গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: উপসংহার

প্রদীপ দত্ত

 


আমাদের দাবি হোক ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে সব ভুক্তভোগীদের সমানভাবে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অবশ্যই সমস্ত অপরাধীদের শাস্তি পেতে হবে, তারা যে ইউনিফর্মই পরুক না কেন, যে রাজনৈতিক দলে বা যে উচ্চ পদেই থাকুক না কেন। যে সমাজ আজ জনসংখ্যার এক অংশের জন্য এই গ্যারান্টি দিতে পারে না তারা আগামীকাল অন্যদের ক্ষেত্রেও একইরকম ট্র্যাজেডি রোধ করতে পারবে না। ভাবতে হবে, কেন আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা এমন লোকেদের হাতে দিই যারা বিভাজনমূলক প্রচার করে, সক্রিয়ভাবে বিভাজনে উত্সাহিত করে? যারা হিংসায় দোষী ব্যক্তিদের তদন্ত ও শাস্তি দেওয়ার জন্য কিছুই করে না?

 

পূর্ব-প্রসঙ্গ: আরবি শ্রীকুমারের প্রতিবাদ

গোধরা-পরবর্তী গণহত্যা বা দাঙ্গার মামলায় হস্তক্ষেপ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের কাছে ১১টি আবেদনের প্রধান বক্তব্য ছিল গণহত্যার তদন্ত যেন সিবিআইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয়। গুজরাত পুলিশ সঠিক তদন্ত করছে না, রাজনৈতিক গোষ্ঠী বা দলের সঙ্গে জড়িত অভিযুক্তদের জামিন অথবা তদন্তের আওতা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে।[1] এইসব কথা উল্লেখ করে ভুক্তভোগী এবং সমাজকর্মীরা আবেদন করার পর সুপ্রিম কোর্ট কয়েকটি মামলার বিচার স্থগিত রেখেছিল। আদালত বিষয়গুলো বিবেচনা করে গণহত্যার মামলা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বলে গুজরাত প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করে এবং  আদালতের তত্ত্বাবধানে ন-টি বড় হত্যাকাণ্ডের মামলা[2] তদন্তের জন্য ২০০৮ সালের মার্চ মাসে একটি বিশেষ তদন্তকারী দল (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম, এসআইটি বা সিট) গঠন করে। গণহত্যায় মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকাও তদন্তের আওতায় ছিল। সিটকে তদন্ত করতে নির্দেশ দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনেক আবেদনকারীই আশায় বুক বেধেছিল। মোদি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ দলের কিছু কর্মী গণহত্যায় কেমন জড়িত তা এর আগে এক টিভি চ্যানেলের ভিডিওক্লিপে দেখা গিয়েছিল। অনেকে মনে করতেন মোদির জন্য সঠিক জায়গা হল জেল, মুখ্যমন্ত্রীর আসন নয়।

২০১২ সালের এপ্রিল মাসে গুজরাত হাইকোর্টে জমা দেওয়া সিটের রিপোর্টে ৬৩ জন অভিযুক্তকে ক্লিনচিট দেওয়া হয়, যার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও ছিলেন। এরপর জাকিয়া জাফরি এক আবেদনপত্রে সিটের রিপোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানান। কিন্তু ম্যাজিস্ট্রেট আদালত সিটের রিপোর্টই গ্রহণ করে, জাকিয়ার আবেদন অনুযায়ী কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। ২০১৭ সালে গুজরাত হাইকোর্ট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সিদ্ধান্তই বজায় রাখে। জাকিয়া হাইকোর্টের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন। তিনি জানান সিট এবং ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মুখ্য সাক্ষ্যকে গুরুত্ব দেয়নি।

মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে সঞ্জীব ভাটের অভিযোগকে সিট আমল দেয়নি। তারা জানায়, মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে ২৭ ফেব্রুয়ারির (২০০২) মিটিঙে সঞ্জীব উপস্থিত ছিলেন না। তারা আরও জানায়, গোধরায় করসেবকদের মৃত্যুর পর মোদি যদি পুলিশকে বলেও থাকেন যে, হিন্দুদের ক্রোধ প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে, তাহলেও তা ঘরের মধ্যে বসে বিবৃতি দেওয়া হিসাবেই দেখতে হবে। তাই মোদি গণহত্যার দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছিলেন। সিটের রিপোর্টে বলা হয়, মোদির বিরুদ্ধে বিচারযোগ্য প্রমাণ নেই। অভিযোগ, সিটের এই ভূমিকার জন্যই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি দৃষ্টিকটুভাবে সিটের চেয়ারম্যান রাঘবনকে সাইপ্রাসের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করেছিলেন।

সিটের রিপোর্টে নানা গোলমালের মধ্যে একটি ছিল দাঙ্গার সময় সেনাদের কাজে না-নামানো নিয়ে। রিপোর্টে বলা হয়েছিল যে, সামরিক বাহিনিকে রাস্তায় নামানোর ক্ষেত্রে গুজরাত সরকার মোটেই দেরি করেনি। বাস্তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি গুজরাতে ব্যাপক হত্যার পর সেনাপ্রধানের নির্দেশে বিমানবাহিনি যোধপুর থেকে তিন হাজার সেনা আহমেদাবাদে নিয়ে এসেছিল। প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট জেনারেল জামিরউদ্দিন শাহ পরে জানিয়েছিলেন, সিটের কথা একেবারেই মিথ্যা, তারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য তাঁকে ডাকেইনি। মোদি সেনাদের একদিনের বেশি সময় ধরে কাজই করতে দেননি। মার্চ মাসের ১ তারিখে রাত দুটোর সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রয়াত জর্জ ফার্নান্ডেজের সামনে ওই প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট জেনারেল মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সেনাদের পরিবহন ও অন্যান্য সহযোগিতার অনুরোধ করার পরও পরিবহন ব্যবস্থার অপেক্ষায় ওই বিপুল সংখ্যক সেনা সকাল সাতটা থেকে আহমেদাবাদের বিমানঘাঁটিতে বসে ছিলেন। রাজ্য সরকার জানিয়েছিল, তারা পরিবহন, পুলিশ গাইড ও ম্যাজিস্ট্রেটকে সেখানে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। চব্বিশ ঘণ্টার বেশি সময়েও সরকার সেই ব্যবস্থা করেনি। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জানান, এই অবস্থায় সকাল দশটা-এগারোটার সময় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজ আহমেদাবাদে এসে সেনাদের সঙ্গে কথা বলেন। যদি ১ মার্চ সকালে সেনারা পথে নামত, বহু মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচত।

মাত্র দুটি মামলায় সিট অপরাধী সাব্যস্ত করেছিল। সেই অনুযায়ী গুজরাতের বিশেষ আদালত ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে গুজরাতের মেহসানা জেলার সর্দারপুরা গ্রামে ২০০২ সালের মার্চ মাসে ৩৩ জন মুসলমানকে হত্যার দায়ে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। এছাড়া সিট গোধরার ট্রেনে হামলায় অভিযুক্ত হিসাবে ৩১ জনকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল।

বিচারপতি কৃষ্ণ আইয়ার, পিবি সাওয়ন্ত এবং হসবেত সুরেশকে নিয়ে গঠিত নাগরিক ট্রাইব্যুনাল (সিসিটি) ২০০৩ সালে সুপারিশ করেছিল যে, অবশ্যই মোদি এবং তার গুন্ডাবাহিনীর বিচার করতে হবে এবং আজীবনের জন্য তাঁদের সরকারি অফিস থেকে সরিয়ে দিতে হবে। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি পিবি সাওয়ন্ত ২০১২ সালে প্রকাশিত সিটের রিপোর্টের সঙ্গে সহমত ছিলেন না। ওই বছর মে মাসে ওই বিচারপতি সাওয়ন্ত এনডিটিভিকে বলেন, আমি সিটের সঙ্গে একমত নই। সিসিটি এবং সিটের রিপোর্ট— দুটোই মানুষ তুলনা করে সিদ্ধান্ত নেবে।

