তানিয়া লস্কর
সিএএ আদতে কোনও নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। বরং সংবিধান যে জন্মসূত্রে তথা রক্তসম্পর্কে নাগরিকত্বের সংজ্ঞা দিয়েছিল যার ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সেটাকে কিছুটা ঘেঁটে দিচ্ছে। অর্থাৎ আগে জন্মের এবং রক্তসম্পর্কের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের অধিকার জন্মাত, কিন্তু এই আইনের মতে সরকারের কাছে প্রথমে বিদেশি বলে হলফনামা দিতে হবে। এরপর সরকার দয়া করলে আপনি নাগরিকত্ব পেলেও পেতে পারেন। সম্পূর্ণ নাগরিকত্ব দেওয়ার সদিচ্ছা থাকলে ২০২১ সালে কিংবা ২০২৩ সালেও রাজস্থানে বসবাসকারী পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু শরণার্থীদের ফিরে যেতে হয় কেন?
ভারতীয় সংবিধান প্রস্তাবনা-সহ আরও নানা অনুচ্ছেদে বারবার সাম্য এবং সমানাধিকারের কথা বলে। সংবিধানের ১৪ নং অনুচ্ছেদ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মস্থানের ভিত্তিতে যে-কোনও ধরনের বৈষম্যকে সরাসরি নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করে। কিন্তু যারা স্বাধীনতার পর নিজেদের সদর দফতরে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেনি, তারা সংবিধানের মর্ম ও মর্যাদা দুটোই ধূলিসাৎ করবে সেটাই স্বভাবিক। তাই করছে। ভারতীয় উপমহাদেশের সম্মিলিত সভ্যতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’-এর একমাত্রিক স্বপ্ন সফল হওয়ার পথে। চেষ্টা তো জোরকদমে চলছে। অনেকেই প্রচণ্ড উৎসাহিত। বিজেপির এক প্রবক্তা দেখলাম উচ্ছ্বাসের চোটে বাংলাদেশকে ‘ম্লেচ্ছ’দের দেশ বলতেও ছাড়লেন না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে নির্বাচনী প্রচারে দেশভাগের ঘা-তে নুনের ছিটে দেওয়া চলবে। আর ইলেকটোরেল বন্ডের থেকেও জনতার নজর ঘোরানো যাবে নাকের ডগায় নাগরিকত্বের ললিপপ ঝুলিয়ে।
কিন্তু ব্যাপারটা কি এতই সরল? শুধু নির্বাচনী অঙ্ক? আমার সেরকম মনে হয় না। কারণ যে দুটি জায়গায় এর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে, অর্থাৎ অসম এবং পশ্চিমবঙ্গ, এ দুই রাজ্যেই আসনের হিসেবে তেমন তারতম্য ঘটবে বলে মনে হচ্ছে না। অসম তো মনে হয় আগে থেকেই সরকারপক্ষের পকেটে আছে। তবে এসব হট্টগোলের মাঝে যে বিষয়টি ঢাকা পড়ে যায় বারবার সেটি হল এর পিছনে পুঁজির হাত। প্রায় সব শ্রেণির পুঁজিপতিরাই টাকা ঢেলে আসছে শাসক দলের লক্ষ্মীর ভাঁড়ারে। পিছনে সেই আদিম অঙ্ক। একটি জাতির কর্তৃত্ব মানেই তো সেই জাতির একটি শ্রেণির হাতে সম্পদের সমাহরণ। আর একটি বিশেষ জাতি বা সম্প্রদায়কে পৃথকীকরণ বা otherization মানে সস্তা শ্রম, কোথাও কোথাও ফাউ হিসেবে কিছু জমি। মায়ানমার, তানজানিয়া, ব্রুনেই ইত্যাদি দেশে সেটাই ঘটেছে। তো সেই পুঁজিপতিদের মুনাফার কী হবে? সম্পূর্ণ নাগরিকত্ব দেওয়ার সদিচ্ছা থাকলে ২০২১ সালে কিংবা ২০২৩ সালেও রাজস্থানে বসবাসকারী পাকিস্তান থেকে আগত হিন্দু শরণার্থীদের ফিরে যেতে হয় কেন? ২০২৩ সনের হিসেবমতে নাগরিকত্ব আইনের ৬ ধারায় নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করা প্রায় ৭৫ শতাংশ দরখাস্ত ভারত সরকারের বিদেশ দফতরে বছরের পর বছর ধরে বিচারাধীন হয়ে আছে। ২০২১-এ প্রায় শতাধিক লোক বিমুখ হয়ে পাকিস্তানে ফিরে গেছেন। তার আগেও গেছেন বহু লোক। এগুলো সব নানাসময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর। আর অনেকগুলো ডিটেনশন ক্যাম্পে বর্তমানে আছেন কয়েক হাজার মানুষ। এবার ৬-বি ধারায় যাঁরা আবেদন করবেন তাঁদের গতি কি ভিন্ন হবে?
