আরণ্যক উপাখ্যান : প্রেম ও হিংসার জোয়ারভাঁটা

হাঁড়িবাঘা - ফলসি চড়া

প্রিয়ক মিত্র

 

নিঃসঙ্গতাই একমাত্র উত্তরাধিকার, যা আদিম যুগ থেকে মানুষ বহন করে চলেছে। এই একুশ শতকের বুকে হাঁটতে হাঁটতেও মানুষ আসলে নির্জন, কারণ একা হয়ে যাওয়াই তার শেষতম নিয়তি। বোর্হেস একমনে বাঘ দেখতেন চিড়িয়াখানায়, খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে। নিজের রাজ্যপাট ছেড়ে যে দুর্দমনীয় রাজা একা বন্দী থাকেন, তার সঙ্গে মিল খুঁজতেন? বোর্হেস ছুঁয়ে দেখতে চাইতেন বাঘকে। ঘৃণা, দ্বেষ, সংঘর্ষের আবহাওয়ায় দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন বোর্হেস, তাঁর কাছে বাঘ ছিল আত্মিক মুক্তির বাহক। সেই মুক্তিতে পৌঁছে মানুষ দলছুট, সেই মুক্তিতে পৌঁছে মানুষ মার্কেজের চিঠি না পাওয়া কর্নেল।

উইলিয়াম ব্লেক তাঁর ‘সংস অফ এক্সপেরিয়েন্স’-এ শব্দে এঁকেছিলেন তাঁর কল্পনার বাঘের প্রতিরূপ। বোর্হেস বা ব্লেকের চেতনায় মুক্তিকামিতার টোটেম হয়ে ওঠা এই বাঘের সাধনা করতে চেয়েছিলেন দীপক মজুমদার তাঁর ‘বড় গাজী খাঁ’ নামক লেখাটিতে। বৌদ্ধিকভাবে স্বাধীনচেতা এক বাঙালির আত্মপরিচয়ে তিনি ‘নিজস্ব বাঘ’-এর সন্ধানে ব্রতী হয়েছিলেন। বাঙালির লৌকিক আত্মানুসন্ধানেও তো বাঘ উপস্থিত স্বমহিমায়। এ বাংলা রায়মঙ্গলের, গাজী খাঁ-র, রতাই মউল্যার, দক্ষিণরায়ের। সুন্দরবনের মানুষের সঙ্গে বাঘের নিত্য সহবাস। সে সহবাসে আছে নিরন্তর সংঘাত, মৃত্যু, রক্তপাত। তবু সে সহাবস্থান। জেলে, মধু সংগ্রাহকদের সঙ্গে তার নিত্য মোলাকাত। দক্ষিণরায় রতাই মউল্যার প্রাচীন উপাখ্যানের ছায়ায় দীর্ঘদিন ধরে অবিরল চলছে রহস্যে ঘেরা সুন্দরবনের মানুষের সঙ্গে বাঘের এই ভয়াল যাপন। এই গোটা ব-দ্বীপ জুড়ে মানুষের এই নিয়ত বেঁচে থাকার যে গোষ্ঠীবদ্ধ ভুবন, তার পাশাপাশি রয়েছে মানুষের একে অপরের কাছে যাওয়ার তাগিদ, রয়েছে প্রেম, রয়েছে ঈর্ষা, রয়েছে শ্রেণিচেতনা, রয়েছে অর্থনৈতিক শোষণ, রয়েছে মালিকের সঙ্গে শ্রমদাতার দূরত্বের চিরাচরিত আখ্যান; আর সেসবের মাঝে মানুষ একাকী, সঙ্গীহারা। গা ছমছমে সুন্দরবন হয়ে ওঠে বাঘ আর সেই একা মানুষের যৌথ সাকিন।

বাঘের সঙ্গে নিরালা মানুষের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে ময়নাতদন্তের হঠাৎ প্রয়োজন হল কেন? ‘রসিকতা’-র প্রযোজনা ‘ফলসি চড়ার উপাখ্যান’ নাটকটি দেখার অভিজ্ঞতা বস্তুত উসকে দিল এসব কথা। মিউজিক্যাল নাটক বাংলা থিয়েটার-এ আগন্তুক কোনও ফর্ম নয়। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ভালোমানুষ’ বা ‘তিন পয়সার পালা’-র বিষয়ে আগের প্রজন্মের অভিজ্ঞতা শুনে এবং পড়ে আমরা ঋদ্ধ হয়েছি। আমাদের কৈশোরে বাংলা মঞ্চে আলোড়ন ফেলেছিল ‘দেবী সর্পমস্তা’। দেবেশ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনাতেই মঞ্চস্থ হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সে’, যা আদ্যন্ত মিউজিক্যাল। এই নাটকটিও সঙ্গীতনির্ভর। তবে নাটকের গঠন এবং আঙ্গিক নিয়ে কথা বলার আগে নাটকটির আখ্যানভাগের দিকে তাকানো যাক।