বিচারপতি পিবি সাওয়ন্ত

২৭ ফেব্রুয়ারি গোধরায় ট্রেনে আগুন লাগার পর, মুখ্যমন্ত্রী মোদি গোধরা ট্র্যাজেডি তদন্তের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিচারক কেজি শাহকে প্রধান হিসাবে নিয়োগ করে ১ মার্চ বিচারবিভাগীয় কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করেছিলেন। এই বিচারকের আচরণ পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করা হত। ওই নিয়োগ গুরুতর বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সুষ্ঠু এবং স্বাধীন তদন্তের খাতিরে রাজ্যের বাইরে থেকে এক সিনিয়র বিচারককে নিয়োগের দাবি ওঠে। ব্যাপক প্রতিবাদের পর ৫ মার্চ ওই বিচারবিভাগীয় কমিশনের তদন্তের শর্তাবলিতে গুজরাত গণহত্যার তদন্তও অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি নানাবতীকেও ওই কমিশনের প্রধান হিসাবে নিয়োগ করা হয়। নানাবতী-মেহতা কমিশন, ২০০২ সালের ৬ মার্চ নিযুক্ত হয়ে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আংশিক রিপোর্ট এবং ২০১৪ সালের নভেম্বরে চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। আজও রিপোর্টটি প্রকাশ করা হয়নি।

গণহত্যায় মোদি-যোগ বুঝতে সুপ্রিম কোর্ট সিট ছাড়া বরিষ্ঠ আইনজীবী রাজু রামচন্দ্রনকে গুজরাত দাঙ্গার তদন্ত করতে বলেছিল। অর্থাৎ রামচন্দ্রন ছিলেন অ্যামিকাস কিউরিয়া বা এই মামলায় আদালতের সাহায্যকারী। তাঁর পর্যবেক্ষণ কিন্তু সিটের সঙ্গে মেলেনি। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি সুপ্রিম কোর্টে রিপোর্ট জমা দেন। তিনি জানান, মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অপরাধের তদন্ত করার পক্ষে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। প্রাথমিক স্তরে মোদির বিরুদ্ধে যে-সব অপরাধের অভিযোগ আনা যায় তা হল, ধর্মের ভিত্তিতে নানা গোষ্ঠীর সঙ্গে শত্রুতা তৈরি করা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে পক্ষপাতমূলক কাজ করা। রামচন্দ্রন জানিয়েছিলেন, পুলিশ অফিসার সঞ্জীব ভাটের অভিযোগের প্রতি আরও গুরুত্ব দেওয়া দরকার। তিনি আদালতে কংগ্রেস পার্টির প্রাক্তন সাংসদ এহসান জাফরির বিধবা স্ত্রী জাকিয়া এহসান জাফরির অভিযোগ অনুযায়ী দাঙ্গায় মোদির ভূমিকা খতিয়ে দেখতে বলেন। জাকিয়া বলেছিলেন, এহসান জাফরি মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করার পর গুলবার্গ সোসাইটিতে দাঙ্গাকারীরা এহসান-সহ ৬৯ জনকে মেরে ফেললেও মোদি ও তাঁর প্রশাসন তাঁদের বাঁচাতে কোনও চেষ্টা করেনি।

সুপ্রিম কোর্ট মোদি-সহ ৬৩ জনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ নাকচ করে, যাঁরা এই মামলাটি চালিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাবিউস অফ প্রসেসে যুক্ত ছিলেন তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা বলে, এবং সেই প্রেক্ষিতে পুলিশ আফিসার শ্রীকুমার এবং সমাজকর্মী তিস্তা শেতলওয়াড় গ্রেফতার হন— এসব ঘটনা আমরা আগের পর্বে দেখেছি।

 

এখন আমরা ফের বাস্তবে ফিরে গিয়ে দেখব সেই দিনগুলোয় ঠিক কী ঘটেছিল। সবরমতি এক্সপ্রেসের এস-৬ কোচটিতে আগুনে লেগে যদি ৫৯ জন যাত্রী পুড়ে মারা না যেত, গুজরাত দাঙ্গা বা গণহত্যা হত না এবং নরেন্দ্র মোদি আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতেন না। ওই ঘটনা না ঘটলে বিজেপি গুজরাত বিধানসভা ভোটে হারত। ২০০১ সালের গ্রামপঞ্চায়েত নির্বাচনে বিজেপি হেরেছে। একই বছর অনুষ্ঠিত তিনটি বিধানসভা উপনির্বাচনেও হেরেছিল। তাই বিজেপি খুবই বিপর্যস্ত ছিল। মুখ্যমন্ত্রী কেশুভাইয়ের স্বাস্থ্য খারাপ যাচ্ছিল, তাছাড়া আরও কয়েকটি অভিযোগে ২০০১ সালের অক্টোবরে তাঁর জায়গায় দিল্লি থেকে মোদিকে নিয়ে আসা হয়েছিল। মোদি বুঝেছিলেন ভোটে জিততে হলে দলের প্রতি হিন্দু সমর্থন বাড়াতে হবে। এই ঘটনাপরম্পরা দেখলে মনে হবে, ক্ষমতায় আসার পাঁচ মাস পরে সবরমতি এক্সপ্রেসে আগুন ধরার মতো ইস্যু যেন হাতে চাঁদ পাওয়া। অভিযোগ, ধর্মীয় বিভাজনের জন্যই ওই রাজ্যে গণহত্যা ও দাঙ্গা হয়েছে। আরও অভিযোগ, মোদি বিভাজনের সুফল পেতে চেয়েছিলেন। গুজরাতে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২০০৩-এর এপ্রিল মাসে। মোদি নির্বাচন চাইলেন ২০০২-এর এপ্রিল মাসে। উদ্দেশ্য একটাই, যে ইসলামোফোবিয়া তৈরি করা হয়েছে সেই ঢেউয়ে চেপে গুজরাতে বিজেপি যেন ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারে। অবশ্য নির্বাচন কমিশন তা অনুমোদন করেনি। শেষে ২০০২-এর ডিসেম্বর মাসে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।

শুরুর ঘটনায় চোখ ফেরানো যাক। ২৭ ফেব্রুয়ারির বিকেলে স্থানীয় সব গুজরাতি সংবাদপত্রে লেখা হয়, ট্রেনলাইনের কাছের ঘাঞ্চি মুসলমান কলোনির লোকে পাথর ও কাপড়ে কেরোসিন ভিজিয়ে প্রতিশোধ নিতে তৈরি ছিল। ট্রেন থামলেই তারা জানলা ভেঙে কেরোসিনে জ্বালানো ওই কাপড় কোচের মধ্যে ছুড়ে দিয়েছিল বলেই ট্রেনে আগুন লাগে। পুলিশের প্রথম চার্জশিটের ভিত্তি ছিল ওই রিপোর্ট, যেখানে সাজানো প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা বলা হয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা সবাই ছিল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লোক। তারা একই বয়ানে বলেছিল, বাইরে থেকে কাপড়ে কেরোসিন ভেজানো আগুন ছোড়া হয়েছিল বলেই ট্রেনে আগুন লাগে।

কিছুকাল পরে পুলিশ তাদের প্রথম বয়ানের বদলে নতুন তত্ত্ব হাজির করে, যার বিশ্বাসযোগ্যতা আরও কম। পুলিশ বলে, মুসলমানরা এস-৬ ও এস-৭-এর ভেস্টিবুল কেটে ওই কোচে ঢুকে পেট্রল ঢেলেছিল। অথচ ২০০৬ সালে গোধরায় এস-৬ কোচে আগুন ধরার কারণ অনুসন্ধানে রেলমন্ত্রকের তৈরি ব্যানার্জি কমিশনের রিপোর্টে স্পষ্ট বলা হয়েছিল যে, দুর্ঘটনাবশতই ট্রেনে আগুন লেগেছিল, যাত্রীদের ভুলবশতই তা ঘটেছিল। তবে নানাবতী- মেহতা কমিশন ২০০৮ সালে জানায় অগ্নিসংযোগ পূর্বপরিকল্পিত, যা ঘটিয়েছিল হাজার মুসলমান জনতা।

অবশ্য তদন্ত শুরু হওয়ার আগেই মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন যে, গোধরার ঘটনা পূর্বপরিকল্পিত এবং তা জঙ্গি মুসলমানদের কাজ। উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গোর্ধন জাডাফিয়া, বার বার দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, যে গোধরা অগ্নিসংযোগের পিছনে পাকিস্তানের হাত ছিল। অভিযোগ, পরিস্থিতির সংবেদনশীলতা বিচার করেই মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করতে ওইসব দায়িত্বজ্ঞানহীন বিবৃতি দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে গোটা মুসলিম সম্প্রদায়কে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও তাদের ধ্বংসের ন্যায্যতা তৈরি করা হয়। ৫ মার্চ একটি সরকারি প্রেসরিলিজে মোদি গোধরাকে তিনবার ‘গণহত্যা’ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর ভাষায় পরবর্তী গণহত্যাগুলো ছিল কেবল ‘দাঙ্গা’ এবং ‘হিংসা’র ঘটনা।

