অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
সম্প্রতি নয়াদিল্লির সিএসডিএস গবেষণা-সংস্থার অধীনে লোকনীতি-প্রকল্পের একটি গবেষণা-কার্যক্রম হিসেবে এ-দেশের মানুষের মতামতকে বুঝতে একটি প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। এই সমীক্ষা অনুযায়ী হিন্দুত্ববাদী নীতিগুলির ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক জনতার ভিতর দোটানার মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। পরিবর্তে বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির মতো ক্ষেত্রগুলি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে
উত্তাপ যতই বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আস্ফালন। কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দল ক্রমশই প্রচারের প্রয়োজনে সরাসরি আক্রমণাত্মক ভাষণেও পিছপা হচ্ছে না। তদুপরি সেই আক্রমণের ঝাঁঝ যুক্তিবোধ তো বটেই এমনকি শালীনতা অথবা সংবিধানের আদর্শের প্রতি যে কাঙ্খিত শ্রদ্ধা, তারও সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। সম্প্রতি যেমন বাংলার এক নির্বাচনী জনসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করে বসলেন “আপনারা কেউ ভয় পাবেন না। আপনারা বিজেপিকে ভোট দিয়ে ক্ষমতায় আনুন। সিএএ-র মাধ্যমে আপনাদের সকলকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে।” যুক্তিবাদী সরল মন প্রশ্ন করতে চায়, নাগরিক না হয়েও কি ভোটাধিকার সম্ভব? বিপুল জনসভার সকল অতিথিকেই মাননীয় শাহ-মহোদয় যে এভাবে বে-নাগরিক ঘোষণা করে দিয়ে গেলেন, নাগরিক না হলে তাঁরা এদেশের নির্বাচনে ভোটদানেরই বা অধিকার পান কীভাবে? যুক্তিযুক্ত উত্তর মিলছে না। দেশের আরেক রাজ্যে, অন্য এক জনসভায় বক্তব্য রাখতে উঠে বিজেপি সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা মহোদয় আবারও ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’-এর পাশাপাশি এবারে ‘আঞ্চলিক দল-মুক্ত ভারত’-এরও প্রস্তাব রেখেছেন। বহুত্ববাদের প্রতি তাঁদের অশ্রদ্ধা বহুকালের। এবারে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকেও ক্রমশ তাঁরা আস্তাকুঁড়ে পাঠাতে চান। ‘ওয়ান নেশন ওয়ান ইলেকশন’-এর পাশাপাশি ‘ওয়ান নেশন ওয়ান পার্টি’র চূড়ান্ত ধারণাটিকেও তাঁরা বোধকরি এইবারে জনমানসে প্রবেশ করাতে উৎসুক হয়ে উঠেছেন। কাজেই সংবাদমাধ্যমগুলির তরফে ‘অ্যাজেন্ডা সেটিং’ অথবা রাজনৈতিক দলগুলির তরফে ‘ন্যারেটিভ’ তৈরির কাজ এখন সর্বত্রই জোরকদমে চলেছে। এরই মাঝে পড়ে আমজনতা, অথবা সাধারণ ভোটারেরই বা চিন্তা-ধারণাগুলি কেমন, তাঁরাই বা কোন পথে এগিয়েছেন, সেই বিষয়েই অনুসন্ধান জরুরি।
সম্প্রতি নয়াদিল্লির সিএসডিএস গবেষণা-সংস্থার অধীনে লোকনীতি-প্রকল্পের একটি গবেষণা-কার্যক্রম হিসেবে এ-দেশের মানুষের মতামতকে বুঝতে একটি প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। এই সমীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী এ-দেশের সাধারণ মানুষের ভাবনা-চিন্তার যে ধরন সামনে উঠে এসেছে, তার ফলে কেন্দ্রীয় শাসকবর্গের কপালে অচিরেই আশঙ্কার ভাঁজ পড়তে চলেছে। সমীক্ষার আওতায় আসা ৬২ শতাংশ মানুষ মনে করছেন আগের চেয়ে বর্তমানে চাকরি পাওয়ার বিষয়টি অনেক বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর বিপরীতে মাত্র ১২ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন আগের থেকে বর্তমানে কাজ পাওয়ার বিষয়টি অনেকাংশে সহজ হয়েছে। অর্থাৎ সমীক্ষার ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ মনে করছেন বেকারত্ব আগের তুলনায় বেড়েছে, এবং এই বিষয়টি তাঁদের রোজকার চিন্তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সমীক্ষা অনুযায়ী মোট ৬৭ শতাংশ মুসলমান মতদাতা, দলিত হিন্দুদের ৫৭ শতাংশ মানুষ, এবং জনজাতীয় মানুষদের ৫৯ শতাংশ প্রতিনিধি