নাটকটি শুরু হয় সুন্দরবনের দরিদ্র মানুষের রোজনামচার সূত্র ধরে। মধু সংগ্রহের পেশা, জেলের পেশায় থাকা কিছু মানুষ, যাদের অস্তিত্ব কঠোর বাস্তবতার জমিতে দাঁড়িয়ে, তাদের দৈনন্দিনতার মাঝেই লুকিয়ে থাকে কল্পজীবন, রূপকথার সমস্ত জরুরি উপাদান। মোড়ল জিতেন সর্দারের কড়া শাসনে থাকা গ্রামবাসীদের কোনও ক্ষোভ নেই, কিন্তু শোষণ আছে পুরোমাত্রায়। অভাবী মানুষকে লঘুপাপে কুমীর কামটের পেটে যাওয়ার মতন গুরুদণ্ড দেন জিতেন সর্দার। তাই ফলসি চড়ার মানুষরা দিনযাপন করে দাঁড় বাওয়া নৌকার ছন্দে। বিশাল অরণ্যানীর সমস্ত বিপদের মধ্য দিয়ে, সন্তর্পণে। তাদের স্বপ্ন আছে, তাদের সুখের মোকাম জানা আছে, কিন্তু তা কোনওভাবেই তাদের অধিকারের সীমারেখা অতিক্রম করে না। এই গ্রামেরই ছেলে নয়ন, সে বাঁশুরিয়া, তার বাঁশিতে বিষমাখানো তীরের থেকেও তীব্র সুর খেলে বেড়ায়, তার গানের গলাই তার একমাত্র অস্ত্র। মোড়লের মেয়ে কাজলের সঙ্গে সে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে, তার শ্রেণি অবস্থান ভুলে, সমস্ত সামাজিক বাধার কথা ভুলে। নয়ন আর কাজল, নায়ক আর নায়িকার নামের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রূপকল্প, বাস্তবের মাটি ছেড়ে যার অবস্থান। নাটকটি খুব বাঁধা গতে সামাজিক নিগড়ের আওতায় পড়ে একটি প্রেমের অপমৃত্যুর দিকেই এগোতে পারত, কিন্তু তা ঘটে না। এর মধ্যেই নাটকের চরিত্র হয়ে ওঠে হাঁড়িবাঘা। বৃদ্ধ বাঘ, মানুষখেকো হয়ে ওঠা ছাড়া যার আর কোনও গতি নেই। সে প্রাণ কেড়ে নেয় একের পর এক মানুষের। মোড়লের ছেলে নিহত হয় তার আক্রমণে, যে নয়ন আর কাজলের প্রেমের মাঝে বাধা হয়ে উঠেছিল। মোড়ল স্বয়ং আহত হয়। এখানেই কাহিনির গতিপথ পরিবর্তিত হয়।

নয়ন প্রাণীহত্যায় অপারগ। সে হাঁড়িবাঘার শিকারকে আর পাঁচজন গ্রামের মানুষের মতন প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে দেখে না। সে বাস্তুতন্ত্রের নিয়মকানুন জানে না, সে বোঝে এটুকুই, যে মৌমাছির কষ্টার্জিত মধু মানুষ ছিনিয়ে আনে চাক ভেঙে। প্রাণীজগতে অন্যায় গাজোয়ারির সব অধিকার মানুষের একার কবলে, কিন্তু বাঘকে শিকার করেই জীবনধারণ করতে হবে। হাঁড়িবাঘা এবং ফলসি চড়ার মানুষ দু’পক্ষই আদতে বেঁচে থাকার জন্য লড়ে। মানুষ আসলে যেভাবে হোক বেঁচে থাকতে চায়। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘কঙ্কাবতী’-তে বলা আছে কুসুমঘাটীর বাঘের কথা, যে বাঘ মানুষ ভিন্ন আর কিছু শিকার করে না, এবং মানুষ নানা কৌশলে তাকে বধ করে। মানুষের কৌশল করে বেঁচে থাকার কথা ব্রেশটও বলেছিলেন। মানুষকে কৌশল জানতে হয়। এমন বাঘের কথাও ‘কঙ্কাবতী’-তে ছিল যে রীতিমত চতুর, যাকে মেরে ফেলা যায় না, ত্রৈলোক্যনাথের মনে হয়েছিল সে আদতে ‘মনুষ্য’। যে ‘মনুষ্য’ নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য একরকমের শেকড়ের সাহায্যে বাঘের রূপ ধরে। সেখানে লুকিয়ে থাকে মানুষের ঘৃণা, যে ঘৃণাতে ক্লান্ত হয়ে বোর্হেস বাঘ দেখতেন মুগ্ধ চোখে।

