সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
বহুদিনের কার্যকর উৎসকে এড়িয়ে নতুন ব্যবস্থাকে বরণ করে নিতে গিয়ে বেঙ্গালুরুবাসীরা হেলায় হারিয়েছে জলের চিরন্তন বিশ্বস্ত উৎসগুলোকে। সাবেকি কুয়োগুলো এখন দৃশ্যমান নয়। পরিবর্তে জলের উৎস হিসেবে বোরহোলের যথেচ্ছ খনন মজুত ভৌমজলভাণ্ডার নিঃশেষ করে ফেলছে। অতীতের হ্রদ বা লেকগুলো ছিল ভৌমজলভাণ্ডার নবীকরণের প্রধান মাধ্যম। আজকের বেঙ্গালুরুতে লেকের অস্তিত্ব বিপন্ন, বিলীয়মান। প্রতিদিন একটি করে সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে হত্যা করে লোভী চাষির যেমন হাল হয়েছিল আজকের বেঙ্গালুরুর ঠিক যেন তেমনই অবস্থা
সেদিন সাতসকালেই চোখ খুলে দেখি আমার অত্যন্ত বিশ্বস্ত ও স্নেহভাজন এক মানুষ একটা উদ্বেগজনক খবর পাঠিয়েছেন হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর বর্তমান বসত-শহরকে নিয়ে— বেঙ্গালুরু শহরে সুতীব্র জলসঙ্কটে বিপর্যস্ত জনজীবন। মার্চ মাসের গোড়াতেই এমন জল নাই-জল নাই কলরব বেঙ্গালুরু তথা কর্নাটক রাজ্যের অধিবাসীদের কাছে এক অশনিসঙ্কেত বয়ে নিয়ে এসেছে। সাম্প্রতিককালে এই দক্ষিণি জনপদটিকে ঘিরেই দেশের তরুণ প্রজন্মের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও ভাবী স্বপ্ন দোলায়িত হয়। অন্য প্রদেশের কথা বাদ দিলেও বলা যায় আমাদের রাজ্যের প্রতি দশজন তরতাজা যুবক-যুবতীর মধ্যে অন্তত পাঁচজন কর্মস্থল হিসেবে এই শহরটিতে তাদের আস্তানা গেড়েছে। এমন প্রবণতা প্রসঙ্গে কোনও তির্যক মন্তব্য করা আজকের কর্মখরার দিনে অনুচিত। তাই সে-কথা নিয়ে কিছু বলার নেই। খালি বলব আশা-আকাঙ্ক্ষা আর আয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে এবার বোধহয় যুক্ত হতে চলেছে আশঙ্কা— জলসঙ্কটের আশঙ্কা। ভিনপ্রদেশের অধিবাসী হয়েও এই বিষয়টি নিয়ে দুই-একটি কথা বলা নিশ্চয়ই অন্যায় হবে না। কেননা যে সমস্যার আঁচ আজ বেঙ্গালুরুকে বিপন্ন করছে আগামী দিনে তা আমাদেরও বিপন্ন করবে অনিবার্যভাবে। তাই এখন থেকেই সতর্ক হতে হবে আমাদের। আসলে বেঙ্গালুরুর এই সঙ্কট গোটা দেশের জন্য, বিশেষ করে উপার্জনমুখী জনমানুষের ভিড়ে ভারাক্রান্ত শহর বা নগরগুলোর জন্য, ক্রমশই এক লাল সঙ্কেত।
কর্নাটক রাজ্যের জল-ছবি
ওপরের মানচিত্রে দর্শিত হয়েছে কর্নাটক রাজ্যের নদীবিন্যাস ব্যবস্থা। জালের মতো জমি আগলে রাখা অসংখ্য নীল রেখাগুলো হল নদী। একনজরে মনে হতেই পারে কর্নাটক একটি নদীপরিবৃত রাজ্য। তাহলে জলসঙ্কট কেন?
স্কুলবেলার ভূগোলের কথা যাদের এখনও স্মরণে আছে তারা একথা নিশ্চয়ই জানেন যে সহ্যাদ্রি বা পশ্চিমঘাট পর্বত হল দক্ষিণাপথ মালভূমির প্রধানতম জলবিভাজিকা। বর্ষাকালে এই পর্বতের ওপর প্রবল রভসে আছড়ে পড়া মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে দক্ষিণি রাজ্যগুলোতে বর্ষার পসরা আসে। ভরসা জাগে মানুষ ও তৃষিত প্রাণীদের মধ্যে। বর্ষার খলখল করে বয়ে যাওয়া জলের ছোঁয়া পেয়ে কুলকুল জলতরঙ্গ তুলে বইতে থাকে স্রোতস্বিনীধারা।
বর্ষার জলেই পরিপুষ্টি লাভ করে তরঙ্গিত তটিনীরা। মালভূমির অসমান পৃষ্ঠভাগের ওপর দিয়ে বর্ষাকালে খরতোয়া ধারায় বয়ে যায় নদীর ধারা। এই বর্ষাপুষ্ট নদীর জল বাঁধ বা হ্রদে ধরে রেখেই চলে সম্বৎসরের জল-বাজেটের হিসেবনিকেশ। মালভূমির পূর্ব ঢাল গড়িয়ে নেমে আসা নদীগুলোর মধ্যে ছয়টি নদী প্রধান। এরা হল— কাবেরী, কৃষ্ণা, গোদাবরী, তুঙ্গভদ্রা, উত্তর ও দক্ষিণ পেন্নার। কর্নাটক রাজ্যের জনজীবনে এই নদীগুলোর প্রভাব অপরিসীম। সহ্যাদ্রি পর্বতের উচ্চতর অংশ থেকে বয়ে আনা এইসব নদীর জলেই কন্নড়বাসী মানুষজনের প্রয়োজন মেটে, পরিপূরিত হয় কৃষিজমির তৃষ্ণা।
সহ্যাদ্রি পর্বতের খাঁড়া পশ্চিমা ঢাল বরাবর নেমে আসা নদীগুলো, যেমন মান্ডবী, শরাবতী, কালী, চক্রা, নেত্রবতীর জলকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদিত হয় জলবিদ্যুৎ। পৃথিবীর সমস্ত দেশে এমনটাই দস্তুর। কর্নাটক এই নিয়মের ব্যতিক্রম হয় কীভাবে?
তবে রাজ্যের নদীদের প্রধান সমস্যা হল এই যে নদীগুলো কেবলমাত্র বৃষ্টির জল দ্বারাই পরিপোষিত। ফলে কোনও বছর বৃষ্টির পরিমাণ যদি পর্যাপ্ত না হয় তবে বাৎসরিক জলের জোগানে ভাঁটা পড়ে, বাড়ে জলের অভাব, আশঙ্কায় ক্লিষ্ট হয় নাগরিকসমাজ। এবারের পরিস্থিতি অনেকটাই এরকম। এই বিষয়ে আলোচনা করব আর একটু খোলা মেজাজে। তবে তার আগে জলের অন্যতর উৎস অর্থাৎ রাজ্যের ভৌম জলের ভাণ্ডার সম্পর্কে কিছু জরুরি কথা বলে নেব। কেননা এবারের সঙ্কটের আবহে সেই আলোচনাও জরুরি।
নদীর প্রবহমান জলের উৎস ছাড়াও আমরা ভৌমজলের ভাণ্ডারের ওপরও ভীষণরকমের নির্ভরশীল। ধরিত্রীর বুকে যুগ যুগ ধরে সঞ্চয় করে রাখা মিঠা পেয় জল তুলে এনে আমরা আমাদের প্রয়োজন মেটাচ্ছি বহুদিন ধরে। বেঙ্গালুরু ও তার আশপাশের এলাকায় এভাবে বোরহোল নলকূপের সাহায্যে জল তুলে এনে চাহিদা পূরণ করতে হয়। তবে এখানেও সমস্যা রয়েছে। প্রাচীন গ্রানাইট ও নিস শিলার শক্ত মলাটে মোড়া কর্নাটক রাজ্যে বৃষ্টির জল অপ্রবেশ্য শিলার ফাঁকফোকর গলে ভূগর্ভে সেভাবে প্রবেশ করতে পারে না। আমাদের রাজ্যের বড় অংশ জুড়েই রয়েছে নরম সুপ্রবেশ্য পলির প্রলেপ, ফলে বৃষ্টির জল খুব সহজেই মাটির গভীরে ঢুকে যেতে পারে। যার ফলে পরিপুষ্ট হয় ক্ষীয়মান ভৌম জলভাণ্ডার। কর্ণাটক রাজ্যের এমন সুবিধা সীমিত। তাহলে জল মিলবে কোথা থেকে?
একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন?
এখানে এসেই একটু থমকে যেতে হয়। আমাদের বুঝতে হবে জলের এই সমস্যা কখনওই এক দিনের নয়। তিল তিল করে বাড়তে বাড়তে আজ তা বিস্ফোরিত হয়েছে। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেই বেঙ্গালুরুর জলবায়ু খানিকটা শুষ্ক মরুদেশীয় প্রকৃতির, স্বল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত। এই অঞ্চলের আদি বসতি স্থাপনকারী মানুষজন এই বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিলেন একেবারে গোড়াতেই। আর সেই কারণেই তাঁরা বৃষ্টির জলকে ধরে রাখার উদ্দেশ্যে বহুসংখ্যক কেরে বা হ্রদ খনন করেন, কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় জলের জোগানের কথা মাথায় রেখে খনন করা হয় বেশ কয়েকটি বড়সড় সরোবর বা পুষ্করিণী। পাথুরে চাট্টান খুঁড়ে এগুলো নির্মাণ করা খুব যে সহজসাধ্য ছিল তা হয়তো নয়, তবে জলের সঙ্কট নিরসনের লক্ষ্যে এটা ছিল সন্দেহাতীতভাবে এক জরুরি ও দূরদর্শী উদ্যোগ। মালভূমির উচ্চাবচ তরঙ্গায়িত ভূমিরূপ এই কাজের পক্ষে সহায়ক ছিল। অতীতের এমন সব কার্যকলাপের এক চমৎকার শিলালিপি বিবরণী পাওয়া যায় বেঙ্গালুরুর পুরনো এয়ারপোর্টের নিকটবর্তী বিভূতিপুরায় যেখানে বিবৃত হয়েছে কীভাবে ১৩০৭ খ্রিস্টাব্দে এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনকারী মানুষজন জঙ্গল কেটে, জমিকে সমান করে গ্রামবসতির পত্তন করেছিল। চোল রাজবংশের শাসকেরা বৃষ্টির জল সংগ্রহ করতে বহুসংখ্যক কেরে বা সরোবর খনন করিয়েছিলেন। তাঁদের কথায় এই জলাশয়গুলো চিহ্নিত করা হত সমুদ্র বা সান্দ্রা নামে। আজকের বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত থিপ্পাসান্দ্রা, মাল্লাসান্দ্রা, সিংহাসান্দ্রা অথবা জুন্নাসান্দ্রা প্রভৃতি নামের আড়ালে জলাশয় বা সরোবরের অতীত অস্তিত্বটুকুই এখনও টিকে আছে। হাল আমলের উন্নয়নের ঠেলায় বিলকুল লোপাট হয়ে গেছে এককালের অত্যন্ত কার্যকর জলাশয়গুলো।
সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে যে বেঙ্গালুরু অঞ্চলের স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ভূমিঢালকে যথার্থ মান্যতা দিয়ে কীভাবে আদি অধিবাসীরা এক আদর্শ জল সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ঢাল-বরাবর নেমে আসা জলকে তাদের উজানে পরিশোধিত করে হ্রদের ভাটি অংশে সঞ্চয় করা হত। এই জলাশয়গুলোকে ঘিরে নির্মাণ করা হয়েছিল বড় বড় ইঁদারা। এগুলো বৃষ্টির জলকে ধরে রাখত সম্বৎসরের ব্যবহারের প্রয়োজনে। যে বছরগুলোতে পর্জন্যদেবের দাক্ষিণ্যে সরোবরের জল উপচে পড়ত সেই বছরগুলোতে সরোবর-দেবী দুগ্গালাম্মার বন্দনায় মেতে উঠত গ্রামের মানুষেরা। এই পরম্পরায় বিশ্বস্ত ছিলেন কেম্পেগৌড়া ও তাঁর অনুবর্তী শাসকেরা, মহীশূরের শাসকেরা, মায় ব্রিটিশ শাসকবর্গ। একটু একটু করে জনসংখ্যা বাড়লেও কেরে নির্মাণের ঐতিহ্যকে কখনওই ত্যাগ করেনি পূর্বতন শাসকেরা। স্থানীয় মানুষদের বিশ্বাস ও বোধের প্রতি সকলেই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। আর তাই জনপদ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কেরে খননের কাজ চলেছে সমান্তরালভাবে। ১৮৯২ সালে স্যাঙ্কি ট্যাঙ্ক খোঁড়ার মধ্যে দিয়ে বাস্তব পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ যাপনের এক দীর্ঘ পরম্পরায় ভাঁটা পড়তে শুরু করে।
অত্যাধুনিক নাগরিক জলপরিষেবা ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করার লক্ষ্যে সাবেকি সরোবর, কুয়োকেন্দ্রিক জল পরিচলন ব্যবস্থাকে বাতিল করে অর্কাবতী নদীর অববাহিকা থেকে পরিশোধিত পাইপলাইনের জল সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হল। ধীরে ধীরে এই পরিষেবা কার্যকর হতেই এতকাল ধরে চলা টেকসই ব্যবস্থা বাতিল করে দিল বৃহত্তর নাগরিক সমাজ। দৃষ্টিভঙ্গির এমন চটজলদি পরিবর্তন সরোবরের অস্তিত্ব সঙ্কটের কারণ হয়ে উঠল অচিরেই। যে সরোবরের জল দীর্ঘদিন ধরে মানুষের প্রয়োজন মিটিয়েছে সেগুলোকে তড়িঘড়ি ম্যালেরিয়া তথা মশার আঁতুড়ঘর বলে চিহ্নিত করে ভরাট করে বুজিয়ে ফেলার কাজ শুরু হল জোরকদমে। এভাবেই সাম্পাঙ্গি লেকের জায়গায় তৈরি করা হয়েছে আজকের কান্তিরাভা স্টেডিয়াম, শুলে ট্যাঙ্ক পরিবর্তিত হয়েছে ঝাঁ চকচকে গরুড় মলে। কেবলমাত্র উলসুর লেককে বাদ দিয়ে আর সব জলাভূমি বুজিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে গগনচুম্বী হর্ম্যমালা, আলোকিত শপিং মল, বাসস্ট্যান্ড, সরকারি আবাসন, অফিসকাছারি আরও কত কী!!
