রঞ্জিত হসকোটে
সমকালীন ভারতীয় ইংরেজি কবিতার অন্যতম কণ্ঠস্বর রঞ্জিত হসকোটে। ‘জোনস অফ অ্যাসল্ট’, ‘দা কার্টোগ্রাফারস অ্যাপ্রেন্টিস’, ‘দা স্লিপওয়াকারস আরকাইভ’, ‘সেন্ট্রাল টাইম’, ‘হাঞ্চ প্রোজ’ তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। ১৪ শতকের কাশ্মিরি কবি লাল দেদের কবিতা এবং মীর এবং গালিব-এর গজল ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন তিনি। ‘ভ্যানিশিং অ্যাক্ট’ কাব্যগ্রন্থটির জন্য ২০০৪ সালে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘গোয়া কলা এবং সাহিত্য উৎসব-২০২৪’-এর মূল ভাষণ দিয়েছিলেন রঞ্জিত। উর্দু, হিন্দি এবং মারাঠিতে অনূদিত হয়েছে এই ভাষণটি। বর্তমান বাংলা অনুবাদটি করেছেন শৌভিক দে সরকার। শিরোনাম আমাদের।
আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি গাজার শিশুদের জন্য একটি প্রার্থনায় আপনারা আমার সঙ্গে সামিল হোন।
সেইসব শিশুরা, যাদের বোমারু বিমান থেকে অনবরত বোমা ফেলে এবং মিসাইল দেগে মেরে ফেলা হচ্ছে।
সেইসব শিশুরা, যাদের নিজেদেরই বাড়িঘর, নিজেদেরই স্কুল, নিজেদেরই লাইব্রেরি, নিজেদেরই হাসপাতালের ধংসস্তুপের নিচে জ্যান্ত কবর দেওয়া হচ্ছে।
আমরা এখানে শান্তি আর সদ্ভাবনার মরূদ্যানে জড়ো হয়েছি— অথচ সেইসব শিশুরা, যারা রাফার আকাশের দিকে আতঙ্কিত হয়ে তাকিয়ে রয়েছে, তারা জানে যে নরহত্যাকামী যাবতীয় শক্তি তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর কোনওদিক থেকে সাহায্যের হাত কেউ বাড়িয়ে দিচ্ছে না।
রাফার ওই শিশুগুলোর মধ্যে শেষ শিশুটিকে যেদিন হত্যা করা হবে, প্যালেস্তাইনের ভবিষ্যতেরও সেদিন মৃত্যু ঘটবে।
দুই.
এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের ভেবে নেওয়া ঠিক না যে গাজা অনেক দূরে। গাজা সর্বত্র রয়েছে। আমরা যে বাতাসে শ্বাস নেই গাজা সেখানেও। আগে যা কল্পনাতীত ছিল কিন্তু আজ প্রায় ভয়ানকভাবে পারস্পরিক অন্তরঙ্গভাবে জুড়ে থাকা একটা দুনিয়ায় গাজা আমাদের হৃৎপিণ্ডে ঢুকে পড়েছে।
এই বিষয়টি একবার ভাবুন: ইজরায়েলে পূর্ণতাপ্রাপ্ত নজরদারি করার টেকনোলোজি ভারতে বিরুদ্ধ মতামত, সমালোচনা আর প্রতিরোধী কণ্ঠস্বরকে দাবিয়ে রাখার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আবার ভারতে তৈরি হওয়া ড্রোন, ইজরায়েলের প্রতিরক্ষাবাহিনি, আইডিএফ ব্যবহার করছে গাজার অসামরিক নাগরিক— স্ত্রী, পুরুষ, শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করার জন্য। আমেরিকা, ইজরায়েলকে অর্থ আর হাতিয়ার যুগিয়ে চলেছে। অথচ দুটি দেশেরই বিপুল সংখ্যক মানুষ এই ধ্বংসলীলার ভয়াবহ পরিণতির কথা মাথায় রেখে এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। জার্মানি, ইজরায়েলের পক্ষে সওয়াল করছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে। এমনটাই মনে হচ্ছে যে জার্মান সংসদের অনেক সদস্যই বিশ্বাস করেই নিয়েছেন যে শাওয়া বা হলোকস্টের মতো উন্মত্ত গণহত্যার প্রায়শ্চিত্ত করার উপায় হল অপর একটি গণসংহার, যেমন নাকবাকে মদত দেওয়া।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
