প্রদীপ দত্ত
শ্রীকুমারকে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গুরুত্বহীন পদ এডিজিপি (পুলিশ রিফর্ম)-এ স্থানান্তর করা হয়। কারণ দাঙ্গার সময় এবং পরে মোদি প্রশাসনের জঘন্য কাজকর্ম মেনে না নিয়ে তিনি আইনের পথে চলতে চেয়েছিলেন। ২০০২ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর ২০০৫-এর মধ্যে তিনি নানাবতী-মেহতা কমিশনে চারটি হলফনামা দিয়েছিলেন, যা থেকে গণহত্যায় মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর প্রশাসনের ভূমিকা, ক্রমাগত সংখ্যালঘু বিরোধী পদক্ষেপ এবং সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টার কথা বোঝা যায়
পূর্ব-প্রসঙ্গ: সঞ্জীব ভাট-এর কথা
গুজরাত দাঙ্গার পরই আরবি শ্রীকুমার গোয়েন্দা বিভাগের এডিজিপি (অ্যাডিশনাল ডিরেক্টর জেনারেল পুলিশ) নিযুক্ত হয়েছিলেন। ২০০২ সালের ২৪ এপ্রিলে তিনি আমেদাবাদের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে রিপোর্ট তৈরি করেন। সেই রিপোর্ট পড়ে শ্রীকুমারের আইনের শাসন মানা ও তা প্রয়োগ করার মানসিকতার জন্য মোদি বিরক্ত হন। শ্রীকুমার যখন তাঁকে দেওয়া মুখ্যমন্ত্রীর সমস্ত অবৈধ নির্দেশ রেজিস্টারে লিখে ফেলতে ব্যস্ত মোদি তাঁকে ডেকে পাঠান। জিজ্ঞেস করেন, আমেদাবাদের হিংসা নিয়ে তাঁর মতামত কী? শ্রীকুমার তাঁর পাঠানো নোটের কথা বলেন। মোদি বলেন, সেই নোট তিনি পড়েছেন এবং মনে করেন শ্রীকুমারের সিদ্ধান্ত ভুল। গুজরাতের হিংসার জন্য বিস্তারিত ও পেশাগত বিশ্লেষণের প্রয়োজন নেই, কারণ তা গোধরার ঘটনার স্বাভাবিক অনিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া। শ্রীকুমারকে তিনি মুসলমান সন্ত্রাসীদের উপর মনোযোগ দিতে বলেন। শ্রীকুমার বলেন, গুজরাতে মুসলমানরা আক্রমণ করেনি, তাছাড়া বিপর্যস্ত ওই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থা ফিরে পেতে মুখ্যমন্ত্রীর তাদের কাছে যাওয়া দরকার। মোদি তাঁর কথায় বিরক্ত হন।
সাংবাদিক বিনোদ জোসকে শ্রীকুমার জানান, দাঙ্গার পর মুখ্যমন্ত্রীর অফিসের নির্দেশে হরেন পান্ড্যর গতিবিধি ও কাজকর্মের বিস্তারিত সংবাদ সেখানে নিয়মিত পাঠাতে হত। গুজরাত গণহত্যার কার্যকারণ বুঝতে শ্রীকুমারের সরকারি খাতায় ১৬ এপ্রিল থেকে ১৯ সেপ্টেম্বর (২০০২) পর্যন্ত তাঁর ব্যক্তিগত লেখা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সাংবাদিক জোস লিখেছেন, ২০৭ পাতার ওই বিবরণ নরেন্দ্র মোদির নীতিজ্ঞানহীন অশুভ কাজকর্মের মাত্রা বোঝার জন্য জরুরি। তা গণহত্যার সাক্ষ্য এবং সেই অপরাধ ঢাকতে নানা কার্যকলাপের দলিল। কয়েকটি লেখায় ট্রাইবুনালে (সিসিটি) সাক্ষ্য দেওয়ার পর গুজরাতের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হরেন পান্ড্যকে সরকারি মেশিনারি ব্যবহারের অপরাধে অভিযুক্ত করার চক্রান্তের কথা রয়েছে।
লিখিত রেকর্ড অনুযায়ী শ্রীকুমারকে মোদির প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিকে মিশ্র পান্ড্যর গতিবিধিতে নজর রাখতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, বিশেষ করে সিসিটি প্যানেলের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে। পান্ড্য প্যানেলের মুখোমুখি হয়েছিলেন কি না তাও জানতে বলেছিলেন।
