প্রদীপ দত্ত
যে-মামলা ভারতের ইতিহাসের দিক পরিবর্তন করে দিল তার অসঙ্গতির দিকগুলো নিয়ে কার্যত আলোচনাই হয়নি। অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাসের অভিযোগ থাকলেও পুড়ে যাওয়া কোচটির শারীরিক পরীক্ষার জন্য পুলিশ দু-মাস ধরে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ডাকেনি। কেন? যেখানে কেউ ঘরের মধ্যে খুন হলে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ডেকে আনা হয়, এত মানুষ অজানা কারণে অগ্নিকাণ্ডে মারা গেল, ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞদের ডাকাই হল না! আইনের দিক থেকে ঘটনা যেখানে ঘটেছে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা না আসা পর্যন্ত পুলিশের সেই ট্রেনটিকে সেই অবস্থায় সংরক্ষণ করা খুব জরুরি ছিল। অথচ প্রথম দিন থেকেই কৌতূহলী দর্শকরা কোনও বাধা ছাড়াই সেই কোচে উঠে কেমনভাবে কতটা পুড়েছে তা দর্শন করেছে, পুলিশ তাদের আটকায়নি
পূর্ব-প্রসঙ্গ: ভূমিকা
গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে মূলত সমাজকর্মী তিস্তা শেতলওয়াড়ের উদ্যোগে বিচারপতি কৃষ্ণা আইয়ারকে শীর্ষে রেখে বিচারপতি পিবি সায়ন্ত, বিচারপতি হসবেত সুরেশ, মানবাধিকার কর্মী কেজি কান্নাবিরন, ইতিহাসবিদ তনিকা সরকার, সমাজকর্মী অরুণা রায়-সহ ৮ জন বিশিষ্ট নাগরিককে নিয়ে কনসার্নড সিটিজেন্স ট্রাইবুনালের (সিসিটি) প্যানেল গঠিত হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে সিসিটি দাঙ্গা নিয়ে নানাজনের সাক্ষ্য নেয়। সেইসব সাক্ষ্য একত্রিত করে পরে দুই খণ্ডে রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। রিপোর্ট অনুযায়ী, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি করসেবকরা আমেদাবাদ থেকে সবরমতি এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে অযোধ্যার উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। যাওয়ার পথে তারা দাহোদ রেলস্টেশনে ভাঙচুর করে স্টেশনের মুসলমান ভেন্ডরদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে। ফৈজাবাদের কাছে রুদৌলি আর দরিয়াবাদ স্টেশনের মাঝে নিরীহ মহিলা-শিশু-সহ মুসলমান যাত্রীদের আক্রমণ করে। এক তরুণ প্রতিবাদ করলে তাঁকে তারা পতরাঙ্গা ও রোজাগাঁও স্টেশনের মাঝে চলন্ত ট্রেনের বাইরে ফেলে দেয়। খুবই আহত, রক্তাক্ত হয়ে কয়েকজন মহিলা ট্রেন থেকে কোনওরকমে রুদৌলি স্টেশনে ঝাঁপ দেন।
ট্রেন থেকে রুদৌলি স্টেশনে নেমে করসেবকরা মুসলমানদের জোর করে “জয় শ্রীরাম” বলতে বাধ্য করে। কয়েকজনের দাড়ি ধরে টানে, ত্রিশূল দিয়ে কোপায়। অতি মারাত্মক এইসব ঘটনা পরপর ঘটলেও রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বা পুলিশ কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। অঞ্চলের সব হিন্দু ও মুসলমানই ওই আক্রমণের নিন্দা করে। মুসলমান ধর্মীয় নেতারা শান্তি বজায় রাখা এবং প্রতি-আক্রমণ থেকে বিরত থাকার আবেদন করেছিলেন।