বাটারফ্লাই এফেক্ট-নিয়ন্ত্রিত এই পৃথিবীতে আমরা যেখানেই থাকি না কেন, ভৌগোলিক শর্ত অনুযায়ী আমাদের মধ্যে যত দূরত্বই থাকুক না কেন, আমাদের নিয়তি কিন্তু এক সুতোয় বাঁধা। আজ গাজা থেকে কাশ্মির, মণিপুর, খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ভারতের আদিবাসী-অধ্যুষিত এলাকা, দিল্লির সীমান্ত, যেখানে ভারতের কৃষকরা ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় জড়ো হয়েছে, সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে, যেখানেই মেরুকরণ, রাজনৈতিক কর্তৃত্বের মুখ্য চাবিকাঠি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিহিংসা, একটি সাংস্কৃতিক স্বর এবং সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে প্রভাবশালী হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈরিতা, সেখানে সর্বত্রই নিয়ন্ত্রণ করার বিকার, দমনপীড়নের বন্দোবস্ত এবং উৎখাত করার পদ্ধতির খোলাখুলি আদান-প্রদান ঘটছে। আর যেখানে ফুয়েরারপ্রিনজিপ অর্থাৎ ফুয়েরার নীতির রমরমা সেখানে “নিরঙ্কুশ প্রভুত্ব ওপর থেকে নিচে প্রবহমান আর নিরঙ্কুশ বশ্যতা, নিচ থেকে ওপরে।”
তিন.
এইরকম অনিশ্চিত, ঘাতক, এমনকি যন্ত্রণাকাতর ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে এই বিষাদগ্রস্ত এবং শোকস্তব্ধ প্রার্থনায় আমি আপনাদেরকে জার্মান ভাষায় লেখা একটি অন্যতম হৃদয়বিদারক কবিতার কথা বলতে চাই। ‘গ্রোডেক’ নামের এই কবিতাটি ১৯১৪ সালের নভেম্বর মাসে লেখা হয়েছিল। ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পূর্ব সীমান্তে অস্ট্রো-হাঙ্গারিয়ান সাম্রাজ্য আর রাশিয়ান সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতম সংঘাতগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে পরিচিত। যে-জায়গাটি একদিন গ্যালিসিয়ায় ছিল আজ তা যুদ্ধ, ধ্বংস আর প্রাণ ও সম্ভাবনার অপচয়ের আর একটি এলাকা ইউক্রেনের অন্তর্গত।
‘গ্রোডেক’ কবিতাটি অস্ট্রিয়াজাত কবি জেয়র্গ ট্রাকল (১৮৮৭-১৯১৪) লিখেছিলেন, যিনি অস্ট্রো-হাঙ্গারিয়ান সেনাবাহিনির মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং যুদ্ধের ভয়াবহতাকে সামনে থেকে দেখেছিলেন। একজন আধিকারিকের ভূমিকায় তাঁকে নারকীয়ভাবে হত্যা করা সৈনিকদের শব প্রত্যক্ষ করতে হয়েছিল এবং ভয়াবহভাবে জখম ও পঙ্গু হয়ে যাওয়া সৈনিকদের শুশ্রূষা করতে হয়েছিল। প্রতিদিন মৃত সৈনিকদের বাড়তে থাকা সংখ্যার হিসেব রাখতে হত তাঁকে। প্রতিটি সৈনিকেরই বয়স খুব অল্প ছিল, জীবনের পরিধি তাদের সামনে খোলা পড়ে ছিল, অথচ এমন একটি দিকচক্রবালরেখা যার তালাশ করা তাদের আর হয়ে ওঠেনি।
