প্রদীপ দত্ত
সিসিটিকে দেওয়া হরেনের সাক্ষ্যের কথা সরকারের কানে গিয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে পার্টিবিরোধী কাজের অভিযোগ আনা হয়। তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করা হয়। বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে প্রার্থীই করা হয়নি। তিনি দিল্লি ও নাগপুরে গিয়ে বিজেপি এবং আরএসএস নেতাদের বলেছিলেন, নিজের লাভের জন্য মোদি পার্টি এবং সঙ্ঘকে শেষ করে দেবে। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ তিনি রহস্যজনকভাবে খুন হলেন। ল গার্ডেনে প্রাতঃভ্রমণের পর গাড়ির মধ্যে বসে থাকা অবস্থায় তাঁর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতদেহ সেখানে কয়েক ঘন্টা পড়েছিল। অঞ্চলটি আমেদাবাদের খুব ব্যস্ত এলাকা হলেও ঘটনার কোনও সাক্ষী পাওয়া যায়নি। হত্যার কয়েকদিন আগেই তাঁর নিরাপত্তারক্ষীদের তুলে নেওয়া হয়েছিল। মাত্র দুদিন আগে ল গার্ডেনের পাশের রাস্তায় বসা হকারদের উৎখাত করা হয়েছিল
পূর্ব-প্রসঙ্গ: দাঙ্গা নিয়ে বিজেপির মধ্যে বিতর্ক
গুজরাতের তদানীন্তন রাজস্বমন্ত্রী[1] এবং প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী[2] হরেন পান্ড্য গুজরাত গণহত্যার কলকাঠি কারা নেড়েছিল সে-কথা কোর্টকে জানাতে তৈরি ছিলেন। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ রহস্যজনকভাবে গাড়ির মধ্যে বসে থাকা অবস্থায় তাঁর গুলিতে খুন হওয়া মৃতদেহ পাওয়া যায়।[3]
২০০২ সালে মোদি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন গুজরাত-বিজেপির যে তিনজন নেতা মোদির স্বৈরাচারী কাজকর্মের বিরোধিতা করেছেন তাঁদের প্রথমজন হলেন হরেন পান্ড্য, গুজরাতের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দ্বিতীয়জন সঞ্জয় জোশি,[4] জাতীয় দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। তৃতীয়জন হলেন গোর্ধন জাডাফিয়া।[5]
এদের মধ্যে হরেন পান্ড্যই ছিলেন মোদির সবচেয়ে বড় কাঁটা। আরএসএসে তাঁর খুব কদর ছিল, সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে ছিল ভাল যোগাযোগ। ২০০১ সালে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি ভোটে দাঁড়িয়ে জিতে আসার জন্য পান্ড্যর বিধানসভা আসন আমেদাবাদের এলিস ব্রিজ বেছে নিয়েছিলেন। বিজেপির পক্ষে তা নিরাপদ আসন হলেও মোদির ইচ্ছায় হরেন সায় দেননি। এ নিয়ে মোদির সঙ্গে তাঁর প্রকাশ্যে ঝগড়া হয়। তাঁর বক্তব্য ছিল, বিজেপির কোনও তরুণের জন্য আমার আসন ছেড়ে দিতে রাজি আছি, তবে ওই লোকটার জন্য নয়।
দাঙ্গা শুরু হওয়ার তিন মাস পর, ২০০২ সালের মে মাসে[6] সিসিটি (কনসার্নড সিটিজেন্স ট্রাইবুনাল) প্যানেলে হরেন গোপন সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। তার কয়েকদিন পর মোদির প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিকে মিশ্র রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেলকে পান্ড্যর গতিবিধিতে নজর রাখতে নির্দেশ দিলেন, বিশেষ করে সিসিটির সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে।
ওদিকে মোদি হরেনের বিরুদ্ধে পার্টিতে অনিয়মের অভিযোগ আনলেন। দু-মাস পরে হরেন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন। ডিসেম্বর মাসে ছিল রাজ্য বিধানসভা নির্বাচন। পনেরো বছর ধরে পান্ড্য যে আসনের প্রতিনিধিত্ব করছেন সেখান থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হল। মোদি জানতেন হরেনকে এলিস ব্রিজ বিধানসভা আসন থেকে সরিয়ে দিলে তাঁর ক্ষমতা কমে যাবে। আরএসএস এবং বিজেপি নেতৃত্ব মোদিকে ওই কাজের সিদ্ধান্ত বদলাতে বললেও তিনি অনড় রইলেন। নভেম্বরের শেষে আরএসএস নেতা মদনদাস দেবী মোদির বাংলোয় গিয়ে অই সংগঠনের প্রধান কেএস সুদর্শন, উপপ্রধান মোহন ভাগবত, বিজেপি নেতা এলকে আদবানি এবং অটলবিহারী বাজপেয়ির বার্তা দিলেন: ঝগড়া করবেন না, নির্বাচনের আগে বিভাজন তৈরি করবেন না, হরেনকে তাঁর আসন ফিরিয়ে দিন। দেবী অনেক রাত পর্যন্ত সেখানে থাকলেও মোদিকে টলাতে পারলেন না।
