বনমালির উমা ও অন্যান্য গল্প

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

বনমালির উমা

পুজোর বেশ কয়েকটা দিন আগে থেকেই শহরের এই ঝুপড়ি গ্যারাজঘর‌ই আস্তানা হয়ে ওঠে বনমালি আর তার সাকরেদ কজনের। একেই ছোট পরিসর তার ওপর গ্যারাজের তিনভাগ জুড়ে ডাঁই করে রাখা ভাঙাচোরা গাড়ির যন্ত্রপাতি আর যতসব অকাজের জিনিস। বাকি এক চিলতে জায়গাতেই তাদের কোনওরকমে শরীর এলানোর  ব্যবস্থা। এই পাব্বনের সময় এটুকুই যে জুটেছে তাই বড় ভাগ্যি, না হলে হয়তো ফুটপাতেই ঠাঁই নিতে হত। এই গ্যারাজের মালিক জগাদা বনমালির গেরামসম্পর্কের দাদা। তাই বছর কয়েক ধরে এখানেই আস্তানা গেড়ে কাজকম্ম সামলানো। এখন তো শহরের বুকে পুজোপাব্বনের হিড়িক ক্রমশ‌ই যেন বেড়ে চলেছে। এদেশে  মানুষের মতো দেবদেবীর সংখ্যাও তো কিছু কম নয় ! তাই সারা বছ্ছর জুড়েই পুজোর ধুম। এক পুজো যায় তো অন্য পুজোর ঢাকে কাঠি পড়ে। সেসব মিটিয়ে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মাস দুয়েক গড়িয়ে যায়। এই পুরো সময়টা এখানেই কেটে যায় বনমালিদের। পুজো কমিটির বাবুদের সঙ্গে কথা কয়ে পয়সাকড়ির ব্যাপারটা খোলসা করে নিতে হয় কিছু আগামের বিনিময়ে, না হলে পরে এই নিয়ে আকচাআকচি করা ভাল লাগে না বনমালির।

আজ আকাশের মুখ ভার। সকলের মনেই শঙ্কা কী হয়, কী হয়? সকলেই ব্যস্ত চোখে আবহাওয়া দপ্তরের টাটকা বুলেটিনে নজর রাখছে। পুজোকমিটিগুলো আজ মণ্ডপে প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে খুব উৎসাহী নয়। তাই এখন একটু গতর এলানোর সুযোগ হয়েছে ওদের। ওরা জানে এরপর বেশ কয়েকদিন দিনরাত এক করে ঠাকুর তোলা-নামানোর কাজ করতে হবে নাগাড়ে।

একেবারেই ছোট ঠাঁই, তাই নিজের অমন লম্বা তাগড়াই শরীরটাকে শামুকের মতো গুটিয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে বনমালি। চাঁপা এই দশাসই চেহারার জন্য বনমালিকে ডাকে দশানন বলে। আজ বনমালির পাশে শুয়েছে শ্যামপদ, তারপর বিল্বদল আর কালাচাঁদ। বাকি কয়েকজন অন্য এক ঠাঁয়ে রয়েছে। এই পাব্বনের সময় ওদের এলাকার গেরাম ঝেঁটিয়ে সোমত্ত মরদেরা দলবেঁধে শহরে পাড়ি দেয়। কুমোরপাড়ার কারিগরদের সঙ্গে এই কয়েক বছরে বেশ খাতির জমে উঠেছে বনমালির। আগে হাতফোনের বালাই ছিল না। পাব্বনের সময় কাছে আসতেই সময় করে শহরে এসে সব যোগাযোগ করে যেতে হত। এখন হ্যালো বলে যন্তরে একবার হাঁক পাড়লেই সব কাজ হাসিল।

শুয়ে শুয়ে বাড়ির কথা, চাঁপার কথা মনে পড়ে। চাঁপার কাছে কথাবলা যন্তর নেই। তাই কেমন আছে তারা তা জানতে পারছে না। মনটা তাই উতল হয়ে আছে। বকুলের কথাও এই পুজোপাব্বনের দিনে মনের গভীরে তুফান তোলে। কোথায় যে হারিয়ে গেল মেয়েটা! আজও তার হদিস করে উঠতে পারেনি বনমালি। মেয়েটা কাছছাড়া হওয়ার পর থেকেই চাঁপা কেমন যেন বদলে গেছে। সবসময় হারিয়ে যাবার ভয় ওকে তাড়া করে ফেরে। বনমালির মা নন্দরানি এখনও যথেষ্ট শক্তসমর্থ রয়েছেন। তিনিই মেয়ের মতো আগলে রাখেন চাঁপাকে। তাঁর কথাতেই হঠাৎ একলা হয়ে যাওয়া চাঁপা আরেকটি সন্তান নিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু কপালের এমন‌ই ফের ছেলেটা জন্মইস্তক রুগ্ন। কলকাতার বড় হাসপাতালে এনে ছেলেটাকে দেখানোর কথা অনেকদিন ধরে ভাবছে সে। নানান তালে এখনও দেখানো হয়ে ওঠেনি। এবার পুজোর পর চাঁপা আর নোদনকে নিয়ে একবার কলকাতা ঘুরে যাবে।

