অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়
১৭ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে, দেশজুড়ে বিভিন্ন বিধানসভা এলাকায় ইভিএম-পরীক্ষা চলাকালীন অভিযোগ আসে কেরলের কাসারগড় বিধানসভা অঞ্চলে পাঁচটি পরীক্ষিত ইভিএম-যন্ত্রের মধ্যে চারটির ক্ষেত্রেই যন্ত্রগুলিতে বিজেপি প্রার্থীর পক্ষে একটি করে অতিরিক্ত ভিভিপ্যাট-কাগজ জমা পড়েছে। অর্থাৎ মোট প্রদত্ত ভোটের সঙ্গে ইভিএম-যন্ত্রে প্রাপ্ত ভিভিপ্যাট-কাগজের সাংখ্যমান সমান নয়। তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, বেহিসেবি ভোটের ‘মত’ সবকটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্টভাবে কেন্দ্রীয় শাসক দলের ‘হেফাজতে’ জমা পড়েছে
সিএসডিএস-লোকনীতি সমীক্ষার বিষয়ে গত ১৪ তারিখের প্রবন্ধে লিখেছিলাম ২০১৯ সালের তুলনায় এবারের নির্বাচন পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনের প্রতিও সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমশ কমেছে, গণতন্ত্রের পক্ষে যা অতীব আশঙ্কার খবর। তারই মধ্যে ১৭ এপ্রিল ২০২৪ তারিখে, দেশজুড়ে বিভিন্ন বিধানসভা এলাকায় ইভিএম-পরীক্ষা চলাকালীন অভিযোগ আসে কেরলের কাসারগড় বিধানসভা অঞ্চলে পাঁচটি পরীক্ষিত ইভিএম-যন্ত্রের মধ্যে চারটির ক্ষেত্রেই যন্ত্রগুলিতে বিজেপি প্রার্থীর পক্ষে একটি করে অতিরিক্ত ভিভিপ্যাট-কাগজ জমা পড়েছে। অর্থাৎ মোট প্রদত্ত ভোটের সঙ্গে ইভিএম-যন্ত্রে প্রাপ্ত ভিভিপ্যাট-কাগজের সাংখ্যমান সমান নয়। তার চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, বেহিসেবি ভোটের ‘মত’ সবকটি ক্ষেত্রেই নির্দিষ্টভাবে কেন্দ্রীয় শাসক দলের ‘হেফাজতে’ জমা পড়েছে। স্বভাবতই, বেসরকারি ভোট-পর্যবেক্ষক সংস্থা অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মের তরফে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা একটি জনস্বার্থ মামলার শুনানি চলাকালীন, আইনজীবী ও অধিকারকর্মী প্রশান্ত ভূষণ বিষয়টিকে মামলাকারীর তরফে আদালতের গোচরে আনেন। এর পরবর্তীতে বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত ও সঞ্জীব খান্নার তরফে বিষয়টিকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খতিয়ে দেখতে নির্বাচন কমিশনকে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়। স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন সংগঠনের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে যে সর্বোচ্চ আস্থা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে বিচারপতিরা তাঁদের মন্তব্যে এ-কথাও কমিশনকে স্মরণ করিয়ে দেন। ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলগুলির তরফে স্বভাবতই এই প্রসঙ্গে গণতন্ত্র-হত্যার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে, এবং তাদের তরফে নিশ্চিতভাবে প্রতিটি ইভিএম-যন্ত্রের ১০০ শতাংশ ভিভিপ্যাট-স্লিপ গণনার দাবি জানানো হয়েছে।
আমরা কথায় কথায় যেখানে পাশ্চাত্য তথা প্রথম বিশ্বের দেশগুলির সঙ্গে নিজেদের তুলনা করে দেখতে ভালবাসি, আসুন দেখা যাক বরং সেই সমস্ত আধুনিক দেশগুলোয় নির্বাচনের নিয়ম কী? ২০০৯ সালের একটি সমতুল জনস্বার্থ মামলায় জার্মানির সাংবিধানিক আদালত তাদের বিশেষ রায়ে জানায়:
এর (ইভিএম-যন্ত্রের) মাধ্যমে প্রদত্ত ভোট বিশেষ এক বৈদ্যূতিন সংরক্ষণ যন্ত্রে বা ইলেকট্রনিক স্টোরেজ পদ্ধতিতে জমা রাখা হয়। ভোটার, ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত থাকা অন্যান্য সাধারণ মানুষ এমনকি সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আধিকারিকেরা অবধি প্রদত্ত ভোট ও সংরক্ষিত ভোটের ভিতরে কোনও গরমিল থেকে গেল কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। ইলেকট্রনিক যন্ত্রের সাহায্যে কেবল প্রদত্ত ভোটের সংখ্যার হিসেব সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।…[1]
