পদ্মাবতী : সামাজিক ও রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থার যুগলবন্দী গণতন্ত্রের নাক কাটবে না মাথা?

পদ্মাবতী

সৌভিক ঘোষাল

 

প্রথমে যাকে মনে হচ্ছিল একটি অকিঞ্চিৎকর স্থানীয় সংগঠনের গুণ্ডামি, এখন তা নানা ধাপ পেরিয়ে সরাসরি রাষ্ট্রের চোখরাঙানিতে এসে ঠেকেছে। শিল্পের স্বাধীনতাকে দুমড়ে মুচড়ে রাজনীতির বড় পর্দা জুড়ে বিধায়ক সাংসদ মন্ত্রী এমনকি মুখ্যমন্ত্রীরা পর্যন্ত তাণ্ডব শুরু করেছেন। সঞ্জয় লীলা বনসালীর পদ্মাবতী সিনেমাটি প্রেক্ষাগৃহে রিলিজ করার কথা ছিল আগামী ১ ডিসেম্বর। সেটি এই হাঙ্গামায় ইতিমধ্যেই অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে গেছে। এখন সিনেমা যাতে আদৌ দিনের আলোর মুখ দেখতে না পায় তা নিয়ে রাজস্থানের নাম-না-জানা কর্নি সেনার হুমকি ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে তিন-তিনটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর দৃপ্ত কণ্ঠস্বর। উত্তরপ্রদেশের আদিত্যনাথ যোগীর পর রাজস্থানের বসুন্ধরা রাজে এবং মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহান জানিয়ে দিয়েছেন এই সিনেমা রিলিজ হোক তারা চান না। বিজেপির বিভিন্ন মন্ত্রী বিধায়ক সাংসদরাও নেমে পড়েছেন আসরে। কেউ পদ্মাবতীর ভূমিকায় অভিনয় করা দীপিকা পাডুকোনের নাক কেটে নিতে চান তো কেউ অভিনেত্রী এবং পরিচালকের মাথার দাম ধার্য করছেন। সিনেমা বিতর্ককে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ আমলে রাজপুতদের বীরত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেওয়ায় গীতিকার জাভেদ আখতারকে রাজস্থানে ঢুকতেই দেওয়া হবে না -– এই হুমকি দেওয়া হয়েছে। একদিকে সুপ্রিম কোর্ট যখন বলছে সিনেমা রিলিজে কোনও বাধা দেওয়া চলবে না, তখন এই সমস্ত নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি থেকে প্রশাসনিক প্রধান মুখ্যমন্ত্রীরা যেভাবে ফতোয়া দিয়ে চলেছেন, তাতে মনে হচ্ছে গোটা দেশটা একটা বিরাট খাপ পঞ্চায়েত হবার দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।

এই লেখাটা ক’দিন আগেও যেভাবে ভাবা হয়েছিল তাতে মুখ্য দিক ছিল পদ্মাবতী রতন সেন আলাউদ্দিন খলজীর এই কাহিনীটি কতখানি ঐতিহাসিক কতখানি কল্প আখ্যান সে সবের বিচার বিবেচনা করা। পরিস্থিতি প্রতিদিন দ্রুতগতিতে যেভাবে মোড় নিচ্ছে তাতে এইসমস্ত বিশ্লেষণে যাবার আগেই বলে ফেলতে হচ্ছে এটা ভারতীয় ফ্যাসিবাদের এক নয়া চেহারা, যেখানে রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থা এবং সামাজিক দক্ষিণপন্থা একে অপরের সাথে মিশে যাচ্ছে এবং পরস্পর পরস্পরকে শক্তিশালী করছে। প্রতিক্রিয়ার এই রাজনৈতিক এবং সামাজিক জোটবন্ধন ফিল্ম সার্টিফিকেট বডি বা সেন্সার বোর্ড থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়কে পর্যন্ত অকিঞ্চিৎকর করে তুলেছে।

