শুভোদয় দাশগুপ্ত
কেন্দ্র হোক বা রাজ্যে বর্তমান শাসনপ্রণালীর স্থিতাবস্থা দেশের ও রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে যে এক অপরিবর্তনীয় বিনাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতমধ্যেই যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা অপূরণীয়। এরপর এ-রাজ্যের আর এ-দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনও ভবিষ্যৎ থাকবে না। ধর্মীয় বিভাজন-নির্ভর, সংস্কারাচ্ছন্ন বিজ্ঞানবিমুখ এক জাতি তৈরি করা হবে যাদের দেশে বা আন্তর্জাতিক দরবারে শিক্ষাজগতে বা কর্মসংস্থানে কোনও গ্রাহ্যতাই থাকবে না। দেশের অর্থনীতি তথা কর্মসংস্থানের অন্যতম অভিমুখ হিসেবে যুবসমাজের সামনে থাকবে ধর্মীয় বিভাজন, আর উগ্র জাতীয়তাবাদকে নিয়ে ব্যবসা করা। ঐতিহ্য, শিক্ষা-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিল্প-সংস্কৃতি সব তাৎপর্যহীন হয়ে যাবে সেই অন্য ভারতবর্ষে। আর সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত
দেশের ও রাজ্যের শিক্ষার হাল নিয়ে আবার একটা লিখবার কি কোনও কার্যকারিতা আছে? আজ এক দশকের বেশি সময় ধরে যে নৈরাজ্য ও অনাচার রাজ্যে ও সমগ্র দেশে চলছে তা নিয়ে প্রতিবাদ আন্দোলন কম হয়নি, মেলা লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু ফল কী ফলেছে কোনও? এই সময়কালের ছাত্রছাত্রীদের প্রজন্ম এক ভয়াবহ ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে। যে ক্ষতি হয়ে চলেছে শিক্ষাব্যবস্থায় এক দশকের বেশি সময় ধরে তার মেরামতের কোনও দিশা নেই। প্রতিনিয়ত যেভাবে তলিয়ে চলেছে শিক্ষাব্যবস্থা তাতে ক্ষত ও ক্ষতি পূরণ হতে ঠিক কতটা সময় লাগবে তা পরিমাপ করার মতো দূরদর্শিতা আছে এমন ব্যক্তির সন্ধান এখনও পাওয়া গেছে বলে জানা নেই। শিক্ষা স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে সবচেয়ে অবহেলিত ক্ষেত্র। যে শিক্ষা জাতিগঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন তাকে দলমতনির্বিশেষে শাসকশ্রেণি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে চিরকাল।
বস্তুত আমাদের রাজ্য দিয়েই গোটা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সার্বিক ভগ্নদশার একটা পূর্ণাঙ্গ পরিস্থিতির হদিশ পাওয়া যায়। নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০, যা কিনা এ-দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে রসাতলে নিয়ে যাওয়ার অব্যর্থ অভিসন্ধি, তারও সবচেয়ে সুচারু প্রণয়ন হচ্ছে আমাদেরই পশ্চিমবঙ্গে। এ-রাজ্যে ২০১১ সালের রাজনৈতিক পালাবদলের ইঙ্গিত যখন স্পষ্ট হয় ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে, তার আগে-পরেই শিক্ষাঙ্গনগুলো হয়ে ওঠে লাগামহীন নৈরাজ্য ও সন্ত্রাসের নিশানা। এই সন্ত্রাস এক প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসবার মাধ্যমে। শিক্ষক-শিক্ষয়িত্রী, অধ্যাপক-অধ্যাপিকারা দিকে দিকে লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হতে শুরু করলেন। আক্রান্ত হলেন শিক্ষাঙ্গনের বাকি দুই গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার শিক্ষাকর্মী ও ছাত্রছাত্রীরা। গণতন্ত্রের নিরঙ্কুশ জয়ের যে মহোৎসব মমতা বন্দোপাধ্যায় কার্যকর করলেন তার মধ্যে অন্যতম ছিল বিরোধীদের পার্টি অফিসগুলো দখল করে তিন-চার দিন ধরে এলাকাবাসীর রাতের ঘুম কেড়ে, অসুস্থ মানুষদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে লাউডস্পিকারে চড়ামচড়াম ঢাকের বাদ্যি শোনানো। তার মধ্যে ছিল লেখাপড়া নেই, কর্মসংস্থান নেই, এহেন অবসাদে ডুবে থাকা অগণিত তরুণদের নিয়ে বাইকবাহিনি গঠন করে এলাকায় এলাকায় তাণ্ডব করে বেড়ানো এবং অবাধে সন্ত্রাস ছড়ানো। গণতন্ত্রের এই মডেলই পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনগুলিতে।