বনমালিদের গ্রাম থেকে শহরে আসাটাও বেশ ঝকমারির কাজ। সেই কাকভোরে ঘুম থেকে উঠে মাইল তিনেক পথ পায়ে হেঁটে খেয়াঘাটে পৌঁছতে হয়। সেখান থেকে ইস্টিমারে চেপে বড় গাঙের পথ বেয়ে লম্বা সফর। শেষে বাস, তারপর ট্রেনে চেপে শিয়ালদা ইস্টিশন। এই দীর্ঘ সফরের ধকল সয়ে তবে কাজের মুরুব্বিদের নাগাল পাওয়া! এখন অবশ্য সমস্যা কিছুটা মিটেছে। বড় গাঙের ওপর লম্বা সেতু বাঁধা হয়েছে। গ্রামের রাস্তাঘাটের চেহারা কিছুটা ফিরেছে। তবে কষ্টের সুরাহা হয়েছে এমন নয়। তাছাড়া বনমালিদের কাজটাও বেশ ঝুঁকির।

শক্ত বাঁশের দোলায় মোটা কাছি দড়ি দিয়ে প্রতিমাকে কষে বেঁধে তাকে নিয়ে যেতে হয় সন্তর্পণে। একটু উনিশ-বিশের ফারাক হলেই সব পরিশ্রম বরবাদ।

বনমালি অবশ্য এই কাজে অনেকদিনের অভিজ্ঞ। বাপ ভুঁইমালি পাইক ছিলেন ঠাকুর তোলার কাজে দক্ষ মানুষ। তাঁর হাত ধরেই গ্রামের লোকজন এই প্রতিমা ব‌ওয়ার কাজ শিখেছে। এখন তাঁর বয়স হয়েছে। গায়েগতরে সেই আগের জুত আর নেই। ছেলে বনমালি নিজেই এখন উস্তাদ হয়ে উঠে বাপের ছেড়ে যাওয়া জমিতে ম‌ই দিচ্ছে।

এই সময় গেরামে কাজকাম কম। আজকাল চাষবাসের অবস্থাও তেমন ভাল নয়। পরপর দুটি বছর টানা ঘরে বসে থেকে জমানো পুঁজি ভাঙিয়েই কোনওরকমে দিন চালাতে হয়েছে। তার ওপর এই সনে তেমন তেজেল বৃষ্টির দেখা পাওয়া যায়নি। বনমালিদের এলাকার লোনামাটিতে বছরে একবার‌ই চাষ হয়, এই ভরা বর্ষায়। আকাশের জলে মাটির লোনা ভাব অনেকটাই কমে গেলে জমি আবাদি হয়ে ওঠে। অন্য সময় সমুদ্দুরের জল গাঙ ছাপিয়ে জমিতে ঢুকে পড়ে সব বরবাদ করে দেয়। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বনমালি স্বপ্ন দেখে দশভুজা মায়ের কৃপায় তার পাকা বাড়ি হয়েছে, জমি থেকেই উঠে আসছে সম্বৎসরের খোরাক‌, চাঁপার ভাঙা গতরে উপচে পড়া জোয়ারজলের ঢল নেমেছে, ছেলেটার বুকের ফুটোটা ভরে গেছে কোন এক মায়ামন্ত্রবলে, তাই ও এখন সারা উঠোনে ছুটে ছুটে খেলা করছে, হারিয়ে যাওয়া বকুল আবার ফিরে এসেছে। কিন্তু একি! বকুলকে অমন বিধ্বস্ত লাগছে কেন? ভয়ার্ত মুখ, ফ্যাকাশে দৃষ্টি, আলুথালু বেশ! ওকে ঘিরে কারা এমন অশ্লীলভাবে অঙ্গভঙ্গি করছে? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তীব্র কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে বনমালি। সহসা তার এমন চিৎকার শুনে সকলে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে।

—ও বনমালিদাদা, এই বুড়ো বয়সে দেয়ালা করছ নাকি?