হিমাচল প্রদেশ এবং গুজরাট নির্বাচনের মুখে দাঁড়ানো বিজেপি নোটবন্দি এবং জি এস টি ক্ষত নিয়ে তার সঙ্কটকে নানাভাবে ঝেড়ে ফেলতে এখন মরিয়া এবং কংগ্রেসের সঙ্গে গুজরাটে দলিত ওবিসি সংগঠনগুলির নির্বাচনী বোঝাপড়া তাকে অনেক আগ্রাসী কৌশল নেওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অতীতে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়ার জন্য মেরুকরণের তাসটি তারা অনেকবার ব্যবহার করেছে এবং উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগর-সহ বেশ কিছু দাঙ্গাও এজন্য পরিকল্পিতভাবে সংঘটিত হয়েছে। ৬ ডিসেম্বর থেকে বাবরি মসজিদ -– রাম মন্দির সংক্রান্ত শুনানি সুপ্রিম কোর্টে শুরু হলে মেরুকরণ তীব্র হবে বলেই বিজেপির ভোট ম্যানেজাররা আশা করেন এবং তার আগেই সলতে পাকানোর জন্য ধর্মগুরু রবিশঙ্করকে ‘আলোচনায়’ নামানো হয়েছে। পদ্মাবতী সংক্রান্ত বিতর্কও এই কঠিন হয়ে আসা নির্বাচনী যুদ্ধে কাজে লাগানোর এক হাতিয়ার। তবে পদ্মাবতীকে কেন্দ্র করে যে অলীক কুনাট্য রঙ্গ আমরা দেখতে পাচ্ছি তা শুধুই নির্বাচনী সমীকরণে সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের দেশে মোদিরাজ আর্থিক দক্ষিণপন্থার সাথে সাথে অন্য যে দুই দক্ষিণপন্থাকে সংহত করছে এবং ক্রমশ ছড়িয়ে দিচ্ছে সেই রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থা এবং সামাজিক দক্ষিণপন্থার অনেকটা “স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত” অভিব্যক্তি এই ধরনের আগ্রাসী খাপ স্বৈরতন্ত্র। তথাকথিত সতীত্ব রক্ষার জন্য নারীর আত্মবিসর্জনের জহরব্রত এখানে অনন্য মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান পদ্মাবতীকে রাষ্ট্রমাতা হিসেবে অভিহিত করে ঘোষণা করেন তাঁর জীবনকাহিনী স্কুল সিলেবাসে পাঠ্য করা হবে। মহিলাদের “রক্ষা করায়” যারা বীরোচিত ভূমিকা রাখবে তাদের রাষ্ট্রমাতা পদ্মাবতী পুরস্কার দেওয়ার কথাও তিনি ঘোষণা করেছেন।

বিতর্ক বড়সড় রাজনৈতিক মোড় নেওয়ার অনেক আগেই সামাজিক দক্ষিণপন্থার এক স্থানীয় শক্তি কর্নিসেনা লাঠিসোটা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছিল। সিনেমার শ্যুটিং চলাকালীন সময়েই তারা পদ্মাবতীর সেট ভাঙচুর করেছে। সিনেমার সাথে যুক্ত লোকজনকে মারধোর করেছে। সম্প্রতি তারা চিতোর দুর্গ অবরুদ্ধ করে রেখে দিয়েছে।

কর্নিসেনা ও হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলির আপত্তির জায়গা মূলত দুটো। এক — পদ্মাবতী চরিত্রটি এই সিনেমায় নাচগান করেছেন। এই নাচগান করা নাকি রাজপুত রাণীদের ঐতিহ্যসম্মত নয়, তাদের মর্যাদার পক্ষে সিনেমার এইসব দৃশ্যাবলী নাকি কলঙ্কজনক। দ্বিতীয় সমস্যাটি চিতোর আক্রমণকারী সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর চরিত্রায়ণকে নিয়ে। চিতোর আক্রমণকারী এই সুলতানকে আগ্রাসী দানব হিসেবে দেখতেই রাজপুতরা নাকি অভ্যস্ত। তার চরিত্রে অন্য শিষ্ট মাত্রা সংযোজন এবং পদ্মাবতীর সাথে তার প্রেমের সম্পর্কের ইঙ্গিত রাজপুত মানসিকতাকে নাকি আঘাত করে।