ট্রাকলের লেখা শেষ কবিতা ছিল ‘গ্রোডেক’। যুদ্ধের দুমাস পর যখন তাঁর জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল, সেখানে তাঁর করে যাওয়া ইচ্ছাপত্রের পেছনে হাতে লেখা ছিল কবিতাটি।
আসলে গভীরভাবে দেখতে গেলে ‘গ্রোডেক’-ই ছিল তাঁর শেষ ইচ্ছা এবং ইচ্ছাপত্র, হৃদয়মথিত কান্নায় ভেজা তাঁর উত্তরাধিকার। ভিয়েনায় বন্ধু লুডউইগ ভন ফিকারকে এটা পাঠানোর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আত্মহত্যা করেছিলেন ট্রাকল। খুব কাছ থেকে এক নারকীয় সন্ত্রাসকে তাঁর অনুভবকে আক্রমণ করতে, তাঁর সংবেদনশীলতাকে পরিহাসে পর্যবসিত করতে এবং প্রতিকারের জন্য আহ্বানযোগ্য ভাষার সংস্থানকে অগ্রাহ্য হতে দেখার চরম মূল্য দিতে হয়েছিল তাঁকে।
‘গ্রোডেক’ কবিতাটি আমি প্রথমে মূল ভাষায় পড়ব তারপর অনুবাদে।
Grodek [auf Deutsch]
Am Abend tönen die herbstlichen Wälder
Von tödlichen Waffen, die goldnen Ebenen
Und blauen Seen, darüber die Sonne
Düstrer hinrollt; umfängt die Nacht
Sterbende Krieger, die wilde Klage
Ihrer zerbrochenen Münder.
Doch stille sammelt im Weidengrund
Rotes Gewölk, darin ein zürnender Gott wohnt
Das vergoßne Blut sich, mondne Kühle;
Alle Straßen münden in schwarze Verwesung.
Unter goldnem Gezweig der Nacht und Sternen
Es schwankt der Schwester Schatten durch den schweigenden Hain,
Zu grüßen die Geister der Helden, die blutenden Häupter;
Und leise tönen im Rohr die dunkeln Flöten des Herbstes.
O stolzere Trauer! ihr ehernen Altäre
Die heiße Flamme des Geistes nährt heute ein gewaltiger Schmerz,
Die ungebornen Enkel.
‘গ্রোডেক’
সন্ধ্যার সময় শরতের বনভূমি গুমরে ওঠে
ঘাতক হাতিয়ারের শব্দে, সোনালি মাঠ
আর নীল হ্রদের ওপর দিয়ে পাড়ি দেয়
ডুবতে থাকা সূর্য; রাত এসে দখল করে নেয়
মৃতপ্রায় সৈনিকদের, বন্যরা আর্তনাদ করে
তাদের থেঁতলে যাওয়া মুখগুলো দিয়ে।
কিন্তু নিঃশব্দে তারা জড়ো হয় উইলোগাছের জঙ্গলে
একজন ক্রুদ্ধ দেবতাকে ধারণ করে লাল রঙের মেঘ
চলকে পড়া রক্ত নিজে, চাঁদের মতো হিম,
সবকটা রাস্তাই এগিয়ে যায় কালো ক্ষয়ের দিকে
রাতের সোনালি ডালপালা আর তারাদের নিচে
বোনের ছায়া, বোবা ঝোপঝাড় মাড়িয়ে এগোতে থাকে
বীরদের প্রেত, রক্তমাখা মাথাগুলোকে জড়িয়ে ধরতে
আর নলের ভেতর শরতের অন্ধকার বাঁশি ফিকে হয়ে আসে।
হে, গর্বিত শোক, তুমি ব্রোঞ্জের বেদি
আত্মার উষ্ণ শিখা তীব্র যন্ত্রণা পেয়েছে আজ
সন্ততিরা আর কোনওদিন জন্ম নেবে না।
চার.