পাশে শুয়ে থাকা শ্যামপদর কথায় সম্বিত ফেরে বনমালির। ধড়মড়িয়ে সতরঞ্চির বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। তারপর চোখ কচলাতে কচলাতে বলে— সবাই উঠি পড়। মেয়েটা অনেকক্ষণ মোদের জন্যি অপিক্ষে করি আছে। উমারে ঘরে নিরাপদে পৌঁছে দিতি হবে। রাস্তাঘাটে আজকাল অসুরের দাপাদাপি। আর দেরি করা চলবেনি। মেয়েটা আমাদের জন্য পথ চেয়ি বসি আছে। চল উঠি পড়।

 

ফুলমাসি ও দেবীপক্ষ

রাতের আঁধার থাকতেই বেড়িয়ে পড়েছে শঙ্করী। বড় বড় পায়ে হেঁটে স্টেশনে পৌঁছে এই লাইনের প্রথম আপট্রেনটা ধরতে না পারলে আজকের দিনটাই বেকার হয়ে যাবে। এখন অলিতে-গলিতে তিনচাকার টোটোগাড়ি দাপিয়ে বেড়ালেও এইদিকে এখনও খুব একটা চালু হয়নি। কাঁচা পয়সার লোভে অনেক উঠতি বয়সের ছেলেছোকরারাই স্কুলকলেজের পড়া ছেড়ে আজকাল টোটো নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। এসব দেখে শঙ্করীর ভয় হয় যদি তার ছেলে সন্তুও এমন করে! সন্ত এখন ক্লাস নাইনের ছাত্র। পড়াশোনা করতে ভালবাসে। ইস্কুলের মাস্টারমশাই দিদিমণিরা সবাই সন্তুকে খুব আগলে রাখেন। রেখাদিদিমণি তো রাস্তায় দেখা হলেই বলবে— শঙ্করীদি, ছেলেটার খেয়াল রেখো। বিগড়ে না যায়। দেখো, ও একদিন আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। এ-কথা শুনে শঙ্করী মনে মনে খুব খুশি হয়। এই আশাতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে চলে।

রাত-অন্ধকারেই স্টেশনে বিস্তর লোকজন গিজগিজ করছে। সকলেই যাবে ফুলের হাটে। আজকাল এই লাইনেও অনেক মানুষের ভিড়। শঙ্করীর মতো গৃহস্থ পরিবারের মেয়েব‌উরাই বেশি। বাজারের যা হাল তাতে করে একহাতের রোজগারের ভরসায় থাকা চলে না। ছেলেপিলেদের চাহিদা মেটাতেই বাপমায়েদের নাজেহাল অবস্থা। সন্তুকে নিয়ে এসব বিষয়ে একদম চিন্তা নেই। ছেলেটা একেবারে ওর বাপের ধারা পেয়েছে। সব বিষয়েই কেমন নিরাসক্তি। শঙ্করীর ভয় হয় ছেলেটা আবার তার বাপের মতো সব ছেড়েছুড়ে বিবাগী না হয়ে যায়!

এইসব ভাবনা মাথায় পাক খেতে খেতেই গম্ভীর শব্দ তুলে ট্রেন ঢুকে পড়ে প্ল্যাটফর্মে। রোজকার মতো ঠেলেঠুলে একটা কামরায় সেধিয়ে যায় শঙ্করী।

ঘোষবাড়ির সামনে একচিলতে ফাঁকা জমিতে প্লাস্টিক বিছিয়ে বসেছে শঙ্করী। পুজোর দিনগুলোতে বেচাকেনা ভাল হয়। আজকাল লোকজনের ঠসক বেড়েছে। পাড়ার মেয়েব‌উরা বসতে না বসতেই ভিড় জমায় তাকে ঘিরে। মঙ্গল, বেস্পতি আর শনি— এই তিনদিন খদ্দেরদের আনাগোনা বেশি। আমসরা, বেলপাতা, তুলসীপাতা, দুব্বো, কুচোফুল, ছোট মালা, বড়ো মালা— নানানজনের নানান ফরমাইশ! সব কিছুর জোগাড় রাখতে হয়। নাহলে খদ্দের ধরে রাখা যায় না। ইদানিং ব্যবসায়ীদের দেখাদেখি ফ্ল্যাটবাড়ির নতুন বাবু-বিবিরা ঘরের দরজার মাথায় লেবুলঙ্কা ঝোলানো শুরু করেছে। এ-সবের‌ও জোগাড় রাখতে হয়। মালক্ষ্মীর মতো খদ্দেররাও যে চঞ্চলা শঙ্করী তা জানে। একা হাতে সব সামলে চলা।

