গৌতম রায়
আমাদের মনে রাখা দরকার, আগামী ২০২৫ সালে আরএসএসের শতবর্ষ। এই শতবর্ষকে সামনে রেখে, ভারতকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করবার এক গভীর চক্রান্ত গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির করছে। এই চক্রান্ত যে কেবলমাত্র বিজেপি বা তার সহযোগী দলগুলি করছে এমনটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। বিজেপির সঙ্গে বাইরে কুস্তি-ভেতরে দোস্তি করা বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলিও নানাভাবে বিজেপির সুবিধে করে দিয়ে চিরন্তন-বৈচিত্র্যময়-সমন্বয়বাদী ভারতকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে
অদ্ভুত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে ভারতের সাধারণ নির্বাচন হতে চলেছে। এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে ভারতে কখনও সাধারণ নির্বাচন হয়নি। এই নির্বাচন নির্ধারিত করতে চলেছে ‘৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে যে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে দিয়ে ভারতরাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে, সেই ধারা অব্যাহত থাকবে কিনা আগামী দিনে।
গত ১০ বছর ধরে ভারতে শাসনক্ষমতায় এককভাবে অধিষ্ঠিত ছিল আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি। এই দলটি বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি এদের আদৌ নেই। সরাসরিভাবে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের পক্ষে এরা ওকালতি করে। গত ১০ বছর ধরে ভারতকে তারা পরিচালিত করেছে রাজনৈতিক হিন্দু মতাদর্শের দৃষ্টিকোণ দিয়ে।
যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো এরা বিশ্বাস করে না। সে-কারণে গত ১০ বছরে যখনই সুযোগ পেয়েছে বিজেপি চেষ্টা করেছে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে খর্ব করতে। বিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী সকলের প্রতি রাজনৈতিক অসূয়া নিয়ে চলাই যেন ভারতের শাসক বিজেপির এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যে-কোনও উপায়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে, হয় বিজেপির শিবিরভুক্ত করা, নতুবা তাদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ তুলে, বিভিন্ন ধরনের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সিকে উসকে দেওয়া। এটাই হয়ে দাঁড়িয়েছে গত ১০ বছরে ভারতের শাসকদের এক এবং একমাত্র লক্ষ্য।
আসলে বামপন্থীরা ব্যতীত অন্য সমস্ত অ-বিজেপি দলের কোথাও না কোথাও দুর্বলতা থাকায়, বিশেষ করে আর্থিক দুর্বলতা বা ক্ষমতার অপব্যবহারজনিত দুর্বলতা, বিজেপির পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী এজেন্সিগুলিকে বিরোধীদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো।
গত ১০ বছরে ভারতের অর্থনীতি একটা ভয়াবহ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। ভারত জুড়ে বেকারের সংখ্যা দিনের পর দিন বাড়ছে। কর্মসংস্থানের সুযোগ গোটা ভারতে ক্রমশই সীমিত হচ্ছে। ভারত সরকার বাজার অর্থনীতির প্রয়োগে একেবারে খুল্লামখুল্লাভাবে আসরে নেমে পড়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনস্থ রাষ্ট্রীয় শিল্পগুলিকে, বিমানবন্দরকে, ডককে একেবারে জলের দরে বিজেপির পছন্দের তালিকায় থাকা একটা ক্ষুদ্র অংশের পুঁজিপতিদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। ধীরে ধীরে গোটা সরকারি নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থাকা জনসেবামূলক ব্যবস্থাকেই যে বিজেপি সরকার একেবারে বেসরকারিকরণ করে দেবে, সেই পথেই তারা তাদের সমস্ত রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবনাগুলিকে প্রসারিত করছে।