লেখক হিসেবে আমরা জানি যে আমাদের জীবনের স্বর— আমাদের চিন্তা করার, লেখার, সৃষ্টিশীল থাকার বিষয়গুলো— নিভৃতির ওপর গভীরভাবে নির্ভরশীল। দীর্ঘ চিন্তন এবং ধীরে ধীরে তাকে উন্মুক্ত করে দেওয়া। আমরা এক গভীর হৃদ্যতা বহন করি, দুনিয়ার মুখোমুখি হই, তার সঙ্গে বোঝাপড়া করি। তবুও একটা সৃজনশীল দূরত্ব বজায় থেকেই যায়। আমরা আমাদের একাকিত্বকে প্রাধান্য দিই এবং মনে করি যে একাকিত্ব সৃজনশীলতা বিকশিত হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
নিঃসন্দেহে অভিজ্ঞতার নিরিখে আমরা এটা জানি যে বিষয়টির বিশেষ সারবত্তা রয়েছে। কিন্তু এই অবস্থানের একটি অসুবিধাও রয়েছে, যদি একে চরম জায়গায় নিয়ে যাওয়া যায় তাহলে তা এক একান্তবাদে পরিণত হয়ে যাবে যা অস্থির সময়ে সুরক্ষাকেই বিশেষাধিকার দেবে, এমন একটা প্রশান্তি উপস্থিত হবে যা কোনওরকম সঙ্কট থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে অথচ লেখক হিসেবে দূরত্বহীন থাকাটা আমাদের সাক্ষ্যবহন করার কাজের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ।
‘গ্রোডেক’ কবিতায় ট্রাকল এই কাজটিকেই সঠিকভাবে তার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পেরেছিলেন। ধর্মনিষ্ঠ নীরস কোনও উক্তি কিংবা তরল স্লোগানের মাধ্যমে নয়, জ্বলন্ত, দুঃসাহসিক ভাবময় দাবির মাধ্যমেই তিনি পাঠকের মনোযোগকে আকর্ষিত করেছিলেন। নিজস্ব ভাষার আলোড়নের মধ্য দিয়ে, ইমেজারিকে ভেঙে দিয়ে, তার পুনর্নির্মাণ করে, প্রাকৃতিক দৃশ্যের রোমান্টিসিজমকে দুমড়ে মুচড়ে ছত্রখান করে দিয়ে, গুলিতে এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাওয়া হাড়— মাথার খুলি, থকথকে রক্ত, খোবলানো মাংস, দলাপাকানো নাড়িভুঁড়ি, বুটে লেপটে যাওয়া কাদার ভেতর থেকে এমন একটি কাব্যপথ বেছে নিয়েছিলেন যা আদতে বীরত্বের মিথের আন্তরযন্ত্রীয় বাস্তবতারই নির্মাণ করে।
যখন সার্বজনিক পরিসরের মধ্যে বাধ্যতামূলক কোনও পরিস্থিতি আমাদের অপর একটি স্থিতি, সংঘর্ষ এবং অন্য একটি পার্থিব বিষয়, অত্যাবশকতার দিকে চালিত করে, তখন আমরা সমালোচনার আদেশ, আলোচনাত্মক কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে পারি না। আমরা এটা ভেবে আত্মপ্রবঞ্চনা করতে পারি যে আমাদের কণ্ঠস্বর প্রান্তিক, তাৎপর্যহীন, এরকম একটা সময়ে পাঠককে দেওয়ার মতো সান্ত্বনা, আস্থা বা এগিয়ে যাওয়ার মতো কোনও দিশা আমাদের কাছে নেই।
কিন্তু এটা একটা ভুল। নিজেদের পেশাদার লক্ষ্যের অনুসরণ করতে গিয়ে আমরা নিজেদেরকে তাচ্ছিল্যের আত্মতৃপ্তির মিথের ভেতর প্রশমিত করে রাখতে পারি না যখন একটা সংঘর্ষ এবং অত্যাবশকতাকে স্পষ্ট করে তোলার জন্য কর্মসূচি, উপলক্ষ এবং স্থানের খোঁজ জারি রাখাটা জরুরি।