তাই ক্ষমতায় আসার পর একদিকে যেমন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দপ্তরের দখল নেওয়া হল, অন্যদিকে শিক্ষাঙ্গনগুলোকেও কার্যত দখল করা হল শাসকদলের দুষ্কৃতিদের দিয়ে। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর সব নির্বাচিত পরিচালন সমিতি ভেঙে দিয়ে শাসকদলের মনোনীত প্রতিনিধিদের বসিয়ে দেওয়া হল। মমতা যে শাসনব্যবস্থা কায়েম করেন তার চালিকাশক্তি হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছিলেন বাংলার কৃষ্টিকে কলুষিত করা। আর এই কৃষ্টিকে ধ্বংস করবার সহজতম রাস্তা হল শিক্ষাব্যবস্থাকে অচল করে দেওয়া। এই একটা অস্ত্রেই ঘায়েল হতে পারে রাজ্যে মানুষের সমস্ত গণতান্ত্রিক অধিকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সন্ত্রাসের আবহে মুড়ে ফেলা হল। সুস্থ-স্বাভাবিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিবেশ, স্বাধীন মতপ্রকাশের সব পরিসর রুদ্ধ করা হল। এই দমবন্ধ করা পরিস্থিতিতেও দিব্যি রাজ করে গেলেন শাসকদলের কাছে আত্মসম্মান বিকিয়ে দেওয়া কিছু শিক্ষক, অধ্যক্ষ, উপাচার্য ও শিক্ষাকর্মী। এই আবহেই সারা রাজ্যে লাঞ্ছিত হলেন, নিপীড়িত, শারীরিকভাবে নিগৃহীত হয়ে চললেন বিপুল সংখ্যক শিক্ষক, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ ও উপাচার্য।
আজ দীর্ঘ তেরো বছরেও এই পরিবেশ কাটল না। প্রতিবাদে মুখর হলেন না সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী বা ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবককুল। এই আবহেই আরাবুল, মনিরুল, অনুব্রতর মতো বাহুবলীরা মহা-বাহুবলী হয়ে উঠলেন। আর এদেরকে সন্ত্রাসের অবাধ ছাড়পত্র দিয়ে মাননীয়া এ-রাজ্যে গণতন্ত্রের অন্তর্জলীযাত্রাকে এক উৎসবে পরিণত করেছেন। এই উৎসবের উপকরণ হল একের পর এক বিরোধী জনপ্রতিনিধিকে ভয় দেখিয়ে অথবা লোভ দেখিয়ে শাসকদলের পতাকা ধরিয়ে বিরোধী-শূন্য বিধানসভা গঠনের লক্ষ্যে এগোনো। এই উৎসবের উপকরণ হল বিরোধীদের ঘরছাড়া করা, তাঁদের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাঁদের রাতের ঘুম কেড়ে নেওয়া। কিন্তু সবচেয়ে বড় প্রহসন হল এই যে, মাননীয়া এ-রাজ্যের নিরঙ্কুশ অংশের মানুষের স্বচ্ছ ভোটদানের মাধ্যমেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। আর মাননীয়াও হয়তো তার দূরদর্শিতা দিয়ে অনুধাবন করেছিলেন যে তিনি নিজের হাতযশে নয়, রাজ্যবাসী চৌত্রিশ বছরের শাসনের অবসান ঘটানোর প্রত্যয়ে এক নেগেটিভ ভোটে তাঁকে ক্ষমতায় এনেছেন। সেই কারণেই হয়তো গণতন্ত্র তাঁর পক্ষেও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে এই আশঙ্কায় প্রথম থেকেই তিনি গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করে একনায়কত্বের দিকে ঝুঁকেছিলেন। এই একনায়কত্বকে নিশ্চিত করতে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থার উপর আক্রমণ নামিয়ে এনেছিলেন।
এই সন্ত্রাসের আবহেই ধীরেধীরে শিক্ষার পণ্যায়ন, শিক্ষাকে চিরতরে গরিব, সাধারণ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে ঠেলে দেওয়ার প্রধান অ্যাজেন্ডা চরিতার্থ করে গিয়েছে শাসকদল। এই মেথেডোলজির হবহু মিল এনডিএ সরকারের সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে গরিব ও সাধারণ মধ্যবিত্ত ছাত্রসমাজকে শিক্ষার আঙিনা থেকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে পাঠানোর অভিসন্ধির সঙ্গে। এই অভিসন্ধিরই পরিণতি দলিত ছাত্রদের উপর মানসিক উৎপীড়ন এমনকি আত্মহত্যায় প্ররোচনা। বিগত এক দশকে আমাদের রাজ্যে তথা সারা দেশে শিক্ষাব্যবস্থার এই একই অভিমুখ— পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশন, গরিব সাধারণ মধ্যবিত্ত ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত হওয়ার এই একমাত্র অবলম্বনকে চিরতরে ধ্বংস করে দেওয়া। অ্যাজেন্ডা একই। শুধু ভিন্ন ভিন্ন রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন স্থানীয় পরিস্থিতিতে তার উনিশ-বিশ প্রায়োগিক তফাত। এই অ্যাজেন্ডা চরিতার্থ করতেই অতিমারিকালে ঘোষণা করা হল জাতীয় শিক্ষানীতি-২০২০। মান্যতা পেল অনলাইন শিক্ষা। পাবলিক ফান্ডেড শিক্ষা-নির্ভর লক্ষ লক্ষ ছাত্রছাত্রীর শিক্ষিত হওয়ার স্বপ্ন চিরতরে হারিয়ে গেল। আর ধীরেধীরে শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ বেসরকারিকরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়ার রাস্তা মসৃণ থেকে মসৃণতর হল।
