সৈকত ভট্টাচার্য
ক্লাউড ব্রাইটনিং-এর প্রথম পরীক্ষা সফল। পিচকিরি থেকে কয়েকশো ফুট উপর অবধি স্প্রে করা গেছে বিশেষ ধরনের এরোসল। দেখা গেছে, তার কণিকার মাপও প্রয়োজনমাফিক ঠিকই আছে। তবে এখনও অনেকরকম পরীক্ষানিরীক্ষা বাকি। পরের ধাপ আরও উঁচুতে ছুড়ে দেওয়া। ধীরে ধীরে সে মেঘ স্পর্শ করবে। আরও অন্তত বছর দশেক পরীক্ষানিরীক্ষার পরই এর ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হবে হয়তো। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে থেকেই যায়— এইভাবে খোদার উপর খোদকারি করাটা কতটা সমীচীন?
বেলা দ্বি প্রহর, ধু ধু বালুচর
ধূপেতে কলিজা ফাটে পিয়াসে কাতর….
গরমকাল পড়লেই আমাদের এই ক্রান্তীয় সমতলভূমিতে এই পঙক্তিগুলো বোধহয় জাতীয় সঙ্গীতের রূপ নেয়। প্রত্যেক বছরই সূয্যিদেব তাঁর প্রবলতর তেজ নিয়ে হাজির হয়ে যান। ফলে জমি থেকে কলিজা— সব শুকিয়ে ফেটে চৌচির দশা হয়। এ বছর ব্যাঙ্গালোরে আবার ‘নাই রস নাই’। ভূগর্ভে জলের পরিমাণ এমনিতেই এই মালভূমি অঞ্চলে কম। তার উপর অতিরিক্ত জনসংখ্যা। ফলে ‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান সামার’ মাটির বুকের ভিতর বন্দি যেটুকু জল তাকেও শুকিয়ে ফেলে সে একেবারে যাকে টেনিদার ভাষায় বলে ‘পুঁদিচ্চেরি’, সেই দশা করে ফেলেছে। এদিকে বৃষ্টির দেখা নেই। সে বুঝি ‘হ য ব র ল’র শ্রীনিবাসের মতো দেশে চলে গিয়েছে। ফেরার নাম নেই। আকাশে শুধু সাদা মেঘের ভেলার ঠেলাঠেলি। ওদিকে মরুর দেশ দুবাইতে নাকি বৃষ্টির ঠেলায় বন্যা হয়ে গেছে। মানে, হচ্ছেটা কী?
পরিবেশবিজ্ঞানীরা অবিশ্যি এইসব অশৈলী কাণ্ডকারখানাকে ‘গ্লোবাল ওয়ার্মিং’ নামে দেগে দিয়েছেন অনেককাল আগেই। এই যবে থেকে মানুষ আধুনিক হয়েছে, শিল্প-টিল্প হয়েছে, কারখানা গজিয়েছে, কলের গাড়ি, বিজলি বাতি, ইত্যাদি এবং প্রভৃতির ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছে, তবে থেকে আসল গোল বেধেছে। তার আগে কয়লা, খনিজ তেল সমস্তই ছিল মাটির তলায়, পাথরের খাঁজে লুকনো। কিন্তু এত হরেকরকম কল চালানোর জন্য চাই প্রভূত পরিমাণ শক্তি। তা সেই শক্তি আসবে কোথা থেকে? তার জন্য চাই বিপুল পরিমাণ জ্বালানি। অতএব খোঁড়ো মাটি। পৃথিবীর যত গুপ্ত সম্পদ আছে, বের করো— জ্বালাও। আর এই জ্বালানিই ধীরে ধীরে হয়ে উঠল গোটা মানবসভ্যতার চালিকাশক্তি। যার হাতে যত জ্বালানি, সে তত ধনী, তত ক্ষমতাবান। তার দখল নেওয়ার জন্য যত কামড়াকামড়ি, মারামারি, লোকক্ষয়। কিন্তু ধীরে ধীরে এই জ্বালানির ধোঁয়া যে ঢেকে ফেলেছে বায়ুমণ্ডল, তার খেয়াল করেনি কেউ। আর এই গ্যাসের এমনই মহিমা যে মহাভারতের চক্রব্যূহের মতো সূর্যতাপবেশী অভিমন্যুকে ঢুকতে বাধা দেয় না, কিন্তু বের হতে গেলেই মহারথীরা ঘিরে ধরে। ফলে এই ‘গ্রিন হাউজ’ গ্যাসের ফাঁদে পড়ে আমাদের এই ধরাধামের মোট তাপের পরিমাণ বাড়তেই থাকল। তবে আমাদের পিঠে যখন ছ্যাঁকা লাগল তখন আর কিছু করার নেই— দেরি হয়ে গেছে। মানবকল্যাণের খাতিরে তৈরি এত কল-কারখানা তো আর রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া যায় না!