৭ জুন তিনি লেখেন: “ডক্টর পিকে মিশ্র বলেন যে, সন্দেহ করা হচ্ছে রাজস্বমন্ত্রী হরেনভাই পান্ড্য এই ব্যাপারে জড়িত। তিনি একটি মোবাইল নম্বর[1] দিয়ে তার কল-ডিটেলস জোগাড় করতে বলেন। কারণ সেই রেকর্ড থেকেই বোঝা যাবে সিসিটির মিটিঙে পান্ড্য ছিলেন কি না।”
সেই নির্দেশ মানতে গড়িমসি করলে পাঁচদিন পর, ১২ জুন, ডক্টর মিশ্র আরেকবার শ্রীকুমারকে সেই নির্দেশ দেন। সেদিন শ্রীকুমার লেখেন: “ডক্টর পিকে মিশ্রকে জানিয়েছি, যে মন্ত্রী সিসিটিতে গিয়েছিলেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তিনি শ্রীহরেন পান্ড্য। ওই টেলিফোন নম্বরটিও শ্রীহরেনভাই পান্ড্যর। এও জানিয়েছি যে বিষয়টা লিখিত দেওয়া যাবে না, কারণ তা যথেষ্ট সংবেদনশীল তথ্য এবং মুম্বাই পুলিশ ম্যানুয়াল অনুযায়ী স্টেট ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর কাজের মধ্যে পড়ে না।” শ্রীকুমার হরেন পান্ড্যর কল-ডিটেলস পুলিশের আইজি ও পি মাথুরের মাধ্যমে মিশ্রের কাছে পাঠিয়েছিলেন।
ওই বছর আমেদাবাদের জামালপুর থেকে পরিকল্পিত বার্ষিক রথযাত্রা (৭ জুলাই) নিয়ে ২৮ জুন মুখ্যসচিব সুব্বারাও উপরমহলের অফিসারদের নিয়ে মিটিং ডাকেন। মোদির পছন্দের অফিসাররা সবাই সেখানে ছিলেন। শ্রীকুমার বলেন গোয়েন্দাদের প্রস্তাব ছিল, এই ভঙ্গুর পরিস্থিতিতে রথযাত্রা বাতিল করা হোক। আমেদাবাদের পুলিশ কমিশনার সেই মত সমর্থন করেন। শ্রীকুমার বলেন, মুসলমান যুবকদের প্রতিশোধমূলক ক্রোধ থেকে উত্তেজনা সৃষ্টি হতে পারে। তিনি কেন্দ্রীয় সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া খবর উল্লেখ করে বলেন, ইসলামিক জঙ্গিরা রথযাত্রা এবং হিন্দুদের ক্ষতি করার পরিকল্পনা করছে। এরপর সবাই যখন রথযাত্রা ও তার রুটবদল নিয়ে আলোচনা করছেন, সুব্বারাও বলেন, যাত্রা বাতিল করার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ এরই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী অতীতের রুটেই ওই যাত্রার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
মোদির পছন্দের অফিসার মুখ্যসচিব সুব্বারাও মিটিঙের পর বলেন, যদি বোঝা যায় কেউ রথযাত্রায় বিঘ্ন ঘটাতে বা উপদ্রব করতে চায়, তার সমাধানে মুখ্যমন্ত্রীর সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত হল, তাদের সরাসরি ‘নির্মূল’ করতে হবে। শ্রীকুমার তাতে রাজি হননি। বলেন, এই ধরনের কাজ একেবারেই অবৈধ এবং অনৈতিক। মুখ্যসচিব বিষয়টা নিয়ে চাপ দেওয়ার চেষ্টা করলেও তিনি অনমনীয়ই ছিলেন।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
শ্রীকুমার নানাবতী-মেহতা কমিশনকে বলেন, মোদি সরকার স্টেট ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোকে হরেন পান্ড্যর ফোনে আড়ি পাততে বলেছিল, যেন তিনি সিসিটিতে গিয়েছিলেন কিনা নিশ্চিত হওয়া যায়। দাঙ্গার পর মোদি সরকার মেয়াদ ফুরাবার আগেই বিধানসভা নির্বাচন করতে চেয়েছিল। সে-কথা সরকার দিল্লির চিফ ইলেকশন কমিশনারকে জানিয়ে বলেছিল, রাজ্যের পরিস্থিতি শান্ত। চিফ ইলেকশন কমিশনার রাজ্যের গোয়েন্দা রিপোর্ট জানতে চাইলে শ্রীকুমার জানান ১৮২টি বিধানসভা ক্ষেত্রের মধ্যে দাঙ্গায় আক্রান্ত ১৫৪টি। ওই রিপোর্ট পেয়ে কমিশন বছরের মাঝে নির্বাচনের পরিকল্পনা বাতিল করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করে ডিসেম্বর মাসে।