হাঁড়িবাঘা-র কোনও ঘৃণা নেই। হাঁড়িবাঘা-র কোনও আক্রোশ নেই। সে জানে শিকার এবং আত্মরক্ষার উপায়। কাজল নয়নের রোমান্টিকতায় ভেসে যেতে পারে না। গানের দরিয়ায় সাঁতার কাটতে কাটতেই সে ভাবে নয়ন যদি একটা দুর্দান্ত বাঘ শিকার করে তার বাবাকে সন্তুষ্ট করতে পারে। জীবিকার প্রয়োজনে জঙ্গলে গিয়ে হাঁড়িবাঘা-র খাদ্য হয় ফলসি চড়ার মানুষ। তারা জানে মোড়ল শোষক, কিন্তু মোড়লের ছত্রছায়াতেই তারা নিজেদের প্রাণ রক্ষা করে। নয়ন ভাবে না বিপদ নিয়ে। গানের সুরের কাছে বিপদ মানেই ঠাট্টা, ‘ফাল্গুনী’ নাটকের ঠাকুরদাদার সংলাপের মতো। কিন্তু সমষ্টির এই উত্তাপ তাকেও অনুভব করতে হয়, যখন প্রতিহিংসাপরায়ণ কাজল নিজেই বাঘশিকার করতে যেতে চায়। নয়ন মরণপণ বাজি রেখে হাঁড়িবাঘা-র সঙ্গে যুদ্ধে যায়। রতাই মউল্যা তখন লোকায়ত ইতিহাসের ছায়ার আড়াল থেকে তাকিয়ে থাকেন। কিন্তু হাঁড়িবাঘাকে পরাজিত করে কাজলের কাছে রক্তমাখা নয়ন যখন ফিরে আসে তখন কাজলের মৃতদেহ যন্ত্রণায় নীল হয়ে উঠেছে। কাজলকে কেউ অন্তর থেকে চেয়েছিল, নয়নের প্রতি ঈর্ষায় সে কাজলকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দিয়ে ফেলে। অন্য অনেক লোককথার মতোই বিয়োগান্তক হয়ে থাকে এই প্রেমের কাহিনি। শুধু অটুট থাকে চরিত্র হিসেবে কালান্তক সুন্দরবনের থমথমে উপস্থিতি।