কবি বলেছেন, প্রি-কশান ইজ বেটার দ্যান কিওর। কিন্তু প্রি-কশানের সময় পার হয়ে গেছে যখন, হাতে থাকে পেনসিল, থুড়ি, কিওর। ফসিল-ফুয়েলের দহন কমানোর আর উপায় নেই। বরং সময়ের সঙ্গে তা বাড়তেই থাকবে। অতএব, এই সূর্যতাপকে কী করে বাবা-বাছা বলে গ্রিন-হাউজ গ্যাস-রূপী জয়দ্রথ-ভীষ্মদের চোখে ফাঁকি দিয়ে মহাকাশে ফেরত পাঠানো যায় তার উপায় বের করতে উঠে পড়ে লাগলেন বিজ্ঞানীকুল।
ঊনিশশো নব্বই সালের এমনই এক গ্রীষ্মদিনে অ্যাটমোস্ফেরিক-ফিজিসিস্ট প্রোফেসর জন ল্যাথাম ছেলের সঙ্গে বেড়াতে বের হয়েছিলেন উত্তর ওয়েলসের বেলাভূমিতে। নীল সমুদ্রের উপর দিয়ে আয়ারল্যান্ডের দিকে তাকিয়ে শোভা দেখছেন, এমন সময় ছেলের প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘোরালেন। ছেলের নজর সমুদ্রের উপর জমে থাকা মেঘের দিকে। “আচ্ছা, বাবা, এই মেঘগুলোর উপরদিকটা অমন চকচকে, আর নিচের দিকটা অমন কালচে কেন হয়?”
প্রশ্নটা সহজ। উত্তরও জানা। মেঘের উপরিস্তরে সূর্যের আলো এসে পড়ে, প্রতিফলিত হয়, তাই তার অমন জ্বলজ্বলে রং।
কিন্তু এই সাধারণ প্রশ্নটা ডক্টর ল্যাথামের মাথায় একটা নতুন ভাবনার উদয় ঘটিয়ে দিয়ে গেল। বিখ্যাত ‘নেচার’ পত্রিকায় একটা চিঠি লিখলেন। চিঠির শুরুটা এরকম— “Is it quantitatively feasible to introduce in a controlled manner into the atmosphere particulate material, to change the characteristics of natural low level clouds in such a way as to inhibit or neutralize global warming?” তারপর বিস্তর অঙ্ক কষে দেখালেন যে কোনওভাবে যদি বায়ুমণ্ডলের নিচের দিকে থাকা এই নিরীহ মেঘেরদলের প্রতিফলনক্ষমতা শতকরা তিনভাগ বাড়ানো যায়, তাহলে তা গ্লোবাল ওয়ার্মিং-কে সামলাতে পারবে। অর্থাৎ জীবাশ্ম-জ্বালানির ফলে উদ্ভূত কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং তার মাসতুতো-ভাইদের চক্করে ফাঁদে পড়া সূর্যতাপকে বের করে মহাকাশে ফের ফেরত পাঠাতে পারা যাচ্ছে না— তাই সূর্য থেকে আগত আলো তথা তাপকেই ভূপৃষ্ঠে পাঠানোর আগে একটু কেটেছেঁটে কম করে দেওয়া গেল। ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং যেমন চলছে চলুক, দূষণ-টুষন যেমন বাড়ছে বাড়ুক, কোই বাত নেহি, আমরা ছাতা দিয়ে মাথা রক্ষা করব।
