বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
পূর্ব প্রকাশিতের পর
পরিযায়ী পাখি
তিন.
সময় আর দিনের হিসাব চলে গেছে। খাওয়ার কোনও উপায় নেই। ব্যান্ডেজের ফাঁক দিয়ে নলে করে খাবার ঢুকছে। সারা দিন আচ্ছন্নের মতো পড়ে থাকা। কখনও লেখা পায়ের কাছে, কখনও মাধুরী। রতন হাসপাতালের বারান্দায় পায়চারি করে বেশি। হাঁটতে হাঁটতে কখনও দাঁড়িয়ে পড়ে, হাসপাতালের বারান্দায় লেপে দেওয়া পোস্টার, নোটিসবোর্ডে ঝুলিয়ে রাখা অসংখ্য ঘোষণাপত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে। মাথাটাকে ভাবনার বাইরে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা সারাদিন। অথচ তার হাটার সঙ্গে ভাবনারা দৌড়ায়, দাঁড়ানোর সময় মাথার উপরে মশার মতো ভনভন করে। মাধুরী বারবার বলেছে এখানে এভাবে বসে থেকে কী করবে, কলেজে যাওয়া শুরু করো। হাজিরা দেওয়া যায়, কিন্তু কী পড়াবে সেখানে? মাথাটা যে ফাঁকা হয়ে গেছে। লেখারও এখন স্কুল বন্ধ। সেটার অবশ্য অন্য কারণ। এক মেয়ের এই অবস্থা। মাধুরী চাইছে না লেখা এখনই দুর্গাপুরের রাস্তায় এমনি ঘুরে বেড়াক। কাজটা যে বীরুর, সেটা তো জানে। এখন ওদের হাতে পাওয়ার, যা খুশি করতে পারে। সব গুন্ডাই তো এখন ওদের তাঁবে। এরা কাউকে ভয় করে না। এর মধ্যে একদিন হাসপাতাল চত্বরেই ভটভট করতে করতে এসে দুটো ছেলে রতনকে দাঁড় করিয়েছিল। রতন চা খেতে গেছিল। রাস্তা জুড়ে দাঁড়িয়ে বলল, কেন বেফালতু পুলিস কেস করছেন কাকু? কোনও লাভ হবে? পিছনে বসা ছেলেটা আর এক ধাপ এগিয়ে। আর একটা মেয়ে আছে, সময় থাকতে ওটার কথা ভাবুন, না হলে বিপদ আছে। রতন রাগে ফেটে পড়েছিল। হারামজাদা, আমার একটা মেয়েকে শেষ করে আবার আমাকেই ধমকি দিতে এসেছিস? সামনের ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে আপনি থেকে তুইতে নেমে এল। এই শালা, মল্লিকের চামচা! ভাল কথা কানে ঢোকে না তোদের? তোর গুরুর মতো ভেঙে দ হয়ে পড়ে থাকবি, তখন মাথায় ঢুকবে। পিছনের ছেলেটা ডান হাত দিয়ে বিশ্রী ইঙ্গিত করল, গাঁড়ে খুব দম হয়েছে না? হাম্পু গুঁজে দেব একেবারে। ভাল কথায় এফআইআর তুলে নে, না হলে ঘোষের বংশে বাতি দেওয়ার কেউ থাকবে না। গুম গুম আওয়াজ করে মোটর সাইকেল চলে গিয়েছিল। ওইখানে দাঁড়িয়েই বাঁশপাতার মতো কাঁপছিল রতন। হাসপাতাল চত্বরে তখন অনেক লোক। রতন তাদের সবার দৃষ্টি পিঠের পিছনে অনুভব করতে করতে দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে এসেছিল। কেউ কোনও প্রতিবাদ করেনি। এমনকি এক পা বাড়িয়ে কাছে এগিয়ে আসেনি। রতনের মুখচোখ কাগজের মতো সাদা, দেখেই মাধুরী দৌড়ে এসেছিল। কী হয়েছে?