মোদি জানতেন, আরএসএস-এর নাগপুর হেডকোয়ার্টার এবং দিল্লি থেকে এবার তাঁর কাছে ফোন আসবে। তাই রাত তিনটের সময় ক্লান্তি ও অবসাদের অজুহাতে গান্ধিনগর সিভিল হাসপাতালে ভর্তি হলেন। আরএসএস ও বিজেপির নেতারা হাল ছাড়তে বাধ্য হলেন। দুদিন পর হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে দলে যোগ দেওয়া নতুন একজনকে হরেনের আসন উপহার দিলেন। এরপর ডিসেম্বরে গোধরা-পরবর্তী সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের ঢেউয়ে চেপে নির্বাচনে জিতে মোদি আবার ক্ষমতায় এলেন।
২০০২ সালের মে মাসে গুজরাত দাঙ্গা নিয়ে সিসিটি প্যানেলে বিচারপতি পিবি সায়ন্ত এবং হসবেত সুরেশ, মানবাধিকার কর্মী কেজি কান্নাবিরন এবং তিস্তা শেতলওয়াড়ের সামনে, আমেদাবাদে হরেন গোপন সাক্ষ্য দিতে এসেছিলেন। তাঁকে প্রশ্ন করা হয়, তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র এলিস ব্রিজের অন্তর্গত পালডিতে দাঙ্গার সময়ে উন্মত্ত জনতার ভিড়ে তাঁকে দেখা গিয়েছিল। তিনি তাদের থামাননি কেন?
পান্ড্য বলেন, জনতা ক্ষিপ্ত ছিল, মানুষের প্রাণ না নিয়ে সম্পত্তি ধংসের মধ্যেই যেন তাদের রাগ সীমিত থাকে সেই চেষ্টা করেছি। সেদিনের অবস্থা, জনতার উন্মত্ততার কথা মনে রাখতে হবে। তা শুধু সম্প্রদায়গত উত্তেজিত প্রতিক্রিয়াই ছিল না, পুলিশও সব দেখেশুনে নিষ্ক্রিয় ছিল, উপরমহলের সেইরকমই নির্দেশ ছিল।
সিসিটি প্যানেলকে হরেন জানান, ক্যাবিনেটের কয়েকজন মন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রীর অফিস ও সচিবালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অফিসাররা, পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল, আমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার এবং অন্যান্যদের উপস্থিতিতে এক মিটিঙে মোদি পুলিশকে বলেছিলেন যে, ২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরা কাণ্ডের পরের দিন রাস্তায় হিন্দুদের ক্রোধের প্রকাশ দেখা যাবে, সেই ক্রোধ প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে, অর্থাৎ জঙ্গি হিন্দুদের হিংসা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এইভাবে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ডাকা বনধের দিন মোদি গোধরার ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক হিংসা শুধু গুজরাত সরকারের পঙ্গুত্বের জন্যই দেখা দেয়নি, জেনেবুঝে হিংসা, খুন, ধর্ষণে বাধা দেওয়া হয়নি। ওই নিষ্ঠুর, মানববিদ্বেষী হিংসা তাঁকে অস্থির করে তুলেছিল। তিনি কখনওই প্রতিশোধ, খুন, ধর্ষণের পক্ষে ছিলেন না। উদাহরণ হিসাবে জানান, সেদিনই তাঁর সিকিউরিটিকে নিয়ে এক মুসলমান ধর্মগুরুকে সরসপুর থেকে বম্বে যাওয়ার জন্য তিনি বিমানবন্দরে ছেড়ে এসেছিলেন। বলেন, বিষয়টার নিষ্পত্তি গোধরাতেই হতে পারত, তাতে হয়তো শ-খানেক মানুষের মৃত্যু হত। কিন্তু মোদি দাঙ্গা বয়ে নিয়ে এলেন আমেদাবাদে, গোটা রাজ্যে।
আউটলুক ম্যাগাজিনকেও (৩ জুন, ২০০২) হরেন বলেছিলেন: দাঙ্গার আগের দিন (২৭ ফেব্রুয়ারি) রাতে মুখ্যমন্ত্রী তাঁর সরকারি বাংলোয় পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসার ও আমলাদের বলেছিলেন, মানুষের হতাশা প্রকাশ করতে দিতে হবে এবং হিন্দু প্রতিক্রিয়ার মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়ানো চলবে না।