এইসব আক্রমণের মুখে পড়ে পরিচালক সঞ্জয় লীলা বনসালী জানিয়েছেন তিনি রাজপুত ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধাবনত এবং ইতিহাসকে বিকৃত করেননি। কিন্তু মূল প্রশ্নটা উচ্চকিত শোরগোলের বাতাবরণে সেভাবে আলোচিতই হচ্ছে না। বিক্ষোভকারীরা ইতিহাসের বিকৃতি নিয়ে যখন সোচ্চার তখন এই প্রশ্নটিই প্রথমে আসে পদ্মাবতী কি আদৌ একটি ঐতিহাসিক চরিত্র না একটি ফিকশনাল ক্যারেকটার? এই চরিত্রটি লোকগাথায় পর্যবসিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা কোনও ইতিহাসের সূত্র ধরে নয়। হিন্দি কবি মালিক মহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্যের সূত্র ধরেই এই চরিত্রটির উন্মেষ। এই কাব্যটি অন্যান্য ভাষাতেও অনূদিত হয়েছে। যেমন বাংলা ভাষায় এর অনুবাদ করেন রোসাঙ্গের রাজসভার কবি সৈয়দ আলাওল। জায়সীর ‘পদুমাবৎ’-এর সেই অনুবাদ ‘পদ্মাবতী’র সূত্রেই বাংলায় পদ্মাবতী চরিত্রটি বিখ্যাত হয়ে ওঠে। কর্নেল টড যখন রাজস্থানের ইতিহাস লোকশ্রুতি ইত্যাদি নিয়ে তিন খণ্ড জুড়ে “অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অব রাজস্থান” লেখেন, তখন সেখানেও স্থান পায় পদ্মাবতী আখ্যান। এভাবেই একটি ফিকশনাল ক্যারেকটার আস্তে আস্তে লোকগাথায় কল্প ইতিহাস হিসেবে জায়গা করে নিতে থাকে।

চিতোরের রাণী রূপে কল্পিত পদ্মিনী বা পদ্মাবতীর কাহিনী এ কাব্যে রূপায়িত হয়েছে। জায়সীর কাব্য অনুযায়ী পদ্মাবতী ছিলেন সিংহলের রাজকন্যা। সিংহলের রাজা গন্ধর্ব সেনের কন্যা পদ্মাবতীর প্রিয় পাখীর নাম ছিল হীরামন। এই পাখিটি এক ব্যাধের কাছে ধরা পড়ে এবং তাকে বিক্রি করে দেওয়া হয় এক ব্রাহ্মণের কাছে। তিনি চিতোরে আসেন পাখিটিকে নিয়ে। নাগমতির স্বামী রত্ন সেন বা রতন সেন তখন চিতোরের রাজা। তিনি পাখিটিকে এক লক্ষ মুদ্রা ব্যয় করে কেনেন। পাখির কাছ থেকে রাজা রতন সেন পদ্মাবতীর রূপের বর্ণনা শোনেন এবং রাণীর আপত্তি উড়িয়ে তাকে বিবাহ করার জন্য ব্যাকুল হন। রতন সেন পাখিকে নিয়ে যোগীর ছদ্মবেশে সিংহলে যান। প্রাথমিক বাধাবিঘ্নের পর রতন সেন পদ্মাবতীর বিবাহ হয় এবং তারা চিতোরে ফেরেন। নাগমতি ও পদ্মাবতী দুই স্ত্রীর সাথেই রতন সেন জীবন অতিবাহিত করতে থাকেন। নাগমতির গর্ভে নাগসেন এবং পদ্মাবতীর গর্ভে কমল সেন নামে রতন সেনের দুই পুত্রের জন্ম হয়।

এই সময়ে ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয় একজন পারিষদের প্রতিশোধস্পৃহাকে কেন্দ্র করে। রাঘবচেতন নামের এই পারিষদ রাজা রতন সেনের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন এবং তাকে চিতোর থেকে নির্বাসিত করা হয়। রাঘবচেতন চলে আসেন দিল্লিতে সুলতান আলাউদ্দিনের দরবারে। সুযোগ বুঝে প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে দিল্লির সম্রাট আলাউদ্দীনের কাছে পদ্মাবতীর অপরূপ রূপের প্রশংসা করে সুলতানকে রাঘবচেতন প্ররোচিত করেন পদ্মাবতীকে অপহরণ করতে। রতন সেনের কাছে পদ্মাবতী সম্বন্ধে অনুরূপ প্রস্তাব দিয়ে আলাউদ্দিন প্রত্যাখ্যাত হন এবং প্রতিশোধ নিতে চিতোর আক্রমণ করেন। উভয় পক্ষের যুদ্ধে রতন সেন বন্দি হন। কিন্তু বিশ্বস্ত অনুচরদের সাহায্যে তিনি আবার মুক্ত হন। এর পর রাজা দেওপালের সাথে যুদ্ধ বাঁধে রতন সেনের। এ যুদ্ধে দেওপাল নিহত হন এবং রতন সেন আহত হন। এ সময় সুযোগ বুঝে আলাউদ্দিন পুনরায় চিতোর আক্রমণ করেন। কিন্তু ইতিমধ্যেই রতন সেনের মৃত্যু হয় এবং সহমৃতা হন পদ্মাবতী। যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আলাউদ্দিন চিতোর পৌঁছে দেখতে পান পদ্মাবতী-রতন সেনের জ্বলন্ত চিতা। সেই চিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি ফিরে গেলেন দিল্লি।