মাধুরীর কাঁধে হাত রেখে নিজের কাঁপুনি কমানোর চেষ্টা করছিল রতন। কী সাহস মাধু, এদের কী সাহস!
—কার সাহস? কী হয়েছে?
রতনের অসংলগ্ন কথা থেকে ব্যাপারটা বুঝতে একটু সময় লেগেছিল মাধুরীর। শুনে তারও বুক ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। কারুর প্রাণে কি আর কোনও ভয় নেই? দিনদিন কী হচ্ছে দুর্গাপুরের? রাজনৈতিক খুনোখুনি নতুন নয় এই শিল্পশহরে। কিন্তু জলজ্যান্ত একটা মেয়েকে অ্যাসিড ছুঁড়ে নিকেশ করে দিল, তারপরে আবার এত সাহস গায়ে পড়ে ধমকি দিয়ে যায়? গুন্ডা-বদমাশ আর পার্টির নেতার মধ্যে আর কোনও দূরত্ব থাকল না। বীরুর বাবা নিজেই তো রাজনীতি করেছে, এখনও করে। ইউনিয়নের নেতা। জনসভায় মুখে এত বড় বড় কথা। কিন্তু তার ছেলে বীরেন যুবনেতা হয়ে কোনও রাখঢাক না রেখে এইরকম দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, কেউ দেখার নেই? আজ পুলিশও এদের কব্জায়। কোনদিকে তাকাবে মাধুরী? কোন ভরসায় মেয়েকে স্কুলে পাঠাবে?
বারীন ছেলেটা দুবার এসেছিল খবর করতে। সেদিন ওই ছেলেটা না থাকলে মেয়েটা বোধহয় ওখানে পড়েপড়েই মরে যেত। এমন লোক আছে বলেই জীবন থেকে পুরোপুরি ভরসা উঠে যায়নি এখনো। কিন্তু সেও এল মুখ কাঁচুমাচু করে। বড় বিপদে পড়ে যাচ্ছি কাকিমা। আমি তো বাঁচাতে গেছিলাম। কে অ্যাসিড ছুড়েছে সে কথা আমি কী জানি। পুলিশকেও তো আমি সেইরকমই বলেছি। তা সত্ত্বেও আমার উপর চাপ আসছে।
—তোমার উপর কীসের চাপ বাবা? তুমি তো মানুষের কাজ করেছ। তোমরা না থাকলে মেয়েটাকে আর কি ফিরে পেতাম?
—আমি তো ডিএসপিতে কাজ করি। ওখানে ইউনিয়নের মেম্বার। সেজন্য এখনও আস্ত আছি। আমাকে দিয়ে খবর পাঠাচ্ছে আপনাদের এফআইআর তুলে নেওয়ার জন্য। একটু ভেবে দেখুন কাকিমা। আজকাল পুলিশ দলের কথায় ওঠে বসে। আপনি কি মনে করেছেন পুলিস কাউকে ধরবে আদৌ? শুধু শুধু আপনাদের হেনস্থা হবে।
—কী বলছ বারীন? আমার মেয়েটার এত বড় সর্বনাশ করল, আর আমরা এমনি এমনি ছেড়ে দেব?