সেই মিটিঙে একসময় ডিরেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ কে চক্রবর্তী তীব্র আপত্তি জানান। মোদি তাঁকে কঠোরভাবে থামিয়ে তাঁর নির্দেশ মেনে চলতে বলেন। মিটিংটি ছিল মোদির সাধারণ মিটিঙের মতোই, আলোচনার চেয়ে নির্দেশ বেশি। তিনি নিশ্চিত করেন যে, পুলিশ সঙ্ঘ পরিবারের লোকদের ছোঁবে না। সেই খবর তাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
আউটলুক পত্রিকার অভিযোগ নিয়ে ঝড় ওঠে। সেই প্রথম নরেন্দ্র মোদিকে দাঙ্গার জন্য প্রকাশ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। গুজরাত সরকার আউটলুকের প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, ২৭ ফেব্রুয়ারি মোদির বাড়িতে কোনও মিটিং হয়নি। আউটলুক হরেনের নাম প্রকাশ করেনি। নাম প্রকাশ করা যাবে না— এই শর্তেই হরেন কথা বলেছিলেন। সরকার তারপরও সন্দেহ করেছিল রিপোর্টে যে অজ্ঞাত মন্ত্রীর কথা বলা হয়েছে তিনি হরেন পান্ড্য।
হরেন আউটলুকের সঙ্গে আরেকবার কথা বলেন। এবার তারা কথোপকথন রেকর্ড করে রাখে। তিনি বলেন, তাঁর পরিচিতি যেন প্রকাশ না করা হয়। লিখিত তো নয়ই মুখেও নয়, মন্ত্রী বা বিজেপি নেতা বলেও উল্লেখ নয়। তাঁর ভয় ছিল বিজেপি নেতা বা মন্ত্রী বলে উল্লেখ করা হলেও তিনি খুন হয়ে যাবেন। হরেন বলেন, যে অফিসাররা সেই মিটিঙে উপস্থিত ছিলেন বলে জানিয়েছি, তাঁদের বলুন তা অস্বীকার করতে। তাঁরা বলুন কোনও মিটিং হয়নি, সরাসরি বা পরোক্ষভাবে কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি, কাগজে-কলমে লিখে সই করুন। আমি আপনাদের যা বলেছি তা কোনও হতাশ মানুষের কথা নয়, ক্ষুব্ধ বলে তা বলিনি। আমার মতো জায়গায় কেউ নেই যে মোদির বিরুদ্ধে লড়তে পারে, বাইরের লোক কিছু করতে পারবে না। তাই ভিতরে থাকা, ক্ষমতায় থাকা, জায়গামতো থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণেই পরিচয় গোপন রাখতে চাই। সাক্ষাৎকার শেষে তিনি সাংবাদিককে বলেন, হিংসা সবে শেষ হয়েছে, কিন্তু আবার তা শুরু হতে পারে। মোদির লোকদের সঙ্গে যখন দেখা হবে সাবধান থাকবেন। এরা কিন্তু আপনার কাছ থেকে আমার নাম বার করে নিতে চাইবে, সাবধান!
কানাঘুষো চলছিলই যে গণহতার দিন সন্ধ্যায় ডাকা মিটিঙে মোদি পুলিশের শীর্ষকর্তাদের হিন্দুদের হতাশা প্রকাশে বাধা না দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবার আউটলুক জানাল সেই কানাঘুষো বাস্তব। সিসিটির প্যানেল-সদস্য প্রাক্তন বিচারপতি হসবেত সুরেশ আউটলুককে বলেছিলেন: ক্যাবিনেটের সহকর্মী মোদি সম্বন্ধে মর্মান্তিক বক্তব্য রেখেছেন। হ্যাঁ, প্রবীণ মন্ত্রী আমাদের সামনে ৩৫-৪০ মিনিট ছিলেন, তিনি এমন কতগুলো বিষয় নিয়ে কথা বলেছিলেন যার জন্য গুজরাত গণহত্যা হয়েছিল। অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে তিনি ২৭ ফেব্রুয়ারি রাতে মোদির মিটিঙের কথাও বলেছিলেন। বলেছিলেন, ২৮ ফেব্রুয়ারি, দাঙ্গার দিন, দুই ক্যাবিনেট মন্ত্রী পুলিশের কন্ট্রোল রুমে উপস্থিত ছিলেন। কন্ট্রোল রুম সেদিন তাঁদের দায়িত্ব ও তত্ত্বাবধানেই ছিল।[7] হরেনের শর্ত ছিল ট্রাইবুনালের চূড়ান্ত রিপোর্টে তাঁর নাম উল্লেখ করা যাবে না।