অযোধ্যা থেকে ট্রেনে চড়ে আমেদাবাদ ফেরার সময়েও করসেবক মহিলা-পু্রুষ ত্রিশূল বা লাঠি হাতে প্রতিটি স্টেশনে নেমে— ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’, ‘জয় শ্রীরাম’, ‘মুসলিম ভারত ছোড়ো’, ‘দুধ মাঙ্গো তো ক্ষির দেঙ্গে, কাশ্মির মাঙ্গো তো চিড় দেঙ্গে’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়। ট্রেনের সব সংরক্ষিত আসন করসেবকরা দখল করে নিয়েছিল। ট্রেনে ভিড় ছিল অস্বাভাবিক। সাধারণ যাত্রীরা নাজেহাল হলেও ছিল অসহায়।
২৭ ফেব্রুয়ারি সকাল ৭-৩০ মিনিটে ট্রেন গোধরায় পৌঁছয়। করসেবকরা প্ল্যাটফর্মে মুসলমান মেয়েদের শ্লীলতাহানি করে, হাত টেনে ট্রেনে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করে। মুসলমান ভেন্ডররা তা প্রতিহত করতে এগিয়ে এলে তা পেরে ওঠেনি। এক মুসলমান চা-বিক্রেতা চায়ের কেটলি নিয়ে এস-৬ কোচে উঠলে, যাত্রীরা চা কিনে খাচ্ছিল। কয়েকজন করসেবক তাকে অপমান করে কোচ থেকে নামিয়ে দেয়। ওদিকে স্টেশনে ট্রেন থামার পর মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা, ত্রিশূলধারী কিছু করসেবক সবরমতি এক্সপ্রেসের মাথায় চড়ে বসে। স্টেশনের উল্টোদিকের বসতিতে যে সব মুসলমান মহিলারা সকালের কাজ সারতে বাইরে এসেছিল করসেবকরা পোশাক খুলে তাদের দিকে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে। এরপর পাথর ছোড়াছুড়ি শুরু হয়, শেষে ৬ নম্বর কোচে আগুন লাগে।
স্টেশনের কাছেই ছিল ঘাঞ্চি মুসলমানদের বসতি। সরকারি মতে, দু-হাজার মুসলমান জড়ো হয়ে ট্রেনে আক্রমণ করতে গিয়েছিল। তারা ট্রেনে যে আগুনের গোলা ছুড়েছিল তা থেকেই আগুন লাগে। ছয় নম্বর কোচটি একেবারে জ্বলে যায়। ট্রেনের ধারণক্ষমতা এগারোশো হলেও ছিল দু-হাজার যাত্রী, যার মধ্যে সতেরোশোই করসেবক। দু-হাজার মুসলমান জড়ো হয়ে থাকলেও কেন অন্য কোনও কোচ আক্রমণ করেনি সে-কথার উত্তর জানা নেই। অন্য কোচ থেকে কি কেউ স্টেশনে নামেনি বা পাথর ছোড়েনি? সে-কথাও জানা নেই।
৫৮টি মৃতদেহের মধ্যে ২৬টি ছিল মহিলার, ২০টি পুরুষের এবং ১২টি বাচ্চার। মোট ৪৩ জন আহত হয়েছিল, তার মধ্যে ৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, বাকিদের আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না। হাসপাতালে ১ জনের মৃত্যু হয়, বাকি ৪ জন সুস্থ হয়ে ছাড়া পায়। গোধরার কালেক্টর ট্রাইবুনালে (সিসিটি) বলেন, মৃতদেহগুলো এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে কাউকে চেনার উপায় ছিল না। অঙ্গে থাকা চিহ্ন বা অলঙ্কার এবং সঙ্গে থাকা জিনিসপত্রের ভিত্তিতে মাত্র পাঁচজনকে চিহ্নিত করা গিয়েছিল। তার মধ্যে ছিলেন গোধরার স্টেশনমাস্টারের স্ত্রী, গোধরা থেকেই তিনি ভাদোদরা যাচ্ছিলেন। বাকিদের পরিচয় জানা যায়নি।