কাজ পাওয়ার বিষয়টি আরও শক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন। এমনকি উচ্চবিত্ত-পরিসরেও ৫৭ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন আজকের দিনে চাকরি পাওয়া আগের চেয়ে অনেক কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠন আইএলও-র যে বার্ষিক রিপোর্ট, সেখানেও কিন্তু এই বিষয়টিকেই পরোক্ষে মান্যতা দেওয়া হয়েছে। সেই রিপোর্ট অনুসারে আমাদের দেশের মোট বেকার-জনসংখ্যার ৮৩ শতাংশেরই বয়স এখনও ত্রিশের কোঠা পার করে উঠতে পারেনি। অর্থাৎ, যে যুব-সম্প্রদায়কে অর্বুদে-নির্বুদে চাকরির দিবাস্বপ্ন দেখিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় মসনদে চড়েছিলেন, ক্রমশই সেই স্বপ্ন এখন ফেটে যাওয়া ফানুসের মতোই গোঁত্তা খেয়ে মাটিতে এসে পড়েছে।
এছাড়াও জনসাধারণকে চিন্তায় ফেলেছে মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির ঘটনা। সমীক্ষার ৭১ শতাংশ মানুষ মনে করেন আগের চেয়ে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। গরিব জনতার ৭৬ শতাংশ মানুষ মুদ্রাস্ফীতির ঘটনাকে অন্যতম সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন। সমীক্ষায় মাত্র ২২ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন তাঁরা তাঁদের দৈনন্দিন আয়-ব্যয়ের হিসেবের পরবর্তীতে সামান্য কিছু সঞ্চয়ও হাতে রাখতে পেরেছেন। এর বিপরীতে ৩৬ শতাংশ মানুষ জানিয়েছেন, তাঁরা তাঁদের নিজস্ব আয়ের মাধ্যমে জীবননির্বাহ করতে পারলেও সঞ্চয় তাঁদের কাছে অলীক স্বপ্ন হিসেবেই থেকে গিয়েছে।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
এই তথ্য কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপির কাছে আশঙ্কার বিষয়। কারণ, ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, এমনই এক প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষায় লোকনীতি-র তথ্য অনুসারে যেখানে মাত্র ১১ শতাংশ মানুষ বেকারত্বকে নির্বাচনী-মতদানের ক্ষেত্রে প্রধান বিচার্য বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দিয়েছিলেন, এ-বছরের সমীক্ষা অনুসারে তেমন মানুষের সংখ্যা একলাফে বেড়ে ২৭ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়াও মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে আগের নির্বাচনে গুরুত্ব দিয়েছিলেন ৫২ শতাংশ মানুষ, এবারে যে সংখ্যার হিসেব ৭১ শতাংশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে শহুরে মানুষের বিপরীতে গ্রামীণ-প্রান্তিক মানুষেরই ভাবনায় বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির মতো ইস্যুগুলি অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়েছে। সমীক্ষায় সরাসরি এও দেখা গিয়েছে, অল্পশিক্ষিত মানুষ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টিকে নিয়ে ও তুলনায় অধিক শিক্ষিত, যুবক-সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা বেকারত্বের বিষয়টিকে নিয়ে নিজেদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এর বিপরীতে তাহলে রামমন্দির ও ভ্রষ্টাচারের মতো বিষয়? সেই নিয়েই বা কী ভাবছেন সাধারণ মানুষ? সমীক্ষার ফলাফলে দেখা যাচ্ছে, নিজে থেকে মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ এই দুটি বিষয়কে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনী-ইস্যু হিসেবে নিজেদের বক্তব্যে তুলে ধরতে চেয়েছেন। ‘সশক্ত ভারত’ অথবা ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান’-এর স্লোগান অন্তত বেকারত্ব কিংবা মূল্যবৃদ্ধির গুরুত্বকে ছাপিয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখনও অবধি হয়ে উঠতে পারেনি।
