চণ্ডী মুখোপাধ্যায়
তিনজন মানুষ তিনভাবে কুমার সাহনির জীবনে এসেছেন। ঋত্বিকের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন মহাকাব্যিক সিনেমার ধারণা, প্রখ্যাত ব্যতিক্রমী ফরাসি পরিচালক ব্রেঁস-র কাছ থেকে তিনি শেখেন ক্যামেরার আনুগত্য থেকে ছবিকে মুক্ত করা— ক্যামেরায় ধরা ছবি তার নিজস্ব ধর্মেই এই মৌলিক অর্থ নির্মাণ করবে। আর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তাত্ত্বিক ডিডি কোসাম্বির কাছ থেকে পেলেন মার্কসীয় চর্চার সূলুকসন্ধান। এই তিন সিনেমাগুরুর ভাবনা নিজের মতো করে সাজিয়ে কুমার নির্মাণ করলেন তাঁর নিজস্ব সিনেমাপথ। যা শেষ অবধি মৌলিক। কুমারের কৃতিত্বটা এখানেই। তিনি ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন ভাষা নির্মাণ করেছেন
ক্ষমতার চেয়ে কল্পনার শক্তি অনেক বেশি। এই কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন কুমার সাহনি। কল্পনা অবশ্যই সৃষ্টিশীল হওয়া চাই। যার পরিধি নিশ্চিত হতে হবে দিগন্তবিস্তৃত। চলচ্চিত্রে সে-কল্পনাকেই প্রশয় দিতে চান তিনি। প্রশয় শব্দটায় অবশ্য আপত্তি আছে তাঁর। তাঁর কাছে এটা অমোঘ ব্যবহার। আর এই সূত্র থেকেই তিনি ভারতীয় সিনেমায় নিয়ে আসেন এপিক ভাবনা। আর এখানে তিনি মণি কাউলের সহমর্মী। মণির সঙ্গে তাঁর আরও মিল। দুজনেই পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটের ছাত্র। মাস্টারমশাই হিসেবে পেয়েছেন ঋত্বিক ঘটককে। ঋত্বিককে চলচ্চিত্রগুরু হিসেবে মেনেছেন। দুজনেই ব্রেঁস-ভক্ত। দুজনের ছবিতেই ব্রেঁস-প্রভাব স্পষ্ট। কিন্তু দুজনের চলচ্চিত্রধারা ভিন্ন। দুজনেই স্বতন্ত্র। আর কোসাম্বির প্রভাব ভীষণভাবে রয়েছে কুমার সাহনির সিনেমায়। কোসাম্বির চিন্তাভাবনা থেকেই কুমার মার্কসীয় ভাবনায় অনুপ্রাণিত হন। তিনজন মানুষ তিনভাবে কুমার সাহনির জীবনে এসেছেন। ঋত্বিকের কাছ থেকে তিনি পেয়েছেন মহাকাব্যিক বা এপিক সিনেমার ধারণা, প্রখ্যাত ব্যতিক্রমী ফরাসি পরিচালক ব্রেঁস-র কাছ থেকে তিনি শেখেন ক্যামেরার আনুগত্য থেকে ছবিকে মুক্ত করা, ক্যামেরায় ধরা ছবি তার নিজস্ব ধর্মেই এই মৌলিক অর্থ নির্মাণ করবে। মহাকব্যিক বৃহত্তম পরিপেক্ষিতের সঙ্গে ছবির মূল বিষয়ের কীভাবে দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। আর প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ তাত্ত্বিক ডিডি কোসাম্বির কাছ থেকে পেলেন মার্কসীয় চর্চার সূলুকসন্ধান। এই তিন সিনেমাগুরুর ভাবনা নিজের মতো করে সাজিয়ে কুমার নির্মাণ করলেন তাঁর নিজস্ব সিনেমাপথ। যা শেষ অবধি মৌলিক। কুমারের কৃতিত্বটা এখানেই। তিনি ভারতীয় সিনেমায় এক নতুন ভাষা নির্মাণ করেছেন। তার মূল লক্ষ্য নিশ্চিত হলিউড ন্যারেটিভ থেকে সিনেমাকে মুক্ত করা। ঋত্বিক-সঙ্গ করেছেন দীর্ঘকাল। ঋত্বিক-চিন্তনের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি অনেকদিনের। সিনেমা করতে নেমে ঋত্বিক-তন্ত্রের প্রভাব তিনি এড়িয়ে উঠতে পারেননি। এদিকে রবার্ট ব্রেঁস-র ছবিতে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। আর সেই শিক্ষার অবশ্যই প্রতিফলন ঘটেছে সাহনির ছবিতে। “ব্রেঁস ছিলেন আমার প্রতি অত্যন্ত আন্তরিক,” কুমার এক সাক্ষাৎকারে জানান, “রবার্ট ব্রেঁসর সঙ্গে আমার দারুণ একটা মুহূর্তের কথা মনে পড়ে, আমি অনেকটা দূরে থাকতাম যেখানে আমাদের শুটিং হত সে-জায়গা থেকে। তো তিনি প্রতিদিনই প্রায় আমাকে নিজে ড্রাইভ করে দিয়ে আসতেন।”
ঋত্বিক-স্মৃতিও রয়েছে কুমারের মধ্যে:
ঋত্বিক ঘটক মানুষ হিসেবে দারুণ মানুষ ছিলেন তো বটেই, এমনকি উনি শিক্ষক হিসেবেও দারুণ ছিলেন। আমি ঋত্বিকদাকে চিনতাম এফটিআইআই (ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া)-এ যাওয়ার আগেই। সেসময় ‘সুবর্ণরেখা’ চলচ্চিত্রকে কলকাতার মানুষ রিফিউজ করে দিয়েছে, তো আমরা মুম্বাইতে এই চলচ্চিত্রের ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্ব নিলাম। আমি তখন ফিল্ম সোসাইটির ফাউন্ডার, তরুণ একজন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী। মাত্র কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছি। ভাবতেই পারছিলাম না এরকম দারুণ একটা কাজ বিশ্বের কোথাও হয়েছে আর সেটা ইন্ডিয়াতেই! এরপর থেকে আমি নিজেই পথ চলা থামাতে চাইনি আর। চলতেই শুরু করলাম। এটার একটা বিরাট প্রভাব ছিল আমার উপর। ঋত্বিকদা এফটিআিআই-তে জয়েন করার আগেই আমি ভর্তি হয়েছিলাম। আমার জন্য এটা বিশাল এক সারপ্রাইজ ছিল যখন তিনি জয়েন করলেন। প্রথম যখন ঋত্বিকদা ইন্সস্টিটিউটে এলেন আমি তার আগে থেকেই তাঁর কাজ সম্পর্কে জানি, তাঁকে চিনি। আমি জানতাম, তিনিই যথার্থ একজন এই পোস্টের জন্য। ঋত্বিকদা ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটির ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন এবং আপনি জানেন তখন দুইজন ভাইস চেয়ারপার্সন ছিলেন, একজন ঋত্বিকদা, আরেকজন কে জানেন? ইন্দিরা গান্ধি।
সত্যজিৎ রায় মেমোরিয়াল লেকচার দিতে কলকাতায় এসেছিলেন কুমার সাহনি। বক্তা কুমার সাহনির পরিচয় দিতে গিয়ে অভিনেতা ধৃতিমান চট্রোপাধ্যার জানান, কুমার সাহনি হলেন এমন একজন পরিচালক যিনি নন-ন্যারেটিভ, নন-ইমোটিভ, নন-ড্রামাটিক। কুমার সম্পর্কে মুল নির্যাসই তুলে আনেন তিনি। এই সূত্র ধরে এগোলে কুমার-চলচ্চিত্রে প্রবেশ সহজতর হয়ে ওঠে। ঋত্বিক