সেই সঙ্গে রয়েছে ভয়াবহ মেরুকরণের রাজনীতি। এই মেরুকরণের রাজনীতি হল আরএসএস, বিজেপি বা তাদের ছত্রছায়ায় থাকা সমস্ত রাজনৈতিক শিবিরের এক এবং একমাত্র রাজনৈতিক অস্ত্র। এই অস্ত্র দিয়েই তারা দীর্ঘদিন ধরে গোটা ভারতকে ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে, বর্ণের নামে, ভাষার নামে বিভাজিত করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
নয়ের দশকের গোড়ায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলবার সময় রাষ্ট্রশক্তির কিছু অংশকে কাজে লাগিয়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তি বড় ধরনের সামাজিক ক্ষমতা বিস্তার করতে পেরেছিল। ভারতের নানা রাজনৈতিক ঘটনাক্রমের বিবর্তন এবং অবশ্যই হিন্দুত্ববাদীদের ভয়াবহ সামাজিক প্রযুক্তি— এই দুটিকে কাজে লাগিয়ে গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রভাবকে এতটাই শক্তিশালী করে ফেলতে পেরেছে যে, কেবল ভোটরাজনীতিতেই নয়, হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির বিস্তারের ক্ষেত্রে তারা আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে পর্যন্ত অনেক বেশি সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে।
পশ্চিমবঙ্গ কখনও সামাজিক বিভাজনকে স্থায়ীভাবে ঠাঁই দেয়নি। নিজেদের মধ্যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এই রাজ্যে কখনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ হয়নি বা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়নি তা নয়, কিন্তু সেই উত্তেজনা, সংঘর্ষের মানসিকতা আমাদের রাজ্যে কখনও স্থায়ী চিহ্ন রেখে যায়নি দেশভাগ-উত্তরকালে। পবিত্র হজরতবাল ঘিরে যে-দাঙ্গা গোটা ভারতে লেগেছিল সে-দাঙ্গার প্রভাব কলকাতাতেও পড়েছিল ছয়ের দশকের শুরুতে। শহরতলিতেও যে সে-দাঙ্গার প্রভাব ছড়ায়নি তা নয়।
পরবর্তীকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর শিখদের প্রতি বীতরাগ খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রাজ্যে প্রভাব ফেলতে শুরু করা মাত্রই তৎকালীন প্রশাসন এবং প্রধান শাসকেরা যেভাবে শক্ত হাতে গোটা ব্যাপারটার মোকাবিলা করেছিলেন তার ফলে সেই সংঘর্ষের পরিবেশ পশ্চিমবঙ্গের গোটা আকাশবাতাসকে আকীর্ণ করতে পারেনি।
ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী সময়ের ঘটনাক্রম ঘিরে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার এবং শাসক হিসেবে বামপন্থী দলগুলি প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিক প্রাজ্ঞতার এবং আন্তরিকতার যে পরিচয় তখন দিয়েছিলেন, তার জেরে সাম্প্রদায়িক শক্তি এই রাজ্যে সেভাবে থাবা বসাতে পারেনি।
কিন্তু তার পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময়কালেও ধীরে ধীরে যেভাবে হিন্দু-মুসলিম, উভয় মৌলবাদী শক্তি এই রাজ্যে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে, তা মোকাবিলার জন্য যতখানি রাজনৈতিক ক্ষিপ্রতা দেখানো দরকার ছিল, ক্ষমতায় থাকার শেষপর্বে সেই ক্ষিপ্রতা দেখাতে পারেননি বামপন্থীরা। তখন থেকেই যে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িকতা আর প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার একটা চোরাস্রোত বইতে শুরু করছে, এটা সমাজবিজ্ঞানীরা বুঝলেও, প্রগতিশীল রাজনীতির মানুষেরা কতটা বুঝেছিলেন, তা নিয়ে একটা সন্দেহ এবং সংশয় থেকেই যায়।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পরবর্তী সময়কে ব্যবহার করে এই রাজ্যে খুব ধীরগতিতে হলেও আরএসএস তার প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে। বিশেষ করে দেখা গিয়েছিল, আরএসএসের ‘শাখা’ যদিও তখন আজকের মতো সেভাবে বিস্তৃত হয়নি, কিন্তু তাদের যে সাম্প্রদায়িক বার্তা এবং মানুষের মনকে সহনাগরিক মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ সম্পর্কে ক্ষিপ্ত করে তোলা, ক্লিন্ন করে তোলা— এই পরিস্থিতিটা কিন্তু তখন থেকেই ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করেছিল।
সেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করবার জন্য যে পাল্টা সামাজিক প্রযুক্তির প্রয়োগ করা দরকার ছিল, সে-সম্পর্কে বামপন্থী এবং অন্যান্য অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলগুলি কতটা সচেতন ছিল তা ঘিরে একটা সংশয় থেকেই যায়। তার পাশাপাশি বলতে হয়, বাংলাদেশের সেই সময় ক্ষমতাসীন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থী ইসলামি মৌলবাদী শক্তি, সেখানকার ভয়ঙ্কর যুদ্ধাপরাধীদের পশ্চিমবঙ্গের অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সীমান্তবর্তী এলাকাগুলিতে ধর্মসভার নাম করে এক ধরনের ইসলামীয় মৌলবাদ ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করত।
আজ যে সন্দেশখালি ইত্যাদি এলাকাগুলি নানা ধরনের রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার দরুন আলোচনায় উঠে আসছে, এইসব অঞ্চলগুলিতে নয়ের দশকের একটা বিস্তৃত সময় জুড়ে বাংলাদেশের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো লোক ধর্মসভার (জলসা) নাম করে গরিব ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের উত্তেজিত করত নানা কৌশল নিয়ে। দেলোয়ার হোসেন সাঈদী হল সেই কুখ্যাত জামাত-এ-ইসলামির নেতা যে বাংলাদেশের মহান বিজয়ের অব্যবহিত আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পুরনো ঢাকায়, নিজের বাড়ি থেকে বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক শহিদুল্লাহ কায়সারকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তারপরে আর শহিদুল্লাহ কায়সারের কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এই লোকটি পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শহিদ হওয়ার পর ধীরে ধীরে আবার বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ইত্যাদিদের দ্বারা সামাজিক, রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত হতে শুরু করে। সেই লোকটি যখন পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকা, যেখানে মুসলমান জনগোষ্ঠী একটা ভাল পরিমাণে রয়েছে, সেখানে ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক কথাবার্তা বলছে ধর্মসভার নাম করে এবং সেখানে ওই ধর্মসভাগুলি পরিচালিত করবার ক্ষেত্রে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের মতো আরএসএসের সহযোগী সংগঠনগুলি নানারকম সাহায্য সহযোগিতা করছে, তখন কিন্তু এগুলি মোকাবিলার জন্য যে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল, সেগুলো আদৌ নেওয়া হয়েছিল কিনা সে-সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই।
এই নিবন্ধকার তৎকালীন শাসকদের সাপ্তাহিক পত্রিকা দেশহিতৈষী তে দেলোয়ার হোসেন শহীদ সাঈদীর বসিরহাটের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধর্মসভা করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা করা এবং তাকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ইত্যাদি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সাহায্য করার বিষয়টি লেখে। তারপরেও রাজনৈতিক বা সামাজিকভাবে পাল্টা সামাজিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল কিনা এ সম্পর্কে একটা সংশয় থেকেই যায়।