হরেন আউটলুককে বলেছিলেন: মোদি যেহেতু দাঙ্গা শুরু করেছিলেন তাই নিশ্চিন্ত ছিলেন কয়েক দিনের মধ্যে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে হিংসার মাত্রা ও তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। মোদি কখনওই রাজনীতিবিদ ছিলেন না। ছিলেন আরএসএসের এমন প্রচারক যার দিন গোনা শুরু হয়েছিল। কারণ তিনি ভাল জীবন পছন্দ করতেন, থাকতেন রাজার মতো, অন্য প্রচারকরা যা ছিলেন না। তাই লোকে তাঁকে খুব বেশি পছন্দ করত না। এইসময় পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরাজয় হলে বিজেপি চিন্তায় পড়ল। তারপর যখন সবরমতি বিধানসভা কেন্দ্রে এবং সবর্নকান্ত লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি হারল, বোঝা গেল সাধারণ নির্বাচনে তাদের দিন শেষ। এই সময়েই মোদির রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ। তিনি বিজেপি হাইকমান্ডকে বলেন, কেশুভাই পটেলের চেয়ে তিনি অনেক বেশি উপস্থাপনযোগ্য। কথা দিলেন আগামী নির্বাচনে বিজেপিকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবেন। সাড়ে পাঁচ মাস কাজ করার পর মোদি বুঝেছিলেন যে তাঁর আকর্ষণ কাজ করছে না। তখনই ভাবলেন, তাঁকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় হতে পারে ধর্মীয় বিভাজন। গোধরার ঘটনা তার ঘোড়া (ট্রিগার) হলেও অন্য কোনও কিছুও তা হতে পারত। পরিকল্পনা চলছিল পার্টি যে গরুহত্যার ভিডিও তৈরি করেছিল তা প্রচার করা হবে। শেষে ওই পরিকল্পনা বাতিল করা হয়।
তাঁর কথায়: পার্টিকর্মীদের মোদি যেভাবে বলি দেন সেটাতেই তাঁর সবচেয়ে খারাপ লাগে। রাজ্যে হিন্দুজাগরণের কৃতিত্ব পুরোপুরি আত্মসাৎ করার পর যখন তাঁর উপর ঠান্ডা থাকার চাপ এল তিনি পার্টিকর্মীদের গ্রেফতার করে গণহত্যাকাণ্ডে ভারসাম্য তৈরি করার চেষ্টা করলেন। প্রায় নশো এফআইআর করা হয়েছে, সাড়ে তিন হাজার লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে। পার্টির নিচের তলার কর্মীরা নেতাদের বলছেন, তাঁদের কেন গ্রেপ্তার করা হল?
হরেন আরও বলেন: কোনও পার্টিই একজনের হয় না, ইতিহাস সে-কথাই বলে। সম্প্রতি বিজেপির বড় নেতাদের এক মিটিং হয়েছিল। মোদিকে সেখানে ডাকা হয়নি, অথচ খুব ভিড় হয়েছিল, খুব সফল মিটিং হয়েছিল। কোনও বক্তা মোদির নাম উল্লেখও করেননি।
হরেন যে ট্রাইবুনালে (সিসিটি) যেতে পারেন তা কেউ ভাবেনি। ট্রাইবুনাল কোনও সাংবিধানিক সংস্থা নয়। কাউকে ডাকলেই সেখানে যেতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা ছিল না। কিন্তু হরেন আমেদাবাদের ‘প্রশান্ত’ বিল্ডিঙে সিসিটি প্যানেলের সামনে গেলেন। আউটলুক লেখে: মোদিকে বলা হত ‘ছোটা সর্দার’, ট্রাইবুনালের রিপোর্ট বেরোলে তিনি আরও ছোট হয়ে যেতে পারতেন। সেইসময়ে বিচারপতি হসবেত সুরেশ বলেছিলেন, আমাদের রিপোর্ট মানুষকে শুধু তথ্য জানার অধিকার দেবে। তারা জানবে সত্যি কী হয়েছিল। তার মানে এই নয় যে অপরাধীর শাস্তি হবে।
হরেনের ওই সাক্ষ্যের কথা সরকারের কানে গিয়েছিল। তিনি ট্রাইবুনালে আসার এক মাস পর, জুন মাসে তা আউটলুকে প্রকাশিত হলে তাঁর বিরুদ্ধে পার্টিবিরোধী কাজের অভিযোগ আনা হয়। জুলাই মাসে তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করা হয়। আদবানি ও জেটলির চাপেও তাঁকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি। সেই বছর ডিসেম্বর মাসে বিধানসভা নির্বাচনে তাঁকে প্রার্থীই করা হয়নি। ভোটে জিতে মোদি ফের যখন ক্ষমতায় এলেন হরেন একেবারে কোনঠাসা। ল গার্ডেনে প্রাতঃভ্রমণ এবং গলফ খেলা ছাড়া করার মতো তেমন কাজ নেই।
তিনি দিল্লি ও নাগপুরে গিয়ে বিজেপি এবং আরএসএস নেতাদের বলেন, নিজের লাভের জন্য মোদি পার্টি এবং সঙ্ঘকে শেষ করে দেবে। বিজেপির বড় নেতারা মনে করতেন পার্টির জন্য হরেন অতি মূল্যবান। তাঁরা ঠিক করলেন তাঁকে দিল্লির হেডকোয়ার্টারে জাতীয় একজিকিউটিভ কমিটির সদস্য অথবা দলের মুখপাত্র করে আনা হবে। মোদি জানতেন, হরেনের দিল্লি যাওয়া তাঁর ভবিষ্যতের পক্ষে ক্ষতিকর হবে। তবে তাঁকে আটকানোর চেষ্টা করেও পেরে উঠলেন না। ২০০৩ সালের মার্চ মাসে ফ্যাক্সের মাধ্যমে পার্টির জাতীয় সভাপতির কাছ থেকে তিনি দিল্লিতে আসার নির্দেশ পেলেন।
