সৌমিত্র দস্তিদার
ধান, নদী, খাল তিনে মিলে বরিশাল। বরিশাল মানেই তো প্রাচ্যের ভেনিস। লোকে এখনও মুখে মুখে ছড়া কাটে- আইতে শাল, যাইতে শাল, তার নাম বরিশাল। শাল হচ্ছে শালতি। একধরনের ছোট নৌকা। পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও পরিবহন বলতে ছিল ওই নৌকা। এখন দিনকাল বদলে গেছে।
“আপনাকে আমি শ্মশানে নিয়ে যাব।“
দ্বিতীয়বার বরিশালের নতুল্যাবাদ বাস টার্মিনাসে বাস থেকে নামতে না নামতে সুপ্রিয় জানিয়ে দিল। তখনও বাসের পেট থেকে লাগেজ বের করছি। সুপ্রিয় ব্যাগটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “এবার আপনাকে শ্মশানে নিয়ে যাব। গতবার ব্যস্ত ছিলেন বলে নিয়ে যাওয়া হয়নি।“ খানিকটা আশ্বস্ত হলাম। তাও আমতা আমতা করে বললাম, “এত তাড়াতাড়ি শ্মশানে নিয়ে যাবি ভাই! আরও কিছুদিন পরে গেলে হয় না!” সুপ্রিয় লজ্জা লজ্জা মুখ করে আমাকে সত্যিই আশ্বস্ত করল। “কী যে বলেন, আপনাকে বরিশালের শ্মশান দেখাতে নিয়ে যাব বলছি। ওই শ্মশান এশিয়ার সবথেকে বড় মহাশ্মশান। ওখানে না গেলে বরিশাল দেখা সম্পূর্ণ হয় না।“ আমি তো আগেই এ কথা শুনেছিলাম। সুপ্রিয়র পিছনে লাগলাম মাত্র। আসলে বরিশাল ঘোরা বলতে আমার শুধুমাত্র ট্যুরিস্ট স্পট দেখে বেড়ানো নয়, বরিশাল আমার কাছে এই চমৎকার সব হৃদয়বান ছেলেমেয়ে- সুপ্রিয়, শিপলুভাই, ছুটি, সুকান্ত, রাখী, মনীষাদের সঙ্গে দিনরাত চুটিয়ে আড্ডা মেরে বেড়ানোও বটে। কীর্তনখোলা নদীর ঘাট বা নতুল্যাবাদে বাসে নেমে কোনওরকমে হোটেলে নিয়মমাফিক চেক-ইন করে রুমের মধ্যে ব্যাগ ফেলেই সুপ্রিয় বা সুকান্ত, কাউকে না কাউকে জুটিয়ে টো টো কম্পানি না করলে বরিশাল দেখা আমার অন্তত অসম্পূর্ণ রয়ে যেত। অবশ্য আজও যে সম্পূর্ণ হয়েছে তা বলতে পারি না।
প্রথমবারের বরিশাল যাওয়ার কথা কখনও ভুলব না। কীভাবে যেন বরিশালে আমার পিতৃপুরুষের বাস জানতে পেরে আমার বন্ধু জাকির ব্যবস্থা করে দিল সেখানে যাওয়ার। পুরনো ঢাকার সদর ঘাট থেকে লঞ্চ যাত্রা। সঙ্গে নাগরিক উদ্যোগের আনিস ভাই। এই ফাঁকে বলে রাখি, সদর ঘাট বা পুরনো ঢাকা আমাকে সবসময় টানে। পুরনো ঢাকা না গেলে জানবেন আপনি ঢাকার কিছুই দেখেননি। আমার বন্ধু অপু পুরনো ঢাকার তিনতলার এমন এক বাসায় থাকে যার বয়েস কম করেও তিনশো বছর। লোকে বলে অমাবস্যায় ও বাড়িতে নাকি ভূতের উৎপাত হয়। কারা যেন শব্দ করে হাঁটতে থাকে। আমি অবশ্য ভূত দেখিনি। তবে তিনতলার ছাদ থেকে দূরে বুড়ি গঙ্গা দেখতে দেখতে স্মৃতির শহরকে অনুভব করেছি অনেকবার।
পুরনো ঢাকায় যাব অথচ বাকরখানি খাব না তা তো হবে না। আবার বিউটি লজের ইলিশ মাছের ডিম ভাজা না খেলে তো জীবন বৃথা। পঞ্চান্ন গলি আর ছাপ্পান্ন বাজারের ঢাকা বলতেই তো এই পুরনো জনপদ। শাঁখারি পাড়ায় হাঁটতে হাঁটতে গলিস্য গলি দেখতে থাকুন। নবাববাড়ির ভেতরে ঢুকে ফিরে যান অতীতে। ১৯০৬-এ এখানেই জন্ম নিয়েছিল মুসলিম লিগ। সদর ঘাটের কাছেই পুরনো রূপমহল সিনেমা হল। এখানেই ১৯৫৭ সালে বসেছিল মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে নতুন দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপের প্রথম অধিবেশন। ওই তো খানিক দূরে ব্রাহ্ম সমাজের মন্দির। এখানেই লাবণ্যপ্রভা দাশের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল জীবনানন্দ দাশের। সদর ঘাটে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। তুমুল চিৎকারে কান পাতা দায়। শান্ত বুড়ি গঙ্গায় সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে ঢাউস সাইজের একাধিক লঞ্চ। জেটি জুড়ে যেন মেলা বসে গেছে। বাদাম ভাজা, চা থেকে শুরু করে ঝালমুড়ি, ডিম সেদ্ধ কী নেই সেখানে! তার মধ্যে তারস্বরে মাঝিমাল্লারা চিৎকার করে চলেছে বরিশাল বরিশাল করে। পেল্লাই এক একটা লঞ্চ ডেকেই চলেছে। বাহারি কত নাম! এম ভি সুরভী, এম ভি অ্যাডভেঞ্চার, এম ভি পারাবত, এম ভি গ্রীন লাইন ইত্যাদি ইত্যাদি। লঞ্চ তো নয়, এক-একটা বিশাল জাহাজ! কী নেই ভেতরে! কফি শপ থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কস, ডিম সেদ্ধ, চা কেক যা ইচ্ছে তাই-ই পাবেন। লিফটে করে তিনতলার ডেকে উঠে দূরের আকাশ দেখুন। কোন লঞ্চে উঠলাম মনে নেই। এটুকু মনে আছে কেবিনে ঢুকে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়ে মনে হল আমিই রবীন্দ্রনাথ। শিলাইদহে পদ্মা নদী দিয়ে স্রোতে ভাসছি। গরম গরম ভাত আর দেশি মুরগির অপুর্ব ঝাল এখনও যেন মুখে লেগে আছে। রাত গভীর হচ্ছে। চুপচাপ একা ডেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আনমনে বাইরের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। শীতলক্ষ্যা নদী পার হচ্ছি। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ কত কত জানা-অজানা জনপদ পিছনে ফেলে লঞ্চ এগোচ্ছে। কত রকমের নদী। পদ্মা, মেঘনা, গাদারিয়া, কালা বদর। নদীমাতৃক এই আমার প্রিয় বাংলাদেশ! অন্ধকারে তার অন্য চেহারা। এখন সে যেন বড় বেশি রহস্যময়ী। দিনের বেলায় সে যুবতী নারী। নদীর দুলুনিতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোর ভোর আনিস ভাই ডেকে তুললেন। সামনেই আরেক নদী। এ নদীর নাম কীর্তনখোলা। ওহ, বরিশাল তবে পৌঁছে গেছি। অবাক হয়ে শিশুর সারল্যে কীর্তনখোলাকে দেখছি। এই নদী দিয়েই তো একদিন জীবনানন্দ দাশ কলকাতা যেতেন। জেটি ঘাট দিয়ে হেঁটে আসতেন অশ্বিনী দত্ত বা ফজলুল হক কিম্বা কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেন। চোখ বুঁজে আমি যেন কয়েকশো বছর আগে এই পথ দিয়ে আমার পুর্বপুরুষের আসা যাওয়ার পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি।