এনইপি ২০২০, যা কিনা শিক্ষাব্যবস্থার এক প্রহসন, তাকে জাঁকজমক করে প্রণয়ন করা হল তলায় তলায় পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশন থেকে সরকারি দায়বদ্ধতা প্রত্যাহার করে নিতে। এই শিক্ষানীতি দেশের শিক্ষার্থীদের, বিশেষত সাধারণ মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র পরিবারের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষিত হওয়ার যাবতীয় স্বপ্নকে নির্দয়ভাবে ভঙ্গ করেছে। বস্তুত শিক্ষা যে বর্তমান শাসককুলের কাছে একটা সবচেয়ে অবহেলার ক্ষেত্র তা এই শিক্ষানীতিতে স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
রাজ্য তথা সমগ্র দেশের এই শোচনীয় পরিস্থিতি থেকে মুক্তির দিশা কী? গণতন্ত্রের উপর, শিক্ষাব্যবস্থার উপর এই নজিরবিহীন আক্রমণের মধ্যেও যে প্রতিবাদ যে আন্দোলন জারি আছে তার প্রতি সাহসী জনসমর্থন নেই। যতরকমের নির্বাচন হচ্ছে তাতে এই বিরোধী শক্তি দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক এখন আর চুরি, দুর্নীতি বা নৈরাজ্যে বিচলিত নয়। বর্তমান শাসকেরাই ফিরেফিরে আসছে ক্ষমতায়। এই শাসককুলের পূর্বে যে-কোনও শাসকদলের হিসেব চুকিয়ে দিত জনগণ বিগত দশ-বারো বছরের তুলনায় এক ভগ্নাংশ দুর্নীতি, নৈরাজ্য হলে। ভোটাররা এত বদলে গেলেন কী করে? নাকি বিরোধীদের সেই তত্ত্বই ঠিক যে নির্বাচন অস্বচ্ছ; এমনকি ইভিএম-এও কারচুপি হচ্ছে। এ-কথা নির্ভরযোগ্য নয় বলেই ধরে নিই যদি তাহলে কেন স্বৈরাচারী, নৈরাজ্যের প্রতিভু, দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকদেরই ঘুরেফিরে ক্ষমতায় রেখে দিচ্ছে জনগণ? এর পিছনে রহস্য কী? ডোল পলিটিক্স? গরিব ভোটারদের পুরুষ-নারী নির্বিশেষে কিছু দয়ার দান ছুড়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসীন থাকা নিশ্চিত করা? নাকি শাসককুলের সন্ত্রাসের কাছেই বশ মেনে, ভয়ে স্থিতাবস্থা বজায় রেখে চলেছেন নির্বাচকরা? কিন্তু দেশের যে চরম ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, শিক্ষার যে সর্বনাশ হতে আর বাকি নেই।
আর কেন্দ্র হোক বা রাজ্যে বর্তমান শাসনপ্রণালীর স্থিতাবস্থা দেশের ও রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থাকে যে এক অপরিবর্তনীয় বিনাশের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতমধ্যেই যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে তা অপূরণীয়। এরপর এ-রাজ্যের আর এ-দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোনও ভবিষ্যৎ থাকবে না। ধর্মীয় বিভাজন-নির্ভর, সংস্কারাচ্ছন্ন বিজ্ঞানবিমুখ এক জাতি তৈরি করা হবে যাদের দেশে বা আন্তর্জাতিক দরবারে শিক্ষাজগতে বা কর্মসংস্থানে কোনও গ্রাহ্যতাই থাকবে না। দেশের অর্থনীতি তথা কর্মসংস্থানের অন্যতম অভিমুখ হিসেবে যুবসমাজের সামনে থাকবে ধর্মীয় বিভাজন, আর উগ্র জাতীয়তাবাদকে নিয়ে ব্যবসা করা। ঐতিহ্য, শিক্ষা-বিজ্ঞান-প্রযুক্তি-শিল্প-সংস্কৃতি সব তাৎপর্যহীন হয়ে যাবে সেই অন্য ভারতবর্ষে। আর সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে চলেছে প্রতিনিয়ত। এক অচেনা ভারতবর্ষ রচনা হয়ে চলেছে প্রতিদিন। যেখানে শিক্ষা সংসদে হয়তো একটা জিরো আওয়ারেও আলোচিত হওয়ার পরিসর পায় না। যেখানে মিডিয়া শিক্ষাকে প্রকৃত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবার মতো সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করবার কোনও দায় প্রায় অনুভব করে না। স্বাধীনতার পর পঁচাত্তর বছর পেরিয়েও যে দেশে শিক্ষাখাতে জিডিপির বরাদ্দ ন্যূনতম কাঙ্খিত