২৬ মার্চ তিনি রহস্যজনকভাবে খুন হয়ে গেলেন। ল গার্ডেনে প্রাতঃভ্রমণের পর গাড়ির মধ্যে বসে থাকা অবস্থায় তাঁর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতদেহ সেখানে কয়েক ঘন্টা পড়েছিল। অঞ্চলটি আমেদাবাদের খুব ব্যস্ত এলাকা হলেও ঘটনার কোনও সাক্ষী পাওয়া যায়নি। হত্যার কয়েকদিন আগেই তাঁর নিরাপত্তারক্ষীদের তুলে নেওয়া হয়েছিল। মাত্র দুদিন আগে ল গার্ডেনের পাশের রাস্তায় বসা হকারদের উৎখাত করা হয়েছিল।
হত্যার তদন্ত চালাচ্ছিল গুজরাত পুলিশের অপরাধ দমন শাখা। সেই দলের প্রধান ছিলেন ডিজি বানজারা। পরে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ওই মামলা সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হলেও তদন্তে সাহায্য করার জন্য বানজারার সহকর্মী অভয় ছুদাসামাকে অস্থায়ীভাবে সিবিআই-এ পাঠানো হয়েছিল।[8] সিবিআই ২০০৩-এর মার্চের শেষে তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে এপ্রিল থেকে জুন মাসের মধ্যে ১৫ জনকে সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধ আইনে (২০০২) গ্রেফতার করে। ডিসেম্বর মাসে সিবিআইয়ের বিশেষ কোর্টে পান্ড্যহত্যার চার্জ গঠন করা হয়। গুজরাতের পুলিশ এবং সিবিআই জানায়, পাকিস্তানের আইএসআই, লস্কর-ই-তৈবা এবং আন্ডারওয়ার্ল্ড ডন দাউদ ইব্রাহিম যৌথভাবে হরেনকে হত্যা করেছে।
আদালতে সিবিআই জানিয়েছিল, গুজরাত দাঙ্গায় হরেন পান্ড্যর ভূমিকার প্রতিশোধ নিতে ধর্মগুরু মুফতি সুফিয়ানের নির্দেশে মুসলমান সন্ত্রাসবাদীরা হরেনকে হত্যা করেছে। এদের মধ্যে আসগর আলিই গুলি চালিয়েছিল। সিবিআই দাবি করে, হরেনকে হত্যার জন্য ওই ধর্মগুরু যাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তারা গ্রেফতার হওয়ার আগেই তিনি পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আদালতে বিচার চলাকালীন দেখা যায় ফরিয়াদি বা প্রসিকিউটর যে যুক্তি দিচ্ছেন এবং সাক্ষ্যপ্রমাণ হিসাবে যা পেশ করা হয়েছে তার মধ্যে মিল নেই। তারপরও সিবিআই আদালত, ২০০৭ সালের ২৫ জুন, হেফাজতে থাকা আসামিদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিরোধ আইনে গ্রেফতার করা ১৫ জনের মধ্যে ১২ জনকে হরেন পান্ড্য হত্যায় দোষী হিসাবে ঘোষণা করে।
এরপর ২০১১ সালে গুজরাত হাইকোর্ট ধৃতদের মুক্তি দিয়ে জানায়: সিবিআইয়ের মামলাটিতে অসঙ্গতি রয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ভিত্তিহীন ছাইপাঁশ। চোখে ঠুলি লাগিয়ে যে তালগোল পাকানো তদন্ত করা হয়েছে তার জন্য তদন্তকারী অফিসার দায়ী। তাঁর অযোগ্যতার জন্য এই অবিচার, সংশ্লিষ্ট অনেক মানুষের বিপুল হয়রানি এবং সরকারি সম্পদ ও কোর্টের সময়ের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। কটি গুলি লেগেছে, কটি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, কতজন আততায়ী ছিল, ঠিক কোথায় খুন করা হয়েছিল তাও সিবিআই সঠিকভাবে জানায়নি। ওই তদন্তকে দায়ী করে হাইকোর্ট আরও বলে, কোনও হত্যার বিচারপ্রার্থীকে দোষী করার জন্য পুলিশের হেফাজতে রেখে স্বীকারোক্তির উপর ভরসা করা যায় না। আদালত তদন্তকারীকে এইভাবে ভর্ৎসনা করার পর সিবিআই-এর তদন্তের মূল দায়িত্বে ছিলেন যে আইপিএস অফিসার (ওয়াইসি মোদি), ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁকে কেন্দ্রের মোদি সরকার দেশের সেরা সন্ত্রাস-দমন সংস্থা ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সিতে অধিকর্তা হিসাবে নিযুক্ত করে।