আমরা লেখকরা, আমাদের কাল্পনিক যাত্রাপথের বিকাশের প্রতি সচেতন। কিন্তু আমরা সাংবিধানিকভাবে সঙ্কল্পিত একটি জাতি-রাষ্ট্রের নাগরিক। একটু বড় করে দেখতে গেলে, এমন একটি দুনিয়ার বাসিন্দা যা যাবতীয় প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, সুবিধা এবং অভাব, বিনিময় এবং প্রত্যাহার, অপ্রীতিকর অভিঘাত এবং প্রায়শ্চিত্তযোগ্য বিস্ময়ের এক মন্তাজের মধ্যে দিয়ে দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ। লেখক হিসেবে যে সৃজনাত্মক স্বাধীনতা আমরা প্রবলভাবে আকাঙ্খা করি তাকে কোনওভাবেই বৃহত্তর স্বাধীনতার থেকে আলাদা করা ঠিক নয়— সেই স্বাধীনতা যা কিনা আমরা আমাদের সহনাগরিকদের সঙ্গে ভাগ করে নিই এবং যা আমাদের জীবন, আমাদের মুক্তি, আমাদের আশা এবং স্বপ্নকে অনুসরণ করার সম্ভাবনাকে গ্যারান্টি দেয়— সেই স্বাধীনতা, যাকে আমাদের রক্ষা করতেই হবে।
একজন লেখক-নাগরিক হিসেবে, ক্ষমতা দ্বারা স্বাধীনতা, বিকল্প এবং ব্যক্তিগত স্বতন্ত্রতাকে বিকৃত ও খর্ব করার প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসাটা আমাদের কর্তব্য।
মহান উর্দু কবি মীর তকি মীর (১৭২৩-১৮১০) যা লিখেছিলেন (দিওয়ান-এ পাঞ্জুম: ১৭০৬.৫):
শায়র হো মত চুপকে রহো অব চুপ মেঁ জানেঁ জাতি হ্যায়
বাত করো অব্যত পড়ো কুছ ব্যয়েতেঁ হম কো বাতাতে রহো
তুমি কবি, নিশ্চুপ থেকো না, স্তব্ধতার আড়ালে এখন প্রাণ চলে যায়
কথা বলো, কবিতা পড়ো, কিছু কবিতা আমাদের পড়ে শোনাতে থাকো
উল্লেখযোগ্যভাবে উর্দু শব্দ ব্যত (মূল শব্দ আরবি) এখানে ছন্দোবদ্ধ লাইন বা কবিতাকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছে যার আক্ষরিক অর্থ হল ‘ঘর’। মীর শব্দটির বহুবচন এখানে দুবার ব্যবহার করেছেন, অভিজাত এবং প্রমিত ‘অব্যাত’ এবং লোকগ্রাহ্য, অমার্জিত ও সরাসরি ‘ব্যয়েতেঁ’। দুটি রূপ ব্যবহার করে তিনি সামগ্রিক সমাজকেই তুলে ধরেছেন যেখানে উঁচু-নিচু, অভিজাত-শ্রমজীবী প্রত্যেকেই দমন এবং আরোপিত স্তব্ধতার কাছে শিকার হিসেবে সমান।
মীর তাঁর শ্রোতাদের কণ্ঠের মাধ্যমে নিজেকেই স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন যে প্রাণঘাতী এই সময়ে মানুষ যখন নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে তখন স্বাধীন এবং ভয়হীনভাবে নিজের বক্তব্যকে তুলে ধরার দায়িত্ব থেকে পিছিয়ে আসা কোনওমতেই উচিত না। ক্ষমতা-যন্ত্র যাদের সুরক্ষা এবং নিজস্ব বলয় থেকে বেদখল করে শরণার্থী বানিয়ে দিয়েছে, তারা যখন কবির কথা শুনবে, আশ্রয় খুঁজে পাবে।
পাঁচ.
