সুজন ভট্টাচার্য
৩১/১২/২০১৪ বা তার আগে বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে বৈধ কাগজ ছাড়া যাঁরা ভারতে চলে এসেছেন, তাঁদের দুটো অংশ। যাঁদের নাম ইতিমধ্যেই ভোটার তালিকায় ওঠেনি, একমাত্র তাঁরাই নিশ্চিন্তে আবেদন করতে পারেন। অন্তত জাল নথির ভিত্তিতে ভোটার তালিকায় নাম তোলার অভিযোগ আসবে না। কিন্তু আদৌ কি এমন কেউ আছেন? সম্ভবত নয়। তার মানে প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়ার পরেও ভোটার লিস্টে জালিয়াতি করার অভিযোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, পাসপোর্ট আইন ও বিদেশি আইনের অধীনে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তকমা থেকে ছাড় পাওয়ার বিষয়টির সুরাহা কোনওদিনই হবে না
অবশেষে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯-এর নিয়মাবলি প্রকাশিত হল। এই সামান্য কাজের অন্য চার বছর সময় লাগল কেন, কিংবা লোকসভার ভোটের ঠিক আগেই কেন করা হল, সেই বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অনেকেই আছেন। তাই সেই বিষয়ে আর ঢুকছি না। বলাই বাহুল্য, ভোট-বৈতরণী পার করার তাগিদ এই দেশের প্রায় যাবতীয় সু ও কুকর্মের আদি উদ্দেশ্য। এখানেও তেমনই হওয়া উচিত। না হলেই বরং আশ্চর্য হওয়ার কথা। তবে ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে সুপ্রিম কোর্টের চরম তিরস্কারের দিনই যে এই ঘটনাটা ঘটল, সেটা নিতান্ত কাকতালীয় নাও হতে পারে। যাই হোক, এবারে মূল আলোচ্যে আসি।
কোনও আইন বা তার সংশোধনী আইনসভায় পাশ হওয়ার পরে রুলস বা বিধি প্রনয়ণের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সরকারের। আইনে বলা থাকে, কী করতে হবে। আর সেই কাজ কীভাবে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সম্পন্ন করা হবে, সেটাই বিধিতে নির্দিষ্ট করা হয়। আরেকটা কথা, বিধি কখনওই আইনের ধারাটিকে টপকে কিংবা সংশোধিত করে কোনও পদক্ষেপ নিতে পারে না। সেই হিসাবে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯-এ চারটে বিচার্য ছিল।
- ধারা 2(1)(b)-র শেষে নতুন অনুচ্ছেদ যোগ করা। সেই অনুচ্ছেদে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে বা তার আগে আফগানিস্তান, বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তান থেকে ভারতে আসা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ যাঁদের পাসপোর্ট আইন এবং ফরেনার্স আইনের প্রয়োগ থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে, তাঁদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসাবে গণ্য না করার কথাই বলা হয়েছে। (এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিষয়টি কিন্তু পাসপোর্ট আইন এবং বিদেশি আইনের ভিত্তিতেই বিচার করতে হবে, যে বিষয়ে পরে আসা যাবে)।
- ধারা 6(b)র সংযোজন। এই ধারা অনুযায়ী নাগরিকত্ব আইনের এই সংশোধন অসম, মণিপুর, মিজোরাম ও ত্রিপুরাতে প্রযোজ্য হবে না।
- ধারা 7(D) সংশোধন। এর ফলে ভারত সরকার বিদেশে বসবাসকারী ভারতীয় নাগরিকদের নাগরিকত্ব খারিজ করতে পারবে।
- মূল আইনের সপ্তম তফসিল সংশোধন। ভারতে বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশি নাগরিকদের নাগরিকত্ব অর্পণের (Naturalisation) জন্য এই দেশে বসবাসের ন্যূনতম সময়সীমা ১১ বছরের পরিবর্তে ৫ বছর করা।