হাইকোর্টের রায়ের পরে টাইমস অফ ইন্ডিয়া রিপোর্ট করে, যে বন্দুকটি হরেন পান্ড্যকে হত্যায় ব্যবহার করা হয়েছিল তা পাওয়া গেছে যেখানে সোহরাবুদ্দিনের বাড়ি সেই উদয়পুর অঞ্চল থেকে। সিবিআই কিন্তু বলেছিল, তা আমেদাবাদ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। হরেনের শরীরে যে গুলি পাওয়া গেছে তা হত্যা করার জন্য যে অস্ত্রটির কথা বলা হয়েছে তার সঙ্গে মেলেনি। তাই আদালত মনে করে, হত্যাকারীর ব্যবহার করা অস্ত্র হিসাবে যে অস্ত্রটি পেশ করা হয়েছে, তা হত্যার জন্য ব্যবহারই করা হয়নি। এইসব কারণে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়। চার্জশিটে নাম থাকলেও সিবিআই মন্ত্রী অমিত শাহের বিরুদ্ধে কেন পদক্ষেপ করেনি তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছিল।
সিবিআই তদন্ত শুরু করার আগে যিনি ওই হত্যার তদন্ত করছিলেন গুজরাতের যে পুলিশ অফিসার, সেই ওয়াই এ শেখের রেকর্ড করা কথোপকথন ২০১৬ সালে সাংবাদিক রাণা আয়ুবের বই ‘গুজরাত ফাইলস— অ্যানাটমি অফ কভার আপ’-এ প্রকাশিত হয়। শেখ জানান, অল্প কয়েকদিনের তদন্তের পর রাজ্য পুলিশ যা বলেছিল সিবিআই আদালতে তাই জানিয়েছে, উপযুক্ত তদন্ত করেনি। তিনি একাধিকবার জানান যে, ওই খুন হল রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র। রাজনীতিবিদ ও বানজারার মতো পুলিশ অফিসার ওই বিজেপি নেতার হত্যার সঙ্গে জড়িত। ২০১৯ সালে ‘দ্য ওয়ার’কে ওই পুলিশ অফিসার বলেন, আমি এখন নিশ্চিত যে ফের তদন্ত করে দেখা উচিত।
হরেনের বাবা বিঠলভাই পাণ্ড্য ২০০৬ সালের ডিসেম্বর মাসে এক আবেদনপত্রে সিবিআইয়ের বিশেষ আদালতে দাবি করেন, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র করেই তাঁর পুত্রকে হত্যা করা হয়েছে এবং সিবিআই তদন্তে অন্তর্ঘাত করেছে। তিনি বলেন, হরেনের স্ত্রী জাগ্রুতি পান্ড্যকে ইচ্ছে করেই সাক্ষ্য হিসাবে ডাকা হয়নি। তাই তিনি নতুন করে তদন্ত দাবি করেন। আদালত তাঁর আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। ২০০৭ সালে একই আবেদন করে ফের প্রত্যাখ্যাত হয়। তিনি সরাসরি মোদিকে অভিযুক্ত করে বলেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত করতে হবে। মোদিই তাঁর ছেলেকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন, এই কথা জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে তাঁর ফের তদন্তের আবেদন যথাযথ কারণ ও প্রমাণের অভাবে বাতিল হয়ে যায়।
এরপরও ২০০৮ এবং ২০০৯ সালে বিঠলভাইয়ের নতুন করে তদন্তের আবেদন নানা আদালত বাতিল করে। ২০১২ সালে জাগ্রুতি পান্ড্যর পুনর্তদন্তের আবেদন হাইকোর্ট বাতিল করে। হাইকোর্টে সিবিআই তিরষ্কৃত হওয়ার পর শত আবেদনেও তাদের দিয়ে নতুন করে তদন্তে করানো যায়নি। বিজেপি নেতা সুরেশ পটেল, গোর্ধন জাডাফিয়া এবং জনক পারমারও বরাবর বলেছেন আসল অপরাধীকে ধরাই হয়নি।
Reference:
- Jose, Vinod K. The Emperor Uncrowned: The rise of Narendra Modi. The Caravan. Mar 1, 2012.
- Ayuub, Rana. Gujarat Files: Anatomy of a Cover Up.
- Nag, Kingshuk. What did Modi say at the Feb 27, 2002, meeting? TOI. Apr 25, 2011.
- Jaleel, Syed Imtiaz. & Bhan, Rohit. Gujarat Riots: Former Supreme Court judge says SIT findings incorrect. NDTV. May 12, 2012.
- Mystery over Haren Pandya killing deepens after witness says top Gujarat cop gave order. The Wire. Nov 5, 2018.
- Explainer: Why there is a plea seeking re-investigation of Haren Pandya’s murder. The Wire. Feb 11, 2019.
- Setalvad, Teesta. A murder most foul: How Haren Pandya was silenced. Sabrang. Jul 5, 2019.
- A midnight meeting on Feb 27 and a murdered minister. Outlook. Updated Feb 5, 2022.