ট্রেনে আগুনের খবর, ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (ভিএইচপি), বজরং দল এবং আরএসএস প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৈরি হয়। ভিএইচপি পরের দিন রাজ্য জুড়ে বনধের ডাক দিলে বিজেপি তা সমর্থন করে। সরকারের পক্ষ থেকে আদৌ বনধের বিরোধিতা করা হয়নি। শীর্ষ গোয়েন্দাকর্তার কথা অনুযায়ী পরের দিন, ২৮ ফেব্রুয়ারি সকালে ভিএইচপি এবং বজরং দলের কর্মীরা আমেদাবাদের কিছু অঞ্চলে গোলমাল করে বুঝে নিতে চায় পুলিশ হস্তক্ষেপ করে কি না। তাদের কাছে খবর ছিল, পুলিশকে চোখ বুজে থাকতে বলা হয়েছে। চোখ বুজে আছে বোঝার পরই গণহত্যা শুরু হয়।
গুজরাত দাঙ্গার ভয়াবহ চলমান ছবি কয়েকদিন ধরে টিভিতে দেখা গিয়েছিল। আজকের প্রবীণদের অনেকে তা দেখেছেন। প্রতিশোধকামী যুবকরা রাস্তা দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে, প্রতিশোধ নেওয়ার কথা বলছে, মুসলমানদের দেশ ছেড়ে যেতে বলছে। তিন দিন ধরে ভয়ঙ্কর গণহত্যা চলতে থাকার পর কয়েকটি দেশের সরকার তা বন্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অফিসে চাপ সৃষ্টি করে।
২৭ ফেব্রুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গোধরার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পর সন্ধ্যায় গুজরাত সরকারের প্রেস রিলিজে মোদির বয়ান তুলে দিয়ে বলা হয়, তা হল “পূর্বপরিকল্পিত সমষ্টিগত অমানবিক হিংসাস্রয়ী সন্ত্রাসবাদী কাজ”। এই যে মোদি রাতারাতি বলে দিলেন, ট্রেনে আগুন ধরানোটা সন্ত্রাসবাদী ষড়যন্ত্র, তার পিছনে রাজনীতি ছিল। বলা হল যে, আগুনে পুড়ে মৃত ৫৯ জন (একজন হাসপাতালে মারা গিয়েছিল) যাত্রীই ছিল করসেবক। তারা রামমন্দির প্রচার অভিযানের পর অযোধ্যা থেকে সবরমতি এক্সপ্রেসে ফিরছিল। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অমান্য করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অযোধ্যা যাওয়ার ডাক দিয়েছিল। ২৬ তারিখেই লোকসভায় বিজেপি-বিরোধী সদস্যরা অযোধ্যার প্রচারে দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ছে বলে বারবার অধিবেশনে বিঘ্ন ঘটিয়েছিলেন।
যে-মামলা ভারতের ইতিহাসের দিক পরিবর্তন করে দিল তার অসঙ্গতির দিকগুলো নিয়ে কার্যত আলোচনাই হয়নি। গোধরা মামলায় আদালত ৯৪ জন অভিযুক্তের মধ্যে ৩১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে। অবশ্য যারা দোষী নয়, তাদেরও ৯ বছর জেল খাটতে হয়েছে, জামিন পায়নি। গোধরা-পরবর্তী গণহত্যার ক্ষেত্রে হিন্দু অভিযুক্তরা কিন্তু তাড়াতাড়ি জামিন পেয়েছিল।
অগ্নিসংযোগ ও সন্ত্রাসের অভিযোগ থাকলেও পুড়ে যাওয়া কোচটির শারীরিক পরীক্ষার জন্য পুলিশ দু-মাস ধরে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ডাকেনি। কেন? যেখানে কেউ ঘরের মধ্যে খুন হলে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের ডেকে আনা হয়, এত মানুষ অজানা কারণে অগ্নিকাণ্ডে মারা গেল, ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞদের ডাকাই হল না! মোদি যেমন বলেছেন সেইমতো অগ্নিসংযোগ যদি সন্ত্রাসী চক্রান্তের জন্যই হয় তাহলেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব ছিল ফরেনসিক সাক্ষ্যের। অনুমান করা যায়, মোদির কথা যেন মিথ্যা প্রমাণিত না হয়ে যায় সেই ভয়ে বিশেষজ্ঞদের ডাকা হয়নি। আইনের দিক থেকে ঘটনা যেখানে ঘটেছে ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা না আসা পর্যন্ত পুলিশের সেই ট্রেনটিকে সেই অবস্থায় সংরক্ষণ করা খুব জরুরি ছিল। বিশেষ করে যেখানে মৃতদেহগুলো পাওয়া গিয়েছিল সেই এস-৬ কোচটিকে।