এস-৬ কোচে আগুন লাগার কয়েক ঘন্টা পর আগুনে পোড়া কোচ গোধরায় রেখে সবরমতি এক্সপ্রেস আহমেদাবাদের কালুপুর স্টেশনের দিকে যাত্রা করে। গোধরায় মৃত্যুর প্রথম প্রতিশোধের ঘটনা ঘটেছিল ভাদোদরা স্টেশনের কাছে। সেখানে এক মুসলমানকে খুন করা হয়। আনন্দ স্টেশনে উগ্র হিন্দুরা আরেকজনকে আক্রমণ করে। ট্রেন যখন আমেদাবাদে পৌঁছোয় স্লোগান ওঠে, খুনকা বদলা খুন সে লেঙ্গে। ২৭ তারিখেই গুজরাতে মুসলমানদের উপর আক্রমণের ১৪টি ঘটনা ঘটেছিল। মার্চের ২ তারিখের পর দাঙ্গা বা গণহত্যার ঘটনা কমে এলেও চলেছে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত।

তিস্তা শেতলওয়াড় দু-বছর আগে মার্চ মাসে স্ক্রলে লিখেছেন:

পোড়া মানুষের শরীর পোস্টমর্টেম করার জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা গোধরা স্টেশনে ফেলে রাখা হয়েছিল— যা এরকম খোলা জায়গায় হওয়ারই কথা নয়। গুজরাত পুলিশ ম্যানুয়াল অনুযায়ী, মৃত মানুষের পচা, পোড়া বা ক্ষতিগ্রস্ত দেহের ছবি তোলা বা তা মানুষের মধ্যে ছড়ানো হলে পুলিশের সুপারিন্টেন্ডেন্টকে দায়ী করা হবে। সেই আইন ভাঙা হয়েছে। মৃতদেহের ছবিই হয়েছে প্রতিশোধ নেওয়ার যুক্তি এবং তা ব্যাপকভাবে ছড়িয়েছে। গোধরায় ট্রেনে আগুন ধরার সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক পরিণতি আটকাতে পুলিশ কোনও চেষ্টাই করেনি। বরং ৫৪টি মৃতদেহ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা জয়দীপ পটেল ও হাসমুখ পটেলের হাতে তুলে দেওয়া হয়। নিয়ম অনুযায়ী মৃতদেহ শুধুমাত্র নিকটাত্মীয়দের দেওয়া হয়। সেই নিয়ম ভেঙে পুলিশ আগুনে পোড়া মৃতদেহ সাম্প্রদায়িক সংগঠনের নেতাদের হাতে তুলে দিয়েছিল। নেতারা গাড়ির মিছিলে সেই মৃতদেহ আমেদাবাদে নিয়ে গিয়েছিলেন। এই কাজ শুধু আইন ভাঙেনি, আগুনে ঘৃতাহুতি দিয়েছে। উদ্দেশ্যও ছিল তাই।

তিস্তা শেতলওয়াড়

তিস্তা জানিয়েছেন, ওই রাজ্যের সর্বাধিক প্রচারিত দুটি গুজরাতি দৈনিক পত্রিকা সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বালাতে সবচেয়ে বেশি ইন্ধন দিয়েছে। তার মধ্যে ‘সন্দেশ’ ছিল সবচেয়ে উগ্র। ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্দেশের প্রথম পাতায় রঙিন ছবিতে গোধরার পোড়া মৃতদেহের উপরে ব্যানার হেডলাইন ছিল— মৃতেরা চিৎকার করে বলছে, “১৫ জন হিন্দু মহিলাকে রেলের কম্পার্টমেন্ট থেকে ধর্মান্ধ জনতা টেনে নামিয়ে নিয়ে গেছে।” গুজরাত পুলিশ অবশ্য তা অস্বীকার করে। ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন, এডিটর্স গিল্ড এবং গুজরাত পুলিশের আইপিএস রাহুল শর্মা এবং আরবি শ্রীকুমার পরামর্শ দিয়েছিলেন অপরাধমূলক কাজের জন্য ওই দৈনিকের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। কোনও পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি।

ওই পত্রিকা দাঙ্গা বা হত্যার খবর যখন দিয়েছে বিবরণ পড়ে কোনওভাবে বোঝা যায়নি মৃতেরা কোন সম্প্রদায়ের। ১ মার্চ তাদের প্রথম পাতায় মিথ্যা রিপোর্টের হেডলাইনের নিচে খবর ছিল “সবরমতী এক্সপ্রেস থেকে অপহরণ করা তরুণী নারীদের মৃতদেহ স্তন কাটা অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।” অথচ বাস্তবে সেরকম কোনও ঘটনাই ঘটেনি। পুলিশ যে তা অস্বীকার করেছে রিপোর্টে তার কোনও উল্লেখ ছিল না। পরবর্তীকালে সরেজমিন তদন্তে গুজরাতে আসা এডিটর্স গিল্ডের রিপোর্টের একটা বড় অংশই ছিল সন্দেশের নানা জ্বালাময়ী মিথ্যা হেডলাইন। ওদিকে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন এবং এডিটর্স গিল্ড জানিয়েছিল সরকারি ছাপা বা টেলিভিশন মিডিয়ায় যে খবর প্রচার করেছে অন্তত তিন ডজন ক্ষেত্রে দেখা গেছে তা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের প্যামফ্লেট (ঘোষিত ঠিকানা-সহ) থেকে নেওয়া অংশ। কয়েকটির সূত্র অবশ্য জানা যায়নি। হিন্দু জনতার এই উত্তেজক খবরেরই দরকার ছিল।

 

তবে ২০০২ সালের অনেক আগে থেকেই গুজরাতে ঘৃণা ছড়ানোর কাজ শুরু হয়েছিল। গুজরাত ছিল আরএসএসের হিন্দুত্বের গবেষণাগার। রাস্তাঘাটে প্রথাগত প্রচার ছাড়া ঘৃণা ছড়ানোর জন্য নানা পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের ক্লাসঘরও নিষ্কলুষ ছিল না, কারণ রাজ্যের বোর্ডের সোশাল সায়েন্সের বইয়ের লেখাতেও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ফাটল তৈরি করা হয়েছে। গুজরাতি সমাজের ঘরে, ক্লাসরুমে, স্টাফরুমে, বাজারে— সর্বত্র তাই। রাজ্যে বিরোধী স্বর যেন বাইরের লোকের কথা।

বিদ্বেষী-ঘৃণাপূর্ণ লেখা গুজরাতের নানা পুস্তিকায় ব্যাপকভাবে পাওয়া যায়। ওইসব পুস্তিকার কথা ২০০২ সালের মার্চ-এপ্রিলের ‘কমিউনালিজম কম্ব্যাট’-এ প্রকাশিত হয়েছে। গুজরাত গণহত্যার চার বছর আগে, ১৯৯৮ সালের আগস্ট মাসে গুজরাত, মুম্বাই ও দিল্লির কিছু সমাজকর্মী রাধিকাপুর ও সাঞ্জেলি (পাঁচমহল) থেকে ফিরে বলেছিলেন, যেসব স্থানে আমরা গিয়েছি সব জায়গাতেই দেখেছি লিফলেটে বলা হয়েছে, “হিন্দুরা যখন জেগে ওঠে, খ্রিস্টানরা পালায়।” আমেদাবাদের বিশ্ব হিন্দু পরিষদ পুস্তিকায় মুসলমানদের হত্যা করতে বলে লিখেছে, “আপনার জীবন বিপন্ন— যে-কোনও সময় আপনি খুন হয়ে যেতে পারেন! ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেন: ‘তোমার অস্ত্র তোলো, অধর্মীকে হত্যা করো।’ ভগবান আমাদের কিছু বলতে চান… বিশ্বাসঘাতক মুসলমানদের সামাজিক ও আর্থিকভাবে বয়কট করে দেশপ্রেমের স্বাদ নিন।” বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লেখায় খ্রিস্টান ‘মিশনারি’ ও মুসলমান ‘জেহাদি’দের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বয়কট করে হিন্দু পুরুষকে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