[পরের পর্ব- বিচারবহির্ভূত হত্যা, অমিত শাহ-যোগ]
[1] অক্টোবর ২০০১ থেকে আগস্ট ২০০২।
[2] মার্চ ১৯৯৮ থেকে অক্টোবর ২০০১।
[3] তাঁর শরীরে একাধিক গুলি লেগেছিল, কিন্তু একটি গুলি এমন জায়গা দিয়ে শরীরের উপরের দিকে গিয়েছিল, গাড়িতে বসে থাকা অবস্থায় যা কোনওভাবেই সম্ভব নয়। তাছাড়া যতটা রক্তপাত হওয়ার কথা তাও হয়নি। ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা অবস্থায় মৃতদেহ পাওয়া গেলেও গাড়িতে কোনও গুলির চিহ্ন ছিল না।
[4] বিজেপির এই ক্ষমতাশালী নেতা ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তার আগে ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি গুজরাত বিজেপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মোদি মনে করতেন মূলত সঞ্জয়ের বিরোধিতাতেই তাঁকে দিল্লিতে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নিয়ে গুজরাত থেকে চলে যেতে হয়েছিল।
[5] জাডাফিয়া ১৫ বছর ধরে ভিএইচপি-র নেতা থাকার পর নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় বিজেপিতে যোগ দিয়ে দলের রাজ্য সভাপতি হয়েছিলেন। ২০০১ সাল থেকে ২০০২-এ দাঙ্গার সময়েও জাডাফিয়া ছিলেন গুজরাতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী। তিনি মোদির মতোই দাঙ্গায় জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ।
জাডাফিয়া সাংবাদিক জোসকে বলেছিলেন, আমি বলি না মোদির ইচ্ছাতেই হরেন পান্ড্যকে হত্যা করা হয়েছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। কিন্তু তারপরও সত্যি কথাটা হল, বিজেপির ভিতরে যে-ই মোদির বিরুদ্ধে কথা বলে সে-ই হয় শারীরিক অথবা রাজনৈতিকভাবে শেষ হয়ে যায়।
২০০৫-এর ফেব্রুয়ারির মাসে জাডাফিয়া লক্ষ করেন রাজ্য পুলিশের এক গোয়েন্দা তাঁকে অনুসরণ করছে। তাঁর মুখোমুখি হলে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অফিস থেকে তাঁকে ছায়ার মতো অনুসরণ করার নির্দেশ এসেছে। এর কয়েকদিন পর বিজেপি বিধায়কদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মিটিং ছিল। মিটিং-এ তিনি মোদিকে বলেন, নরেন্দ্রভাই, নিজের পার্টির বিধায়কদের বিরুদ্ধে আপনি গোয়েন্দাগিরি চালাতে চান কেন? গোয়েন্দারা আমায় কেন অনুসরণ করছে? এই অবস্থায় এক প্রবীণ মন্ত্রী, বাজুভাই বালা মাইক্রোফোন টেনে নিয়ে বলেন, গোর্ধনভাই, ঠান্ডা হোন, এখন এই প্রশ্ন করার সময় নয়, আমরা বিষয়টা দেখব। মোদি নিজে একটা কথা না বললেও একটু পরে তাঁর সচিবের কাছ থেকে জাডাফিয়া একটি নোট পান, “প্লিজ মিট দ্য সিএম।”
মিটিঙের পর মোদির চেম্বারে গিয়ে দেখেন উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী (অমিত শাহ) সেখানে রয়েছেন। মোদি তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, সবার সামনে এই ধরনের প্রশ্ন কেন করলেন? তিনি বলেন, করবটা কী? এটা কোনও গোপন বিষয়ও নয়। মোদি কড়া চোখে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, খতম হো জাওগে গোর্ধনভাই। জাডাফিয়া জিজ্ঞেস করেন, কী ধরনের শেষ হয়ে যাওয়ার কথা বলছেন, শারীরিক না রাজনৈতিকভাবে? মোদি বলেন, তুমি দিল্লিতে এলকে আদবানি, এলকে মাথুরের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছ। তিনি বলেন, অবশ্যই, দিল্লিতে অভিযোগ করা ছাড়া আমার কোনও বিকল্প ছিল না। কিন্তু আপনি যে বলছেন, আমাকে শেষ করে দেবেন, জেনে রাখুন সময় এলে আমি মরব, কিন্তু আমাকে আর কখনও ভয় দেখানোর চেষ্টা করবেন না। তারপর থেকে জাডাফিয়া জনা বারো পুলিশ রক্ষী নিয়ে ঘুরতেন।
অভিযোগ, তিনি সক্রিয়ভাবে গুজরাত দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ-ঘনিষ্ঠ পুলিশ অফিসারদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গার পোস্টিং দিয়েছিলেন। ২০০২ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর মোদি তাঁকে মন্ত্রিসভা থেকে ছেঁটে ফেলেন। অনেকে মোদির ওই সিদ্ধান্ত বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের ভাঙন হিসাবে দেখেছিলেন।