শ্রীকুমারকে ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গুরুত্বহীন পদ এডিজিপি (পুলিশ রিফর্ম)-এ স্থানান্তর করা হয়। কারণ দাঙ্গার সময় এবং পরে মোদি প্রশাসনের জঘন্য কাজকর্ম মেনে না নিয়ে তিনি আইনের পথে চলতে চেয়েছিলেন। ২০০২ সালের জুলাই থেকে অক্টোবর ২০০৫-এর মধ্যে তিনি নানাবতী-মেহতা কমিশনে চারটি হলফনামা দিয়েছিলেন, যা থেকে গণহত্যায় মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর প্রশাসনের ভূমিকা, ক্রমাগত সংখ্যালঘু বিরোধী পদক্ষেপ এবং সত্যকে চাপা দেওয়ার চেষ্টার কথা বোঝা যায়। ২০০৫ সালে তাঁকে সরিয়ে রেখে অন্যকে ডিজিপির পদে প্রমোশন দেওয়া হয়। তিনি সেন্ট্রাল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ট্রাইবুনালে তার বিরোধিতা করেন। শেষে ২০০৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি, তাঁর অবসর নেওয়ার দিন ট্রাইবুনাল তাঁর পক্ষে রায় দেয়।
২০২২ সালের ২৪ জুন সুপ্রিম কোর্ট গুজরাত দাঙ্গায় মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-সহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নাকচ করে দেয়। ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কোনও ভূমিকা নেই বলে সিটের (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিমের) ছাড় দেওয়ার বিরুদ্ধে তিস্তা শেতলওয়াড় ও জাকিয়া এহসান জাফরি সুপ্রিম কোর্টে ওই মামলা করেছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট জানায় যে, যাঁরা এই মামলাটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাবিউস অফ প্রসেসে যুক্ত ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়।
তার ঠিক দুদিন পরই গুজরাত পুলিশ শ্রীকুমার ও সমাজকর্মী তিস্তা শেতলওয়াড়কে গ্রেফতার করে। সঞ্জীব ভাট ২০১৮ সাল থেকে জেলেই ছিলেন, ১২ জুলাই ওই মামলায় ফের সিট তাঁকে গ্রেফতার করে। শ্রীকুমার ৩ মাসের বেশি এবং শেতলওয়াড় ২ মাসের উপর জেলে থাকার পর জামিন পান। সরকার তিস্তা, শ্রীকুমার ও সঞ্জীব ভাটের বিরুদ্ধে ওই মামলায় নিরীহ লোকেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাঁড় করাতে নথি জাল করার মামলা করে।
২৭ জুন দেশের ২১টি রাজ্যের প্রায় আড়াই হাজার ভারতীয় তাদের গ্রেফতারের নিন্দা করে এক চিঠিতে লেখে, জাকিয়া জাফরির আবেদনের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের রায় আমাদের মধ্যে অবিচার বোধ জাগায়, যাঁরা সংবিধানের মূল্য বোঝেন তাঁদের কাছে এই মুহূর্ত গভীর ক্ষতি ও বেদনার। শুধু খুন, ধর্ষণ ও সম্পত্তি ধ্বংসের জন্য ষড়যন্ত্রের ধারণাই সুপ্রিম কোর্ট বরখাস্ত করেনি, গোধরার ঘটনার পর যাঁরা সাম্প্রদায়িক ঘৃণার অপরাধের বিচার চেয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতেও বলেছে। ওদিকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের মানবাধিকার অফিস ২৮ জুন জানিয়েছিল, ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গার যাঁরা শিকার তাঁদের হয়ে সহমর্মিতা ও সক্রিয়তার দায়ে শেতলওয়াড়, শ্রীকুমার ও ভাটের উপর নির্যাতন করা যায় না।
[পরের পর্ব – উপসংহার]
[1] ৯৮২৪০৩০৬২৯