একইভাবে গ্রামীণ জনতার কাছে জি-২০ আয়োজনের মতো বিষয় গুরুত্ব লাভ করেনি। মূলত শহরকেন্দ্রিক জনতা এই বিষয়টির সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন। যদিও প্রচারের কারণে, (এবং নিজেদের সার্বিক অজ্ঞানতার কারণে) শহুরে মানুষের কাছে জি-২০ আয়োজনের মতো বিষয় বিদেশনীতির ‘বিরাট সাফল্য’ হিসেবেই উঠে এসেছে। সমীক্ষা বলছে নীতিগতভাবে বিজেপির ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’-এর স্লোগান জনমানসে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদ-ঘেঁষা প্রধান কয়েকটি ইস্যুর ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের তরফে কার্যত এক বহুলাংশে বিভাজিত চিত্রই সমীক্ষায় উঠে এসেছে। ৩৭০ ধারা বাতিলের মতো বিষয়ের ক্ষেত্রেও সমীক্ষায় অংশ নেওয়া মানুষের ২৫ শতাংশই এ ব্যাপারে তাঁদের অজ্ঞানতার কথা জানিয়েছেন। মাত্র এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেছেন এই পদক্ষেপ জরুরি ছিল। বিপরীতে এক-ষষ্ঠাংশ মানুষ কিন্তু এও জানিয়েছেন যে, বিষয়টি জরুরি হলেও যেভাবে সেটিকে বলবৎ করা হল সেই পদ্ধতির সঙ্গে তাঁরা সহমত হতে অপারগ। রামমন্দির উদ্বোধনের বিষয়টিও যে নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে, সমীক্ষায় অংশ নেওয়া হিন্দু মতদাতারা এর সপক্ষে বক্তব্য রাখলেও, রামমন্দিরের বিষয়ে উচ্ছ্বাস কিন্তু উচ্চবর্ণ হিন্দুদের মধ্যে যতখানি দেখা গিয়েছে, নিম্নবর্গের মানুষদের ক্ষেত্রে এই বিষয়ে ততটাও আবেগ উঠে আসতে পারেনি। সবচেয়ে বড় কথা ৫৫ শতাংশ মানুষ ভ্রষ্টাচার বেড়েছে বলে মনে করলেও, তারই মধ্যে ২৫ শতাংশ মানুষ কিন্তু এই বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। মাত্র ১৬ শতাংশ মানুষ মনে করেছেন আঞ্চলিক দল বা রাজ্য সরকারগুলির কারণে দেশে দুর্নীতির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
তদুপরি, ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী যেখানে ৫০ শতাংশেরও বেশি মানুষ দেশের নির্বাচন কমিশনের প্রতি, তাঁদের সততা ও কর্মক্ষমতার প্রতি আস্থা রেখেছিলেন, ২০২৪ সালের তথ্য বলছে এই মুহূর্তে মাত্র ৩৩ শতাংশ মানুষ সেই নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাঁদের আগের আস্থা বহাল রেখেছেন। গণতান্ত্রিক দেশের আলোচনায়, নির্বাচনী পরিস্থিতিতে দেশের নির্বাচন কমিশনেরই নিরপেক্ষতার প্রশ্নে, যদি বা এতখানিই আস্থার অভাব উঠে আসে— সেই পরিস্থিতিকে অত্যন্ত আশঙ্কাজনক বলেই মনে করা উচিত।
পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি
এ-কথা সত্যি সমীক্ষা অনুসারে হিন্দুত্ববাদী নীতিগুলির ক্ষেত্রে দেশের সামগ্রিক জনতার ভিতর দোটানার মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছে। পরিবর্তে বেকারত্ব ও মূল্যবৃদ্ধির মতো ক্ষেত্রগুলি দেশের সাধারণ মানুষের কাছে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে উঠে এসেছে। এখন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির তরফে কেবল সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলিকে নিয়ে প্রচার চালালেই হবে না, তার বিপরীতে কোনওভাবেই যাতে বিজেপি-আরএসএসের তরফে হিন্দুত্ববাদী প্রচার সাধারণ মানুষের কাছে গুরুত্ব না পায়, সেই দিকেও সতর্ক নজর রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে উচ্চ-মধ্যবিত্ত জনতা বিগত বেশ কয়েকটি নির্বাচন জুড়েই তাঁদের অতি-সাম্প্রদায়িক, অর্ধশিক্ষিত মানসিকতার প্রতিফলন দেখিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় কর্নাটক-নির্বাচনে বিজেপি পরাস্ত হলেও, শিক্ষিত-ঝাঁ-চকচকে বেঙ্গালুরুর ‘আধুনিক’ বাসিন্দারা কিন্তু ফ্যাসিস্ট-সূর্যের দলের প্রতিই তাঁদের আস্থা বহাল রেখেছিলেন। কাজেই হিন্দুত্ববাদকে শহুরে-মধ্যবিত্ত পরিসরেই আটকিয়ে রাখা এবং বৃহত্তর মফস্বল অথবা গ্রামীণ ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে বেকারত্ব তথা মূল্যবৃদ্ধির মতো ইস্যুগুলিকেই প্রধান গুরুত্বের সঙ্গে তুলে আনা বিরোধীদের অন্যতম নির্বাচনী কৌশল হওয়া উচিত।
*মতামত ব্যক্তিগত