সংশ্লিষ্ট আদালত তার পর্যবেক্ষণে আরও জানায়, “ইভিএম-যন্ত্র থেকে কিভাবে ধাপে ধাপে গণনা-প্রক্রিয়াটিও সঠিকভাবে সম্পন্ন হল, সেই বিষয়ে সাধারণ মানুষ কিছুই জানতে পারেন না।” ফলাফল ঘোষণার ক্ষেত্রে এতখানি অসামঞ্জস্যতা থেকে যাওয়ার যে সম্ভাবনা তা অত্যন্ত আশঙ্কার ও একেবারেই নির্ভরযোগ্য নয় বলে আদালতের তরফে মতপ্রকাশ করা হয়। এই রায়ের পরেপরেই সমগ্র ইউরোপে ইভিএম-যন্ত্রের সাহায্যে ভোটগ্রহণ অসাংবিধানিক বলে ঘোষিত হয় এবং তারই সঙ্গে সমগ্র মহাদেশেই ব্যালট-কাগজের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ-ব্যবস্থার প্রত্যাবর্তন ঘটে।
স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচনের ক্ষেত্রে ভোট-প্রক্রিয়ার বিষয়ে যে কয়েকটি পূর্ব-শর্ত আন্তর্জাতিক মহলে ইতিমধ্যেই স্বীকৃতি পেয়ে এসেছে, সেগুলির দিকেই বরং চোখ ফেরানো যাক। পাঁচটি প্রধান শর্ত বলছে:
- স্বচ্ছ ভোটদান প্রক্রিয়ার অর্থ হল, তাঁদের ভোট যে সঠিকভাবে গৃহীত ও নিবন্ধীকৃত হয়েছে— প্রত্যেক সাধারণ মানুষ সেই বিষয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হবেন।
- ভোটগ্রহণ ও তারই সঙ্গে গণনা-প্রক্রিয়াটি যে-কোনও সাধারণ নাগরিকের দ্বারা পুনর্মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে।
- ভোটগ্রহণের প্রতিটি ধাপ প্রত্যেক সাধারণ মানুষ হৃদয়ঙ্গম করতে পারবেন।
- ভোটগ্রহণ ও গণনা-পদ্ধতির প্রতিটি ধাপকে যে কোনও সময়ে পুনরায় পরীক্ষা করে দেখা যাবে ও সঠিক প্রমাণ-সহ যাচাই করা যাবে।
- নির্বাচন কমিশন, ভোটগ্রহণ ও গণনাপ্রক্রিয়ার উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে।[2]
দুঃখের বিষয় হল, ইভিএম-যন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ ও গণনার ক্ষেত্রে উপরের একটিও শর্ত মেনে চলা সম্ভব নয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, নির্বাচন কমিশনেরই ম্যানুয়াল অনুসারে[3] নির্বাচনের আগে ভারত ইলেকট্রনিকস (বেল) ও ইলেকট্রনিকস কর্পোরেশন লিমিটেড (ইসিআইএল)-এর প্রযুক্তিবিদেরাই বিশেষ একটি যন্ত্র, সিস্টেম লোডিং ইউনিট বা এসএলইউয়ের সাহায্যে প্রতিটি কেন্দ্রের প্রার্থীতালিকা ও তাঁদের নির্বাচনী-চিহ্ন বিষয়ক তথ্য ইভিএম-গুলিতে সংরক্ষণ করেন বা আপলোড করেন। একই ম্যানুয়াল অনুযায়ী এই বিশেষ যন্ত্র বা এসএলইউ অংশটি নির্বাচনের আগে অথবা পরে কোনওভাবেই কমিশনের তরফে সংরক্ষণ করা হয় না এবং সেটির প্রযুক্তি বিষয়েও নির্বাচনী আধিকারিকেরা কেউই ওয়াকিবহাল নন। নির্বাচন শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই এসএলইউ যন্ত্রটি আবারও সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিবিদদের কাছেই ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
অন্যদিকে একদিকে যখন নির্বাচন কমিশন ও শাসকদলের সমর্থকদের তরফে ১০০ শতাংশ ভিভিপ্যাট-স্লিপ গোণার বিষয়ে আপত্তি অথবা অনীহা প্রকাশ করা হচ্ছে, ১৯৬১-র নির্বাচনী রুলবুকের রুল নং ৫৬(ডি)৪(বি) থেকে উদ্ধৃতি সাজানো যাক—
যদি ইভিএম যন্ত্রের কন্ট্রোল ইউনিট থেকে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা, কাগজ-স্লিপের মাধ্যমে প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যার সঙ্গে না মেলে, তবে ফর্ম ২০-র মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণার সময় কাগজ-স্লিপের মাধ্যমে পাওয়া ফলাফলকেই চূড়ান্ত বলে ঘোষণা করতে হবে।[4]