প্রবর্তিত এপিক সিনেমা-র সম্প্রসারণই কি কুমারের সিনেমা? এটা ভাবা বোধহয় ঠিক হবে না। শুরুর দিকে, মানে যখন তিনি ‘মায়া দর্পণ’ করেছেন, তাঁর ছবিতে ব্রেঁস, কোসাম্বি এবং ঋত্বিকের প্রভাব তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে রোসেলিনির প্রভাবও। তবে ব্রেঁসর প্রতিই তিনি অনুগত থাকতে চেষ্টা করেন। ব্রেঁস-র ছবির মতোই তাঁর ছবিতে আসে এক তপস্যার পরিবেশ। যার মধ্যে থেকে আলঙ্করিক আবহাওয়া যার মধ্যে থেকেই গড়ে ওঠে সিনেমাটিক ইমেজ। যার সম্পুর্ণ উদাহরণ হল কুমারের ‘খেয়াল গাথা’।
অবিভক্ত ভারতের সিন্ধ অঞ্চলের লারকানায় জন্ম কুমার সাহনির। পার্টিশনের পর এদেশে চলে আসেন তাঁরা। বোম্বাইতেই স্থায়ীভাবে থাকতে শুরু করেন। সেখানকার কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশুনা। পরে পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে। একান্নবর্তী পরিবারের মধ্যেই বড় হয়েছেন তিনি। অনেক মানুষজন। বাবা ছিলেন সরকারি উকিল। দারুণ কাজের চাপ। বাবার সঙ্গে কথা হত খুবই কম। সিনেমা সম্পর্কে তাঁর প্রথম আগ্রহ জন্মায় ‘নুরজাহান’ ছবিটি দেখে। বিশেষ করে নুরজাহান-এর ক্লোজাআপগুলো তাঁর মনে দারুণ দাগ কাটে। এরপর তিনি আরও অনেক সিনেমা দেখেন। বোনের ছিল সিনেমা দেখার নেশা। সেই তাঁকে সঙ্গে করে সিনেমা দেখতে নিয়ে যেত। তখন থেকেই সিনেমা তৈরি করার নেশাটা কুমারের চোখে। আর সেটাই সার্থক হয় পুনে ফিল্ম স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর। তিনি তাঁর চলচ্চিত্রগুরুদের সম্পর্কে সবসময় কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন—
তাঁদের প্রভাব আমার ওপর ভীষণভাবে কাজ করেছে। আমি যত ছবি বানিয়েছি, কোনও-না-কোনওভাবে সেগুলো ঋত্বিক ঘটক দিয়ে মোহাচ্ছন্ন। এটা অনেক অংশে ঐন্দ্রজালিক। তাঁর কাছ থেকে চলচ্চিত্রকার হিসেবে আমার নিজস্বতাকে বুঝতে শিখেছি। আর কোসাম্বি অথবা কেলকর আমাকে ইতিহাসের সঙ্গে সংযুক্ত হতে সাহায্য করেছেন। আমি যখনই কোনও দৃশ্য ধারণ করি, তার মধ্যেকার ইঙ্গিত আর ইতিহাস আমার সামনে হাজির হয়। এখানে ইতিহাসের অর্থ হচ্ছে, কোনও-না-কোনওভাবে এর পেছনে ‘হিউম্যান এজেন্ট’ কাজ করে। এই ইতিহাস ও ইঙ্গিতময়তা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কুমার সাহনি নির্মল ভার্মার গল্প নিয়ে তৈরি করেন তাঁর প্রথম ছবি ‘মায়া দর্পণ’। এক নিঃসঙ্গ তরুণীর গল্প। আধাসামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে তাঁর সামাজিক অবস্থানই হল এই ছবির কেন্দ্রীয় বিষয়। পরিচালক কুমার তাঁর নিজস্ব স্টাইলেই এই বিষয়টিকে উপস্থাপন করেন। প্রথম থেকেই এপিক ধারায় চলে ছবি। তারন নামের