কত বয়স হবে ছেলেটার? সাতাশ আঠাশ। এই চাকরির দুর্দিনে পলিটিক্যাল পার্টির দয়ায় চাকরি পেয়েছে। আইটিআই করে কতগুলো বছর বসে ছিল। বাজারে চাকরি কোথায়? স্টিলপ্ল্যান্টে নতুন লোক নিচ্ছে না কতদিন। রাজনীতির দাদাদের ধরে, মিটিং-মিছিলে গিয়ে গিয়ে একটা লাইন করেছে। রোলিং মিলে লেবারারের চাকরি। তাও টেম্পোরারি। পেটের দায় থাকলে ভালমন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের খুঁটি আঁকড়ে আর কতদিন থাকতে পারবে? তবু ছেলেটার শুভবুদ্ধি একেবারে চলে যায়নি এখনও। মাথা নিচু করে জামার কোণ খুঁটছিল।
—ভেবে দেখুন কাকিমা, কী করবেন। আমার জন্য ভাববেন না। আপনাদের যা ভাল মনে হয় সেটাই করুন। আমি যদি কোনওভাবে হেল্প করতে পারি জানাবেন। পরাজিত যোদ্ধার মতো মাথা নিচু করে চলে গেছিল ছেলেটা।
বিশ্বাস, বলভরসা একটু একটু করে ভেঙে যাচ্ছিল বালির বাঁধের মতো। ওরা আজ গর্তে ঢোকা ইঁদুর। মুখ ফুটে প্রতিবাদ করার মতো কেউ নেই। পাড়া-প্রতিবেশী কেঊ না। লোকদেখানো খবর নিতে আসা শুধু। মুখে আহা উঁহু, কিন্তু আসল ব্যাপারে ঢনঢন। কী করবে মাধুরী মিথ্যা স্তোকবাক্য শুনে? তাছাড়া লোক আসুক সেটা রেখা সহ্য করতে পারে না। তাই পাড়ার লোকদের ঠারেঠোরে না করে দিয়েছে মাধুরী। এখন ভিড় করে এসে দেখার কিছু নেই। মিথ্যা কষ্ট বাড়ানো। এদের মধ্যে যারা একটু বুঝদার, মনে ভয় থাকলেও চোখের চামড়া এখনও আছে, এটা-ওটা রান্না করে বাড়িতে টিফিনকৌটো পৌঁছে দেয়। বাড়িতে গিয়ে সেভাবে রান্না করে খাওয়ার অবস্থায় আসেনি মাধুরী এখনও।
আত্মীয়স্বজনদের তো সেইভাবে না করে দেওয়া যায় না। মাধুরী বিশেষভাবে কাউকে খবর দেয়নি, কিন্তু একজনের থেকে আর একজন চাউর হয়ে যায়। রেখার পিসিরা ঘুরে গেছে একবার। রতনের কাকা-কাকিমা এল বর্ধমান থেকে। আসানসোলের জ্যাঠামশাই। ওদের কীভাবে বারণ করবে! আর মাধুরীর বোন। ও তো কলকাতা উজিয়ে বারবার আসে। মালিনীকে কোন মুখে আটকাবে? রেখা মাসির বাড়িতে থেকে স্কুল কলেজ করেছে কতদিন। নিজের মেয়ের মতোই তো দ্যাখে। তাই না স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বারবার আসছে কলকাতা থেকে। মালিনী অনেকবার বলেছে কলকাতায় নিয়ে চল দিদি। তোরাও আমার বাড়িতে থাকবি। দুর্গাপুরের থেকে বেটার ট্রিটমেন্ট হবে।
কথাটা মাধুরীও যে বোঝে না, এমন নয়। রেখা তো গিয়ে থেকেছিল অত বছর। মালিনীর ভালবাসায় কোনও খাদ নেই। কিন্তু সুস্থ মেয়েকে বোনের কাছে রাখা এক জিনিস। আর সপরিবারে বোনের বাড়িতে থেকে মেয়ের চিকিৎসা করানো আরেক ব্যাপার।
মালিনী বলল, তুই কেন এত কিন্তু কিন্তু করছিস দিদি। শেখর আমাকে বারবার বলেছে তোদের সবাইকে নিয়ে যেতে। আমাদের মেয়েটা এই অবস্থায় পড়ে আছে, এখন কি এতসব ভাবলে চলে?