বহুদিনের কার্যকর উৎসকে এড়িয়ে নতুন ব্যবস্থাকে বরণ করে নিতে গিয়ে বেঙ্গালুরুবাসীরা হেলায় হারিয়েছে জলের চিরন্তন বিশ্বস্ত উৎসগুলোকে। পরম্পরাগত ব্যবস্থাপনাকে বাতিল করে নতুন কিছু করে দেখানোর প্রচেষ্টা গোটা বিষয়টিকে জটিল থেকে জটিলতর করে তুলেছে। একদিকে বিশ্ব-উষ্ণায়ন, বৃষ্টিপাতের অনিয়মিতি অন্যদিকে উচ্চাকাঙ্খী চটকদারী শিকড়ছেড়া দৃশ্যমান উন্নয়ন জলসঙ্কটের তীব্রতা বাড়িয়েছে সন্দেহাতীতভাবে। সাবেকি কুয়োগুলো এখন দৃশ্যমান নয়। পরিবর্তে জলের উৎস হিসেবে বোরহোলের যথেচ্ছ খনন মজুত ভৌমজলভাণ্ডার নিঃশেষ করে ফেলছে। অতীতের হ্রদ বা লেকগুলো ছিল ভৌমজলভাণ্ডার নবীকরণের প্রধান মাধ্যম। আজকের বেঙ্গালুরুতে লেকের অস্তিত্ব বিপন্ন, বিলীয়মান। জলসঙ্কট তার অনিবার্য প্রতিফল। প্রতিদিন একটি করে সোনার ডিম পাড়া হাঁসটিকে হত্যা করে লোভী চাষির যেমন হাল হয়েছিল আজকের বেঙ্গালুরুর ঠিক যেন তেমনই অবস্থা।
সন্দেহাতীতভাবে বেঙ্গালুরু ভারতের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল একটি মহানগরী। বছরপিছু ৩.১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে এই শহরটি। ২০১১ সালে এই মহানগরীর জনসংখ্যা ছিল ৮৪,৪৩,৬৭৫ জন। ২০২৩ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩৬,০৮,০০০ জন। আগামীদিনে এই সংখ্যা ২০০০০০০০ ছাপিয়ে যাবে বলে অনুমান। এই বিপুল জনসংখ্যার চাপ সামলাতে গিয়ে নাভিশ্বাস উঠেছে নগর-প্রশাসনের। যে হারে লোকসংখ্যা বেড়ে চলেছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নাগরিক পরিষেবা বৃদ্ধি করা এককথায় অসম্ভব। আকাশছোঁয়া অট্টালিকার সারি এক আত্মঘাতী উন্নয়নের প্রতীক। অথচ সেই পথেই হাঁটছে আজকের নগর পরিষেবা ব্যবস্থা। বৃষ্টির অভাবে ভৌমজলস্তর দ্রুত নামার কারণে অধিকাংশ বোরহোল আজ শুকিয়ে গেছে। কয়েক ফোঁটা জল সংগ্রহের জন্য বাড়ছে দীর্ঘ প্রতীক্ষা, সহবাসীরা জড়িয়ে পড়ছেন বিবাদ-বিসংবাদে। পার্শ্ববর্তী রাজ্যের সঙ্গে নদীজলের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে বাড়ছে রাজনৈতিক বিসংবাদ।
কী আশায় বাঁধি বাড়িঘর
ওপরের মানচিত্রে দর্শিত হয়েছে বেঙ্গালুরুর পরিবর্তিত ভূমি-ব্যবহার ব্যবস্থা। একসময়ের সবুজের সমারোহে ভরে থাকা শান্ত জনপদটি আজ নিরেট কংক্রিটের মলাটে নিজের শরীর মুড়ে ফেলেছে। এমন রূপান্তরের সবটাই ঘটেছে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে। আর তাই গতবছরের বৃষ্টির স্বল্পতার কারণে সব শুকিয়ে যাওয়ার হাহাকার।
আজ যখন গোটা মহানগর জুড়ে পিপাসুদের হইচই, কলরব তখন প্রত্যাশিতভাবেই মিডিয়ার মানুষজন আশঙ্কায় ত্রস্ত। সরকারের পক্ষ থেকেও নানান উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আরোপিত হয়েছে নানান বিধিনিয়ম। বেঙ্গালুরুতে বেসরকারি ট্যাঙ্কার মালিকরা ঝোপ বুঝে কোপ মারতে শুরু করেছে অনিবার্যভাবে। পয়সাওয়ালা মানুষজন পকেট উজাড় করে জল কিনছেন, তবে পরিস্থিতি দীর্ঘায়িত হলে তাঁদের পক্ষেও কষ্টকর হয়ে যাবে