লক্ষ্যের ধারেকাছে আসে না। পক্ষান্তরে দশকের পর দশক ধরে এদেশে পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশনকে রুগ্ন থেকে রুগ্নতর করে বেসরকারিকরণের রাস্তা সুগম করেছে কমেবেশি সব সরকারই। একটা সময় ছিল, যখন পাবলিক ফান্ডেড এডুকেশন প্রান্তিক অঞ্চলের দুঃস্থ পরিবারের ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় অনেক দূর অবধি পৌঁছে দিতে সমর্থ ছিল। সরকারি আনুকুল্যে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা তখন শিক্ষাগত উৎকর্ষের শিখরে উঠে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে; দেশবাসীও ধন্য হয়েছে, গর্বিত হয়েছে তাদের জন্য। আজ এই সুযোগ আর প্রান্তিক পরিবারের দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের নেই বললেই চলে।
রাষ্ট্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে এবং রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে যে নৈরাজ্য, যে বিশৃঙ্খলা ও অচলাবস্থাকে চিরস্থায়ী করে রেখেছে শাসকদল এক দশকের বেশি সময় ধরে তাতেই বোঝা যায় যে সরকারপোষিত এবং সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অচল করে দেওয়াই শাসকদলের অভীষ্ট। এইভাবেই শিক্ষাব্যবস্থার বেসরকারিকরণের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। আর এনইপি তো সোনায় সোহাগা। টিচিং, লার্নিং ও রিসার্চ ইউনিভার্সিটির পৃথকীকরণে যে এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির ভবিষ্যৎ কী হবে তা এই মুহূর্তে অনুমান করা না গেলেও তাও যে শিক্ষার বেসরকারিকরণের পথই সুগম করবে এটা বুঝতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না।
এই রাজ্যেই বা তার ফল কী হবে? আপাতদৃষ্টিতে রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক সংঘাতে এক অভূতপূর্ব সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর দ্বৈরথে এক অভূতপূর্ব অচলাবস্থায় পড়ে যায় রাজ্যের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি। ক্রমশ এই দ্বৈরথ রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রীর লড়াই থেকে দুটি রাজনৈতিক দলের লড়াই ও ক্ষমতার আস্ফালনে পর্যবসিত হয়। সাম্প্রতিক এই দ্বৈরথে যখন রাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে চরমতম অরাজকতা, যখন কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থায়ী উপাচার্য নেই, তখন রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পঠনপাঠন, গবেষণা, ছাত্রছাত্রীদের ডিগ্রিপ্রাপ্তি সবই এক চরম বিশৃঙ্খলা ও অনিশ্চয়তায় বিরাজমান। অচলাবস্থা কাটাবার কোনও দিশা নেই।
সবকটি রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হয়েছেন আচার্য-মনোনীত অস্থায়ী উপাচার্য। তাঁদের মধ্যে আছেন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, আছেন অবসরপ্রাপ্ত আমলারা। রাজ্য সরকার এই অস্থায়ী উপাচার্যদের বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় তাঁদের স্বাধীনতায় বাধ সেধেছে ক্ষমতার পরিসরকে অবরুদ্ধ করে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড, পঠনপাঠন ও গবেষণা ব্যাহত হয়ে চলেছে বহুকাল যাবৎ। এই আবহেই যখন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উচ্চশিক্ষা দপ্তর এই অস্থায়ী উপাচার্যদের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছেন দীর্ঘকাল তখনই উচ্চশিক্ষা দপ্তরের নিষেধাজ্ঞাকে এড়াতে “অ্যাকাডেমিক কমিটি” গঠন করবার উদ্যোগ নিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এই কাউন্সিল আপাতদৃষ্টিতে গঠন হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক অচলাবস্থা নিরসন করতে। বলা বাহুল্য রাজ্যপাল নিয়োজিত অস্থায়ী উপাচার্যদের জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০-তে থাকা বিভিন্ন সুপারিশ কার্যকর করার ক্ষেত্রেও সহায়ক হবে এই অ্যাকাডেমিক কমিটি। হয়তো একই পথে