প্রথম ঘন্টার খদ্দেরঝড়ের পর এখন চাপ খানিকটা কমে এসেছে। ঘাড় উঁচিয়ে চারদিকে নজর করতেই দেখে খানিকটা তফাতে সন্তু একলা দাঁড়িয়ে আছে। সন্তু এখন এখানে কেন? বাড়িতে কোনও ঘটনা ঘটেনি তো! শঙ্করীর মনে শঙ্কার মেঘ। মায়ের সামনেটা কিছুটা ফাঁকা হতেই সন্তু এগিয়ে আসে।

নরম গলায় বলে— মা, বাবা ফিরে এসেছে। সঙ্গে এক…।

সন্তুর কথা যেন ঠিকমতো শুনতে পায় না শঙ্করী। বিস্ময়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ক্ষণেকের খুশি গ্রাস করে নতুন আশঙ্কা। কেন এতদিন পরে ফিরে এসেছে সনাতন? নিছক দেখা করতে? নাকি তার কাছ থেকে সন্তুকে নিয়ে যেতে? একলা এসেছে সে? সঙ্গে কাকে নিয়ে এসেছে? এমন সব প্রশ্ন তোলপাড় করে শঙ্করীর মনে। নিজের আসন থেকে চকিতে উঠে এসে দুই হাতে প্রবল শক্তিতে সন্তুকে জড়িয়ে ধরে শঙ্করী। তার লড়াইয়ের একমাত্র আয়ুধ, তার একমাত্র অবলম্বন। শঙ্করীর চোখমুখের চেহারা নিমেষে বদলে যায়। মনে হয় ঠিক যেন এক ক্ষিপ্ত বাঘিনী তার শাবককে আগলে রাখতে চাইছে সব বিপদের আশঙ্কা থেকে। সনাতন কি জানে না এখন দেবীপক্ষের কাল?

 

ওরা তিনজন

—বেটা সুরজ, উঠ। জলদি কর বেটা। দের করনেসে কুছ মিলেগি নহি।

ফুটপাতের ওপর জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে থাকা ছেলেকে ব্যস্ত হাতে ধাক্কা দেয় লতা। সুরজের ঠিক পাশেই শুয়ে আছে চাঁদনি, সুরজের থেকে ঠিক দু-বছরের ছোট সে। মায়ের হাঁকডাকে ঘুম ভেঙে যায় তার। ঝটপট উঠে পড়ে মাকে জিজ্ঞেস করে— ম্যায় ভি যাঁউ ক্যায়া?

লতা এখন‌ই মেয়েকে এই কাজে লাগাতে চায় না। সে নিজের কথা ভাবে।

বিহারের এক ছোট্ট গাঁও থেকে একদিন মা-বাবা আর ছোটভাইয়ের হাত ধরে এই শহরে পা রেখেছিল লতা। তখন তার কিশোরী বয়স। সেই থেকে এই ইয়ার্ডপাড়াতেই ঘাঁটি গেড়ে থাকা। বাবা-মা দেশে ফিরে গেলেও তার আর ফেরা হয়নি। ইয়ার্ডে মুটিয়াগিরি করত লছমন। তার সঙ্গেই ঘর বেঁধেছিল লতা। প্রথম প্রথম বেশ কয়েকটি বছর ভালই ছিল। কিন্তু প্রথমে সুরজ ও পরে চাঁদনি জন্মাবার পরেই লছমনের মতিগতি কেমন বদলে গেল। একদিন  রেলপাড়ের বস্তির দুলালির হাত ধরে ইয়ার্ডকলোনি ছেড়ে কোথায় উধাও হয়ে গেল। সেই থেকে চলছে লতার লড়াই।

মায়ের ডাকাডাকিতে এবার উঠে পড়ে সুরজ। প্লাস্টিকের বোতল থেকে আঁজলা করে জল নিয়ে চোখমুখে ছিটিয়ে বস্তা হাতে মায়ের পিছনে পিছনে চলতে থাকে। ওদের দেখাদেখি চাঁদনিও হাঁটা লাগায়। ওদের ঠাঁইয়ের পাশে লেজ গুটিয়ে কুণ্ডলি পাকিয়ে শুয়ে থাকা ভুলু কুকুর‌ও লেজ নাড়াতে নাড়াতে ওদের পিছু পিছু চলতে শুরু করে। এ যেন এক মিছিল চলেছে।

লাইনটা পার হয়ে বা  দিকে ঘুরতেই বজরংবলিজির মন্দির। এখন বন্ধ। সবাই কপালে হাত ঠেকায়। লাইনের আশেপাশে পড়ে থাকা প্লাস্টিকের বোতল, প্যাকেট চটপট তুলে ব্যাগে ভরতে ভরতেই নজরে পড়ে একটা ফ্লেক্সের ব্যানার। সুরজ পড়তে শুরু করে—