সত্যি কথা বলতে, দেশভাগ নিয়ে আমার তেমন কোনও ব্যক্তিগত নস্টালজিয়া নেই। বাড়িঘর ফেলে রেখে চলে আসার কোনও কাহিনী আমার পারিবারিক স্মৃতিতে নেই। তার কারণ আমার ঠাকুর্দা বরিশাল ছেড়ে চলে এসেছিলেন ১৯৪৭-এর অনেক আগে। আমার জন্মও কলকাতায়। ফলে বরিশাল নিয়ে আমার আলাদা কোনও পিছুটান থাকার কথাও নয়। তবুও কোন অজ্ঞাত কারণে বরিশাল আমাকে বড় টানে। তার দুর্নিবার হাতছানিতে সাড়া না দিয়ে পারি না। প্রথমবার কীর্তনখোলা নদীর ধারে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে বরিশালকে দেখছিলাম। মায়ের মমতায় কীর্তনখোলা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে আর আমি তা উপেক্ষা করব এমন দুর্বিনীত সন্তান আমি নই। ফলে সময় পেলেই আমি ছুটে ছুটে বরিশাল যাই। ‘যাবই সেখানে, যেখানে রয়েছে থেমে, বাসর রাত্রি, অবিচল কারও প্রেমে…. ।‘
একটা সাধারণ ধারনা আছে, বরিশাল মানেই অশ্বিনী দত্ত, জীবনানন্দ দাশ বা চারণকবি মুকুন্দ দাস। তা তো ঠিকই। তবে তার বাইরেও এক বিস্তৃত জনপদ আছে যাকে দেখা হয়তো এ জীবনে কোনওদিনই আর পুরো হয়ে উঠবে না। তবুও একদা বিখ্যাত চন্দ্রদ্বীপে সময় পেলেই আমি যাই। সঙ্গে থাকে কেউ না কেউ। কখনও একা একা বিবির পুকুরের ফুটপাত ধরে আনমনে হাঁটতে থাকি। ধান, নদী, খাল তিনে মিলে বরিশাল। বরিশাল মানেই তো প্রাচ্যের ভেনিস। লোকে এখনও মুখে মুখে ছড়া কাটে- আইতে শাল, যাইতে শাল, তার নাম বরিশাল। শাল হচ্ছে শালতি। একধরনের ছোট নৌকা। পঞ্চাশ ষাট বছর আগেও পরিবহন বলতে ছিল ওই নৌকা। এখন দিনকাল বদলে গেছে। ঢাকা, খুলনা থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আধুনিক মডেলের বাস পৌঁছে যাচ্ছে বরিশাল সদরে। শহরের মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল এখন ‘উন্নয়নের’ দাপটে অদৃশ্য। তবুও হাঁটতে হাঁটতে, এদিক ওদিক চোখে পড়ে দু-চারটে সাবেক পুকুর। তার মধ্যে বিবির পুকুরের পাড় দিয়ে হাঁটতে বেশ লাগে। এ এক্কেবারে বরিশাল শহরের প্রাণকেন্দ্র। চারপাশে কত কিছুই দেখার। অশ্বিনী দত্ত টাউন হল, খানবাহাদুর হাতেম আলি খানের প্রাসাদ, পুকুরের চারপাশে শ্রীনগরের ডাল লেকের মতো অজস্র খাবারের দোকান। অল্প দামে চমৎকার সব কাবার পাওয়া যায়। খাবারের কথা উঠলেই আমার আবার ‘সকাল সন্ধ্যা’ রেঁস্তোরার নাম মনে পড়ে যায়। ওখানে জলখাবার না খেলে আফসোস করবেন। দুপুরে ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে হলে সদরঘাটে চট্টগ্রাম হোটেলে যেতে পারেন। কাচ্চি বিরিয়ানি ভাল লাগলে নাজেম রেঁস্তোরায় যাওয়া যায়। শহরটার মধ্যে এমন এক প্রাণ আছে যা বারবার না দেখলে বোঝা যায় না। শহরে এখনও অন্তত চল্লিশ শতাংশ হিন্দু জনসংখ্যার বাস। অর্থনীতিতে হিন্দুদের প্রভাব খারাপ নয়। ওই যে হিন্দু-মালিকানাধীন সকাল সন্ধ্যা, ঢাকা ঔষধালয় সেসব তো আছেই। জগন্নাথ মন্দির বা রামকৃষ্ণ মিশন অথবা পুরনো দিনের বিপ্লবীদের গোপন ডেরা শঙ্কর মঠে পুজোপার্বনে ভিড় দেখলে বোঝা যায় অতীতের সুদিন না থাকলেও সব শেষ হয়ে গেছে বলে হাহাকার করে দীর্ঘশ্বাস ফেলার পরিস্থিতিও অন্তত বরিশালে এখনও হয়নি।