তবুও কিছু মানুষ বলবে যে যুগসন্ধিক্ষণের এই জরুরি অবস্থাকে সম্বোধন করার, যা কিছু বলা দরকার তা বলার, ক্ষমতাকে সত্যি কথা শোনানোর সঠিক সময় এখনও উপস্থিত হয়নি।
জাতিগত অথবা সাম্প্রদায়িক সংবেদনশীলতা বিপন্ন। এটা সঠিক সময় না।
রাজনৈতিক প্রত্যাঘাত ভয়ানক হয়ে উঠবে। এটা সঠিক সময় না।
জনগণের মানসিক অবস্থা প্রতিকূল। এটা সঠিক সময় না।
কূটনৈতিক বিষয়গুলো বিপন্ন। এটা সঠিক সময় না।
নিজেদের অসহমতকে গুরুত্ব দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত বুনিয়াদ নেই আমাদের। এটা সঠিক সময় না।
পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি
তাহলে সঠিক সময়টা কখন আসবে? আমি আমার ঘড়ি দেখছি, সন্ধ্যা ৬:৫৫ বাজে। এখন সন্ধ্যা ছটা বাজে আর এখন, এখন, এখনই সঠিক সময়, আর সবসময় তাই হবে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে কথা বলার। আমাদের কণ্ঠস্বর দৃঢ় করার, যেহেতু একসঙ্গে মিলিত হলে আমরা বহুস্বর, আমরাই দল, আমরাই জমায়েত, আমরাই সংহতি। অত্যাচারের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তোলার জন্য। অবিচারের বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তোলার জন্য। সেন্সরশিপ, গণতান্ত্রিক অসহমতকে ধ্বংস এবং বিরোধিতাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে আমাদের আওয়াজ তোলার জন্য, স্বাতন্ত্র্য এবং স্বাধীনতার মহান মানবিক অভিযানকে রুখতে এবং খর্ব করতে ক্ষমতার যাবতীয় ফন্দি-ফিকির, কূটকৌশলের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য যা আমাদের জিজ্ঞাসা এবং সৃজনাত্মক অন্বেষণের অধিকারকে খর্ব করে, ভালবাসা, বিশ্বাস, নৈতিক দৃঢ়তা এবং সাহসের বুনিয়াদের ওপর দাঁড়িয়ে আমাদের সম্পর্ক সৃষ্টি করার উন্মুক্ত পরিসরকে সঙ্কুচিত করে এবং অবশ্যই বাধ্যতামূলকভাবে বিচারধারা-নিয়ন্ত্রিত একরৈখিক অতীত এবং কেন্দ্রিকতা-নিয়োজিত ভবিষ্যতের অংশভাক না হয়ে আমাদের বহুত্বের ইতিহাসকে উত্থাপিত করার এবং বহুত্বের ভবিষ্যৎকে কল্পনা করার বিশেষাধিকারকে অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য।
সময় হয়ে গিয়েছে। এই ভাবনাকে মাথায় রেখেই আমি এই শব্দগুলো, অক্ষর, অভিপ্রায় এবং আলোচনার বর্ণময় সমারোহ ‘গোয়া কলা এবং সাহিত্য উৎসব’-এর দ্বাদশতম সংস্করণকে উৎসর্গ করছি। এই জায়গাটি সবসময় গঠনমূলক অংশগ্রহণের পরিসর এবং জরুরি বিষয়-সম্পর্কিত উন্মুক্ত এবং ভয়হীন আলোচনার মঞ্চ হয়ে থাকুক।