২০১৯ সালে পাশ করা আইনমতে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্শি, খ্রিস্টান ধর্মের লোকেরা ৬-বি নিয়মের অধীনে নাগরিকত্বের সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন। কিন্তু এই নিয়মের অধীনে আবেদন করতে হলে প্রথমে সরকারি পোর্টালে পঞ্জিকরণ করতে হবে। তারপর জেলা প্রশাসনের অফিসে গিয়ে হলফনামা সাক্ষর করতে হবে। জেলা প্রশাসন সেটা আপলোড করবে পোর্টালে। সেখান থেকে যাবে এম্পাওয়ার্ড কমিটির দরবারে। তারা মঞ্জুরি দিলে তবেই হবে নাগরিক হিসেবে পঞ্জিকরণ। আবেদনের সঙ্গে গেঁথে দিতে হবে ৬-বি নিয়মের সঙ্গে জারি করা তালিকা ১-এ উল্লেখিত নথিপত্র। যার মধ্যে আছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কিংবা বাংলাদেশের পাসপোর্ট, জন্ম বা শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণপত্র, লাইসেন্স অর্থাৎ কিনা এমন যে-কোনও প্রমাণপত্র যা প্রমাণ করে যে আবেদনকারীর কিংবা তাঁদের মা-বাবা, কিংবা তাদের ঠাকুমা-ঠাকুরদা ওই তিনটি দেশ থেকে এসেছেন। কজনের আছে এসব?
তাছাড়া ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনে ইতিমধ্যে যত সংশোধন করা হয়েছে সেগুলোর মতে যে-কোনও ব্যক্তি, তিনি হিন্দু মুসলমান যাই হন, তাঁর জন্ম যদি ১৯৮৭ সালের ১ জুলাইয়ের পর হয় তাহলে তাঁর মা-বাবা অনাগরিক হলেও জন্মসূত্রে তিনি ভারতীয় নাগরিক। যাঁদের মা-বাবার যে-কোনও একজন ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বরের আগে ভারতে জন্মেছেন তাঁরা রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে ভারতীয় নাগরিক। আবার অসমের ক্ষেত্রে যাঁরা ৬-ক ধারামতে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে এসেছেন তাঁরাও ভারতীয় নাগরিক, আবার ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত যাঁরা এসেছেন তাঁরা নিজেদেরকে এফআরআরএ অফিসে পঞ্জিকরণ করার ১০ বছর পর থেকে ভারতীয় নাগরিক। তাই সিএএ আদতে কোনও নাগরিকত্ব দিচ্ছে না। বরং সংবিধান যে জন্মসূত্রে তথা রক্তসম্পর্কে নাগরিকত্বের সংজ্ঞা দিয়েছিল যার ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন সেটাকে কিছুটা ঘেঁটে দিচ্ছে। অর্থাৎ আগে জন্মের এবং রক্তসম্পর্কের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের অধিকার জন্মাত, কিন্তু এই আইনের মতে সরকারের কাছে প্রথমে বিদেশি বলে হলফনামা দিতে হবে। এরপর সরকার দয়া করলে আপনি নাগরিকত্ব পেলেও পেতে পারেন। এবার যেহেতু ৬-বি-এর নিয়মগুলো খুব ভালভাবে সংজ্ঞায়িত এবং পোর্টাল ইত্যাদি আছে তো মানুষজন স্বাভাবিকভাবেই সেই নিয়মেই নাগরিকত্ব আবেদন করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। সেই আবেদন যদি অগ্রাহ্য হয় তাহলে কী হবে? তাই খাল দিয়ে যাতে কুমির না ঢোকে সেটা মাথায় রাখতে হবে।
মনে রাখতে হবে আইন বানানোর মাধ্যমে গল্প শেষ নয়, বরং শুরু হয়েছে। নুরেনবার্গ আইনের কথা মনে আছে? প্রথমে শুধু ইহুদিদের লক্ষ্য করা হলেও পরে সময়ে সময়ে এর আওতায় আনা হয় ‘রোমা’দের, পোলিশদের, স্লাবকদের এমনকি সমকামী তথা আদর্শগতভাবে বিরোধী লোকদেরকেও। ভারতেও এমন কিছু ঘটে যেতেই পারে। বর্তমানে জেলে আছেন বহু অ-মুসলিম রাজনৈতিক বিরোধী। এটা কীসের বার্তা দেয়?
মুসলমানদের কষ্ট দিতে গিয়ে সংবিধানকে ধ্বংস করার পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা ভবিষ্যতে নিজেদের রক্ষা করবেন কোন হাতিয়ারের বলে? বিশ্বের একটি বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের যে সুনাম ছিল সেটাও ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। হিটলারের জার্মানি থেকে কোনও খবর বেরিয়ে আসতে সময় লাগত। মুসোলিনির ইতালি থেকেও। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো লোককেও ভুল বোঝানো হয়েছিল। আজকের দিনে সেটা সম্ভব নয়। একদিন না একদিন এসবের যবনিকা পড়বেই নিশ্চিত। কিন্তু শেষের সেদিনে পৌঁছনোর রাস্তা কতটা ভয়ঙ্কর সেটা বুদ্ধিমান লোকেরা আন্দাজ করে নেবেন।
*মতামত ব্যক্তিগত
আপাততঃ শাসকদল খুব গুছিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। জনগণ দোনামোনা করেও বুঝতে পারছে বিরোধীরা ছন্নছাড়া, কোন স্ট্র্যাটেজি নেই, প্ল্যান নেই, তাদের সুযোগ দিলেও কী করবে তার দিশা নেই। বারবার ওদের বানানো স্ক্রিপ্ট ধরে একটু সোস্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে। খন্ডিত রাজ্যদলের দেশভিত্তিক ভিশান নেই। তাই জনগণ বর্তমান অবস্থার বদলে বেটার কিছু না দেখতে পেলে পরিবর্তন চাইবেনা। সাধারণত anti-incumbency শোনা যায় কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত আমাদের দেশে pro-incumbency আজ বেশি জোরালো।
তাই এই অবস্থায় ওরা নিজেদের এজেন্ডার প্রতিটি আইটেম পূর্ণ করে নেবে সেটাই স্বাভাবিক।