অথচ প্রথম দিন থেকেই কৌতূহলী দর্শকরা কোনও বাধা ছাড়াই সেই কোচে উঠে কেমনভাবে কতটা পুড়েছে তা দর্শন করেছে, পুলিশ তাদের আটকায়নি। ঘটনার এক মাস পরে, ৩ এপ্রিল এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়ার তথ্যানুসন্ধানী দল যখন গোধরায় এলেন, অবাক হয়ে দেখলেন এস-৬ কোচটি ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছে, কোনও পাহারা নেই। কৌতূহলীরা ইচ্ছেমতো তার মধ্যে ঢুকে পড়ছে। এর বিপদ হল যা কিছু সাক্ষ্য ছিল কৌতূহলীদের হাঁটাচলায় সেই সাক্ষ্য নষ্ট হতে পারে, সেখান থেকে কেউ কিছু সরাতে বা কিছু রেখে দিতেও পারে।
২৮ এপ্রিল, দুর্ঘটনার দু-মাস পরে পুলিশ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের কোচটিকে শারীরিক পরিদর্শন করার কথা প্রথম বলে। অবশ্য তার আগেই পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়ে গেছে যে, অগ্নিসংযোগকারীরা ক্যানভাসের ভেস্টিবুল কেটে, স্লাইডিং দরজা ভেঙে সেখানে ঢুকেছিল। ১ মে আমেদাবাদের ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিশেষজ্ঞরা সেখানে যায়। এত দেরিতে পরিদর্শনের জন্য তাঁদের সিমুলেশন পরীক্ষা করতে হয়। শেষে তারা জানায়, কোচটির ভিতরে পেট্রোল ছড়িয়েছিল বলেই আগুন ধরেছিল।
২০০৫ সালে ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব আগুন লাগার কারণ খুঁজে দেখতে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ইউসি ব্যানার্জিকে শীর্ষে বসিয়ে এক তদন্ত কমিটি গঠন করেন। ব্যানার্জি কমিটি সেই কাজে পাঁচজন বিশেষজ্ঞেকে নিয়োগ করে। দুর্ঘটনার পর তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর বিশেষজ্ঞ কমিটির কাছে আগুন লাগা এস-৬ কোচটিকেই খতিয়ে দেখা ছাড়া উপায় ছিল না। কোচটির পোড়া ও ধোঁয়ার ধরন কেমন হতে পারে তা দেখতে গিয়ে তাঁরা অন্য একটি আগুন-লাগা কোচের সঙ্গে তুলনা করে দেখেন।
ওইরকম পাঁচটি কোচ রেলইয়ার্ডে পড়ে ছিল। তার একটির পোড়া ও ধোঁয়ার ধরন এস-৬ কোচটির সঙ্গে মিলে যায়। সেই কোচটিতে আগুন লাগার কারণ নিয়ে কোনও সন্দেহ ছিল না। আগুন লেগেছিল কোচটির মাঝে। সম্ভবত কেউ চা বানাতে, খাবার গরম করতে বা রান্না করতে স্টোভ জ্বালিয়েছিল।[1] আগুনের রশ্মি সেই অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল, তবে ধোঁয়া সারা কোচে ছড়িয়ে পড়েছিল। গোধরার দুর্ঘটনায় এস-৬ কোচটির বেশিরভাগই মারা গিয়েছিল শ্বাসরোধ হয়ে। তাই ওই ব্যাখ্যা গুরুত্ব পায়, কারণ রেলের দ্বিতীয় শ্রেণির কামরায় তখন অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা ছিল না। একটি দেশলাইকাঠি জ্বালানো হলেও আগুন লেগে বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে যেতে পারত।