কিন্তু মেঘের এই প্রতিফলনক্ষমতা রাতারাতি বাড়বে কী করে? তার উপায় বাতলাবে কে? ল্যাথাম সাহেব তো খানিক আঁক কষেই খালাস। বিষয়টা তো এতটাও সহজ নয়। খুব ছোট কণার এরোসল হলে মুশকিল— মেঘের প্রতিফলনক্ষমতার বিশেষ কোনও পরিবর্তনই ঘটবে না তাহলে। আবার কণার আকার প্রয়োজনের চেয়ে বড় হলে হিতে-বিপরীত হতে পারে বলে আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের— আগের চেয়েও প্রতিফলনক্ষমতা কমে যেতে পারে। তার ফলে আরও বেশি সৌরশক্তি বায়ুমণ্ডল ভেদ করে পৌঁছে যাবে পৃথিবীর বুকে। হিসেবমতো মানুষের চুলের একের সাতশো ভাগ হতে হবে এই এরোসল কণিকার আকার।
এরোসল কণিকার আকার না হয় ঠিক করা গেল। কিন্তু একটা বিপুল পরিমাণ এরোসলকে যে আকাশে মেঘের দেশে পাঠাতে হবে, তার জন্য চাই একটা সেরকম শক্তিশালী পিচকিরি। বানাবে কে? দু-হাজার ছয় সালে মাইক্রোসফটের তৎকালীন কর্ণধার বিল গেটসের কাছে একটা প্রস্তাব আসে। ডেভিড কিথ নামে এক সৌর-বিজ্ঞানী এসে বলেন যে, তাঁর মাথায় এমন একখান যন্ত্র বানানোর পরিকল্পনা আছে। দরকার শুধু টাকার। বিল গেটস বললেন, লাগে টাকা দেবে বিল গেটস। লেগে পড়ো কাজে। ডক্টর কিথ আরও দুই সঙ্গীকে নিয়ে কাজে নামলেন। তাদের মধ্যে একজন জেরক্স কোম্পানিতে কাজ করার সুবাদে ফটোকপি মেশিনে কীভাবে কালি স্প্রে হয়, সেই বিষয়টার সঙ্গে সম্যক পরিচিত ছিলেন— বলা ভাল, তাঁর হাতেই আধুনিক ফটোকপি মেশিনের ওই কালি-ছড়ানোর ব্যবস্থাটির ডিজাইন হয়েছিল। ভদ্রলোকের নাম আরমান্ড নিউকারম্যান্স। ডক্টর কিথ তাকে বললেন, এবার এমন একটা পিচকিরি বানাও, যা দিয়ে অন্যের গায়ে কালি না ছিটিয়ে আকাশের গায়ে এরোসল ছিটানো যাবে!
বিল গেটসের কাছ থেকে তিন লক্ষ ডলার নিয়ে শুরু হল তাঁদের গবেষণা। একটা ছোট দল বানিয়ে বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকল এই মহা-পিচকিরি বানানোর প্রকৌশল। অবশেষে গত বছরে এসে সেই আশ্চর্য যন্ত্রটা তৈরি হল। কিন্তু এর মধ্যে সানফ্রানসিসকো বে দিয়ে বয়ে গেল গ্যালন গ্যালন জল। বিল গেটসের দেওয়া অর্থ ফুরিয়েছে কবেই। SRI International নামে একটা কোম্পানির হাতে এখন এই প্রোজেক্ট। এ ছাড়াও আরও অনেক প্রাইভেট কোম্পানি এই বিষয়ে গবেষণা করা শুরু করেছে। আর সবচেয়ে বড় পরিবর্তন হয়েছে আবহাওয়াতে। সেই নব্বই সালে ল্যাথাম সাহেব যা হিসাব কষেছিলেন, তার তুলনায় এতদিনে প্রায় কুড়ি শতাংশ গ্রিনহাউজ গ্যাস বন্দি হয়েছে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে। ফলে চ্যালেঞ্জ বেড়েছে আরও।
যন্ত্র তো তৈরি হল, কিন্তু পরীক্ষানিরীক্ষা করতে হবে তো!