বিষয়টি। আম-আদমির সমস্যা গহীন। জল কিনে খাওয়ার ক্ষমতা সীমিত। এঁদের কথাই প্রশাসনকে বিশেষভাবে ভাবতে হচ্ছে। ইতোমধ্যেই অত্যন্ত সঙ্কটাপন্ন এলাকাগুলোতে ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে পানীয় জলের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে, ট্যাঙ্কারের জোগান বাড়াতে কাজে লাগানো হয়েছে দুধ সরবরাহকারী ট্যাঙ্কারগুলোকেও। কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে অত্যাবশ্যকীয় কাজকর্ম ছাড়া জল ব্যবহারের ওপর— বাগানে জল দেওয়া, ঘরদোর সাফসুতরো করা, গাড়ি ধোওয়ার মতো কাজে জলের ব্যবহার আপাতত স্থগিত রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। হোটেলে ডিজপোজেবল থালা, বাটি কাজে লাগাতে বলা হয়েছে। এতে জলের খরচে অনেকটাই রাশ টানা সম্ভব হবে। এগুলো আসলে জলসঙ্কট মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় রণকৌশল। এমন ধারার যাপনে একটু একটু করে ধাতস্থ হয়ে উঠতে পারলে হয়তো পরিস্থিতিকে খানিকটা সামলাতে পারা যাবে।
বেঙ্গালুরুর আজকের জল-ছবিটি গভীর ইঙ্গিতবাহী। এক গভীর শূন্যতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। প্রকৃতির এই রিক্ততা আমাদের নিঃস্ব করে ফেলছে। যতই এই শূন্যতা বাড়ছে ততই চকচকে রঙিন আলোর রংমশাল জ্বালিয়ে আমরা আমাদের ভেতরের আঁধারকে ঢেকে আড়াল করতে চাইছি। এটা নিশ্চিতভাবেই কোনও নির্বিঘ্ন যাপনপথ নয়। সাম্প্রতিক অতীতে বেঙ্গালুরু কর্মপিয়াসীদের কাছে স্বপ্নের এলডোরাডো হয়ে উঠেছে। কাজের খোঁজে সেখানে তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করছে বহু মানুষ। তাই সম্পদের সঙ্কট বাড়ছে। একই সমস্যার ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে পাশের রাজ্যের হায়দ্রাবাদ। সেখানেও শুরু হয়েছে জলছাটাই পর্ব। আমাদের ভাবী উন্নয়নের অভিমুখ কী হবে তা নিয়ে এখন থেকেই সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দ্য সিলিকন ভ্যালি অফ ইন্ডিয়া, উচ্চাভিলাষী তরুণ আইটি-প্রজন্মের কাছে স্বপ্নের গন্তব্য, নিও এলডোরাডো বেঙ্গালুরু আজ জলসঙ্কটের তীব্র অভিঘাতে জর্জরিত। এই শহরের সমস্যা অনেক। এতদিনের ট্রাফিকসমস্যার সঙ্গে জলসমস্যাও যুক্ত হয়ে যাওয়ায় এই মহানগরীর গৌরবের শীর্ষাসন এবার টলে উঠেছে। কর্পোরেট পুঁজিপতিরা ইতোমধ্যেই নতুন বেঙ্গালুরুর খোঁজ শুরু করে দিয়েছে। তাঁদের কাছে পুঁজির সুরক্ষাই প্রাথমিক লক্ষ্য। অসংগঠিত দুর্বল ট্রাফিক পরিচালন ব্যবস্থা, হড়পা বানের দাপটে সিলিকন ভ্যালি ডুবে যাওয়া, জলের জোগানে ঘাটতি— এ সবের জন্য পছন্দের গন্তব্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।
বেঙ্গালুরুতেই এই সমস্যা থমকে যাবে তা মোটেই নয়। বরং এই তো শুরু। আগামীদিনে বেঙ্গালুরুর পেছনে লাইন লাগাবে আরও অনেক শহর। যেমন— জয়পুর, ইন্দোর, থানে, ভাদোদরা, শ্রীনগর, রাজকোট, কোটা, নাসিক… তালিকা বেড়েই চলেছে। সতর্ক থাকুন। আমাদের ভালবাসার শহরও যেন আবার এই লাইনে ঢুকে না পড়ে!!