ব্যানার্জি কমিশনের রিপোর্ট বিজেপি তীব্রভাবে প্রত্যাখ্যান করে, কারণ ওই রিপোর্টে অগ্নিকাণ্ডের জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়নি। পার্টির সেই সময়ের মুখপাত্র অরুণ জেটলি পদ্ধতিগত আপত্তি তুলে বলেন, রেলমন্ত্রকের এই ধরনের তদন্ত করার এক্তিয়ার নেই। যদি এটা দুর্ঘটনাই হয়, যাত্রীরা বাইরে লাফিয়ে পড়ল না কেন? জেটলির জানা ছিল না ৪৩ জন ওইভাবেই কোচ থেকে বেরিয়ে এসেছিল।
ব্যানার্জি কমিটির রিপোর্ট মান্যতা পেলে মুখ্যমন্ত্রীর মান থাকে না। তাই ওই রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ করে পুলিশ গুজরাত হাইকোর্টে এক হিন্দুগোষ্ঠীর একজনকে সাক্ষী হিসাবে তোলে যে ২০০২ সালে ওই হট্টগোলের সময় গোধরা প্ল্যাটফর্মে আহত হয়েছিল। হাইকোর্টের বিচারক রায় দেন, ব্যানার্জি কমিটি গঠন অসাংবিধানিক, অবৈধ এবং বাতিল। তিনি ওই বিশেষজ্ঞ রিপোর্টকে ‘কালারেবল এক্সারসাইজ অফ পাওয়ার উইথ ম্যালাফাইড ইন্টেনশনস’ বলে উল্লেখ করেন। বিশেষ করে রাজ্য সরকার যখন দাঙ্গার পর শাহ কমিশন গঠন করেছে,[2] সেক্ষেত্রে রেলওয়ে মন্ত্রককে ওই কমিটি গঠন করার জন্য তীব্র ভর্ৎসনা করেন। নিজেদের সম্পত্তিতে পরে যেন তা আর না ঘটে তাই সম্পত্তিতে আগুন কীভাবে লাগল তা জানতে রেলের হাই-লেভেল কমিটি গঠনের অধিকারও বাতিল করেন। ওই রায় সম্বন্ধে অন্য কিছু না বলেও এটুকু বলাই যায় যে, বিচারকের রায়টি ছিল বিস্ময়কর। মজার কথা হল, কীভাবে আগুন লেগেছিল তা বুঝতে ব্যানার্জি কমিটির রিপোর্টের উপর ভরসা না করলেও চলে।
গুজরাত সরকারের ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির (এফএসএল) বিশেষজ্ঞরা ওই বছর ৩ মে ঘটনাস্থল ঘুরে এসে আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশের আগের ব্যাখ্যাকে নাকচ করেন। তারা বলেন, বরং বালতির মতো চওড়া মুখের কোনও পাত্র থেকে ৬০ লিটার দাহ্য তরল সেই কোচের মেঝেতে ঢেলে আগুন জ্বালালে যা হবে তার সঙ্গে মিল আছে। প্রশ্ন হল এফএসএলের বিশেষজ্ঞরা পুলিশ চার্জশিটে যা বলেছে তার বিরোধিতা করল কেন? তার সম্ভাব্য উত্তর হল, গোয়েন্দাসূত্রে মোদি খবর পেয়েছিলেন, প্রাক্তন বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত কনসার্নড সিটিজেনস ট্রাইবুনাল (সিসিটি) মে মাসের শুরুতে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনা করছে। কাজেই ঘাঞ্চি মুসলমানদের প্রতিশোধের আখ্যান নিয়ে প্রশ্ন উঠতই।
[পরের পর্ব- সিসিটি গোধরা থেকে ঘুরে আসার পর যা জানিয়েছিল]
[1] কুড়ি বছর আগেও দূরপাল্লার ট্রেনে অনেকেই তা করতেন। গোঁড়া হিন্দুদের তখন ট্রেনে খাবার রান্না করা বা গরম করার অভ্যাস ছিল।
[2] পরে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি জিটি নানাবতী ওই কমিশনে যোগ দেন।