বিস্তারিত ব্যাখ্যার মধ্যে না ঢুকে এটূকুই আপাতত বলা যাক, ভারতে নাগরিকত্ব চারটি পদ্ধতিতে পাওয়া যায়— ক) জন্মসূত্রে, খ) উত্তরাধিকার সূত্রে, গ) রেজিস্ট্রেশন বা নথিভুক্তির মাধ্যমে এবং ঘ) নাগরিকত্ব অর্পণের মাধ্যমে। আজ যাঁরা নাগরিকত্ব পাবেন বলে আনন্দে লাফাচ্ছেন, তাঁরা আসলে নাগরিকত্ব অর্পণের কথাই বলছেন। এবং একদম শুরুতে যে সংযোজনের কথা বলা হয়েছে, সেটি দেখলেও বোঝাই যাবে এই সংশোধনীর লক্ষ্য কারা। বিতর্কের পুরো বিষয়টাই দাঁড়িয়ে আছে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, ২০১৯-এর ধারা 2(1)(b)-র উপরে। আগেই বলেছি, বিষয়টিকে Passport (Entry into India) Act, 1920 এবং Foreigner’s Act, 1946-এর ভিত্তিতেই বিচার করতে হবে, সেটা এই সংশোধনী পড়লেই বোঝা যায়। তাহলে আগে সেই দুটো বিষয় দেখে নেওয়া যাক।
পাসপোর্ট আইনের অধীন Passport (Entry into India) Rules 1950-তে ২০১৫ সালে সংশোধন করা হয়। সেই সংশোধনীতে বলা হয়, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৪ বা তার আগে বৈধ কাগজ ছাড়াই ধর্মীয় নিপীড়ন কিংবা সেই ভয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয় নেওয়া হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের এই আইনের প্রয়োগ থেকে ছাড় দেওয়া হবে। একইভাবে Foreigner’s Act, 1946-এর অধীন Foreigner’s Order, 1948-এ এই সমস্ত মানুষদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর অভিযোগ থেকে রেহাই দেওয়া হয়। এই দুই আইনে কিন্তু আফগানিস্তানের কথা নেই। সেক্ষেত্রে বিষয়টা কিঞ্চিৎ জটিল হয়ে গেল।
যাই হোক, আইন অনুযায়ী ৩১/১২/২০১৪ তারিখে বা তার আগে কোন হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি কিংবা খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতে চলে এলেই হবে না। তাঁকে ধর্মীয় নিপীড়ন কিংবা সেই আশঙ্কার ভিত্তিতেই আসতে হবে। একমাত্র সেক্ষেত্রেই এই আইনের সুযোগ পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটি প্রমাণ হবে কী করে? আইনে তার কোনও বিধান নেই। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের কোনও থানায় এই মর্মে অভিযোগ কিংবা মিডিয়া রিপোর্ট একটা আপাত-গ্রহণযোগ্য নথি হতে পারে। কিন্তু আমরা সবাই জানি, এই ধরনের লিখিত নথি থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
এবারে আসি Citizenship Amendment Rules প্রসঙ্গে। এই বিধির মূল বিষয় হল ২০০৯ সালের বিধিতে Rule 10A সংযুক্ত করা, যেখানে Citizenship by Registration or Naturalisation-এর আবেদনের ছাড়ের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব পাওয়ার কথা ভাবছেন, আর যাঁদের কোনও ছাড় ছাড়া এমনিতেই পাওয়ার কথা, সবারই আবেদনপত্র এক। সেটা হতেই পারে। কিন্তু Passoport Act আর Foreigner’s Act-কথিত ধর্মীয় নিপীড়ন কিংবা তার আশঙ্কায় বৈধ কাগজ অর্থাৎ পাসপোর্ট-ভিসা ছাড়াই ভারতে চলে আসার প্রসঙ্গটি কীভাবে নির্ধারিত হবে? তার কোনও উত্তর কিন্তু নেই। স্পষ্টতই বলা যায়, প্রকাশিত Rules এক্ষেত্রে Act অর্থাৎ আইনকে টপকে গেছে, যা হওয়া সম্ভব নয়। পরবর্তীকালে কেউ যদি এই বিষয়ে আদালতের শরণাপন্ন হন, তাহলে পুরো প্রক্রিয়াটাই খারিজ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
