সৌম্য মণ্ডল
কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১০০ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে দক্ষিণের মদ ব্যবসায়ীদের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। এই মামলার রাজসাক্ষী হলেন হায়দ্রাবাদস্থিত ‘অরবিন্দ ফার্মা’র কর্ণধার পি শরৎ রেড্ডি। ১০ নভেম্বর ২০২২ রেড্ডি গ্রেফতার হওয়ার পর ১৫ নভেম্বর রেড্ডির প্রতিষ্ঠান অরবিন্দ ফার্মা বিজেপিকে পাঁচ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে দিয়েছে। জুলাই মাসে রাজসাক্ষী হওয়ার ২ মাস পরে আবার তিনি বিজেপিকে ২৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে দিয়েছেন। বিজেপিকে বিভিন্ন খেপে ৩৪ কোটি টাকা দান করেছেন তিনি
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জামানায় একের পর এক ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেই চলেছে, যার জন্য তিনি ভারতের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। এই ঘটনাগুলোর একটি ঘটে গেল গত ২১ মার্চ। দেশের ইতিহাসে প্রথমবার গ্রেফতার হতে হল একজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে।
অরবিন্দ কেজরিওয়াল গ্রেফতার হওয়া প্রথম মুখ্যমন্ত্রী না হয়ে দ্বিতীয়ও হতে পারতেন। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের হেমন্ত সোরেন গ্রেফতার হওয়ার আগে মুখ্যমন্ত্রিত্ব থেকে পদত্যাগ করায়, কেজরিওয়াল প্রথমের শিরোপা পেলেন। অন্যদিকে সোরেনের এই পদত্যাগের কারণে নতুন বছরের প্রথম তিন মাসে দুইজন নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করার অনাবিল আনন্দ এবং গৌরব থেকে বঞ্চিত হলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি।
যদিও নির্বাচনের আগে আর কতজন মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হবেন, আমরা এখনও জানি না। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী মোদি বা শাসকদলের উচ্চনেতৃত্ব বাদে আর কেউই জানেন না। আর অজানাকে মানুষ চিরকালই ভয় ভক্তি করে থাকে।
নির্বাচনের ঠিক মাস খানেক আগে যখন জোট, ঘোঁট, দলবদল, প্রার্থী ঘোষণার প্রক্রিয়া তুঙ্গে, তখন পর পর দুইজন মুখ্যমন্ত্রী স্তরের মানুষকে গ্রেফতার কি বিরোধী দলগুলোর মুখ্যমন্ত্রী, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বা নীতিনির্ধারক নেতাদের বার্তা দেওয়ার প্রচেষ্টা নয়?
দুর্নীতির তদন্তে একান্তভাবে যদি গ্রেফতার করতেই হত, তবে কি নির্বাচন অব্দি অপেক্ষা করা যেত না? কেজরিওয়াল গ্রেফতার না হলে কি “দেশের নিরাপত্তা”র বিঘ্ন ঘটত বা কিছু মানুষের প্রাণ চলে যেত?
পরপর নজিরবিহীন গ্রেফতারি কি এই বার্তা দেয় না যে, শাসকদল একদিকে অবাধ্য নেতাদের উপর মানসিক চাপ তৈরি করে বিরোধীদের ঘরে ফাটল ধরাতে চাইছে? আর তাই ফাটল ধরানো হচ্ছে, বিজেপির দলীয় ক্ষমতার জোরে নয়, বরং প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে! অন্যদিকে ভোটারদের মনেও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন জাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আর আমাদের মতো পশ্চাৎপদ দেশে এক বড় অংশের মানুষই বিজয়ীর দলে সামিল হতে বেশি ভালবাসে।
প্রশাসনিক কাঠামোকে দলীয় স্বার্থে কাজে লাগানোর আরেকটি উদাহরণ হতে পারে এসবিআই-র নির্বাচনী বন্ড সংক্রান্ত তথ্য গোপন করার চেষ্টা। যা প্রধানমন্ত্রী মোদির জমানায় আরেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের চাপে একটুর জন্য, জনতার কাছে তথ্য চেপে রাখার গৌরব প্রধানমন্ত্রী মোদির অর্জিত হল না। প্রকাশ হওয়া নির্বাচনী বন্ডের তথ্যও কেজরিওয়ালের মামলা এবং ভারতের গণতন্ত্রের হালহকিকত সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে পারে।
কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে অভিযোগ ১০০ কোটি টাকা ঘুষের বিনিময়ে দক্ষিণের মদ ব্যবসায়ীদের সুবিধা পাইয়ে দিয়েছেন। এই মামলাটি দিল্লি আবগারি মামলা হিসেবে পরিচিত। এই মামলার রাজসাক্ষী হলেন হায়দ্রাবাদস্থিত ‘অরবিন্দ ফার্মা’র কর্ণধার পি শরৎ রেড্ডি।