এই আখ্যান গানের সুরে কথিত হয়, এবং তার সঙ্গে জুড়ে যায় অবিশ্বাস্য শরীরী অভিনয়। মানুষের শরীর এখানে ধীরে ধীরে নির্মাণ ঘটায় জীবন, মৃত্যু, সংগ্রাম, সংঘাত এবং আতঙ্কের উপকূলে জমে ওঠা একটি গল্পের। কয়েকটি লাঠিকে সম্বল করে শরীরী বিভঙ্গ জমাট বাঁধে মঞ্চের ওপর। দর্শককে বিহ্বল করে দেয়। দৃশ্য তৈরি করে শরীর, অনুভব গড়ে তোলে শরীর। নাটকটির রচয়িতা এবং নির্দেশক অভিজ্ঞান ভট্টাচার্যকে কুর্নিশ জানাতে হয় ম্যানগ্রোভ অরণ্যের অন্দরের কথা এত সাবলীলভাবে দর্শকের কাছে উপস্থাপনার জন্য। পাশাপাশি অভিবাদন প্রাপ্য এই নাটকের নৃত্য পরিকল্পক সুমিত কুমার রায়ের। তিনি নিজে নয়নের চরিত্রে অবতীর্ণ, তাঁর চরিত্রায়ণ অসামান্য হয়ে ওঠে তাঁর নিজের এবং কোরাস অংশের প্রত্যেক কলাকুশলীর চূড়ান্ত শরীরী অভিনয়ের দক্ষতায়। প্রেমিক থেকে শিকারী হয়ে ওঠার পথে তাঁর যাত্রাটিকে তিনি অদ্ভুত ছন্দে বেঁধে ফেলেন তাঁর অভিনয়ে। কাজলের চরিত্রে তন্নিষ্ঠা বিশ্বাসের অভিনয়ও প্রশংসার দাবি রাখে। নাটকের বিভিন্ন অংশে তাঁর অনুভূতির চড়াই উতরাই-এর প্রকাশভঙ্গিমা অনবদ্য। মোড়লের চরিত্রে অভিজ্ঞান ভট্টাচার্য রীতিমতো সাবলীল। নজর কাড়ে হাঁড়িবাঘার ভূমিকায় কৌশিক করের ভয়াবহ অভিনয়। হাঁড়িবাঘা প্রথম যে দৃশ্যে মঞ্চে আসে, সেই দৃশ্যে বাঘ আসার সংকেত প্রকাশ পেয়েছিল শব্দের আবহে, হাঁড়িবাঘার আসন্ন উপস্থিতি হাড়হিম করে দিচ্ছিল, সেই আবহ বজায় রেখেই হিংস্র মানুষখেকো বৃদ্ধ দুর্দম বাঘের চরিত্রে কৌশিক কর তাঁর অভিনয়ের তেজ বজায় রেখে চলেন। হাঁড়িবাঘা ও নয়নের লড়াইয়ের দৃশ্যে সুমিত কুমার রায় এবং কৌশিক কর শরীরের নানাবিধ কসরত দিয়ে যে দৃশ্যকাব্য রচনা করেন তা মুগ্ধ করে রাখে। কোরাসের প্রত্যেক অভিনেতা চূড়ান্ত সহযোগিতা দিয়ে চলেন তাদের। তাদের প্রত্যেকের মুন্সিয়ানা এই নাটকটিকে অন্য মাত্রা দেয়।

নাটকটির সঙ্গীত করেছেন ইন্দ্রনীল মজুমদার। হ্যানস আইসলার লোকসঙ্গীতের সুরের মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে রাজনৈতিক বক্তব্যকে নিয়ে যাওয়ার মার্গ নির্দেশ করেছিলেন। বাংলায় গণনাট্য সংঘের হয়ে কাজ করার সময় হেমাঙ্গ বিশ্বাস সলিল চৌধুরীরা সেই পথের অনুসারী হয়েছিলেন, কিন্তু খালেদ চৌধুরী সংশয় প্রকাশ করেছিলেন এই পদ্ধতির মৌলিকতা নিয়ে। শহুরে সুরেই লোককথার আবেশ তৈরি করা যায়, বিশেষত যখন দর্শক নাগরিক। এই নাটকেও তাই হয়েছে, তবে এ জাতীয় নাটকের ক্ষেত্রে সুরের রেশ থেকে যাবে এমনটাই প্রত্যাশিত। এক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। সঙ্গীত এবং তার পরিবেশনা আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন এই নাটকের ক্ষেত্রে।

এই নাটকের আলোক পরিকল্পনা এবং মঞ্চসজ্জা কলাকুশলীদের পারফরমেন্সের পরিপূরক হয়ে থাকে। আলো এবং অভিনয় দিয়ে নাটকের শেষে স্থিরচিত্রের আমেজ তৈরি হয়, তা সত্যিই মোহিত করে দেওয়ার মতন।

‘চাঁদ বণিকের পালা’-র শুরুতে একটি চরিত্র বলে ওঠে, পিতৃপুরুষের নাও যে ‘দূরান্তরের পথে’ পাড়ি জমিয়েছে, সেই পথে গিয়ে পূর্বপুরুষের মর্যাদা জয় করে নিতে হবে। এই অভিযাত্রায় মানুষের সহস্র সঙ্গী থাকলেও প্রকৃতপক্ষে সে একা। সে একা ইতিহাসের বিশালত্বের সামনে। এই নাটকে নয়ন তার গানের রাজ্যে একা, কাজল তার আত্মদহনে একা, বৃদ্ধ হাঁড়িবাঘা তার আগলে রাখা রাজত্ব নিয়ে একা, সে একা মৃত্যুতেও, কাজলের প্রেম না পেয়ে যে যুবক ঈর্ষাকাতর, সে একা বরফের মতন, অপরকে আগুন পোহাতে দেখে সে জমে ওঠে আরও। শেষপর্যন্ত প্রতিটা একা মানুষের জীবননাট্য সমষ্টির স্বরলিপিতে বোনা হয়। সুন্দরবন তার ভয়ঙ্কর সুন্দরকে যখের ধনের মতো আগলে জেগে থাকে, হাজার বছরের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির সাক্ষী থেকে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...