এই তরুণীকে ঘিরে তৈরি হতে থাকে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে সংঘাতের পরিবেশ। ট্রিটমেন্টের দিক থেকে ধীর লয়ে চলায় বিশ্বাসী কুমার। সেটাই তাঁর ঘরানা। স্বাধীনতার ঠিক পরবর্তী সময়ের পটভূমিতে তৈরি এই ছবি। ক্যামেরায় ছিলেন কেকে মহাজন এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেন ভাস্কর চন্দ্রভারকর। কুমারের অন্যান্য ছবির মতোই সঙ্গীত এক বড় ভুমিকা পালন করে এই ছবিতে। তাঁর জীবনের প্রথম ফিচার ‘মায়া দর্পণ’। এর আগে ফরাসি দেশে রবার্ট ব্রেঁস-র সঙ্গে কাজ করেছেন। দেশে ফিরে ছবি করতে নামলেন। এই সম্পর্কে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন—
আমি অনেকগুলো চিত্রনাট্য লিখেছিলাম। কিন্তু সবগুলোই আমি বাতিল করে দিলাম নিজে থেকেই। সবেমাত্র ফিরেছি তখন ফ্রান্স থেকে। এরপর আমি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম যে আমি ফ্রান্সে কী মিস করেছি যার উপর দাঁড়িয়ে একটা ফাউন্ডেশন দাঁড় করানো যেতে পারে চিত্রনাট্যের? আমার তখন মনে হল আমি সবচেয়ে বেশি মিস করেছি এনার্জি আর রং! এবং এখানকার শব্দের এই শক্তিটাও। আরেকটা জিনিস দারুণভাবে মিস করেছিলাম সেটা হচ্ছে চিন্তার মান যেটা মুভমেন্টকে অন্তর্ভুক্ত করে। ফ্রেঞ্চ ভাষায় যাকে বলে ‘Cartesian’ (কার্টেজান)। আরেকটা জিনিস হচ্ছে ইউরোপিয়ান সোসাইটি যা যা চর্চা করছিল তা থেকে দূরে সরে যাওয়া কঠিন ছিল। এমনকি ব্যক্তিগত দৈনন্দিন জীবনেও। তবে শিল্পে মানুষ সে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। তো আমি এ-সমস্ত বিষয় নিয়ে ভাবছিলাম, সেকারণেই ‘মায়া দর্পণ’কে বেছে নেওয়া।
‘মায়া দর্পণ’-এর পর দু-একটি ছোট ছবি বা তথ্যচিত্র করলেও ফিচার ছবি করেন প্রায় এক যুগ মানে বারো বছর পর ১৯৮৪-তে ‘তরঙ্গ’। যে ছবিতে এসেছে এক একান্নবর্তী অতি অভিজাত পরিবারের অভ্যন্তরীণ আভিজাত্য ও তৎসংলগ্ন সংঘাত। আসলে এই বড় এক ব্যবসায়ীর গল্পের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা সাব-প্লট। সেখানে একের পর এক উঠে এসেছে এই ব্যবসায়ীর ভাইপো ও জামাইদের ঘিরে নানা অপরাধজনিত ক্রিয়াকলাপ। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহবোধ। তবে এই সমস্তই কুমার উপস্থাপন করেন প্রচলিত ন্যারেটিভের বাইরে। সযত্নে এড়িয়ে চলেন হলিউড বা মূলস্রোতের বলিউডের ধারাকে। বরং নিজের ভাবনাজনিত নির্মাণের মধ্যে দিয়ে তিনি নির্মাণ করে নেন এক ভারতীয় ঐতিহ্যের ধারা যার উৎস মার্কসীয় বীক্ষাতে।