শেখর শুরুতেই এসেছিল। নিজে মাধুরীকে বলে গেছে। আমাদের বাড়িটা নিজের বাড়ি মনে করুন দিদি। আপনারা আমার ওখানে থাকবেন কদিন। রতনকেও বারবার বলে গেছে।
মালিনী দিদিকে সমঝে চলে। এই কথাগুলোও নেহাত ফিসফিস করে দিদির কানে ঢোকাচ্ছিল। মাঝেমাঝে। ফাঁকে-ফোঁকরে। এই যেমন একবার বলল, তোদের জামাইয়ের এক বন্ধুর চেনা ডাক্তার আছে। স্পেশালিস্ট। মেডিক্যাল কলেজে। চেনা থাকলে যত্নটা বেশি পাবে।
—বুঝি রে মানু। আর একটু দেখি। এই ডাক্তারও খুব যত্ন নিয়ে দেখছে। ও কী বলে দেখি।
ডক্টর মল্লিক নিজেই বলেছেন, এখানে বেশিদিন রাখার দরকার নেই। একটু শুকালেই আপনাকে প্লাস্টিক সার্জনের কাছে নিতে হবে। গ্রাফটিং করতে হবে। বাঁ-চোখটা বাঁচানো যাবে না, কিন্তু ডান-চোখটার জন্য ভাল ডাক্তার দেখানো দরকার। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। সব জানে মাধুরী। বোঝে। কিন্তু আগে যেমন ঝট বলতে সিদ্ধান্ত নিতে পারত আজ সেই ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে তার অদৃষ্ট। এমন লক্ষীমন্ত রূপ তার মেয়ের! সব এমন ছারখার হয়ে গেল! মন ভরে কাঁদতেও পারেনি মাধুরী। কে জানে কপালে আর কত কান্না লেখা আছে তার।
এইরকম সাতসতেরো ভাবনায় ডুবে ছিল মাধুরী। লেখা দিদির পায়ের কাছে মাথা রেখে ঢুলছে। ডক্টর মল্লিক আসতে ধড়ফড় করে উঠে বসল। মালিনী রতনের সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। ডাক্তারকে দেখে সেও পিছন পিছন ঘরে ঢুকে এসেছে। ডাক্তার মল্লিক অভিজ্ঞ ডাক্তার। স্টিলপ্ল্যান্টের দরুণ বার্ন-কেস অনেক হ্যান্ডেল করেছেন। কেমিক্যাল স্পিলও তো হয় প্ল্যান্টে। ওদের যেমন নিরাশ করেননি, তেমনি ভরসাও দেননি। আসলে ওদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করেছেন। মেয়ের যে মুখ দেখেছেন, যদি ভাবেন ব্যান্ডেজ খোলার পর ওরকম পাবেন আবার, সেটা বড় ভুল হবে। অ্যাসিড কিছু রাখে না। আমাদের ওর মুখটাকে আবার রিকন্সট্রাক্ট করতে হবে। একবারে হবে না, বারবার সার্জারি করে, গ্রাফট করে। আর সবচেয়ে বড় কথা মেয়ের সামনে আপনারা এমনভাবে রিয়্যাক্ট করবেন না যেন ওর জীবন শেষ হয়ে গেছে।
এরকম অনেক কথা শুনে শুনে মাধুরীর বলভরসা আরও কমে গেছে। কিন্তু তবুও যা দেখতে হল তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল না মাধুরী। ডাক্তার বললেন, আজকে আমি ব্যান্ডেজটা খুলব। মালিনীকে বলল, আপনি ছোট মেয়েটাকে নিয়ে একটু বাইরে দাঁড়ান, শুধু মা থাকলেই চলবে। এত ভিড়ের মধ্যে আমার অসুবিধা হবে। মালিনী লেখাকে নিয়ে বারান্দায় গেল। রতন দরজার পাল্লা ধরে দাঁড়িয়েছিল, সেও বেরিয়ে গেল।