আবেদনের সঙ্গে তিনটি স্তরের নথি যুক্ত করতে বলা হয়েছে। Schedule 1A-তে বলা নথিগুলোর মধ্যে যে কোনও একটি দিতে হবে। এগুলো আবেদনকারী যে দেশ থেকে এসেছেন, সেই দেশের সরকারের দেওয়া যে কোনও নথি, যেমন পাসপোর্ট, জন্মের সার্টিফিকেট, শিক্ষাগত সার্টিফিকেট কিংবা জমির মালিকানার দলিল ইত্যাদি। একইভাবে schedule 1B-তে বলা ভারত সরকারের দেওয়া যে-কোনও নথি যেমন ভিসা, সেনসাসের স্লিপ, জন্মের সার্টিফিকেট, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, প্যান কার্ড ইত্যাদির যে-কোনও একটি দিতে হবে। সঙ্গে schedule 1C অনুযায়ী এফিডেবিট।
বিদেশের নথি নিয়ে সমস্যা কী হতে পারে, জানা নেই। কিন্তু এ-দেশের নথি নিয়ে সমস্যা অবশ্যই আছে। ধরা যাক আধার কার্ড। প্যান কার্ড এবং EPIC অর্থাৎ ভোটার কার্ডের সঙ্গে ইতিমধ্যেই যুক্ত করা হয়েছে। তার মানে এমন তথ্য পেলে খুব সহজেই বের করে ফেলা যাবে, আবেদনকারীর নাম ভোটার তালিকায় আছে কিনা। যদি থাকে, আবেদনকারী জাল নথি দিয়ে ভোটার তালিকায় নাম তোলার দায়ে অভিযুক্ত হতেই পারেন। পরিণামে জেলবাস। হ্যাঁ, সহজ সমাধান একটা আছে। স্থানীয় পঞ্চায়েত বা পৌর প্রতিনিধির সার্টিফিকেটও চলবে। যাক, দুশ্চিন্তা গেল। কিন্তু গেল কি? এমন অভিযোগ তো যে কেউই করতে পারেন। সেটা সামালানো যাবে কী করে?
এতক্ষণ বলছিলাম Rules আইনকে টপকে গেছে। না, সেটাকে সামলানোর চেষ্টা করা হয়েছে Schedule 1C-তে বলা এফিডেবিটে। এফিডেবিটের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আবেদনকারীকে ঘোষণা করতে হবে যে তিনি পাসপোর্ট আইন ও বিদেশি আইনে দেওয়া ছাড়ের উপযুক্ত। সেই ছাড় যে ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে বা তার আশঙ্কায় ভারতে আশ্রয় নেওয়ার ভিত্তিতেই হতে পারে, সেটা আমরা আগেই দেখেছি। এফিডেবিটের এই অংশের জন্য কোনও প্রমাণ দিতে হবে না। বাস্তবত সেই প্রমাণ থাকাটাও সম্ভব নয়। তাহলে? পুরো বিষয়টাই তো ঘেঁটে ঘ হয়ে যাচ্ছে। তার মানে পরবর্তীকালে মিথ্যে এফিডেবিটের অভিযোগের চাপ থেকেই যাবে। হ্যাঁ, NRC-র সহজ শিকারও হবেন এঁরাই।
তাহলে কী দাঁড়াল? ৩১/১২/২০১৪ বা তার আগে বাংলাদেশ বা পাকিস্তান থেকে বৈধ কাগজ ছাড়া যাঁরা ভারতে চলে এসেছেন, তাঁদের দুটো অংশ। যাঁদের নাম ইতিমধ্যেই ভোটার তালিকায় ওঠেনি, একমাত্র তাঁরাই নিশ্চিন্তে আবেদন করতে পারেন। অন্তত জাল নথির ভিত্তিতে ভোটার তালিকায় নাম তোলার অভিযোগ আসবে না। কিন্তু আদৌ কি এমন কেউ আছেন? সম্ভবত নয়। তার মানে প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই নাগরিকত্ব পেয়ে যাওয়ার পরেও ভোটার লিস্টে জালিয়াতি করার অভিযোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, পাসপোর্ট আইন ও বিদেশি আইনের অধীনে অবৈধ অনুপ্রবেশকারীর তকমা থেকে ছাড় পাওয়ার বিষয়টির সুরাহা কোনওদিনই হবে না। সেক্ষেত্রে তাঁদেরও আমৃত্যু আশঙ্কায় থাকতে হবে।
বিস্তর ঢাকঢোল বাজিয়ে, সভা সাজিয়ে যা করা হচ্ছে, তাতে সাধারণ মানুষেরই বিপদ বাড়ার সম্ভাবনা। অবোধের অবশ্য চিরকালই গোবধে আনন্দ। তাই এই কথা প্রায় কারও কানেই ঢুকবে না। উল্লাসের নৃত্য চলছে, চলবে।
*মতামত ব্যক্তিগত