বিভাজনকে শক্তিশালী করবার জন্য অভিন্ন শ্রেণিস্বার্থে অবস্থান করা মুসলিম মৌলবাদও সহযোগী হয় হিন্দু মৌলবাদের। আজকের বাংলাদেশে ভারতের সিএএ আইন ইত্যাদিকে ঘিরে সে-দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের উত্তেজিত করে চলেছে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে যারা ভারত এবং বাংলাদেশ, উভয় দেশেই ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। আর তার জেরে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি এমন কিছু কর্মকাণ্ড করার চেষ্টা করছে যাতে ভারতের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি রাজনৈতিক হিন্দুরা ‘হিন্দু বিপদের মধ্যে আছে’— এই আবেগটা পশ্চিমবঙ্গ-সহ গোটা ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে ব্যাপকভাবে প্রচার করে নিজেদের রাজনৈতিক শক্তিবৃদ্ধি করতে পারে, আর ভোট-রাজনীতিতে তার ফায়দা তুলতে পারে।
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা ছাড়া কার্যত অন্য রাজনৈতিক দলগুলি রাজনৈতিক ইস্যু প্রায় তুলছেই না বলা যেতে পারে। মন্দির-মসজিদ, মসজিদ ভেঙে মন্দির করা, যত মসজিদ রয়েছে সেগুলি সব মন্দির ভেঙে বা মন্দিরের সামগ্রী দিয়ে তৈরি, নাগরিকত্বের একমাত্র নির্ণায়ক হল ধর্ম, সেখানে হিন্দু তো থাকবেই, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন সবাই থাকতে পারে। কিন্তু মুসলমান নয়।
নাগরিকত্ব ঘিরে শংসাপত্র কে দেবে? সেটা দেবে পুরোহিত। কোনও সরকারি অফিসার নয়। জনপ্রতিনিধি নয়। এই সমস্ত অরাজনৈতিক প্রসঙ্গগুলিকেই রাজনীতি হিসেবে তুলে ধরছে আরএসএস-বিজেপি। একটিবারের জন্য তারা তুলে আনছে না দেশের ভয়াবহ অর্থনীতির কথা। গোটা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অর্থশক্তি আর পেশিশক্তির দাপটের প্রতিযোগিতা চলছে।
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন নিজের দু-কোটির অধিক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবের দোহাই দিয়ে ভোটে লড়তে চাইছেন না। তাঁর স্বামী মোদির অর্থনীতির একদা অন্যতম প্রবক্তা হয়েও ঠিক জোসেফ স্টিগলিৎসের মতো আজ মোদির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমালোচক। মার্কিন রাষ্ট্রপতি হিসেবে যখন বিল ক্লিন্টন কর্মরত ছিলেন, সেই সময়ে তাঁর ভয়াবহ অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদী নীতির প্রবক্তা ছিলেন এই জোসেফ স্টিগলিৎস। পরবর্তীকালে তিনি হন বাজার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমালোচক।
ঠিক সেইরকমভাবেই আজ যে নির্মলা সীতারামনের স্বামী, যিনি এককালে মোদির এই আত্মঘাতী অর্থনীতির অন্যতম প্রবক্তা ছিলেন, তিনি হয়ে উঠেছেন মোদির অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সমালোচক।
আমরা গত ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদিকে যেভাবে দেখেছি, তার সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, তিনি কখনও সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। তাঁর দলের ভেতরে যাঁরা তাঁর রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সমালোচক, তাঁদেরকে হেনস্থা করতে মোদি যে কী ধরনের পদক্ষেপ নেন, সেটা কাশ্মিরের প্রাক্তন রাজ্যপাল, যিনি প্রাক্তন বিজেপি নেতাও, সেই সত্যপাল মালিকের প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এজেন্সি ব্যবহার করে কী ধরণের প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করেছে, সেটা সকলেই দেখেছেন।
আশঙ্কা হচ্ছে নির্মলা সীতারামনের স্বামীর ক্ষেত্রেও ভোটের পরে না সেই ধরনের কোনও কিছু ঘটে।