দাঙ্গার অনেক আগে থেকেই তরুণ-তরুণীরা হিন্দু-মুসলমান বিচার না করে বিয়ে করলে লাভ-জেহাদের লক্ষ্য হত। রাজকোটের ১০৩ বছরের পুরনো খ্রিস্টান প্রতিষ্ঠান আইপি গার্লস সেকেন্ডারি স্কুলে নিউ টেস্টামেন্টের তিনশো কপি পোড়ানো হয়েছিল এবং গোটা রাজ্যে অন্তত ছত্রিশবার খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ করা হয়েছিল। খ্রিস্টান ও মুসলমানদের উপর হিংসার তদন্ত করতে ন্যাশনাল মাইনরিটিজ কমিশনের একটি দল গুজরাতে এসেছিল। গুজরাত গণহত্যা ছাড়া এইসব ঘটনার দিকে নজর রাখা খুবই জরুরি। ক্ষমতায় যাঁরা রয়েছেন তাঁদের নজরদারি সংগঠন ঘৃণার প্রচারের মাধ্যমেও ধর্মীয় সংখ্যালঘু, মহিলা ও দলিতদের ভয়ানক ক্ষতি করছে।

অতীতে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছিল একটি শহুরে বিষয়, গ্রামে ছড়িয়ে পড়েনি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ধর্ম নিয়ে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ব্যাপক প্রচারের জন্য ২০০২ সালে গ্রামেও ব্যাপক হত্যাকাণ্ড হয়েছিল। সেই রকম ঘটনাগুলির মধ্যে একটি ছিল ১ মার্চ সরদারপুরায় ৩৮ জন গ্রামবাসীকে কুপিয়ে হত্যা করার ঘটনা। ওই নৃশংস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে মোদি বলেছিলেন, ‘গুজব, সন্দেহ, অবিশ্বাসের জন্য উভয়পক্ষের উত্তেজনার ফলে সর্দারপুরা গ্রামে একটি ঘটনা ঘটেছিল।’ গুজব ঠেকাতে তিনি কোনও পদক্ষেপ করেননি।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

রাজ্য মন্ত্রিসভার অন্য মন্ত্রীরাও মোদির মতো একই মনোভাব দেখিয়েছেন। মন্ত্রিদের কারও কারও নির্বাচনী এলাকা একইরকম হিংস্র হয়ে উঠেছিল। কিছু ক্ষেত্রে মন্ত্রীরাই আক্রমণকারী জনতার নেতৃত্ব দিয়েছেন। যেমন রাজস্বমন্ত্রী, হরেন পান্ড্য, তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র আহমেদাবাদের পালডিতে আক্রমণকারী জনতার অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। পান্ড্যর শেষ নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল ‘পালডি থেকে মুসলমানদের চিহ্ন মুছে ফেলা হবে।’ মন্ত্রীরা ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী যে শপথ নিয়েছিলেন, সেই শপথকে তাঁরা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছেন। বোধহয় এখান থেকেই ‘জুমলা’ কথাটার উৎপত্তি হয়েছিল!

দাঙ্গা ও গণহত্যাকাণ্ড হয়েছিল বজরং দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতৃত্বে। গণহত্যা ঘটতই না, যদি পুলিশ শুরু থেকে যথাযথভাবে সতর্ক হত। পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ ছিল এবং আইনশৃঙ্খলার নিয়ন্ত্রণ হাত থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র হিংসাত্মক হয়ে উঠতে পারে এমন সম্ভাব্য ব্যক্তিদের প্রতিরোধমূলক গ্রেফতার করে। ওই ধরনের লোকের হিসাব সব থানাতেই পাওয়া যায়। ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ধারা ১৫১ পুলিশকে প্রতিরোধমূলক গ্রেফতারের অনুমতি দেয়। গোধরা কাণ্ডের পর দাঙ্গা ঠেকাতে পুলিশ তেমন প্রতিরোধমূলক গ্রেফতার করেনি। ২৭ ফেব্রুয়ারি আহমেদাবাদে অল্পকিছু প্রতিরোধমূলক মামুলি ও অন্যায় গ্রেফতার পুলিশের অভিপ্রায় কী ছিল বুঝিয়ে দিয়েছিল। অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রী ২৭ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় এক মিটিং-এ পুলিশের হাত-পা বেঁধে দিয়েছিলেন।

 

ট্রাইব্যুনালের (সিসিটি) সামনে স্পষ্ট প্রমাণ ছিল যে, গুজরাত পুলিশের বৃহৎ অংশ তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং গণহত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগ প্রতিরোধে সম্পূর্ণ ব্যর্থ ছিল। বরং দাঙ্গায় তাদের যোগসাজস ও বর্বরতা প্রকাশ পেয়েছে। তাই প্রাক্তন ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদের সচিব টিএসআর সুব্রমনিয়ন সেই সময় গুজরাত প্রসঙ্গে বলেছিলেন, গুজরাতে কোনও সিভিল সার্ভিস অবশিষ্ট নেই।[3] ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (আইএএস) এবং ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসের (আইপিএস) অফিসাররা, যাদের সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নিরপেক্ষ ও স্বাধীন বলে মনে করা হত, সরকার ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছিলেন।

তিস্তা জানিয়েছেন, গোধরায় অগ্নিসংযোগের পর গুজরাতের ২৫টির মধ্যে ১৯টি জেলায় ব্যাপক হিংসা ছড়িয়েছিল। গ্যাস সিলিন্ডারকে বোমার মতো ব্যবহার করা হয়েছে। সাদা রাসায়নিক পাউডার ব্যবহার করে মানুষের মাংস পোড়ানো হয়েছে, ত্রিশূল, রিভালভার-সহ নানা অস্ত্রের ব্যবহারই শুধু নয়, এমনভাবে খুন এবং মানুষকে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়েছে যে নারী, পুরুষ, শিশুকে আলাদা করে চেনা যায়নি। যেখানে মৃতদেহ পোড়ানো হয়নি, সেখানেই নিষ্ঠুরতার প্রকাশ সবচেয়ে বেশি হয়েছে। সে ছিল এক অমানুষিক করুণ দৃশ্য। দেখে মনে হয় একচেটিয়া রাজনীতির ইচ্ছা থেকে কি তীব্র ঘৃণা, কি তীব্র অমানুষিকতার জন্ম হয়েছে। ২০০২ সালে, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ দাঙ্গা বিষয়ের প্রতিবেদনে এক পুলিশ কর্মকর্তার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছিল যে, মুসলমানদের বাঁচানোর জন্য কোনও আদেশ ছিল না! ওই গণহত্যার কুড়ি বছর পর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আজও দেশ জুড়ে প্রচার চলছে।

অসরকারিভাবে দু-হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হলেও মুসলমানদের ঘরবাড়ি, সম্পত্তি ও ব্যবসার ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৪ হাজার কোটি টাকা। প্রায় পাঁচ হাজার ঘর সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে, দোকান পুড়েছে সাড়ে দশ হাজার, ভাঙচুর করা হয়েছে দু-হাজার তিনশো বাড়ি, আড়াই হাজারের বেশি হকারের ঠেলা লুঠ করা এবং আগুন ধরানো হয়েছে। পুড়েছে অসংখ্য গাড়ি ও মোটরসাইকেল। প্রায় তিনশো দরগা, আড়াইশো মসজিদ, ৩৬টি মাদ্রাসা, ৩টি চার্চ ও ২১টি মন্দির ধ্বংস অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দাঙ্গার সময় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় পাঁচশোটি ধর্মীয় ভবনের মেরামতের জন্য সরকারকে অর্থ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল, যা আদালত রাষ্ট্রের অবহেলা হিসাবে বর্ণনা করে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া দাঙ্গায় যাদের দোকান ধ্বংস হয়েছিল এমন ৫৬ জনকে ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য গুজরাত হাইকোর্ট মোদি সরকারের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার নোটিস জারি করেছিল।