সরাসরি বলা উচিত, ইভিএম-যন্ত্র ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন কমিশন ভোটগ্রহণ, তদুপরি গণনাপ্রক্রিয়ার উপরেও সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, যে ইলেকট্রনিক তথ্য-সংরক্ষণ ব্যবস্থা (ইইপ্রম বা ইলেকট্রনিকালি ইরেজেবল অ্যান্ড প্রোগ্রামেবল মেমরি) এই যন্ত্রে ব্যবহার করা হয়, বেল অথবা ইসিআইএল-এর মতো সংস্থার প্রযুক্তিবিদদের হাতেই তার সম্পূর্ণ প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ থাকে। উল্লেখ্য, এই দুটি সংস্থা কোনওভাবেই নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণাধীন নয়, বরং ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রকের তত্ত্বাবধানেই তাদের যাবতীয় ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রিত।[5]
কেন্দ্রীয় শাসকদলের সমর্থকেরা হাত-পা ছুড়ে ছুটে আসতেই পারেন, ভোটের ময়দানে হার নিশ্চিত বুঝেই এসব বিরোধীদের অপপ্রচার মাত্র। তাঁদেরকেই বরং স্মরণ করিয়ে দিই, ভারতীয় জনতা পার্টির ভূতপূর্ব সাংসদ জিভিএল নরসিমহা রাওয়ের লেখা ‘Democracy at risk — can we trust our electronic voting machines’ বইটিতেই প্রথম ইভিএমের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ ব্যবস্থার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করা হয়েছিল।[6] বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা, সঙ্ঘ-প্রচারক, বাবরি-ধ্বংসের মূল-কাণ্ডারি ও সেই সূত্রে পরবর্তীতে ভারতরত্ন-অভিধায় ভূষিত লালকৃষ্ণ আদবানি স্বয়ং ২০১০ সালে প্রকাশিত এই বইটির মুখবন্ধ লেখেন, এবং সেই মুখবন্ধে তিনিই সর্বপ্রথম ইভিএম-যন্ত্রে ভিভিপ্যাট-স্লিপ ব্যবস্থা প্রণয়নের পক্ষে সওয়াল করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আরেক বিজেপি সাংসদ সুব্রহ্মনিয়ম স্বামী সেই একই সময়ে দিল্লি হাইকোর্টে ভিভিপ্যাট-ব্যবস্থা প্রণয়নের দাবিতে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন এবং সেই মামলারই রায় দিতে গিয়ে ২০১২ সালে দিল্লি হাইকোর্ট তাদের পর্যবেক্ষণে জানায়, “ইভিএম-যন্ত্রে জালিয়াতি সম্ভব, তদুপরি এই যন্ত্রের সঙ্গে তথ্যের নিরাপত্তাজনিত বেশ কিছু বিষয়েরও জড়িত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।”[7] একই মামলা ক্রমশ সুপ্রিম কোর্টের এজলাসে দায়ের হলে পরে, ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্টের তরফে প্রত্যেক ইভিএম-যন্ত্রে ভিভিপ্যাট-ব্যবস্থা প্রণয়নের নির্দেশ জারি করা হয়।
পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি
নিয়তির পরিহাসে শাসক-নিয়ন্ত্রণাধীন নির্বাচন কমিশন অথবা বিজেপিরই তরফে আজ, একদা আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে আদায় করে আনা ভিভিপ্যাট-ব্যবস্থা ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনীহা প্রদর্শন করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক থেকে সাংবিধানিক পরিসরে, দেশের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিগত দশ বছরের কুশাসনের কারণে চূড়ান্ত দলদাসত্বের যে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়েছে, সেই অন্ধকার থেকেই কি মুক্তির পথ দেখাবে এবারের নির্বাচন? অবাধ সেই নির্বাচন নিশ্চিত করতে তারও পূর্বে, সর্বোচ্চ আদালতের এজলাসেই আজ মৌলিক সেই নির্বাচনী প্রক্রিয়ারই স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ভার…
নির্বাচকেরা অপেক্ষায়।
[1] Devasahayam, M.G. From the will of the people to the whim of the machines. The Wire. Dec 10, 2022.
[2] Devasahayam, M.G. The case for bringing paper ballots back. The Wire. Feb 13, 2024.
[3] পূর্বোক্ত।
[4] পূর্বোক্ত।
[5] এ-ও উল্লেখ্য, ইরেজেবল অর্থ যা সহজেই মুছে দেওয়া যায়, ও প্রোগ্রামেবল অর্থ সহজেই যে সংরক্ষণ-ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সংরক্ষণ-নীতির পরিবর্তন করা চলে।
[6] দ্রষ্টব্য, টীকা ১।
[7] দ্রষ্টব্য, টীকা ১।
*মতামত ব্যক্তিগত