গত মার্চ মাসের এক রৌদ্রোজ্জ্বল মঙ্গলবার সানফ্রানসিসকো বে অঞ্চলে দ্য হর্নেট নামে এক পরিত্যক্ত যুদ্ধজাহাজের ডেকের উপর এই যন্ত্রের পরীক্ষার স্থান ও কাল ঠিক হল। উজ্জ্বল নীল রঙের যন্ত্রটা জাহাজের ডেকের এক প্রান্তে রেখে তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল শিপিং কন্টেইনারের মতো দেখতে প্রকাণ্ড এক বাক্স। যন্ত্রটার উপর তিন ফুট চওড়া একটা ধাতব নল। ওখান দিয়েই ছিটকে আকাশের পানে উঠে যাবে এরোসল। আর ওই প্রকাণ্ড বাক্সের মধ্যে নানাবিধ যন্ত্রপাতি।
প্রথম পরীক্ষা যথারীতি সফল হল। পিচকিরি থেকে কয়েকশো ফুট উপর অবধি স্প্রে করা গেল বিশেষ ধরনের এরোসল। দেখা গেল, তার কণিকার মাপও প্রয়োজনমাফিক ঠিকই আছে। তবে এখনও অনেকরকম পরীক্ষানিরীক্ষা বাকি। পরের ধাপ আরও উঁচুতে ছুড়ে দেওয়া। ধীরে ধীরে সে মেঘ স্পর্শ করবে। আরও অন্তত বছর দশেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পরই এর ব্যবহারিক প্রয়োগ শুরু হবে হয়তো। কিন্তু একটা প্রশ্ন মনের মধ্যে থেকেই যায়— এইভাবে খোদার উপর খোদকারি করাটা কতটা সমীচীন?
বিজ্ঞানীকুল এই বিষয়ে দুইভাগ। একদল সন্দিহান। এইভাবে মেঘের উপর কারিকুরি করার ফল অনেকদূর অবধি গড়াতে পারে বলেই তাঁদের অভিমত। এর ফলে সমুদ্রস্রোত পাল্টে যেতে পারে। সমুদ্রস্রোত পাল্টে গেলে শস্যশ্যামলা বাংলা হয়ে যেতে পারে মরুভূমি আবার সাহারার বুকে জঙ্গল গজিয়ে উঠতে পারে। এত কিছু না হলেও মাছের দল পাল্টে ফেলতে পারে তাদের গতিপ্রকৃতি। ফলে অনেক দেশের মৎস্যজীবীরা হয়তো বিপদে পড়বেন। তার ফলে দেশ তথা পৃথিবীর অর্থনীতিতেও আসতে পারে নানা গোলমাল। অন্য দল অবিশ্যি আশা রাখছেন মানুষের উপর। তারা নিজেরাই শুধরবে হয়তো। ফলে এই কৃত্রিম উপায়ে খোদার উপর খোদকারি করার প্রয়োজনই হয়তো পড়বে না— মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ।
কিন্তু মানুষের উপর বিশ্বাস করাও চাপ। বিশেষ করে নীতিনির্ধারকদের উপর। কমবেশি সকলেই নিজেদের আখের গোছানোতেই ব্যস্ত। নবজাতকের কাছে শুধু ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স বাড়ানোর দৃঢ় অঙ্গীকার করে যাচ্ছেন তাঁরা। নিজেদের গদি বাঁচানো, দেশের গণ্ডি বাড়ানো, ধর্ম-ধর্ম খেলা— এইসবে এত মনোযোগ যে তোতার মরোমরো দশা তাদের নজরেই পড়ছে না। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের যদিও বা পড়ছে, তাদের সংখ্যা এতই নগণ্য যে কোনও ফল হচ্ছে না। তাই জনৈক পরিবেশবিজ্ঞানী মুচকি হেসে বলেছেন, এমনিতেই পৃথিবীকে যে অবস্থার দিকে নিয়ে চলেছি আমরা, তাতে মেঘের গায়ে আরশি বসিয়ে যদি ধরাতলকে খানিক ঠান্ডা করার চেষ্টা করা হয়, তাতে খুব একটা ক্ষতি বৃদ্ধি হবে কি?