শহর আর কতটুকু! তবে বেশ ছিমছাম। মোটের ওপর পরিচ্ছন্ন। রুবেল, সুপ্রিয় বা অন্য কোনও বন্ধুর স্কুটারে ঘন্টাখানেক চক্কর দিলেই শহরের দ্রষ্টব্য মোটামুটি দেখা হয়ে যায়। কিন্তু তা অবশ্যই ওপর ওপর। ওই যে বলছিলাম এ দেখা ট্যুরিষ্টের চোখে দেখা। কিন্তু আসল বরিশালকে চিনতে হলে আপনাকে হাঁটতে হবে। এটা অস্বীকার করা যাবে না, বরিশাল শহরের বৃত্তান্ত অশ্বিনী দত্ত, স্বদেশী আন্দোলন, চারন কবি মুকুন্দ দাসকে বাদ দিয়ে হতে পারে না। এখনও কত কত স্মৃতি রয়ে গেছে অতীত মনীষীদের। স্কুল, কলেজ, কালীমন্দির সবই তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত। কত বছর আগে মহাত্মা গান্ধী এসেছিলেন এ শহরে। যে আমগাছের তলায় তিনি সভা করেছিলেন আজও তা রয়ে গেছে। রাখালবাবুর পুকুর দেখি, যখনই যাই। রাখালবাবু ছিলেন জীবনানন্দ দাশের সম্ভবত একমাত্র বন্ধু। কলকাতা যাওয়ার আগে অবধি বিকেল হলেই জীবনানন্দ চলে আসতেন বন্ধুর কাছে। বরিশাল শহরে ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাব ছিল একসময়। এখন রামমোহন রায়ের আদি সমাজের উপাসনালয় প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে রয়ে গেছে। যখনই যাই তখনই চেষ্টা করি রুচিরা রেস্টুরেন্ট খুজেঁ বের করতে। সেখানে একদিন ছিল বামপন্থী রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র। কমিউনিস্ট নেত্রী মণিকুন্তলা সেনের ভাইরা এটি চালাতেন। বরিশাল শহরের আদি ইতিহাস নাড়াচাড়া করলে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। অন্তত ১৯৪৭ সালের আগে শহরের রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ছিল উচ্চবর্গের হিন্দু অভিজাত সম্প্রদায়ের লোকজন। দু-একজন ব্যাতিক্রম থাকলেও সামগ্রিকভাবে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বাস ছিল গ্রামে। তারা অধিকাংশ ছিলেন চাষি-বাসী, জেলে, জোলা বা আরও সমাজের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া অংশ । হিন্দু নিম্নবর্গের সামাজিক অবস্থানও ছিল একই। মুসলমানদের মতো প্রান্তিক। বস্তুত এখন যে বরিশালকে চিনি তা তো দেড়শো দুশো বছর আগেও ছিল কীর্তনখোলা নদী তীরবর্তী সামান্য এলাকা। অঙ্কের হিসেবে জমির মাপ ছিল ২’৫ একর মাত্র। কয়েকজন জমিদারদের সম্পত্তি ছিল বরিশাল সদর। ১৮৩১ এলাকা হাতবদল হয়ে সরকারি উকিল রামকানাই রায় হলেন সদর শহরের মালিক। তাঁর কাছ থেকেই বৃটিশ সরকার এলাকা অধিগ্রহণ করে দ্রুত শহরের উন্নয়নের দিকে মন দিলেন। ততদিনে গ্রাম থেকে লোকজন বসবাস করতে শহরে আসতে লেগেছে। ফলে চাপ বাড়ছে। ওই সময় সময় আরও তিনটি গ্রাম কাউনিয়া, আলেকান্দা ও আমানগঞ্জ কে মুল শহরের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে আজকের নগরায়নের সূচনা হল। ১৮৭৬ সালে বরিশাল মিউনিসিপ্যালিটি জন্ম নিল। সুপ্রিয় যে শ্মশানে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, সেটা ওই একদা কাউনিয়া গ্রামের অন্তর্গত। এশিয়ার বৃহত্তম শ্মশান কিন্তু সত্যিই অবশ্য দ্রষ্টব্য। এখানে কালীপুজোর রাতে দীপ উৎসব দেখার মতো। অন্যান্য শ্মশানে এত হিন্দু সমাধি মন্দির কখনও দেখিনি। এই সমাধি মন্দির কনসেপ্ট বোধহয় গড়ে উঠেছে ব্রাহ্ম সমাজের প্রভাবে।