নারোদা পটিয়া এবং নরোদা গামে দাঙ্গার ঘটনাস্থলে টেলিফোন রেকর্ড থেকে নেতাদের উপস্থিতি প্রমাণিত হয়েছিল। টেলিফোন রেকর্ডে জানা গিয়েছিল যে ওই বরিষ্ঠ নেতারা জনতাকে প্রাণঘাতী অস্ত্র সরবরাহ করেছিল এবং মুসলমানদের উপর আক্রমণের প্ররোচনা দিয়েছিল। তহেলকার আশিস খেতান গোপন ক্যামেরা ব্যবহার করে কিছু অভিযুক্তের সঙ্গে কথা বলে প্রমাণ করেছেন যে হামলাগুলিতে মোদির কেমন আশীর্বাদ ছিল। বেশিরভাগ দাঙ্গার ঘটনা পুলিশ থানা পর্যায়েই খারিজ করে দিয়েছিল। যা কিছু আদালতে গিয়েছিল সেক্ষেত্রে সরকারি আইনজীবীরা দাঙ্গাকারীদের রক্ষা করেছে। তহেলকার গোপন ক্যামেরার সামনে বাবু বজরঙ্গি বড়াই করে নিজের প্রসঙ্গে বলেছিল যে, যতক্ষণ না কেউ তাকে জামিন দেয় মোদি আদালতের বিচারক পরিবর্তন করে চলেছেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে যে গণহত্যা শুরু হয় ভারতের ইতিহাসে তা বিরাট কলঙ্ক। শুধু তাই নয় তারপরের বাইশ বছরে বেশিরভাগ অপরাধীরই সাজা হয়নি। হলেও হয়েছে সাধারণ ঘাতক জনতার কারও কারও। শুধুমাত্র একটি মামলায় ঘাতক জনতার নেতা বা নেতৃকে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তিনি ডাঃ মায়া কোদনানি। তিনি গাইনোকোলজিস্ট, এমএলএ এবং মোদি মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। নারোদা পটিয়ায় ৯৬ জন মুসলমানকে হত্যা করে পুড়িয়ে মারার ক্ষেত্রে উসকানি ও নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। তাঁর যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। ২০১২ সাল থেকে জেল খাটা কোদনানিকে ২০১৩ সালের নভেম্বর মাসে জামিন দেওয়া হয়। দিল্লিতে সরকার পরিবর্তনের পরে ২০১৪ সালের জুলাই মাসে অসুস্থতার জন্য তাঁর সাজা মুলতুবি রাখা হয়। চার বছরের মধ্যে, ২০১৮ সালে গুজরাত হাইকোর্ট তাকে নারোদা গণহত্যার অপরাধ থেকে অব্যাহতি দেয়। দশ বছর হল কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ক্ষমতায় রয়েছে। এই গণতান্ত্রিক দেশে, মোদির ভাষায় ‘মাদার অফ অল ডেমোক্র্যাসিস’তে এখন তীব্র নতুন উদ্বেগ চলছে, ডিকটেটরশিপ বা একনায়কতন্ত্র চালু হল বলে।

আহমেদাবাদে প্রায় লাখ খানেক মুসলমান বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী শিবিরে ঠাই নিয়েছিল। সরকার সহায়তা দেওয়ার পরিবর্তে, ক্যাম্পের শরণার্থীদের উপর লাঠিধারী পুলিশের মাধ্যমে সন্ত্রাসের কৌশল নিয়েছিল। আহমেদাবাদের বাইরে বাস্তুচ্যুত প্রায় ৬০ হাজার জন অকথ্য পরিস্থিতির মধ্যে শিবিরে ঠাঁই নিয়েছিল। তাদের প্রতি সরকার ও প্রশাসনের ছিল চূড়ান্ত অবহেলা। গুজরাত জুড়ে কয়েক ডজন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া দাঙ্গার শিকারদের মোদি সরকারি সহায়তা দেননি। এমনকি ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য পাঠানো আর্থিক সাহায্যও কেন্দ্রীয় সরকারকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। শোনা যায়, শরণার্থীদের উপহাস করে মোদি বলেছিলেন যে, শিবিরগুলো শিশু উৎপাদনের কারখানা, সেখানে সাহায্য করার দরকার নেই। তিনি ব্যঙ্গাত্মক স্লোগান তুলেছিলেন ‘হাম পাঁচ, হামারে পচিস’।[4] মুসলমান নাগরিকরা যে যন্ত্রণার শিকার হয়েছিল সে বিষয়ে পুরোপুরি অবহেলার ফলে যতক্ষণ না প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ি আহমেদাবাদে এসে শাহ-ই-আলম শিবির পরিদর্শন করেন, মোদি একটি শিবিরেও পরিদর্শনে যাননি। সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি দাঙ্গার শিকারদের আবেদন নেওয়ার সময় পরোক্ষভাবে মোদিকে ‘মডার্ন ডে নিরো’ বলে উল্লেখ করেছিলেন।

৪ এপ্রিল, প্রধানমন্ত্রী যখন ‘শাহ-ই-আলম’ শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন, নারী ও শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি শোক প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে রাজধর্ম পালন করার কথা, অর্থাৎ সরকারকে দায়িত্ব পালনের কথা বলেছিলেন। পরে, তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে ভারতের মুখ হারানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। ওই হত্যাকাণ্ডকে জাতির উপর দাগ হিসাবেও অভিহিত করেন।

তৎকালীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এলকে আদবানির ভূমিকা স্পষ্টতই পক্ষপাতমূলক ছিল। গুজরাত হত্যাকাণ্ড যে হিন্দুদের পক্ষে অমানবিক, লজ্জাজনক কাজ তা স্বীকার করতে তাঁর প্রবল অনীহা ছিল। তবে ইংল্যান্ডে তাঁর বিদেশযাত্রার সময় গুজরাত হত্যাকাণ্ডকে দেশের জন্য একটি দাগ হিসাবে উল্লেখ করেছিলেন।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছাত্রদের জীবন ও ভবিষ্যতের দিকে সরকারের নজর ছিল না। দাঙ্গার পর মর্মান্তিকভাবে দুঃস্থ ও অসহায় শিক্ষার্থীরা বার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করার সরকারকে অনুরোধ করেছিল। রাজ্য সরকার এবং পরে গুজরাত হাইকোর্ট তাদের আবেদন খারিজ করে দেয়। ১০ এপ্রিল, গুজরাত সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের ছাত্রদের নিরাপত্তার জন্য সংখ্যালঘু অঞ্চলের সমস্ত পরীক্ষাকেন্দ্র স্থানান্তর করার সিদ্ধান্ত নেয়। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ছেলেমেয়েদের কিন্তু এতসবের পরেও পরীক্ষা দিতে যেতে হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে, তাদেরই বরং নিরাপত্তার দরকার ছিল।

৩ সেপ্টেম্বর, ২০০২, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কার্যনির্বাহী সভাপতি, অশোক সিঙ্ঘল গুজরাতের গণহত্যাকে ‘সফল পরীক্ষা’ হিসাবে বর্ণনা করে সতর্ক করেছিলেন যে সারা ভারতে তার পুনরাবৃত্তি হবে। সিঙ্ঘল বলেছিলেন যে, গুজরাতের সাফল্যের উদাহরণ হল সমস্ত গ্রামগুলিকে ইসলাম এবং মুসলমানদের থেকে ‘শুদ্ধ করা’ হয়েছিল। তাঁর বক্তব্য সংবিধানবিরোধী ও আইনবিরোধী হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। কিন্তু সিঙ্ঘলের কথা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। বিজেপি একই কায়দায় দেশকে অনেকদিন ধরে মুসলমান-মুক্ত করতে চাইছে।

নিউ ইয়র্ক-ভিত্তিক ‘হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’ ২০১২ সালে জানিয়েছিল, গুজরাত সরকার অত্যাচারীদের রক্ষা করছে, যারা বিচারের প্রত্যাশী তাদের হয়রান করছে। যারা গণহত্যায় দোষী তাদের বিচার করা এবং অত্যাচার সয়ে যারা বেঁচে রয়েছেন তাদের বেশিরভাগকেই ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ রাজ্য সরকার মানেনি। নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত ঊর্ধ্বতন রাজ্য এবং পুলিশ কর্মকর্তাদের বিচার করার পরিবর্তে, সরকার ন্যায়বিচারকে অস্বীকার এবং বাধা দেওয়ার কাজে লিপ্ত হয়েছে। মনে রাখতে হবে, জীবিতদের অধিকাংশই কেবল তাদের জীবিকা ও আশ্রয় হারিয়ে ফেলেনি বরং দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকের মর্যাদায়ও অবনমিত হয়েছে।

গুজরাতে দাঙ্গা মামলার সঙ্গে জড়িত কর্মী ও আইনজীবীদের পরিকল্পিতভাবে হয়রানি করা ও ভয় দেখানো যেন স্বাভাবিক ঘটনা। ২৭ জানুয়ারি, ২০১২ সুপ্রিম কোর্টে একটি হলফনামায়, সিটিজেনস ফর জাস্টিস অ্যান্ড পিস-এর তিস্তা শেতলওয়াড় ক্রমাগত আইনি হয়রানির অভিযোগ করেন। একটি মামলায় প্রমাণের হেরফের করার জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তিস্তা ও তাঁর সংস্থা দাঙ্গা বা গণহত্যার পর থেকেই ন্যায়বিচারের জন্য লড়াই করছেন বলে তাঁদের এইভাবে হয়রানি ভোগ করতে হয়েছে। তিস্তা শেতলওয়াড়ের মতো কর্মী ও তাঁদের সংগঠনের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় কিছু ক্ষেত্রে অপরাধীরা দোষী সাব্যস্ত হয়েছিল। সমাজকর্মী এবং ভুক্তভোগীদের পরিবারের আবেদনের পরে সুপ্রিম কোর্ট বেশ কয়েকটি মামলার ক্ষেত্রে পুনর্বিচারের আদেশ দিয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে স্বাধীন তদন্তের তত্ত্বাবধান করেছে, বিচার নিশ্চিত করার জন্য মামলা গুজরাতের বাইরে স্থানান্তর করতেও বারবার হস্তক্ষেপ করেছে।