সুরজ থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে দেখে চাঁদনি তাড়া দেয়— সুরজ ভাইয়া, জলদি আও।

বোনের ডাক শুনে সুরজ হালকা ছুট লাগায়। নিজের মনেই বিড়বিড় করে বলে— সির্ফ তিন কিলো, সির্ফ তিন কিলো। মা, হমে আজ কমসে কম দশ কিলো প্লাস্টিক একাঠ্ঠা করনা হ্যায়।

লতা ছেলের এই ভাবান্তর দেখে বেশ অবাক হয়। সে বুঝতে পারে না সুরজের হঠাৎ কী হল?

কাছে গিয়ে বুকেপিঠে হাত বুলিয়ে বলে— তেরা ক্যায়া হুয়া বেটা? কোই তকলিফ হো রহা হ্যায়? মুঝে বতা বেটা, মুঝে বতা।

সুরজ কোনও উত্তর দেয় না। ছেলের চোখমুখের চেহারা দেখে লতা খানিকটা ভয় পেয়ে যায়। কী করা উচিত তা বুঝতে না পেরে বলে— চল বেটা, ঘর মে ওয়াপস চল। ঘরে ফিরে যাওয়ার কথা শুনে সুরজ চঞ্চল হয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলে— নহি, মা নহি। মুঝে কুছ নহি হুয়া। ম্যায় বিলকুল ঠিক হুঁ। আজ হমে কমসে কম দশ কিলো প্লাস্টিক কচড়া জুটানা হ্যায়। আজ হম সব মিল কর চিকেন মাস ঔর ভাত খায়েঙ্গে। ভুলুয়া তু ভী হমারে সঙ্গ জুট যা বেটা। তুঝে ভি আজ চিকেন খিলায়েঙ্গে। সব কাম পে জুট যাও। আজ জিৎ হমারি হোগি। জয় বজরংবলি।

এখনও ভোরের আলো ফুটতে অনেকটাই দেরি আছে। ইয়ার্ড লাগোয়া কুঠির মাঠে তিনজোড়া ব্যস্ত হাত তখন নাগরিক কচড়া কুড়োতে ব্যস্ত, ভীষণ রকমের ব্যস্ত। ওই ফেলে দেওয়া আবর্জনাই ওদের বেঁচে থাকার রসদ জোগায়। দ্রুত ভরে উঠছে ওদের বস্তাগুলো। বারবার বস্তাগুলো হাতে করে তুলে তুলে তাদের ওজন বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করে সুরজ। মাঠের আবর্জনার দুর্গন্ধ ছাপিয়ে ভোরের বাতাস যেন ভরে ওঠে গরম ভাতের সুবাসে।

ফেরার পথেই দেখা হয়ে যায় গুলাবির সঙ্গে। গুলাবির মেয়ে ইমলি সুরজের‌ই বয়সি। লতাকে দেখে বেশ খুশি হয় সে। এগিয়ে এসে বলে—

—কাল কহা থে তুমলোগ? আমাদের মহল্লার সবাই কাল মাংস-ভাত খেতে গিয়েছিলাম। ওই যে কেলাবের ছেলেরা প্লাস্টিকের কচড়ার বদলে খাওয়াল। ইমলি কাল পাঁচ কিলো প্লাস্টিক কচড়া একাঠ্ঠা কিয়া থা। কত দিন পর মেয়েটা পেট ভরে খেতে পেল‌। তা লতা! তোরা এলি না কেন?

গুলাবির কথাগুলো লতা, সুরজ আর চাঁদনির কানে ঢোকে না। খোলা মাঠের আবর্জনার স্তূপের পাশে ওরা একদম স্থির হয়ে দাঁড়ায় বেইজের অবিস্মরণীয় ভাস্কর্য হয়ে। তারিখটা দেখতে ভুল হয়ে গেছে সুরজের।

ভোরের হালকা কুয়াশার চাদর ক্রমশ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে ঢেকে ফেলে ওদের চারজনের বুভুক্ষু অবয়বগুলোকে। সূর্যোদয়ের এখনও দেরি আছে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. অন্তহীন দুঃখের কথা। অথচ মিষ্টি গদ্য যা কষ্ট অনুভব করায় কিন্তু খুঁচিয়ে দেয় না।

  2. এই অণুগল্পগুলোর পটভূমিতে রয়েছে একদল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষ। এঁরা অচেনা হয়তো নয় তবে এদের ওপর এভাবে আলো ফেলার প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। খুব সংবেদনশীল আখ্যান।

আপনার মতামত...