কাউনিয়া গিয়ে শ্মশান বৈরাগ্যে যদি বিষন্ন হন, তাহলে চলে যেতে পারেন চট্টগ্রামের সমুদ্র বন্দরের অনুসরণে গড়ে ওঠা ত্রিশ গোডাউনে। নদীতীরে সবসময় যেন মেলার ভিড়। পসরা সাজিয়ে দোকানদার আপনাকে ডাকবে। বেঞ্চে তরুণ-তরুণীর অন্তরঙ্গতা না দেখে নদীর জলধারা দেখতে থাকুন। কত রকমের নৌকা। সিঙ্গাড়া খেতে পারেন খিদে পেলে। এখানকার সিঙ্গাড়া বিখ্যাত। এমন ঝলমলে ত্রিশ গোডাউন ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল বধ্যভূমি। পাক বাহিনীর সেনারা, সঙ্গে রাজাকার, আলবদর মিলে রাতের অন্ধকারে, দিনের পর দিন, শয়ে শয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খুন করত। আনন্দ আর হাহাকার এখানে মিলেমিশে একাকার। জীবন তো এই-ই। আনন্দ বা দুঃখ কিছুই চিরস্থায়ী নয়।
আগেই বলেছি বরিশাল শুধু তো আর শহরের অলিগলি, খাল-পুকুর নয়। সুযোগ পেলে এখনও ঘুরে বেড়াই অভিভক্ত বরিশালের গ্রামে গ্রামে। কত যে নদী- সন্ধ্যা, বিষখালী, ধানসিঁড়ি আরও কত নাম! তবে গাইড হিসেবে সুপ্রিয় আমার কাছে এখনও এক নম্বরে। কত জায়গায় যে গেছি ওর দু-চাকার পিছনে বসে। কালীপুজোতে গেছি। ঈদেও গেছি। গত বছরে, আমার বন্ধু জাকিরের গ্রাম বালিহারি ভ্রমণ ও আতিথ্য কখনও ভুলব না। মাধবপাশায় গেলে অখণ্ড বঙ্গের বারো ভুঁইয়াদের অনেক আখ্যান শুনতে পাবেন। চন্দ্রদ্বীপ হয়ে বাখরগঞ্জ থেকে আজকের বরিশালের কাহিনি নিয়েই তো হতে পারে চমৎকার এক চলচ্চিত্র বা উপন্যাস। বরিশাল যেতে যেতে অতীত সময় সময় আপনার পথ আটকাবে। ওই তো সিদ্ধকাঠি, ঝালকাঠি, কিম্বা স্বরূপকাঠি। গৌরনদী হয়ে বটজোড়। অশ্বিনী দত্তের গ্রাম। আশপাশে আজও মনসা পূজা হয় ঘটা করে। নাম বদলে দেবার কাজে সব দেশের শাসকদেরই জুড়ি মেলা ভার। স্বরূপকাঠি হয়েছে নেছারাবাদ। যদিও তা কেউ বলে না। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রাম এখানে অনেক। জলা বাড়ি, বাটনাতলা, মৈসানী ইত্যাদি ইত্যাদি। এখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে কলেজ আছে। এসব এলাকায় বর্ষাকালে আসলে দেখতে পাবেন পেয়ারার বিপুল উৎপাদন। এই পেয়ারা বাগান ৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট বিপ্লবী সিরাজ সিকদারের শক্ত ঘাঁটি। স্কুটারে করে যাচ্ছি বানোয়ারীপাড়ার গাভা গ্রামে। এই গাভা গ্রামই আমাদের অর্থাৎ ঘোষ দস্তিদার পরিবারের আদি নিবাস। পথে ছোট্ট চায়ের দোকানে থামলাম। চা খেয়ে শরীর জুড়িয়ে গেল। দূর থেকে কীর্তনের সুর বড় ভাল লাগছে। সুপ্রিয় মনে করিয়ে দিল, বরিশালের ঢ়াকীদের সুনাম কিন্তু জগৎজোড়া। আচমকা ক্ষিরোদ নট্টর কথা মনে পড়ল। বরিশালের গ্রাম-শহরের বহু বহু চিত্রকল্প কলকাতা ফিরে চোখ বন্ধ করলেই আজও ভেসে ওঠে।
*সব ছবি লেখক ও তাঁর বন্ধুদের ক্যামেরায় তোলা
বাহঃ চমৎকার একটি লেখা।
হীরক সেনগুপ্ত
khoob sundor , keu ki aachhen jini Bangladesh ghure dekhte haat bari e deben ?