২০২২ সালের ১০ নভেম্বর রেড্ডি গ্রেফতার হন। ২০২৩ সালের মে মাসে রেড্ডি স্বাস্থ্যজনিত কারণে জামিন পান। সরকারের তরফে জামিনের বিরোধী করা হয়নি। জুন মাসে রেড্ডি রাজসাক্ষী হন। অভিযুক্তের বোধোদয় হতেই পারে, সে-নিয়ে সমস্যা ছিল না। যদি না ইলেক্টোরাল বন্ডের তথ্য প্রকাশিত হত।
দেখা যাচ্ছে ১০ নভেম্বর ২০২২ রেড্ডি গ্রেফতার হওয়ার পর ১৫ নভেম্বর রেড্ডির প্রতিষ্ঠান অরবিন্দ ফার্মা বিজেপিকে পাঁচ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে দিয়েছে। জুলাই মাসে রাজসাক্ষী হওয়ার ২ মাস পরে আবার তিনি বিজেপিকে ২৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে দিয়েছেন। বিজেপিকে বিভিন্ন খেপে ৩৪ কোটি টাকা দান করেছেন তিনি।
রেড্ডির প্রতিষ্ঠান মোট ছয়বার নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। গ্রেফতারির আগে দুইবার এবং গ্রেফতারির পর চারবার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে গ্রেফতারির আগে তিনি একবার তেলুগু দেশম পার্টিকে ২.৫ কোটি এবং ভারত রাষ্ট্রীয় সঙ্ঘকে ১৫ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড কিনে দেন। গ্রেফতারির পরের চারবারই টাকা পেয়েছে বিজেপি। সুতরাং রেড্ডির কাছ থেকে বিজেপির অ্যাকাউন্টে যাওয়া এই অর্থকে চাঁদা না ভেবে অনেকে তোলা ভাবছেন। ফলত রেড্ডি স্ব-ইচ্ছায় রাজসাক্ষী দিচ্ছেন নাকি কোনও হুমকি, ব্ল্যাকমেলিং বা চাপের মুখে তিনি এটা করছেন, সেই প্রশ্নও উঠতে বাধ্য।
ঝাড়খণ্ড এবং দিল্লি, এই দুই রাজ্যের মধ্যে আভিজাত্যে, সংস্কৃতিতে, জাতীয় গুরুত্বে ব্যাপক পার্থক্য থাকলেও, মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতারে দুই রাজ্যের কিছু মিল আছে। দুই রাজ্যেই কিন্তু নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীদের গ্রেফতারির পেছনে আছেন সংশ্লিষ্ট রাজ্যের রাজ্যপাল। যে পদটি অনির্বাচিত এবং কেন্দ্রের দ্বারা মনোনীত।
একসময় কেন্দ্রের নির্দেশে সরাসরি রাজ্যপাল রাজ্যের নির্বাচিত সরকার ভেঙে দিতেন। তার ফলে ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়। শাসক অভিজাতদের বিভিন্ন অংশের মধ্যে তৈরি হয় বিরক্তি। ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা থেকে একই সঙ্গে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন, অন্যদিকে জয়প্রকাশ নারায়ণের “সম্পূর্ণ ক্রান্তি” আন্দোলন ঘটে গেছে। এই দুই ধারার দুই আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে সম্পূর্ণ ক্রান্তি না আনতে পারলেও, রাজ্য সরকার নিয়ে ছেলেখেলা অন্তত কমেছে। যদিও রাজ্য সরকারকে উত্যক্ত করার স্টাইল বদলেছেন মহামহিম বা রাজ্যপালেরা।
গ্রেফতারির পর বিশেষ অনুমতি নিয়ে ঝাড়খণ্ড বিধানসভায় আস্থাভোটে উপস্থিত হয়েছিলেন হেমন্ত সোরেন। সোরেন স্পষ্টভাবে তাঁর গ্রেফতারির পেছনে রাজ্যপালের ভূমিকার কথা উল্লেখ করন। অন্যদিকে দিল্লি আবগারি মামলার ক্ষেত্রেও মূল উদ্যোক্তা হিসেবে হাজির হয়েছেন দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিজে।
একদিকে হেমন্ত সোরেন যেমন আদিবাসী আত্মপরিচিতির উপর রাজনীতি করেন, তেমনি কেজরিওয়ালের রাজনীতির মূল ভিত্তিই হল দুর্নীতির বিরোধিতা। তাই দুর্নীতির মামলায় কেজরিওয়ালের গ্রেফতারি অবশ্যই তাৎপর্য বহন করে। কেজরিওয়াল গ্রেফতার হওয়ার পর যদি তার দল ভেঙে না যায়, তবে বলাই যায় যে, তিনি বিপুল শক্তি ও সমর্থন নিয়ে জেল থেকে বেরোবেন। আর ২০২৪ সালের পরেও যদি ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্র টিকে থাকে, তবে সেটা বিজেপির ঘাঁটি গুজরাতের ওপরেও ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলবে।
কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্রদের আবার ভাবাতে বাধ্য, সেটা হল কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক। যে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নির্বাচিত এবং কর্মরত মুখ্যমন্ত্রী গ্রেফতার হতে পারেন, সেই কাঠামোকে আর কতদিন যুক্তরাষ্ট্রীয় বা গণতান্ত্রিক বলা যায়?
আরও যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ওঠে, সংসদে “আব কি বার চারশো পার”-এর স্লোগানটির প্রতি বিজেপি নেতৃত্বের আদৌ কি আস্থা আছে?
*মতামত ব্যক্তিগত