অতএব সময় থাকতে সাধুজনেরা সাবধান হও। আমরা যদি নিজেদের না বদলাই তাহলে এমন পরিণতি আমার, আপনার, সকলের জন্য অপেক্ষা করছে।
আসুন এক ফোঁটা জল বাঁচাতে আমরা যুদ্ধ শুরু করি।
সংযোজন
লেখাটা শেষ করে পাঠিয়েছিলাম সম্পাদকীয় দপ্তরে। কিন্তু মাত্র চব্বিশ ঘন্টায় পটচিত্রের কিছুটা রদবদল ঘটায় কিছু নতুন খবর সংযোজনের লোভ সামলাতে পারলাম না। খবরগুলো হল—
- কাবেরী নদীর উজানে আকস্মিকভাবে জলপ্রবাহের মাত্রা বেড়ে গেছে। ধর্মপুরী জেলায় কাবেরী নদীতে বৃষ্টিপাতের কারণে নদীতে জলের জোগান অনেকটাই বেড়েছে। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীতে জলের গড় প্রবহন মাত্রা ছিল ২০০ কিউসেক, তা রাতে হঠাৎ করেই বেড়ে দাঁড়ায় ৬০০০ কিউসেকের মতো। সেচবিভাগের আধিকারিকদের মতে এর ফলে মেট্টুর বাঁধে মিঠা জলের জোগান বাড়বে। জলসঙ্কট নিরসনে এই জল হয়তো সহায়ক হবে।
- মানুষ সঙ্কটকালে নতুন উদ্ভাবনে মেতে ওঠে। বেঙ্গালুরুবাসী সাম্প্রতিক জলসমস্যার কথা মাথায় রেখে নিজেরাই আইআইএসসি ও প্রশাসনের সহযোগিতায় কতগুলো বিধিনিয়ম প্রবর্তন করেছে এই আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য। এই বিধিনিয়মগুলো হল—
- প্রতিদিনের পরিবর্তে একদিন বাদে একদিন স্নানের ব্যবস্থা। এর ফলে জলের সঞ্চয় বাড়বে।
- হোটেলের মতো বাড়িতেও কাগজের থালার ব্যবহার। এতে ধোয়াধুয়ির সমস্যা কমবে, কমবে জল খরচের মাত্রা।
- ঘরদোর মোছামুছির কাজে ভিজে ওয়াইপার কাজে লাগাতে বলা হয়েছে।
- স্কুল কলেজ পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
দেখা যাক… বেঙ্গালুরুবাসীর লড়াই জারি আছে…
*মতামত ব্যক্তিগত
সর্বত্র একই ধরনের সমস্যা। গ্রামের সব কুয়া, সব পুকুর মজে গেছে। সব কাজে নলপানি ভরসা। একটা ছেলেও সাঁতার পর্যন্ত জানেনা।
অসাধারণ এই লেখা। ভূগোলের এতো গভীরে যাওয়া আপনার পক্ষেই সম্ভব। এমন লেখা আরও লিখুন। মানুষ বুঝতে পারবে কি করা উচিৎ বা উচিৎ না।👌👌👌
একটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং মূল্যবান লেখা। কতো কি যে জানা গেলো। কিন্তু এই সঙ্কটের মোকাবিলায়, আপাৎকালীন যে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে জানলাম, তাতে না বর্জ্য পদার্থ মোকাবিলার না নতুন কোনও সমস্যা শুরু হয়।
সোমনাথদা আরও এমন অনেক অনেক লেখা পড়ার অপেক্ষায় রইলাম। 🙏
অন্তহীন সমস্যা। একা সোমনাথ মুখোপাধ্যায় এর সাধ্যনেই সবদিকে নজর দেবার।চাই সত্যিকারের গণ চেতনার। আমি অপেক্ষায় রইলাম।