করে নেব – সংসারের অভাব ঘুচবে কিছুটা।’
কথামতো বাবা খাঁচা নিয়ে এল। ছেলে তোতাপাখি হয়ে ঢুকে গেল খাঁচার ভিতর। পাখি হয়ে যাওয়া ছেলেকে খাঁচায় দুলিয়ে বাপ চলল হাটে।
ঘটনাচক্রে, সেইদিনই হাটে এসেছিল এক রাজা। খাঁচায় তোতাপাখি দেখে রাজা জিজ্ঞেস করল,
‘এর দাম কত?’
বাপ কিছু বলে ওঠার আগেই খাঁচার ভিতর থেকে তোতা বলে উঠল,
‘এক হাজার টাকা।’
এমন বলিয়ে কইয়ে সমঝদার পাখি দেখে খুশি হয়ে সেই দামেই তাকে কিনে নিল রাজা। এনে রাখল রাজপ্রাসাদে। পরের দিন খাঁচার পাখি বলে উঠল,
‘খাঁচা খোলো, আমি স্নান করব।’
যেই না খোলা, অমনি ফুড়ুৎ করে উড়ে সে বাবার কাছে ফিরে এল। এসে বলল,
‘দড়ি কিনে আনো, এ’বার হাতি হব।’
ছেলে হাতি হয়ে গেল, তাকে দড়িতে বেঁধে মাহুত হয়ে চলল বাবা। তবে এবার গেল ভিনরাজ্যে — আগের রাজাকে সে যে তোতা বিক্রি করেছিল, সেটা পালিয়েছে, অতএব ভিনরাজ্যে পারি দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। ভিনরাজ্যে গিয়ে সে সটান হাজির হল সেই রাজ্যের রাজার কাছে। সেই রাজাও অমন সুন্দর হাতি থেকে তৎক্ষণাৎ ১০ হাজার টাকায় কিনে নিল তাকে। এদিকে পিলখানায় ঢুকে হাতি খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিল। রাজা তখন ভাবল, হাতিটাকে জঙ্গলে নিয়ে যাওয়া যাক, সেখানে সতেজ ফলমূল-গাছপালা খেয়ে সুস্থ হবে হাতি। জঙ্গলে পৌঁছতে না পৌঁছতেই ছেলে হাতি থেকে সাপ হয়ে গিয়ে সুড়ুৎ করে দে’ চম্পট।
অনেক দূরে গিয়ে সে সাপ থেকে বৈরাগীর আকার ও বেশ ধারণ করে, নানান ঘর-গেরস্থালী থেকে দান-দক্ষিণা গ্রহণ করতে করতে তার বাড়ির দিকে চলতে লাগল। ঘটনাচক্রে সেইখান দিয়ে তাদের সেই শিক্ষক সাধুবাবা যাচ্ছিল। গুরুর চোখে কি আর শিষ্য লুকোতে পারে? দেখামাত্রই চিনতে পেরে সাধু ভাবল,
‘আমার থেকেই এই শিক্ষা নিয়ে এ’ বেজায় সেয়ানা হয়ে উঠেছে দেখছি। এর একটা বিহিত করতে হচ্ছে তবে!’
এদিকে গুরুকে দেখতে পেয়ে ভীতসচকিত শিষ্য উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে একটা দীঘির জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সেই দীঘিতে তখন আবার জল খেতে এসেছিল একটা মোষ। সুযোগ বুঝে সেই ছেলে তখন একটা মাছির আকার ধারণ করে মোষের নাকের ফুঁটো দিয়ে ঢুকে সটান আস্তানা গাড়ল তার বুকের কলজেতে। কিন্তু এত করেও কি আর গুরুকে ফাঁকি দেওয়া যায়? মোষের পিছু পিছু তার মালিকের ঘরে পৌঁছে গেল সাধুবাবা। মালিকের থেকে এক হাজার টাকায় কিনে নিল মোষটাকে। তারপর সেটাকে মেরে সেটার কলজে যেই না সে বের করেছে অমনি কোথা থেকে একটা বাজ এসে ছোঁ মেরে উঠিয়ে নিল সেই মোষের কলজেটা। তখন সাধুও বাজের আকার ধারণ করে সেই বাজের সঙ্গে ঘোর সংগ্রামে লিপ্ত হল।
তালেগোলে বাজের মুখ থেকে মোষের কলজেটা পড়ে গেল। পড়তে পড়তেই সেই কলজে-রূপী ছেলে দেখল যে নীচে রয়েছে সেই রাজ্যের পরমাসুন্দরী রাজকন্যা ববি। মোষের কলজে থেকে এক লহমায় সুন্দর মালা হয়ে সে পড়ল রাজকুমারীর গলায়।
নাছোড়বান্দা সাধু এদিকে হাজির হল রাজার প্রাসাদে। তাকে আপ্যায়ন করে রাজা শুধোল,
‘বলুন কী দিয়ে সেবা করতে পারি আপনার?’
সাধু তখন বলল,
‘আমার শুধু রাজকুমারীর গলার সুন্দর হারটা চাই।’ তলব পড়ল ববির। এদিকে ফাঁকতালে রাজকন্যার সাথে ভালোমতোই মিতালি পেতেছে হাররূপী সেই ছেলে। সে রাজকন্যাকে যেতে যেতে মন্ত্রণা দিল,
‘সাধুর সামনে গিয়ে তুমি গলা থেকে আমাকে খুলে ছুঁড়ে আছাড় মেরে ফেলে দেবে যাতে এই হার টুকরো টুকরো হয়ে যায়…’
রাজকন্যা রাজা আর সাধুর সামনে গিয়ে কথামতোই কাজ করল। তখন সেই হারের টুকরো থেকে উঠে এল সেই ছেলেটা। ব্যপার দেখে চমকে উঠল রাজা। তার মেয়ের সেই ইচ্ছাধারী ছেলের সাথে বিবাহপ্রস্তাব দিল। দু’পক্ষই আনন্দের সাথে রাজি হল তাতে। এইভাবেই রাজার জামাই হয়ে সংসারের অভাব চিরতরে ঘুচিয়ে দিল সেই বুদ্ধিমান বালক। সব দেখেশুনে প্রসন্ন হয়ে সাধুবাবাও নবদম্পতিকে দু’হাত ভরে আশীর্বাদ করে বলল,
‘গুরুর থেকে শিষ্য কখনওই বড় হতে পারে না এই অহংকারী চিন্তা আমাকে পেয়ে বসেছিল। কিন্তু প্রকৃত শিক্ষকের কখনওই এই অহমবোধ থাকতে নেই, কারণ সকলেরই শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের অধিকার রয়েছে।’ এই কথা বলে অন্তর্হিত হল সে।
এরপর …তৃতীয় উপকথা