‘কসবা’ আন্তন চেখভের গল্প অবলম্বনে নির্মিত। এই ছবির পটভূমি কাংরা উপত্যকা। চারদিক ঘিরে আছে হিমালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্যই কুমারের ভাবনায় ক্রমশই ছবির চরিত্র হয়ে ওঠে। ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র এক নারী যে শ্বশুরের দোকান দেখাশোনা করে। মূলত চারটি চরিত্র— শেঠ মণিরাম, তার দুই ছেলে এবং পুত্রবধূ তেজো। তেজোর স্বামী মানসিক প্রতিবন্ধী। হিমালয়ের প্রাকৃতিক পরিবেশে এই চার চরিত্রের মধ্যে ক্রমশ এক বৃহত্তর আকার নির্মাণ করেন কুমার। আধুনিক ভারতের সামজিক গঠনটা বার বার মার্কসীয় ভাবনার মধ্যে দিয়ে তুলে আনতে চান কুমার সাহানি। এখানে কোসাম্বি আর ঋত্বিককে মেলান তিনি। তাই ‘কসবা’-ও ক্রমশ রাজনৈতিক সামাজিক ছবি হয়ে ওঠে।
১৯৯৭ সালে কুমার সাহনি রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে হিন্দিতে একটি ছবি করেন। অবশ্য হিন্দিতে ‘চার অধ্যায়’ এই প্রথমবার নয়। এর আগে ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে হিন্দিতে ‘জ্বলজ্বলা’ নামে একটি ছবি হয়। তবে কুমার সাহনি মূলত ঋত্বিক ঘটকের শিষ্য। খুব স্বাভাবিকভাবেই কুমারের ওপর ঋত্বিকের প্রভাব খুবই। আর কুমারও নিজেকে ঋত্বিক-পন্থী বলতে কখনও দ্বিধা করেননি। তবে কুমার কখনওই তার ছবির বিষয়কে ঋত্বিকতন্ত্রের অংশ করে তোলেননি। সুররিয়ালিজম-কে ভারতীয় সিনেমায় আনার ব্যাপারে একটা বড় ভূমিকা রয়েছে পরিচালক কুমার সাহানির। তাই কুমার যখন চার অধ্যায় নিয়ে ছবি করেন, তখন তা এক অন্যতর মাত্রা পায়। চলচ্চিত্রে ‘চার অধ্যায়’-এর এক নতুন ইন্টারপ্রিটেশন তৈরি করেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-এ যে-সশস্ত্র বিপ্লবের কথা আছে তাকে নতুন ভাবনায় জারিত করেন কুমার সাহনি। রবীন্দ্রনাথকে যদি কেউ পোস্টমর্ডান ভাবনায় চলচ্চিত্রে নিয়ে এসে থাকেন, তিনি হলেন অবশ্যই এই পরিচালক। কুমার সাহনির চলচ্চিত্র যাঁরা দেখেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন, এই পরিচালক বিশুদ্ধ সিনেমায় বিশ্বাস করেন। পিওর সিনেমা এই ভাবনাটি তিনি যতটা ভারতীয় চলচ্চিত্রে নিয়ে এসেছেন ততটা বোধহয় আর কোনও পরিচালক সাহস কুরেননি। ‘চার অধ্যায়’ করতে গিয়েও কুমার সাহনি রবীন্দ্রভাবনায় স্থির থেকেও তাঁর ছবিটিকে পুরোপুরি সাহিত্যমুক্ত করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ন্যারেশন নিয়ে এই ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়াটা খুব সহজ কথা নয়। রবীন্দ্র-চলচ্চিত্রে সত্যজিৎ রায় একধরনের ভাষা তৈরি করে দিয়ে গেছেন। সেই ভাষারই সম্প্রসারণ হল পূর্ণেন্দু পত্রী বা নীতিশ মুখোপাধ্যায়-এর রবীন্দ্র-চলচ্চিত্র। যাঁরা সত্যজিতের রবীন্দ্র-চলচ্চিত্রের ভাবনাটিকে অবশ্যই নিজের ভাবনার সঙ্গে মিশিয়েছেন। কিন্তু