গোটা দেশে আসন্ন লোকসভা নির্বাচন ঘিরে হিন্দুত্ববাদী শিবির, রাজনৈতিক প্রশ্নগুলিকে অত্যন্ত কৌশলের এড়িয়ে যাচ্ছে। গত ১০ বছরে নরেন্দ্র মোদি একক-গরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকাকালীন দেশের অর্থনৈতিক হাল কী? দেশের বেকারত্বের হাল কী? শিক্ষার অবস্থা কেমন? স্বাস্থ্যের অবস্থা কেমন? ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থা কেমন? প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি কী জায়গায় রয়েছে? কেন বাংলাদেশের মানুষকে তিস্তার জল, যেটি তাঁদের আইনগতভাবে প্রাপ্য, সেটি থেকে তাঁদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে? এই বঞ্চনার পেছনে ভারত সরকারের রাজনৈতিক বক্তব্য কী? ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি, তা ঘিরে কেন্দ্রীয় সরকারের কী বক্তব্য? প্রধান শাসকদল বিজেপির কী বক্তব্য? তাঁদের নীতিবিহীন সুবিধাবাদী জোট এনডিএ-র অন্যান্য শরিকদের কী বক্তব্য? এসব কোনও কিছুই রাজনৈতিক প্রচারে যাতে না আসে, সেজন্য ভোটের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই হিন্দু-মুসলমান, ততই মন্দির-মসজিদ ততই জ্ঞানবাপী মসজিদ নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট যাতায়াত— এই ধরনের বিষয়গুলিকে রাজনীতিক জায়গায়, রাজনীতিকে মুছে দিয়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।
আগেই বলেছি, বামপন্থীরা ছাড়া ভারতের আর কোনও রাজনৈতিক দল নির্বাচনী প্রচারে রাজনৈতিক ইস্যুগুলোকে তুলে আনছে না সেভাবে। আরএসএস-বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের মোকাবিলার নাম করে কোনও কোনও রাজনৈতিক দল নরম হিন্দুত্বের পথে যাচ্ছে। আবার তৃণমূলের মতো দল, তারা যাচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার পথে।
এইরকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে এবারে যে লোকসভার ভোট হতে চলেছে সেই ভোট যে ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ, ধর্মনিরপেক্ষ পরিবেশ আগামী দিনে বজায় থাকবে কিনা তার নির্ণায়ক হিসেবে উঠে আসছে, এ-বিষয়ে বামপন্থীরা ছাড়া কোনও কোনও ক্ষেত্রে কংগ্রেস কিছু কথা বললেও, দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলি কোনওরকম শব্দ উচ্চারণ করছে না।
বিজেপির ষড়যন্ত্র ভারতের সংবিধানের খোলনলচে বদলে দেওয়া। সেই ষড়যন্ত্রকে মাথায় রেখেই তারা এবারের লোকসভা নির্বাচনে নেমেছে। বিগত ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ঠিক পরেই, সংসদের প্রথম অধিবেশনে, আমরা দেখেছি কীভাবে অত্যন্ত গোপনে সঙ্ঘের রাজনৈতিক কর্মসূচি, সংবিধানের ৩৭০ নম্বর ধারার অবলুপ্তি, সেটি বিজেপি করেছে।
আমাদের মনে রাখা দরকার, আগামী ২০২৫ সালে আরএসএসের শতবর্ষ। এই শতবর্ষকে সামনে রেখে, ভারতকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করবার এক গভীর চক্রান্ত গোটা হিন্দুত্ববাদী শিবির করছে। এই চক্রান্ত যে কেবলমাত্র বিজেপি বা তার সহযোগী দলগুলি করছে এমনটা ধরে নেওয়ার কোনও কারণ নেই। বিজেপির সঙ্গে বাইরে কুস্তি-ভেতরে দোস্তি করা বিভিন্ন আঞ্চলিক দলগুলিও নানাভাবে বিজেপির সুবিধে করে দিয়ে চিরন্তন-বৈচিত্র্যময়-সমন্বয়বাদী ভারতকে রাজনৈতিক হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করবার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে।
তাই এবারের নির্বাচন নিছক কাউকে লোকসভায় পাঠানোর নির্বাচন নয়। এবারে নির্বাচন জাতীয় আন্দোলনের বিভিন্ন ধারায় লড়াই করে যে স্বাধীনতা আমরা অর্জন করতে পেরেছিলাম, তার ভিত্তিতে যে ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সংবিধান আমরা পেয়েছি, এবারে নির্বাচনী সংগ্রাম সেই সংবিধানকে রক্ষা করবার লড়াই।