ধর্মমতে সুফী সাধক এবং কাব্যকলা বিচারে রোমান্টিক আখ্যান লেখক ছিলেন কবি জায়সী। অতি অল্প সময়েই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল প্রতিভাবান এই লেখকের হাতে ঠেট ভাষায় রচিত অতি সহজ বুলি, গল্পরসপূর্ণ ও সূক্ষ্ম তত্ত্বসমন্বিত কাম-প্রেমকথা সম্বলিত কাব্য। আর তাই পদুমাবৎ হয়ে উঠেছিল প্রেমিকের কাছে প্রেম ও কামতত্ত্ব, ভাবুকের কাছে জীবাত্মা-পরমাত্মাবিষয়ক তত্ত্বের আকর, আর সাধারণ গল্পপ্রেমী পাঠকের কাছে বাস্তব ঘটনামিশ্রিত রসকাব্য। আলাউদ্দিনের চিতোর অভিযানের কাহিনী ইতিহাসে বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু তাতে পদ্মিনী সংক্রান্ত কোনও কথার উল্লেখ নেই। যৎসামান্য ইতিহাসে ভর করে দেশের চারণ কবিরা রাজপুত-বীরদের যে গল্পকাহিনী গেয়ে বেড়াতেন, কবি জায়সী তার ওপর নির্ভর করে কল্পনা মিশিয়ে এই আখ্যান রচনা করেছিলেন। এতে ইতিহাসের সূত্র খুঁজতে যাওয়ার কোনও মানে হয় না।

রত্নসেন-নাগমতি-পদ্মাবতীর রোমান্স কাহিনী এবং সিংহল সংক্রান্ত আখ্যানটিই এর প্রথম প্রমাণ। এই অংশটি বিশুদ্ধভাবেই কবির স্বকপোলকল্পিত। শুকপাখির দৌত্যের মাধ্যমে নায়ক নায়িকার প্রেম আখ্যান ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্য এবং প্রাদেশিক সাহিত্যগুলিতে বহু প্রচলিত। লোককথাগুলিতেও এরকম প্রচুর নিদর্শন আছে। সেই প্রকরণকেই জায়সী তাঁর এই কল্পকাহিনীতে ব্যবহার করেছেন।

সুলতান আলাউদ্দিনের চিতোর জয়ের বিষয়টি ঐতিহাসিক। কিন্তু পদ্মাবতীর কোনও উল্লেখ এই সংক্রান্ত ইতিহাসে পাওয়া যায় না। যদিও আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণের সময় সেখানকার রাজা রতন সেনের কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়, তবে চিতোর জয়ের যে আখ্যান জায়সী এই কাব্যে উপস্থিত করেছেন তা ইতিহাসের ধারা মেনে রচিত নয়। ১৩০৩ সালের ২৮ জানুয়ারি আলাউদ্দিন চিতোর অভিযান করেন এবং ২৬ আগস্ট চিতোর অধিকৃত হয়। আলাউদ্দিন প্রথম অভিযানেই চিতোর জয় সম্পন্ন করে তাঁর পুত্র খিজির খানকে চিতোরের অধিপতি করেন। জায়সীর কাব্যে বর্ণিত আলাউদ্দিনের দীর্ঘকাল চিতোর অবরোধ করে সন্ধি প্রস্তাব এবং দ্বিতীয় প্রচেষ্টায় চিতোর অধিকারের কাহিনী অনৈতিহাসিক ও কাল্পনিক।

আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণের সময় প্রত্যক্ষদর্শী ঐতিহাসিক আমীর খসরু এবং সুলতানের সমসাময়িক ঐতিহাসিকবর্গ -– নিজামুদ্দিন, মওলানা উসামী, জিয়াউদ্দিন বরণী -– যারা চিতোর বিজয়ের ইতিহাস লিখেছেন, তারা কেউই পদ্মাবতী প্রসঙ্গের কোনওরকম উল্লেখ করেননি।

আলাউদ্দিন পদ্মিনী উপাখ্যানটি অনেক পরে সংযোজিত হয় রাজপুতদের নিয়ে রচিত কাহিনী ‘খুমান রাসো’তে। এই কাহিনী এরপর থেকে কল্প-ইতিহাস হিসেবে পল্লবিত ও জনপ্রিয় হতে থাকে এবং স্থান পায় আকবরের রাজত্বকালে রচিত ‘আইন-ই-আকবরি’তে এবং জাহাঙ্গীরের সময়ে লেখা ‘তারিখ-ই-ফিরিসতা’তে এবং বিটিশ শাসনকালে টডের ‘অ্যানালস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিজ অব রাজস্থানে’। এর মধ্যেই লেখা জায়সীর কাব্য পদ্মাবতী আখ্যানকে লোকসমাজে ব্যাপক জনপ্রিয়তা দেয় এবং তা কল্প-ইতিহাস থেকে ছদ্ম-ইতিহাস হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে।

একটি কথা বলে শেষ করা যাক। পদ্মাবতী সংক্রান্ত বিতর্ক প্রসঙ্গে মাথায় রাখা দরকার এস রঙ্গরাজন ও জগজ্জীবন রাম মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণটি। সর্বোচ্চ আদালত সেই মামলা সূত্রে জানিয়েছিল, আইনশৃঙ্খলার অবনতির আশঙ্কার কথা বলে কখনওই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে খর্ব করা যায় না। এ সব সুভাষিতাবলী অবশ্য রাজনীতিবিদ এবং প্রশাসকেরা থোড়াই কেয়ার করেন। ফিল্ম যথাযথ সার্টিফিকেট পাওয়ার পরেও আমরা এ রাজ্যে কিছুদিন আগে দেখেছিলাম একটি মুসলিম যুব সংগঠনের হুমকির সামনে নত হয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে জুলফিকর ছবিটিকে কাটছাঁটে বাধ্য করতে। পরিচালককে তা মেনেও নিতে হয়েছিল ফিল্ম রিলিজের স্বার্থে। পদ্মাবতী নিয়ে সমস্যাটি অবশ্যই আরও অনেক গভীর ও ব্যাপ্ত। এখানে কল্পকাহিনীকে ইতিহাসের আখ্যা দিয়ে যে সব নৈরাজ্যবাদীরা আইনশৃঙ্খলার সমস্যা তৈরি করতে চাইছে ও সমাজের নৈতিক অভিভাবক সাজতে চাইছে, প্রশাসনের উচিত ছিল উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে তাদের নিরস্ত্র করা এবং মতপ্রকাশের অধিকারকে রক্ষা করা। সে ঔচিত্য মানা দূরে থাক, সুপ্রিম কোর্টকে পর্যন্ত বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে রাজ্য সরকার ও মুখ্যমন্ত্রীরা দামামা বাজিয়েই চলেছেন ছবিটি আটকানোর লক্ষ্যে। অনুমান করে নিতে অসুবিধে হয় না কেন্দ্রের সর্বোচ্চ শাসকদের এতে স্পষ্ট সম্মতিই আছে। ফলে ঈপ্সিত কোনও সমাধানের লক্ষ্যে প্রশাসনের ওপর ভরসা ক্রমশ কমছে। এমত পরিস্থিতিতে শিল্পের স্বাধীনতা রক্ষা এবং তার চেয়েও বড় কথা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সমস্ত মহলকে অবশ্যই নাছোড় লড়াই চালাতে হবে। মনে রাখতে হবে পদ্মাবতী নামক কোনও সিনেমার মুক্তির সঙ্কট কেবল তার অভিনেত্রী পরিচালকের সঙ্কটমাত্র নয়, ভারতের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্যেরই এখন নাক ও মাথা কাটা যাওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সেই বড় সঙ্কটটাকেই পেরোতে হবে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...