কুমার সাহনি যখন রবীন্দ্রনাথের কাহিনি ‘চার অধ্যায়’ করেন তখন তিনি পুরোপুরি চার অধ্যায়-কে সিনেমার ভাষায় নিয়ে আসতে চান। সাহিত্যের অবদানটিকে তিনি নেহাতই ভিত হিসেবে রেখে দেন। কুমার সাহানির ‘চার অধ্যায়’-তে শুধু রবীন্দ্রনাথ নয়, অত্যন্ত সচেতনভাবে আছেন রবীন্দ্র-পরবর্তী কবি জীবনানন্দ দাশও। ছবির কতগুলি বিশেষ মুহূর্তে ব্যবহার করা হয়েছে জীবনানন্দের কবিতা, ছবির ভিস্যুয়াল মুডের সহায়ক হিসেবে। যেমন লৌকিক ছড়া বা বাউল গানও ছবির অনেক প্রধান প্রধান দৃশ্যের অনুসঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। তবে কুমার সাহানির ‘চার অধ্যায়’-এর সেন্ট্রাল থিম যতটা না রবীন্দ্র-উপন্যাস, তার চেয়ে অনেক বেশি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা ‘প্রহর শেষের রাঙা আলোয় সেদিন চৈত্রমাস/তোমার চোখে দেখেছিলেম আমার সর্বনাশ’-এর। রবীন্দ্র-রচনাতেও এলার জীবনে অতীন আসার পর থেকেই সবকিছু বদল হতে থাকে। এলাও দোলাচলের মধ্যে পড়ে। এলার যে এই অনুপ্রেরণাদাত্রীর ভাবমূর্তি সেটাকেই ক্রমশ চ্যালেঞ্জ করতে থাকে অতীন। আসলে যে এলার মতো সুন্দরী যুবতীর সৌন্দর্যকেই কাজে লাগানো হচ্ছে বিপ্লবীদের অনুপ্রেরণা হিসেবে সেটা অতীন ক্রমশই স্পষ্ট করতে থাকে এলার কাছে। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’-তে ইঙ্গিতে এটা ছিল। সেটাকেই ওপর তলে তুলে এনেছেন সিনেমায় কুমার সাহনি। স্বাধীনতার সশস্ত্র আন্দোলনের অন্তর্নিহিত রহস্যটাকেই ভেদ করতে চেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’তে অতীন এলাকে বলে “জিজ্ঞাসা করি, দেশের কাছে তুমি আমাকে সঁপে দেওয়ার কে? তুমি সঁপে দিতে পারতে মাধুর্যের দান, যা তোমার যথার্থ আপন সামগ্রী। তাঁকে সেবা বলো বা যাই বলো, বরদান বলো যদি তাও বলতে পারো, অহঙ্কার করতে যদি চাও অহঙ্কার, নম্র হয়ে যদি আসতে বলো তবে তাও আসতে পারি। কিন্তু তোমার আপন দানের অধিকারকে আজ দেখছ তুমি ছোট করে। নারীর মহিমার অন্দরের সৌন্দর্য যা তুমি দিতে পারতে তা সরিয়ে নিয়ে তুমি বলছ। দেশকে দিলে আমার হাতে। পারো না, দিতে পারো না, কেউ পারে না। দেশ নিয়ে এক হাত থেকে আরেক হাতে নাড়ানাড়ি চলে না।” কুমার সাহনির ‘চার অধ্যায়’-এর তো এটাই মূল থিম। সেই অর্থে রবীন্দ্রানুসারীই। শেষ দৃশ্য হল এক নারীশরীরকে ধুয়ে দিচ্ছে নদীর ঢেউ। নদী তো দেশমাতৃকাই। আর নারীশরীর সে। এলা-ই। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ যখন ‘চার অধ্যায়’ লিখছেন তখন তিনি ছবি আঁকার দিকেও ঝুঁকছেন। সেই রবীন্দ্র-চিত্রাবলির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে কুমার সাহনির ‘চার অধ্যায়’-এর প্রতিটি ফ্রেমে। আর এই অসাধ্যসাধন করেছেন আলোকচিত্রী কেকে মহাজন। এলা এবং অতীনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন নন্দিনী ঘোষাল এবং সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়।