কপাল থেকে যখন ব্যান্ডেজ খোলা হল দেখেই সারা শরীরে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল মাধুরীর। জায়গায় জায়গায় হাড় পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে! মেয়ের একটা চোখ মায়ের উপর বসানো। ডুকরে কেঁদে উঠবে তারও উপায় নেই। বাঁদিকের কানের জায়গায় শুধু একটা গর্ত, লতিটা নেই। এ কে চেয়ে আছে মাধুরীর দিকে। সেই চোখে যদিও কোনও ভাষা ছিল না, মায়ের জন্য কোনও প্রশ্ন ছিল না, তবু মাধুরীর মনে হল সমস্ত যন্ত্রণা আর অভিযোগভরা একটা ধংসাবশেষ যেন তার দিকে চেয়ে আছে। মুখে হাত চাপা দিয়ে দাঁড়িয়েছিল মাধুরী। মেয়েকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা তার মুখে জোগায়নি।
ডাক্তার আলগোছে তার কাঁধে আঙুল ছোঁয়ালেন। বুকে শক্তি রাখুন। আমার যা করার আমি করেছি। ওর প্রাণ বেঁচে গেছে। ওখানেই তো আসল মানুষটার বাস। এরপর আপনারা ওকে কলকাতা নিয়ে যান। আমি ডাক্তারের ডিটেলস দিয়ে দিচ্ছি। ডাক্তার পণ্ডিত আমার পরিচিত। উনি গ্রাফট করবেন। পায়ে তো ক্ষতি হয়নি। থাই থেকে স্কিন নিয়ে মুখের উপর কাজ হবে। একসঙ্গে সব হবে না, আস্তে আস্তে বারে বারে করতে হবে। রেখার দিকে মুখ ঝুঁকিয়ে বললেন, তোমাকে শক্ত হতে হবে মা। তোমার মনে যদি জোর থাকে, তোমাকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে নিয়ে যাব আমরা।
ডাক্তারের মুখে প্রত্যয় থাকলেও মা-মেয়ের মধ্যে কোনও এফেক্ট হল না। রেখার চোখ শুকনো, মুখে কোনও ভাবান্তর নেই। মাধুরী স্তব্ধ মূর্তির মতো, চোখ দিয়ে শুধু জলের ধারা নেমে আসছে। কী আশায় বুক বেঁধেছিল মাধুরী। যেন ব্যান্ডেজ সরালেই তার চিরপরিচিত মেয়ের মুখ বেরিয়ে আসবে। অন্যায় সে আশা, কিন্তু মানুষ তো এমন আশা নিয়েই বুকে বল আনে। এখন কোন ভরসায় এগিয়ে যাবে মাধুরী? কীসের আশায়?
এতক্ষণে মালিনী, রতন, লেখা ঢুকে এসেছে। লেখা মায়ের আঁচল ধরে বিহ্বল চোখে চেয়ে আছে। রতনের ঠোঁট থরথর করে কাঁপছে, কিন্তু মুখে কোনও আওয়াজ নেই। এর মধ্যে মালিনীই এগিয়ে এল। এরপর কী করতে বলেন ডাক্তারবাবু?
—আমি ওনাকে বলেছি। ডাক্তারের নামঠিকানা দিয়ে দিচ্ছি। আপনারা একটুও দেরি না করে ওকে কলকাতা নিয়ে যান। গ্রাফট করাতে হবে। আর হ্যাঁ, ডঃ রঞ্জিত সরকারকে দেখান। চোখের জন্য। আপনাদের অন্য কাউকে কনসাল্ট করতে ইচ্ছে হলে করুন। আমার তাতেও আপত্তি নেই। কিন্তু দেরি করবেন না। পারলে কালকেই অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে কলকাতায় নিয়ে যান। এখানে আর কিছু করার নেই। আপনারা যেরকমভাবে ঠিক করবেন আমি ডিসচার্জ করাবার ব্যবস্থা করব।
ডাক্তার মল্লিক সঙ্গের নার্সকে কিছু ইন্সট্রাকশান দিয়ে রওয়ানা দিলেন। যেতে যেতে আবার ফিরে এলেন ডাক্তার মল্লিক। গলার স্বর এবার একটু কড়া, যদিও স্বর খুব নিচু। দেখুন, আমি বুঝি আপনাদের উপর দিয়ে কী ঝড় গেছে। কিন্তু এই মেয়েটির ভিতরে যে ঝড় চলছে, তার কাছে কিছুই নয়। আপনাদের যদি শোক করতে হয়, বাইরে গিয়ে করবেন। এখানে নয়। গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন ভদ্রলোক।