বেস্ট বেকারি মামলায় ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করেছিল। হাজারের বেশি হিন্দু জনতা মার্চের ১ তারিখে ভাদোদরায় বেস্ট বেকারি জ্বালিয়ে দিয়ে ১৪ জনকে হত্যা করেছিল। স্থানীয় ফাস্ট-ট্র্যাক আদালতের বিচারে, ২১ জন অভিযুক্তকে ২০০৩ সালের জুন মাসে খালাস করে দেওয়া হয়। বেশ কয়েকজন সাক্ষী বিরূপ হয়েছিল। পরে তারা জানায় যে তাদের ভয় দেখানো হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে মামলাটি মহারাষ্ট্রে পুনর্বিচারের পরিণতিতে ২০০৬ সালে ন-জন অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হয় এবং প্রত্যেককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একইভাবে ২০০৮ সালে, মুম্বাইয়ের এক নিম্ন আদালত বিলকিস বানোকে গণধর্ষণ এবং তাঁর পরিবারের ১২ জন-সহ মোট ১৪ জনকে হত্যার জন্য ১২ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে। গুজরাত দাঙ্গার বিচারের ক্ষেত্রে বার বার রাজ্য সরকারকে কাজ করতে বাধ্য করার জন্য সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। গুজরাতের বাইরে স্থানান্তরিত মামলাগুলির সফল বিচার দেখায় যে সরকার চাইলে অত্যাচারের যাঁরা শিকার, তাঁদের এবং অন্য সাক্ষীদের সুরক্ষা দিতে পারে।

 

গুজরাত গণহত্যার পর থেকে মোদিকে তাঁর জনসংযোগ দল ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। তখনই ‘গুজরাত মডেল’ স্লোগানটি তৈরি করা হয়েছিল। এখন গুজরাতের এলাকাগুলি কার্যত বিভক্ত, মুসলিম ও হিন্দু এলাকার মধ্যে বিভাজন রয়েছে যা আগে ছিল না। ২০০২ সাল থেকেই গুজরাতের শহরে ও গ্রামে  সংবিধান অমান্য করে অসংখ্য সাইনবোর্ডে লেখা হয়েছে, ‘ওয়েলকাম টু হিন্দু রাষ্ট্র’। ওদিকে দাঙ্গার কিছু পর থেকে প্রচারের সুবাদে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর জন্ম হয়েছে। সে আরেক গল্প।

২০১৪ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মোদি সারা দেশে ওই মডেলটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করছেন। গরুর মাংস খাওয়া বা নিয়ে যাওয়া, মুসলমান যুবকের হিন্দু যুবতী বা হিন্দু যুবকের মুসলমান যুবতীকে বিয়ে করার বিরুদ্ধে, হিন্দুদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার অজুহাতে বহু মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে, কারও শাস্তি হয়নি। করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়, বিদ্বেষের বশে ভারতীয় মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইসলামি ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে সারা দেশে করোনা ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

গুজরাতের অপরাধ থেকে চোখ ঘোরাতে সঙ্ঘ পরিবার ক্রমাগত ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যা বা ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে কাশ্মিরি পণ্ডিতদের হত্যা ও নির্বাসনের কথা তোলে। এই প্রচেষ্টার লক্ষ্য হল সরকারি দায়বদ্ধতা এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্নগুলি যেন হারিয়ে যায়। রাষ্ট্রের সকলকে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যর্থতা যেন ঢেকে যায়। বিজেপি এবং কংগ্রেস একে অপরের দিকে আঙুল তুললেও, তাদের দাঙ্গায় জড়িত থাকার অভিযোগগুলি শুধুমাত্র রাজনৈতিক লাভের জন্য, দোষীদের বিচারের আওতায় আনা নিশ্চিত করার জন্য নয়। এ-কথাও মনে রাখা দরকার, দিল্লির সরকারের বেশ কয়েকবার পরিবর্তন সত্ত্বেও ১৯৮৪ সালের নভেম্বরের শিখ গণহত্যার ন্যায়বিচার করা হয়নি। কাপুর-মিত্তল কমিশনের মতো সরকারি তদন্ত কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী অভিযুক্ত পুলিশের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, উল্টে অনেকে পদোন্নতি পেয়েছেন।

৬৫ হাজার কাশ্মিরি পণ্ডিত পরিবারের বাধ্যতামূলক নির্বাসন রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকার বা শাসক দলের প্রশ্রয়ে হয়নি, হয়েছে তাদের অক্ষমতায়, পাকিস্তানি মদতে জঙ্গি উপদ্রবের জন্য। তারপর এত বছর ধরে কাশ্মির সেনাবাহিনি দিয়ে ঢেকে দিলেও সেই অক্ষমতা কাটেনি। একটি সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠীর বিক্ষিপ্ত, বিপর্যস্ত দলে পরিণত হওয়া অবশ্যই ভারতের মর্মান্তিক ট্র্যাজেডিগুলির একটি। তবে ভারত সরকার বাস্তুচ্যুত এইসব পরিবারদের মৌলিক সুযোগ-সুবিধা এবং ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করেছে, আর্থিক সাহায্যও করেছে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সংসদে এক প্রশ্নের উত্তরে জানা গেছে, মাত্র একটি কাশ্মিরি পন্ডিত পরিবার ২০০৮ সালের কাশ্মিরি অভিবাসীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের জন্য ব্যাপক প্যাকেজ অনুসারে কাশ্মির উপত্যকায় ফিরে গেছে এবং মোট দেড় হাজার যুবককে সরকারি চাকরি দেওয়া হয়েছে।

পরিহাসের বিষয় হল যে কেন্দ্রের ধারাবাহিক সরকারগুলো কাশ্মিরি পণ্ডিতদের জন্য যে ত্রাণ সরবরাহ করেছিল তা ২০০২ সালের দাঙ্গার পরে গুজরাতের মুসলমান শরণার্থীদের সঙ্গে যে নির্মম আচরণ করা হয়েছিল তার তুলনায় খুবই উদার বলে মনে হবে। ১৯৮৪ সালের গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া শিখরাও আর্থিক ক্ষতিপূরণের দিক থেকে এগিয়ে ছিল। কংগ্রেস টাকা দিয়ে পাপ ধুয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু গুজরাত তাও করেনি।

আমাদের দাবি হোক ধর্মীয় বা রাজনৈতিক বিশ্বাস নির্বিশেষে সব ভুক্তভোগীদের সমানভাবে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। অবশ্যই সমস্ত অপরাধীদের শাস্তি পেতে হবে, তারা যে ইউনিফর্মই পরুক না কেন, যে রাজনৈতিক দলে বা যে উচ্চ পদেই থাকুক না কেন। যে সমাজ আজ জনসংখ্যার এক অংশের জন্য এই গ্যারান্টি দিতে পারে না তারা আগামীকাল অন্যদের ক্ষেত্রেও একইরকম ট্র্যাজেডি রোধ করতে পারবে না। ভাবতে হবে, কেন আমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা এমন লোকেদের হাতে দিই যারা বিভাজনমূলক প্রচার করে, সক্রিয়ভাবে বিভাজনে উত্সাহিত করে? যারা হিংসায় দোষী ব্যক্তিদের তদন্ত ও শাস্তি দেওয়ার জন্য কিছুই করে না?