১৯৭৬-তে চলচ্চিত্রজীবন শুরু। মৃত্যুর আগে অবধি, এই দীর্ঘ ৪৮ বছরে বেশ কিছু তথ্যচিত্রের কথা বাদ দিলে ফিচার করেছেন মাত্র পাঁচটি। এতই কম ছবি করেছেন তিনি। গুরু হিসেবে জীবনে পেয়েছেন ঋত্বিক ঘটক এবং রবার্ট ব্রেঁস-কে। চলচ্চিত্রভাবনায় দুজনের অবস্থান দুই মেরুতে। তবুও দুজনকেই তাঁর চলচ্চিত্রজীবনে সুচারুভাবে মিলিয়েছেন তিনি। কী শিখেছেন ঋত্বিকের কাছ থেকে, সেই সম্পর্কে তিনি বলেন:
ঋত্বিক ঘটক আমাদের সামনে শব্দের বিকল্প জগতের গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। দুটি শব্দকে পাশাপাশি রাখলে তারা শুধু একে অন্যের সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরি করে তা-ই শুধু নয়, তৃতীয় কোনও ভাব প্রকাশের অনুষঙ্গে পরিণত হয়। এ-কারণেই রুশ চলচ্চিত্রনির্মাতা সের্গেই আইজেস্টাইনের ওভার টোনাল মন্তাজের ধারণাকে আমার গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। ক্যামেরা বা মাইক্রোফোন আমাদের জন্য সবকিছু বাস্তবসম্মতভাবে ধারণ করে বটে, কিন্তু শিল্প কাজ করে এর ঊর্ধ্বে, সৃজনশীলভাবে। বাস্তববাদীদের সঙ্গে আমার দ্বন্দ্ব এখানেই। আমার ছবি বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু বাস্তববাদী সিনেমা নয়।
ব্রেঁস-র সঙ্গে ঋত্বিককে কী করে মেলান তিনি? সে সম্পর্কেও ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায় সেই সাক্ষাৎকারে বলেন:
হ্যাঁ, এটা ঠিক, তাঁরা দুজনেই একেবারে ভিন্ন ধরনের নির্মাতা। কিন্তু তাঁদের দুজনের ছবিই অর্থবহ ও ইঙ্গিতপূর্ণ, সেই অর্থে, যে তাঁরা দুজনেই বাস্তবতার ধারণাকে অস্বীকার করেছেন। আমি যখন ফ্রান্সে যাই, তখন জঁ লুক গদার বা ফ্রঁসোয়া ত্রুফোর মতো পরিচালকেরাই তারকা নির্মাতা, কিন্তু ব্রেঁসর বালথাজার দেখার পরে আমি ঠিক করেছিলাম যদি কারও সঙ্গে কাজ করতে হয়, তবে তিনি হবেন রবার্ট ব্রেঁস। কারণ, মানবচিন্তার মূলসূত্রগুলোর সঙ্গে ঋত্বিক ও ব্রেঁস— তাঁদের দুজনের কোথাও না কোথাও মিল আছে। আমার মতে, তাঁরা দুজনেই সুফিদের মতো প্রাতিষ্ঠানিকতাকে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে তোমার নিজেকেই সংযুক্ত হতে হবে। বোঝাপড়া আসলে নিজের আত্মার সঙ্গে নিজেরই। সেভাবে দেখলে ঋত্বিকদা ও ব্রেঁস খুব আলাদা নন। আমিও বিষয়গুলোকে সেভাবেই দেখতে চেয়েছি।
আজ কুমার সাহনির মৃত্যুতে ভারতীয় চলচ্চিত্রে ঘোষিতভাবে ঋত্বিক-যুগ শেষ হয়ে গেল।