হাঁটবেন রাজ্যের অন্যান্য অস্থায়ী উপাচার্যরাও। কারণ ফ্যাকাল্টি কাউন্সিল, যাতে বিভিন্ন বিভাগের বিভাগীয় প্রধানরা থাকেন তার মাধ্যমেই স্নাতক, স্নাতকোত্তর স্তরে ভর্তিপ্রক্রিয়া, ক্লাস শুরু, পরীক্ষা ও ফলাফলের নির্ঘন্ট তৈরির মতো অত্যাবশ্যক বিষয়গুলো সম্পাদিত হয়। আর রাজ্য-রাজ্যপাল সংঘাতে স্থায়ী উপাচার্যদের পদচ্যূত করে অস্থায়ী উপাচার্যদের বসানোর পাল্টা পদক্ষেপ রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দপ্তর কর্তৃক ফ্যাকাল্টি কাউন্সিলগুলো ভেঙে দিয়ে অস্থায়ী ভিসি-দের আরও নিধিরাম সর্দার করে রাখা। আচার্য-উপাচার্য এই পদগুলি ঘিরে, রাজ্যপাল-মুখ্যমন্ত্রীর সংঘাতে এক দীর্ঘস্থায়ী অচলাবস্থা চলেছে এ-রাজ্যের রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে পঠন-পাঠন ও গবেষণা। সবচেয়ে বেশি মূল্য চোকাচ্ছে ছাত্রছাত্রীরা, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থায় এ-রাজ্যে এবং সমগ্র দেশে যে-ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনও মাথাব্যথা কোনও দায়বদ্ধতা নেই শাসকদলগুলোর। এ-রাজ্যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অচলাবস্থার কার্যকারণ এবং তার প্রতিকার এখন উচ্চতর ন্যায়ালয়ে বিচারাধীন। সাম্প্রতিকতম ঘটনা হল এই যে দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল এসেছিলেন অস্থায়ী উপাচার্যদের সঙ্গে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির কিছু সিনিয়র প্রফেসরদের সঙ্গে আচার্য-সহ আলোচনা করতে। সূত্রের খবর (অসমর্থিত সূত্রের) অস্থায়ী উপাচার্য ও তাঁদের সঙ্গে আসা বরিষ্ঠ অধ্যাপকরা সেখানে অত্যন্ত কাতরভাবে আবেদন জানিয়েছেন অস্থায়ী উপাচার্যদের ক্ষমতায়নের জন্য এবং অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে তাঁদের নিয়োগের সময়সীমা বৃদ্ধির জন্য।
এই পরিস্থিতিতেও খটকাটা লাগে অন্য জায়গায়। কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে শিক্ষা নিয়ে এই চরম সংঘাতের পরেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার তথা তাঁর রাজ্যের উচ্চশিক্ষাদপ্তর জাতীয় শিক্ষানীতির গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলি এ-রাজ্যে প্রণয়ন করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে চলেছে ধারাবাহিকভাবে। সেই এনইপি-২০২০ যা কিনা ভারতবর্ষের ইতিহাসকেই বদলে দেওয়ার নীল নকশা। যা কিনা এদেশের সংবিধানকেও মান্যতা দেয় না। দেশের বহুত্ববাদের গরিমা ও ঐতিহ্যকে ধুলিসাৎ করতে চায়। প্রশ্ন জাগে মনে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস কি তবে মিথ্যা, অর্থহীন? আজ কি তবে এই সাধের দেশ, সব ঐতিহ্য, সব ইতিহাসকে কালের গহ্বরে নিক্ষেপ করে এক মৌলবাদী রাষ্ট্র হয়ে উঠবে? যেখানে থাকবে না বহুত্ববাদ, যেখানে থাকবে না পরধর্মসহিষ্ণুতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, স্বীয় স্বীয় খাদ্যাভাস, সংস্কৃতি ও পোশাক-পরিচ্ছেদের রুচিকে বহন করে চলবার পরিসর? যে দিন আসছে তাতে এইসব ঐতিহ্য অতীত হয়ে যাবে, ধ্বংস হয়ে যাবে। ইতিহাস হয়ে যাবে এ-কথাও ভরসা করে বলা যাচ্ছে না কারণ— ইতিহাসও এখন পরিবর্তনশীল। নিরঙ্কুশ জনসমর্থন নিয়ে— তা সে স্বচ্ছপথে হোক বা অস্বচ্ছপথে, ক্ষমতায় আসীন থাকলে যে-কোনও ইতিহাসকে আস্তাকুড়ে ছুড়ে ফেলে শাসকদলের মনপসন্দ ইতিহাস পুনর্নির্মাণ করা যায় তার জ্বলন্ত উদাহরণ বর্তমান ভারতবর্ষ।
ইতিহাসেরই কি তবে এক অস্তিত্বের সঙ্কট এল? আর তার এক পরম প্রতিফলন আমাদের দেশ ভারতবর্ষ? এ-দেশের সব ইতিহাস মিথ্যে হয়ে গেল? স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, স্বাধীন ভারতবর্ষের পথচলা, স্বাধীন ভারতের নিজস্ব সংবিধান এবং তা কমবেশি ৬৫ বছর মাথা উঁচু করে থাকা— কোথায় অস্বচ্ছতা ছিল? কোথায় ফাঁক ছিল যাকে কেন্দ্র করে আজ এ-দেশের সব ইতিহাস মিথ্যে পর্যবসিত করবার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে?