লেখাকে দিদির পাশে বসিয়ে মালিনী দিদি আর জামাইবাবুকে নিয়ে দরজা পেরিয়ে বারান্দায় এল। এখনও কী ভাবছিস এত দিদি? আমি ওকে এখুনি ফোন করে দিচ্ছি। সব গুছিয়ে রাখবে। ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে ওখানে ভর্তির ব্যবস্থা হলেই আমরা সোজা রেখাকে নিয়ে চলে যাব।
মাধুরী রতনের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদছিল। রতন যেন ঝড়ে বাজপড়া গাছ একটা। ছাইয়ের মতো সাদা মুখ। শুধু বিড়বিড় করছে, আমার মা চলে গেল, আমি রাখতে পারলাম না। আমি কিছু করতে পারলাম না।
—কী বলছ দাদাবাবু, এখন কি এইভাবে ভেঙে পড়ার সময়? আমি বরং ওকে বলছি এসে আমাদের নিয়ে যাক।
মাধুরী সোজা হয়ে দাঁড়াল এবার। আঁচল দিয়ে চোখ মুছল। তাই হবে মানু, আমরা তোদের ওখানেই যাব। কিছুদিন থাকতে হলে থাকব না হয়। তুই ব্যবস্থা কর। তোর দাদাবাবু লেখাকে নিয়ে এখানেই থাক, সবাই মিলে ভিড় বাড়িয়ে কী কাজ। লেখার স্কুল আছে, ওকেও তো কলেজটা করতে হবে। চাকরি না করলে খাব কী আর মেয়ের চিকিৎসাই বা কী করাব? মাধুরীর গলা কান্নাভেজা হলেও, চিন্তার দৃঢ়তাটা ফিরে আসছিল। দেখে স্বস্তি পেল মালিনী।
কিন্তু ওরা যেন কাচের ঘরে বাস করছে। ক্ষণে ক্ষণে ঝনঝন করে ভেঙে পড়ছে। কীভাবে কী হবে, কখন বেরোনো হবে, বাবা-মেয়ের খাওয়াদাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে, বাড়ি গিয়ে দু-চারটে জামাকাপড় গুছিয়ে নেবে— মাধুরী যখন এইসব জল্পনা করছে বারীন এল ছুটতে ছুটতে। চুল উসকোখুসকো, হাঁফাচ্ছে। যেন পুরো রাস্তা দৌড়েই এসেছে।
—কাকিমা, আপনারা একদম আজ বাড়িমুখো হবেন না। খুব গণ্ডগোল ওদিকে।
—কেন বারীন, কী হয়েছে আবার? দুঃসংবাদ ছাড়া তো আর কিছু পায় না মাধুরী। বুকটা কাঁপতেও ভুলে গেল।
—আপনাদের বাড়ির সামনে ওরা বোম মেরেছে, পরপর কয়েকটা। আমি মনাদার কাছে খবরটা শুনেই ছুটতে ছুটতে এসেছি।
—আমাদের বাড়িতে? বাড়িটা কি আছে না গেছে? রতন ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল।
—আমি এখনও দেখিনি। আপনারা কেউ যাতে আজ ওদিকে না যান, সেই জন্য সাবধান করতে এলাম আগে। কে জানে আরও কিছু যদি হয় আজ? এখান থেকে কোথাও বেরোবেন না এখন। আমি গিয়ে একবার দেখে এসে আপনাদের সব খবর দেব।
বারান্দার বেঞ্চিতে বসল তিনজন। কোনওভাবেই কি বেঁচে থাকা যাবে না আর? মাধুরীই মুখ খুলল। আমি ভেবে নিয়েছি। আর এখানে থাকা নয়। তোর হয়তো একটু কষ্ট হবে, কিন্তু আমি এদের সবাইকে নিয়ে তোর বাড়িতেই উঠব মানু। দুর্গাপুরের পাট আমি তুলে দিলাম। এখানে আর ফিরব না।
[আবার আগামী সংখ্যায়]