 

গত দশ বছর ধরে যেভাবে নরেন্দ্র মোদির প্রচার করা হয়েছে, ভেবে দেখুন, তা একেবারে তুলনাহীন। এমন বুক বাজানো আমাদের সংস্কৃতিতে আগে কখনও দেখেছি কি? দেশের সরকার ও রাষ্ট্র সব ব্যাপারে এমন প্রধানমন্ত্রী-নির্ভর ছিল না। ওদিকে গণতন্ত্র ভয়ঙ্করভাবে বিপন্ন, দেশের গণতন্ত্রের উপর চলেছে অবিরাম আক্রমণ। আমাদের অলক্ষ্যে এরই মধ্যে দেশের মানুষের মনও বদলে যাচ্ছে। স্কুল ও কলেজের সমীক্ষা ইঙ্গিত করছে যে, তরুণরা ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় আদর্শ নেতার রোলমডেল হিসেবে গান্ধির চেয়ে হিটলারকে বেছে নিচ্ছে।

ভারতীয়দের নিয়ে ২০২৩ সালে পিউ ইন্সটিটিউট-এর এক সার্ভেতে জানা গেছে, দেশের ৮৫ শতাংশ মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসক বা মিলিটারি শাসকদের পছন্দ করে। যেসব দেশে পিউ ইন্সটিটিউট ওই সার্ভে করেছে তার মধ্যে আর কোনও দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসকের জন্য এত বেশি শতাংশ মানুষের সমর্থন নেই। হর্ষ মন্দর জানিয়েছেন, ভারত বিশ্বের অল্প কয়েকটি দেশের মধ্যে একটি যেখানে হিটলারের আত্মজীবনীমূলক ইস্তেহার ‘মেইন কামফ’ খোলামেলাভাবে বিক্রি হয়। বইটি দেশের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া বইয়ের মধ্যে পড়ে। আমাদের তাই জানা প্রয়োজন ওই সমর্থন শেষ পর্যন্ত আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে।[5] একই সঙ্গে জানা দরকার হিটলার যে সময়ে জার্মানিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং দেশটি যখন ব্যাপক হত্যাকাণ্ড বা হলোকস্টের জন্য তৈরি হচ্ছে, সেই সময় হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতারা ইহুদি সমস্যা মেটানোর জন্য হিটলারের কাজের কেমন  প্রশংসা করেছেন।

হর্ষ মন্দর

১৯৩৮ সালে জার্মানিতে যখন ইহুদিবিরোধী আইন তৈরি হল হিন্দু মহাসভার বড় নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকর ভারতীয় মুসলমানদের একইরকম নিয়তির কথা বলেন। তিনি বলেন, “জাতি গঠিত হয় সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে… জার্মানিতে ইহুদিরা কী করছে? তারা সংখ্যালঘিষ্ঠ বলে জার্মানি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।”

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু হওয়ার পর, ১৯৪০ সালে সাভারকর বলেন, “হিটলারকে মানবদানব মনে করার কোনও কারণ নেই… জার্মানি যে অবস্থায় পড়েছিল, এটা প্রমাণিত যে নাৎসিবাদ তার ত্রাণকর্তা… বাস্তব হল নাৎসি বা ফ্যাসিস্টদের জাদুদণ্ডের স্পর্শে জার্মানি বা ইতালি চমৎকারভাবে উঠে দাঁড়িয়ে প্রবল ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছে। সেটাই প্রমাণ করে যে তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ওই রাজনৈতিক ইজমের সবচেয়ে উপযোগী টনিক দরকার ছিল।” তিনি আরও লেখেন, “আর্য সংস্কৃতির শত্রুদের বিরুদ্ধে জার্মানির ধর্মযুদ্ধ পৃথিবীর সমস্ত আর্য জাতিকে প্রণোদিত করবে এবং ভারতীয় হিন্দুদের অতীতের গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্য জাগ্রত করবে।”

মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর হলেন আরএসএসের সবচেয়ে প্রভাবশালী মতাদর্শী, যেন বিজেপির মতাদর্শের ধ্রুবতারা। তিনিও নাৎসিবাদের জোরালো সমর্থক এবং ভারতে সেই মতাদর্শের প্রয়োগের কথা বলেছেন। তাঁর কথায়: “জার্মান জাতিগর্ব আজকের দিনের বিষয় হয়ে উঠেছে। সেই জাতি এবং তার সংস্কৃতির বিশুদ্ধতা রাখতে গিয়ে জার্মানি ইহুদিদের মতো সেমেটিক জাতি থেকে দেশকে শুদ্ধ করে বিশ্বকে হতবাক করেছে। সেখানে সর্বোচ্চ জাতি-অহঙ্কার উদ্ভাসিত হয়েছে। জার্মানিই দেখিয়েছে জাতি এবং সংস্কৃতির জন্য তা কতটা সম্ভব।… হিন্দুস্তানে (ভারতে) আমাদের তা শেখা এবং লাভের জন্য এক ভাল পাঠ।

হিটলারের বক্তৃতাকে প্রতিধ্বনিত করে, ইউরোপীয় ইহুদিদের জায়গায় ভারতীয় মুসলমানদের প্রতিস্থাপিত করে তিনি আরও বলেছিলেনঃ দেশীদের জন্য কেবল দুটি পথ খোলা রয়েছে, হয় জাতীয় বর্ণে নিজেদের একীভূত করে তার সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে, অথবা যতক্ষণ না জাতীয় বর্ণ তাদের সেই অনুমতি দেয় বা জাতীয় জাতির মিষ্টি ইচ্ছায় দেশ ছেড়ে চলে যেতে হয়, তাদের দয়ায় জীবনযাপন করতে হবে। সংখ্যালঘু সমস্যা নিয়ে এটাই একমাত্র সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি, এটাই একমাত্র যৌক্তিক ও সঠিক সমাধান। এটাই জাতীয় জীবনকে সুস্থ ও শান্তিপূর্ণ রাখে।

হর্ষ মন্দর সাম্প্রতিক স্ক্রলে লিখেছেন:

রসায়নবিদ, লেখক এবং আউশউইৎস থেকে বেঁচে ফেরা প্রিমো লেভি ছিলেন ইহুদি। তিনি ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধেও সামিল হয়েছিলেন। তাই তাঁকে ইতালিতে আটক করা হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বা মৃত্যুশিবির থেকে মুক্তি দেওয়া হয়, তাঁকে দেখে চেনার উপায় ছিল না। অপুষ্টিতে মুখ ফুলে গেছে, ওদিকে শরীর যেন কঙ্কাল। জীবনের বাকি ৪০ বছর ধরে, তিনি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের স্মৃতিদানবের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। প্রিমো লেভি সমস্ত মানবজাতির উদ্দেশ্যে হলোকস্ট নিয়ে সতর্কবার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, এটা ঘটেছে, তাই আবার এটা ঘটতে পারে…

 

References:

[সমাপ্ত]


[1] মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধেও বড় অভিযোগ ছিল।
[2] এর মধ্যে ছিল গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ড, নারোদা পাটিয়া এবং নারোদা গাম হত্যাকাণ্ড।
[3] দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। এপ্রিল ১০, ২০০২।
[4] আমরা পাঁচজন, আমাদের আছে পঁচিশজন। অর্থাৎ, প্রতিটি মুসলিম পুরুষ চারটি মহিলাকে বিয়ে করে, পঁচিশটি সন্তানের জন্ম দেয়।
[5] ইউরোপীয় ইহুদিদের নাৎসি গণহত্যাকে হলোকাস্ট বলা হয়। আউশউইৎজ ছিল জার্মান-অধিকৃত পোল্যান্ডে ৪০টি নাৎসি নির্মূল শিবিরের এক কমপ্লেক্স। এই নির্মূল শিবিরে, আউশউইৎজে নিহতদের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হত।

আট দশক আগে, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত সেখানে হত্যা করার জন্য অথবা দাস হিসেবে কাজ করানোর জন্য চিহ্নিত দশ লক্ষেরও বেশি মানুষকে রেলপথে নিয়ে আসা হয়েছিল আউশউইৎসে। বেশিরভাগই ছিল জার্মান-অধিকৃত ইউরোপের ইহুদি মহিলা-পুরুষ-শিশু। সাধারণ মানুষ, যুদ্ধবন্দি, বুদ্ধিজীবী এবং রাজনৈতিক কর্মী, ক্যাথলিক যাজক, সমকামী— সবাই ছিলেন। মালবাহী ট্রেনের অন্ধকার, বায়ুবিহীন বগিতে একসাথে কয়েক দিনের কষ্টকর যাত্রার পর তাঁদের চলা শেষ হয়েছিল। ট্রেনে শুয়ে থাকার জায়গা ছিল না, মলমূত্র ত্যাগেরও আলাদা জায়গা ছিল না। পথেই অনেকের মৃত্যু হয়েছে।