স্বাধীনতার পর ষাট বছরেরও বেশি সময় যে ভারতবর্ষ বিরাজ করেছিল সেই উদারমনা এক দেশের বিবিধ ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির সহাবস্থান কি তাহলে আরোপিত ছিল? গোপনে গোপনে কি ছিল শুধুই অসহিষ্ণুতা, বিদ্বেষ অপর ধর্মের প্রতি অসূয়া? দাঙ্গা ও দেশভাগের আবহে যে স্বাধীনতা এসেছিল তাতে অনেক যন্ত্রণা ছিল সন্দেহ নাই। কিন্তু ভারতবর্ষের যে-সংবিধান রচিত হয়েছিল ভীমরাও রামজি আম্বেদকারের নেতৃ্ত্বে, সেই সংবিধান কি এদেশের মানুষ মন থেকে গ্রহণ করেননি? আর যদি বলি সেই প্রজন্মের নাগরিকরা পাঁচ-ছয় দশক আগে অন্য মানসিক ঔদার্যে চলেছিলেন, আজকের প্রজন্ম ভিন্ন— তাহলে প্রশ্ন— দেশভাগ, দাঙ্গা, ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজনের উন্মাদনা স্বজনবিয়োগ, হত্যা-হিংসা-হাহাকার এই প্রজন্ম তো প্রত্যক্ষই করেনি। তাহলে কী সেই চালিকাশক্তি যা তাদের উন্মত্ত করছে উগ্রজাতীয়তাবাদে এবং ধর্মীয় বিভাজনের উদগ্র প্রতিশোধস্পৃহায়? এ রহস্যের কিনারা হবে না? কিন্তু কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদল এক অব্যর্থ অঙ্ক হাসিল করে ফেলেছে এই ধর্মীয় পোলারাইজেশনের রাজনীতিকে নির্ভর করে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকে হাতের মুঠোয় পুরে। দেশের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ কায়েমে ভোটের রাজনীতির অঙ্ককে নিরাপদ রাখতে এদেশকে এক মৌলবাদী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করবার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করে চলেছে বর্তমান শাসকরা।
এই আবহেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দেশে আজকের শিক্ষাব্যবস্থা। যেখানে দেশে শিক্ষার কোনও অভিমুখ নেই, দিশা নেই। এই সঙ্কটের বীজ তো নিশ্চয়ই নিহিত ছিল স্বাধীনতা-উত্তর ষাট বছরে। সবচেয়ে বড় দায় ছিল স্বাধীন ভারতের শাসকদের যারা পঞ্চাশ-ষাট বছর নির্বিবাদে দেশ শাসন করে গেছে। দুশো বছরের ঔপোনিবেশিক শাসন থেকে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতিগঠনের প্রাথমিক কর্তব্যে উদাসীন থেকেছে তারা। বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠন করে স্বাধীন ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার এক ইতিবাচক রূপরেখা রচনা করেও শিক্ষার জন্য দেশের মোট আয়ের যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে তা অপ্রতুল শুধু নয়— শিক্ষাব্যবস্থার অগ্রগতির পরিপন্থী। শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের পরিমাণকে প্রয়োজনের তুলনায় নেহাতই সামান্য রাখা হয়েছিল। যা কিনা স্বাধীন ভারতের শাসককুলের এই অভিমুখ স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে শিক্ষার অগ্রগতিকে সীমাবদ্ধ রাখা হবে নিরুপদ্রবে দেশ শাসন করবার স্বার্থে। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃ্তীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় শিক্ষাখাতে কেন্দ্রীয় বরাদ্দের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭.৯, ৫.৮ এবং ৬.৯ শতাংশ। আর নবম পরিকল্পনায় এই বরাদ্দ নেমে আসে ৩.৫ শতাংশে।
এ-দেশে শিক্ষাব্যবস্থার অতীতটা যদি এমন না হত তাহলে হয়তো আজকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা এই বিপন্নতার মুখোমুখি হত না। ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থার নানা অভিমুখ— ইয়ং বেঙ্গল থেকে মেকলের মিনিটস পেরিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতের শাসকশ্রেণির শিক্ষাভাবনা এ-দেশকে এক অশিক্ষার বাতাবরণে রুদ্ধ করে রেখেছে। এই পঞ্চাশ-ষাট বছরেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বৃহত্তর ক্ষতি হয়েছে। এ-রাজ্যের এবং দেশের শাসকদলেরা এই দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থাকেই হাতে পেয়েছে চরম ক্ষতিসাধনের যাবতীয় পরিকল্পনা সুচারুভাবে সম্পাদন করতে। আর তাই রাজ্যে হোক অথবা দেশে, শাসকদলগুলির মুখ্য অভিমুখ শিক্ষা বিষয়ে যাবতীয় রাষ্ট্রীয় দায় থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া। একদিকে আমরা দেখছি আমাদের রাজ্যে শিক্ষাই হয়ে উঠেছে দুর্নীতির সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র। এ-রাজ্যে মমতা ব্যানার্জীর শাসনকালেই এই আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে যে শিক্ষা দুর্নীতির কত শক্তিশালী ও সম্ভাবনাময় একটা মাধ্যম। একদিকে যেমন এই মাধ্যমকে কর্পোরেটদের অকল্পনীয় মুনাফা লোটার যাবতীয় সুবিধা করে দিয়ে প্রভূত উৎকোচ লাভ করা যায়— অন্যদিকে শিক্ষাকে চিরতরে দুর্বল করে দিয়ে শাসকদলগুলির বিরুদ্ধে শিক্ষিত প্রতিরোধের যাবতীয় সম্ভাবনাকে গোড়ায় বিনাশ করাও সহজ হয়। আজ এ-রাজ্যে হাজারে হাজারে শিক্ষকতার চাকরি ঘুষের বিনিময়ে বিক্রি হয়ে গেছে। প্রকৃত যোগ্য চাকরিপ্রার্থীরা বেকারত্বের জীবন যাপন করছেন। কলকাতার দু-বছর ধরে আন্দোলন করছেন চাকরি থেকে বঞ্চিত এই চাকরিপ্রার্থীরা।
কোন দেশে, কোন রাজ্যে বাস করছি!! প্রান্তিক পরিসর থেকে আসা দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের বিদ্যালয়ছুট হওয়া রুখতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় প্রণীত মিড-ডে-মিলের টাকাও চুরি করছে শাসক দলের কর্তাব্যক্তিরা। কলেজের চাকরিতে ইন্টারভিউয়ের নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। কলেজের চাকরির বদলি নীতি যাকে মান্যতা দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ উচ্চশিক্ষা প্রশাসন ও নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৭, সেই নিয়ম কার্যকরী হওয়ার পর অধ্যাপকদের বদলি নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
আর অন্যদিকে দেশজুড়ে শিক্ষার অভূতপূর্ব অবক্ষয়। লকডাউনে প্রত্যেক রাজ্যে অগণিত প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীরা অকালে হারিয়ে গেছে শিক্ষাঙ্গন থেকে। তাদেরকে শিক্ষার মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনা তো দুরস্থান, চিহ্নিত করবার প্রয়াসও গ্রহণ করেনি কেন্দ্র। আর অতিমারিতে ঘোষিত হয়েছে এনইপি ২০২০। এই এনইপি-র মূল অভিমুখ অনলাইন শিক্ষার প্রসার। যে এনইপির প্রধান অবলম্বন ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ডিজিটাল ডিভাইড তৈরি করে কর্পোরেটদের হাতে সঁপে দেওয়া দেশের শিক্ষাব্যবস্থা। এ-রাজ্যের সঙ্গে সারাদেশে হাজার হাজার সরকারপোষিত স্কুল বন্ধ হতে বসেছে। উচ্চশিক্ষাতেও এই সঙ্কটের মুখোমুখি অসংখ্য কলেজ। পাশাপাশি বিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষায় পাঠ্যক্রম বদলে দেওয়া হচ্ছে ইতিহাসকে বিকৃত করে, সংবিধানের অবমাননা করে। অনলাইন শিক্ষা-ডিজিটাল শিক্ষার প্রসার ক্লাসরুম পঠনপাঠন, শিক্ষক-ছাত্রের অতি মূল্যবান শ্রেণিকক্ষের আদানপ্রদানের অবকাশ রুদ্ধ করে সঙ্কট ঘনীভূত করছে। প্র্যাকটিকাল ক্লাস যে-সব সাবজেক্টে অপরিহার্য— সেইসব মূল্যবান ব্যবহারিক শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে ছাত্রসমাজ। তার ফলে আগামী দিনে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর মতো গুরুত্বপূর্ণ পেশায় যারা আসবে তাদের পারফরমেন্সে আত্মবিশ্বাস থাকবে না। অতিমারির কারণে এরকম একটা সঙ্কট ইতিমধ্যে এসে গেছে আমাদের দেশে। লকডাউনে ডিজিটাল ডিভাইডে যেসব প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীরা আর্থিক সঙ্গতির অভাবে ছিটকে গেছে শিক্ষার আঙ্গিনা থেকে তারা তো হারিয়েই গেছে। যারা আর্থিক আনুকূল্যে অতিমারি পেরিয়ে এগিয়ে চলতে পেরেছে তারা বস্তুত শ্রেণিকক্ষে প্র্যাকটিকাল ক্লাস ছাড়াই এই সময়কালে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে গেছে। এদের কোনও রেমিডিয়াল কোচিং-এর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি সরকারি উদ্যোগে। ফলত সেইসব ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, আইনজীবীরা বিপজ্জনকভাবে মিশে গেছে সমাজের মূলস্রোতে।