[6] ওই মাসে গুজরাতের স্থানীয় সাংবাদিকদের মধ্যে প্রথম খবর ছড়ায় যে মোদি অবিবাহিত নন। গান্ধিনগরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সাংবাদিক দর্শন দেশাই জানান, মোদির স্ত্রী ভাদনগরের কাছে ব্রহ্মানন্দ গ্রামে থাকেন। একদিন সকালে তিনি সেই গ্রামে গিয়ে মোদির স্ত্রী যশোদাবেন, তাঁর দাদা এবং যে প্রাইমারি স্কুলে যশোদাবেন পড়ান তার হেডমাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। তবে প্রতিফলের ভয়ে কেউই সাক্ষাৎকার দেননি। স্থানীয় বিজেপির সমর্থকরা দর্শনকে বলে, তিনি যেন সেখান থেকে চলে যান, তাঁর প্রশ্ন তাদের পছন্দ হচ্ছে না।
সাংবাদিক জোসকে দর্শন বলেছেন, মনে আছে, আমি যখন বাড়িতে ঢুকে জুতো খুলছি সেলফোন বেজে উঠল। ফোনের ওপার থেকে কেউ গুজরাতিতে বললেন, মুখ্যমন্ত্রী আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। মোদি লাইনে এসে নমস্কার জানিয়ে বললেন, তাহলে আপনার অ্যাজেন্ডা কী? দর্শন বলেন, কী বললেন বুঝলাম না। মোদি বলেন, আপনি আমার বিরুদ্ধে লিখেছেন, আপনার পত্রিকা ‘মোদি মিটার’ শুরু করেছে (দাঙ্গার সময় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের একটা কলাম বা স্তম্ভের ওই নাম ছিল)। আমি চুপ করে থাকলাম। বললেন, আমি জানি আজ আপনি কীসের জন্য গিয়েছিলেন। আজ যা করেছেন তা সীমা পেরিয়ে গেছে, সে-কারণেই জানতে চাই আপনার অ্যাজেন্ডা কী? দর্শন বলেন, আমি ভয় পাইনি, তবে কিছুটা নার্ভাস হয়েছিলাম। তিনি বলেন, আমার কোনও অ্যাজেন্ডা নেই, আমার এডিটরের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। মোদি বলেন, ঠিক আছে, এটা নিয়ে ভাবুন— বলে ফোন কেটে দেন।
[7] পরবর্তীকালে পুলিশসূত্রে ওই দুই মন্ত্রী অশোক ভাট এবং আইকে জাদেজার নাম বারবার উচ্চারিত হয়েছে।
[8] পুলিশের ডিআইজি ডিজি বানজারা মোদিকে বলতেন ‘আমার ভগবান’। ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসে কুখ্যাত গ্যাংস্টার সোহরাবুদ্দিন শেখ ও তার স্ত্রীকে জাল এনকাউন্টার বা বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগে ২০০৭ সাল থেকে সাত বছর জেলে ছিলেন। একই বছর ডিসেম্বর মাসে পুলিশের হেফাজতে তুলসিরাম প্রজাপতির মৃত্যু হয়। গুজরাতের একটি পত্রিকা জানিয়েছিল, পান্ড্যর রাজনৈতিক হত্যার সঙ্গে যোগ ছিল বলেই সোহরাবুদ্দিনকে মেরে ফেলা হয়। ওদিকে সোহরাবুদ্দিন বিচারবহির্ভূত হত্যার মামলার তদন্তকারী আইপিএস অফিসার রজনিশ রাইকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক ২০১৮ সালে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করেছিল।
বানজারা জেলে থাকার সময়, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, গুজরাত সরকারের বিচারবহির্ভূত হত্যানীতির কথা চিঠিতে জানিয়েছিলেন। তিনি এও জানান যে, তুলসিরাম প্রজাপতির হত্যার সঙ্গে হরেন পান্ড্যর হত্যার যোগ রয়েছে। বানজারা ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিচারাধীন বন্দি হিসাবে জেল থেকে এক চিঠিতে লেখেন, তিনি ও অন্য অফিসাররা যারা সোহরাবুদ্দিন, তুলসিরাম, সাদিক জামাল ও ইসরাত জাহানের জাল এনকাউন্টার মামলায় অভিযুক্ত, তারা সরকারের সচেতন নীতি বাস্তবায়ন করেছে। সেই কারণে সরকারেরও জেলে যাওয়া উচিত। ২০১৭ সালে সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলা থেকে তিনি রেহাই পান, বাকি বিচারবহির্ভূত হত্যার মামলা থেকে ২০২০ সালে।
অভয় ছুদাসামাও সোহরাবুদ্দিন হত্যা মামলায় জেলে ছিলেন। পান্ড্য-হত্যার দায়িত্বপ্রাপ্ত দুর্নীতিগ্রস্ত বানজারা ও ছুদাসামা— দুজনেই মোদির উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সিন্ডিকেটের অংশীদার ছিলেন। অমিত শাহ জুলুমবাজির র্যাকেট ছাড়াও নিজে নানা হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তুলসিরাম প্রজাপতির হত্যার পরে ওই মামলার মুখ্য তদন্তকারী অফিসার (সিআইও) মুম্বাইয়ের সিবিআই আদালতে জানিয়েছিলেন, অমিত শাহ ও তিন আইপিএস অফিসার ওই হত্যার মূল চক্রান্তকারী। তুলসিরাম হত্যার অভিযোগে ২০১০ সালের ২৫ জুলাই মাসে অমিত শাহ গ্রেফতার হয়ে তিন মাস সবরমতি জেলে ছিলেন। পরে জামিন হলেও কোর্ট তাঁকে ২০১২ সাল পর্যন্ত গুজরাতে পা ফেলতে নিষেধ করেছিল। দীর্ঘকাল দিল্লির গুজরাত ভবনই ছিল তাঁর ঠিকানা।