তারপরও তারা শান্ত ছিল, কারণ তাদের বলা হয়েছিল যে সেই নতুন জায়গায় তারা পরিবারের সঙ্গে পুনর্বাসিত হবে। তাদের সবচেয়ে মূল্যবান ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ৫০ কেজি ওজনের একটি স্যুটকেস বহন করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যারা শ্রম দিতে সক্ষম এবং যারা তা ছিল না তাদের সবাইকে রেললাইনের শেষ প্রান্ত থেকে বিভিন্ন দিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল— বয়স্ক  মানুষ, প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী মহিলা, ছোট বাচ্চা সহ মহিলা। শিশুরা শ্রমের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত ছিল।

কেউ জানত না, সন্দেহও করেনি যে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে। শ্রমের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত দলকে বলা হয়েছিল যে তাদের জীবাণুমুক্ত করে স্নান করানো হবে। তাদের স্যুটকেসগুলো কেড়ে নিয়ে নগ্ন হতে বলে শাওয়ার রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রায় ২ হাজার লোক ছোট, প্রায় বাতাসবিহীন ঝরনাঘরে বন্দি ছিল। মানুষ আতঙ্কিত হলে, প্রতিবাদ করলে গুলি করে মেরে ফেলা হত। কেউ নড়াচড়া করতে পারবে না এমনভাবে ঘরটি ভর্তি করে রক্ষীরা দরজা ও জানালাগুলো বন্ধ করে দিত। এরপর ঘরে ব্লু জাইক্লন বি ক্রিস্টাল ছুঁড়ে দেওয়া হত। ওই স্ফটিক থেকে প্রাণঘাতী হাইড্রোজেন সায়ানাইড নির্গমন হওয়ার জন্য ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে সবাই মারা যেত। বিশাল চুল্লিতে মৃতদের লাশ পুড়িয়ে ফেলা হত। আউশউইৎজ কমপ্লেক্সের বৃহত্তম বিরকেনাউ নির্মূল শিবির শ্মশানে প্রতিদিন দু-হাজার মৃতদেহ পুড়িয়ে ছাই করার ক্ষমতা ছিল। তাদের মনে হল, এও খুব কম, খুব ধীরগতিতে কাজ হচ্ছে। তারপর দিনে কুড়ি হাজার মৃতদেহ পোড়ানোর ক্ষমতার বড় চুল্লি তৈরি করা হল। মানুষ পোড়া ছাই পরবর্তীকালে সার হিসেবে ব্যবহার করা হত, জঙ্গল ও নদীতে ছড়িয়ে দেওয়া হত।

দাস শ্রমের জন্য বেছে নেওয়া অন্য দলকে— প্রধানত রাসায়নিক জায়ান্ট কোম্পানি আইজি ফারবেন, ক্রুপস এবং সিমেন্সের মতো বড় কর্পোরেশনের কাজে ব্যবহার করা হত। ব্যারাকে নিয়ে যাওয়ার আগে তাদের চুল-দাঁড়ি-গোঁফ কাটিয়ে জেলের ইউনিফর্ম পরানো হত।  বাহুতে একটা নম্বর ট্যাটু করা হত, তখন থেকে তারা আর মানুষ নয়, কেবল সংখ্যা।

প্রতিটি ব্যারাকের আয়তন ছিল ৩৫ বাই ১১ মিটার। প্রথমদিকে সেখানে ৫৫০ জন, পরে ৭০০-র বেশি বন্দিকে রাখা হত। প্রতিটি বাঙ্ক বিছানায় তিন-চারজন করে শুত। একজন বন্দির শরীর এবং জিনিসপত্রের জন্য মাত্র এক বর্গ মিটার জায়গা বরাদ্দ ছিল। ব্যারাকের একপাশে ছিল সারি সারি শুকনো খোলা কমোড, যা ব্যবহার করার জন্য প্রতিটি বন্দিকে দিনে এক মিনিট করে সময় দেওয়া হত। খাবার ছিল জলের মতো স্যুপ আর দিনে ৩০০ গ্রাম রুটি। বন্দিদের ওজন দ্রুত কমে হত ৩৫ কেজি কিংবা আরও কম। কঙ্কালের মতো চেহারা হয়ে যেত।

প্রতিদিন তাদের অর্কেস্ট্রার আনন্দ সঙ্গীতের সঙ্গে ১১ ঘন্টা কাজ করতে হত। কখনও কাজ করার জন্য দূরেও নিয়ে যাওয়া হত। জেলের ডোরাকাটা পাতলা ইউনিফর্ম শীতকালের তাপমাত্রার জন্য কিছুই নয়, তবু এছাড়া শরীরে চাপাবার আর কিছু দেওয়া হত না। বেশিরভাগই রোগ, ক্ষুধা বা ক্লান্তিতেই মারা গেছে। ওইরকম দাস শ্রমের পরও যারা বেঁচে গিয়েছিল তারা নিজেদের কঙ্কাল হিসাবে বর্ণনা করেছিল। কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে একজন বন্দি দাস শ্রমিকের গড় জীবনকাল ছিল মাত্র দু-মাস।

যেসব বন্দিদের অবাধ্য বা বিদ্রোহী মনে করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি ছিল কঠোর এবং নির্দয়। যে ক্রিয়াকলাপকে শাস্তিযোগ্য মনে করা হত তার মধ্যে রয়েছে খাবার পরিবেশন করার সময় দ্বিতীয়বার খাবার নিতে আসা, গোপনে রুটি কেনার জন্য সোনার দাঁত তুলে ফেলা, শূকরের খাবার চুরি করা, কারও পকেটে হাত দেওয়া, কাউকে সাহায্য করা, বন্দিকে মারধর করা বা মাটি থেকে সিগারেটের বাট তোলা। কে শাস্তির যোগ্য সেই সিদ্ধান্ত নিত রক্ষীরাই, তারাই শাস্তি কার্যকর করত। কাউকে বেত মারা হত। কারও মাথা এমনভাবে চুল্লির আগুনের কাছে নিয়ে যাওয়া হত যে মুখ, ভুরু পুড়ে যেত। কাউকে জানালা বহীন মাটির নিচের ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হত। সেখানে চারজন পুরুষের দাঁড়ানোর জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল না। কখনও কখনও তালাবন্ধ অবস্থায় তিন সপ্তাহও রাখা হত, অবশ্য যদি ততদিন বেঁচে থাকত। বিরতিহীনভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। ওইভাবেই ঘুমাত, মলত্যাগ, পেচ্ছাপ করত। কখনও অজ্ঞান হয়ে যেত বা মারা যেত।

কয়েকজনকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া বন্দিদের নগ্ন করে, পিঠের পিছনে হাত বেঁধে দিয়ে রক্ষীরা মাথার পিছনে গুলি করত। বন্দিরা জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখত। সেখানে বিদ্রোহ হয়নি বললেই চলে। আউশউইৎজের মৃত্যুশিবির থেকে মাত্র ১৪৪ জন পালাতে পেরেছিল। কোনও বন্দি পালালে, খুশিমতো অন্য কিছু বন্দিকে নিয়ে একটি ঘরে তালাবন্ধ করে রেখে খাবার না দিয়ে অনাহারে মেরে ফেলা হত।

কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের বন্দিদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাস এবং মাথার উপরের আকাশ সর্বদাই মানুষের ঘাম ও দেহ পোড়ানোর ধোঁয়ায় ঢাকা থাকত। ক্যাম্পে নতুন বাসিন্দারা জিজ্ঞাসা করত: আমাদের সন্তান, আমাদের স্ত্রী, আমাদের বাবা-মা কোথায়? কবে তাদের সঙ্গে দেখা হবে? অভিজ্ঞরা আকাশের দিকে ইশারা করত। বলত, উপরে তাকান, ধোঁয়াই আপনার সন্তান, আপনার স্ত্রী, আপনার মা। তাদের দেখতে হলে এইই দেখতে হবে, যতদিন না আপনিও তাঁদের সঙ্গে মিলিত হন।

আউশউইৎস ঘটেছে, কারণ সেই সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ জার্মান আউশউইৎজের ধারণাকে সমর্থন করেছিল। মনে করেছিল যে, একদল লোকের অন্যকে শত্রু হিসাবে বিবেচনা করার অধিকার রয়েছে। তারা এতই বিপজ্জনক যে তাদের নিপীড়ন, বহিষ্কার এবং নির্মূল করাই হল অন্যদের পরিত্রাণের পথ। তাদের জগতে নৈতিকতা বলে কিছু ছিল না।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. এ রকম লেখা সময়োপযোগী, পড়তে পড়তে শিউরে উঠি |

1 Trackback / Pingback

  1. গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি: আরবি শ্রীকুমারের প্রতিবাদ – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...