এই পরিস্থিতি ছাড়াও অনেক অনেক হতাশা, দিশাহীনতা এ-দেশে আজকের ছাত্রসমাজের। মুখ বুজে তারা এই সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে চলেছে, যখন যেমন নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার তার চেষ্টা করে। যদিও তাদের সামনে কোনওই ভবিষ্যত নেই। চাকরির প্রতিশ্রুতি নেই। তাই তারা যদি দুর্বিনীত হয়, তারা যদি শিক্ষকদের সম্মান না দেয়— কিছুই বলার থাকে না। যেমন ধরা যাক স্নাতক স্তরে পর্যাপ্ত পরিকাঠামো ছাড়া সেমেস্টার সিস্টেম চালু হওয়া। ধরা যাক শিক্ষাব্যবস্থাটা শুধুই এক-দেড় মাস ক্লাস আর বাকিটা পরীক্ষা দেওয়া হয়ে ওঠা। তারপর ধরা যাক এনইপি— যা পূর্ববর্তী অবস্থা থেকেও আরও অনিশ্চয়তায় ভরা একটা সিস্টেম। যার কোনও দিশা নেই। অনেক রাজ্যে এনইপি চালু হয়ে গেছে কিন্তু কোনও সিলেবাস নেই, ভবিষ্যতের দিশা নেই। এনইপি সুপারিশ মোতাবেক চালু হয়ে গেছে ব্লেন্ডেড মোড, চালু হয়ে গেছে অ্যাকাডেমিক ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট— এসবই ছাত্রছাত্রীরা যারা অতিমারি, ডিজিটাল ডিভাইড অতিক্রম করেও কোনওক্রমে টিকে আছে তাদের ভবিষ্যৎও বিপন্ন করে চলেছে।
কেউ কি ভেবেছেন এইসব নিয়ে? প্রাথমিক ভাবনার দায়ভার তো রাষ্ট্রনায়কদের। সেই অর্থে শিক্ষাব্যবস্থার ভবিষ্যৎ জড়িয়ে আছে রাজনীতির সাথে। কিন্তু রাজনীতি এখন নিয়ন্ত্রিত হয় অর্থের দ্বারা, বাহুবলীদের দ্বারা— যেখানে শিক্ষা একটা অনুচ্চারিত বিষয়। রাজনীতি ব্যতিরেকে এগোতে পারবে না শিক্ষা এই দেশে। স্বাধীনতার পর এই দেশে কোনও সরকার সরকারি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেয়নি নানা কায়েমি স্বার্থে— কিন্তু শিক্ষাকে তারা বর্জনও করেনি— ন্যূনতমটুকু উল্লেখ করেছে নানা ছলচাতুরি করে। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে রাজনীতি এ-দেশে বিত্তবান, আর বাহুবলীদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তারা যেভাবে চাইছে সেইভাবেই দেশ চলেছে। ডেইলি লটারি আর ইলেকটোরাল বন্ডে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। শিক্ষা সেখানে ঠাঁই পায় না। ভারতীয় সংবিধানের বহু যত্নে লালিত গণতন্ত্রও এই পরিস্থিতিতে প্রহসনে পরিণত হয়েছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থা তাই এখন বস্তুত ধ্বংসের মুখোমুখি। এই পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়ানোই এখন শিক্ষাব্যবস্থার প্রধানতম চ্যালেঞ্জ। গভীর উদ্বেগের কথা এ-দেশে তথা আমাদের রাজ্যে শিক্ষা এখন শিক্ষিত মানুষদেরও ভাবনার জগতে ঠাঁই পায় না। কৃষ্টির এক দেশব্যাপী সঙ্কটেও নিরুত্তাপ নির্লিপ্ত এই ব্যাপক অংশের শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা। সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পকলা তথা সংস্কৃতির চর্চা এখন সমাজে এক প্রান্তিক অংশের মানুষের মধ্যেই বিরাজমান। রাষ্ট্র, সমাজ, সংবাদমাধ্যম তা নিয়ে একেবারেই ভাবিত নয়। দেশ ও রাজ্যের আপামর মানুষকে সম্মোহিত করে রাখা হচ্ছে, সন্ত্রস্ত করে রাখা হচ্ছে এক অদ্ভুত রাজনীতি দিয়ে যে রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত লটারি, ইলেকটোরাল বন্ড তথা কর্পোরেটদের বিপুল বে-আইনি অর্থের লেনদেনে। শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে গেলে তাকে মুক্ত করতে হবে এই রাজনীতিবিহীন রাজনীতির থেকে।