অমিত শাহের একটি সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকার— সাংবাদিকরা যখন স্বধর্ম ভুলে যান

গৌতম রায়

 


আসন্ন লোকসভা ভোটের সব থেকে বড় রাজনৈতিক প্রশ্নটি হল, দেশের মানুষ পেট ভরে খেতে পাবে কিনা। দেশের মানুষ অল্প মূল্যে আধুনিক চিকিৎসা পাবে কিনা। বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ তাঁদের মেধা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী নিজের নিজের রাজ্যে মেধা বা শারীরিক পরিশ্রমের বিনিময়ে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবে কিনা। তারকা সাংবাদিকদের কাছে অমিত শাহের সামনে এই সমস্ত প্রশ্নগুলি কোনও গুরুত্ব পায়নি

 

আসন্ন লোকসভা নির্বাচন (২০২৪) ঘিরে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সম্প্রতি কলকাতার একটা বাংলা খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। সাক্ষাৎকারের প্রায় গোটাটাই খরচ হয়েছে আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির সাফল্য পাওয়ার তথাকথিত সম্ভাবনাকে ঘিরে। সাক্ষাৎকারটি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর, নাকি বিজেপির কোনও শীর্ষনেতার, যিনি প্রশাসনিক কোনও পদে নেই, তা নিয়ে প্রথমেই একটা সংশয় পাঠকের মধ্যে জাগবে।

প্রশাসনিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে অমিত শাহের যে-ধরনের মন্তব্য এই সাক্ষাৎকারে উঠে আসা দরকার ছিল, সেই ধরনের মন্তব্য পাওয়ার প্রত্যাশা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের মধ্যে আদৌ ছিল না-ই বলা যেতে পারে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে কী কী কৌশলের ওপরে জোর দিয়ে বিজেপি তাদের লক্ষ্যমাত্রা থেকেও বেশি আসনের প্রত্যাশায় রয়েছে, সেই দিকগুলিকে তুলে ধরাই যেন প্রশ্নকর্তাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য ছিল ওই সাক্ষাৎকারে।

প্রশ্নকর্তারা হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন, তাঁরা দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। তাঁরা বোধহয় মনে করেছিলেন, বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় যেমন অমিত শাহ বিজেপি দলের সভাপতি ছিলেন, এখনও বুঝি তিনি এমনটাই আছেন। হিন্দুত্ববাদী শক্তি শাহকে বিজেপি সভাপতি পদের আবদ্ধ না রেখে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করেছে, এ-কথাটা সম্ভবত প্রশ্নকর্তারা ভুলে গিয়েছিলেন।

তাই বিজেপি দল ঘিরে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা যত বেশি প্রশ্ন করেছেন, তার ন্যূনতম প্রশ্ন তাঁরা করেননি ভারতের আইনশৃঙ্খলা থেকে শুরু করে, নরেন্দ্র মোদি নেতৃত্বাধীন-বিজেপি পরিচালনাধীন সরকারের প্রশাসনিক সাফল্য, অর্থনৈতিক সাফল্য, কর্মসংস্থান এসব ঘিরে।

বিজেপি দল আসন্ন নির্বাচনে কত আসন পাবে? সেই প্রশ্ন তো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে করবার থেকে, অনেক বেশি জরুরি ছিল, বিজেপির দলীয় সভাপতির কাছে করা। আর বিজেপি দলীয় সভাপতিও সে-প্রশ্নে আশা করি অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন উত্তর দিতে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তুলনায়।

সাক্ষাৎকার পর্ব যত এগিয়েছে, তত মনে হয়েছে, অমিত শাহ ভুলে গিয়েছিলেন তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। দলীয় সভাপতির জায়গা থেকেই যেন বিজেপির রাজনৈতিক কলাকৌশল যতটা রেখেঢেকে মানুষের সামনে তুলে ধরলে বিজেপির রাজনৈতিক সাফল্য আসন্ন নির্বাচনে উঠে আসে, সেটাকেই বাঙালি সমাজের কাছে তুলে ধরতে সংশ্লিষ্ট পত্রিকাটিকে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছেন।

দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে সাংবাদিকেরা সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করে বসেন বিগত বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপির আসন ঘিরে অমিত শাহের প্রত্যাশা এবং প্রত্যাশা না পূরণ হওয়ার বিষয়টিকে ঘিরে। গোটা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেও তীব্র বেকারত্ব, সম্পদের অসম বণ্টন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার গঙ্গাযাত্রা, শিক্ষাব্যবস্থার অন্তর্জলী যাত্রা, ভয়াবহ সামাজিক বিভাজন, হিন্দু-মুসলমান, মন্দির-মসজিদ ছাড়া যখন শাসকের মুখে আর কোনও শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে না, ঠিক তখনই, কেন বিগত বিধানসভা নির্বাচনে (২০২১) পশ্চিমবঙ্গে আশানুরূপ সাফল্য বিজেপি পেল না তার ময়নাতদন্ত দিয়ে সাক্ষাৎকার-পর্ব শুরু হল। আর তার উত্তরে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রথমেই তীব্র করে তুললেন তাঁদের চিরাচরিত সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী অবস্থানটিকে। বোঝা গেল, আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে সরকার, শাসক এবং গোদি মিডিয়ার অবস্থানটি ঠিক কোন জায়গায়।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, তাঁর দলের কর্মী, সমর্থক, নেতা— সবার কাছে আসন্ন নির্বাচনে দলের জন্য আসনসংখ্যা বেঁধে দেওয়ার বিষয়টি ঘিরে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সামনে প্রশ্ন উচ্চারিত হয় সাংবাদিকের মুখ থেকে, তখন সংশয় জাগে এটা কি কোনও পেশাদার সংবাদপত্র পড়ছি? নাকি, আরএসএসের সাংগঠনিক পত্রিকা ‘পাঞ্চজন্য’ বা ‘স্বস্তিকা’ বা ‘অর্গানাইজার’ বা ‘বিশ্বহিন্দু বার্তা’ জাতীয় কোনও পত্রিকা আমরা পড়ছি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে অমিত শাহ ওই সাক্ষাৎকারে প্রশ্নকর্তার প্রশ্নের উত্তরে যখন জানান, রামমন্দিরের ‘ফায়দা’ বিজেপির হবে, তখনই খুব পরিষ্কার হয়ে যায়, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি কীভাবে দশরথনন্দন রামকে কার্যত তাঁদের দলীয় সদস্য হিসেবে ব্যবহারে প্রয়াসী।

অযোধ্যায় ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের ধ্বংসস্তুপের উপর নির্মিত বিতর্কিত রামমন্দির যদি ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের উদ্দেশ্যে পরিচালিত না হয়ে থাকে, তাহলে এই রামমন্দিরকে ঘিরে ‘ফায়দা’ শব্দটি কী করে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ব্যবহার করলেন? এই কথা থেকেই এটা পরিষ্কার, রামকে ঘিরে কোনওরকম আধ্যাত্মিক বা ধর্মীয় আবেগ সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তি আরএসএস-বিজেপি বা তাদের হাজারো রকমের শাখা সংগঠনের ছিল না। রামকে ঘিরে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের আবেগকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা তোলাই তাদের উদ্দেশ্য।

১৯৫০ সাল থেকে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে রামমন্দির নির্মাণের যে রাজনৈতিক পরিকল্পনা, সামাজিক পরিকল্পনার আবডালে আরএসএস নিয়ে আসছে, তাকে এই সাক্ষাৎকারে প্রায় খোলাখুলিভাবে স্বীকার করেছেন অমিত শাহ।

আমরা নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন দেখেছি, বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মোদি বলেছিলেন: সংসদে বিজেপির কতখানি আসনসংখ্যার শক্তি থাকবে, তার উপরে নির্ভর করবে তাঁদের নিজস্ব যে-সমস্ত রাজনৈতিক ইস্যু, অর্থাৎ বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর রামমন্দির নির্মাণ, সংবিধানের ৩৭০ ধারার অবলুপ্তি, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ইত্যাদি বিষয়গুলিকে তুলে ধরা।

সংবাদমাধ্যম সেই সময়কালেও ওই সমস্ত ইস্যুগুলিকে আরএসএসের হিডন অ্যাজেন্ডা বা গোপন কর্মসূচি বলে ব্যাখ্যা করে যেত। কিন্তু গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসেই মোদি বলেছিলেন, ওগুলি আদৌ বিজেপির গোপন কোনও কর্মসূচি নয়। একেবারে প্রকাশ্য কর্মসূচি। কেবলমাত্র সংসদে বিজেপির আসনসংখ্যার উপর লক্ষ্য রেখে, সময়বিশেষে, এই সমস্ত ইস্যুগুলিকে তারা জোরদার করবে।

কার্যক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মোদি যে দাবি জানিয়েছিলেন, বিজেপি এককগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর সেই দাবিগুলিকে রূপায়িত করবার ক্ষেত্রে কতখানি তীক্ষ্ণ এবং তীব্র ভূমিকা তারা পালন করেছে। বিজেপি সরকারের এই কর্মসূচিগুলি পালনের কথা অমিত শাহের যে সাক্ষাৎকারটি ঘিরে আমরা আলোচনা করছি সেখানেও তিনি জোরের সঙ্গেই বলেছেন।

আমাদের ভাবতে আশ্চর্য লাগে, দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময় বহুলপ্রচলিত সংবাদপত্রের তাবড় তাবড় সাংবাদিকেরা একটিবারের জন্যও দেশের বে-রোজগারি নিয়ে প্রশ্ন করেন না। প্রশ্ন করেন না দেশের ভয়াবহ বেকারত্ব ঘিরে। প্রশ্ন করেন না, লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলিকে প্রায় জলের দরে কেন্দ্রের শাসকদের প্রীতিভাজন গুটিকয়েক শিল্পপতিদের হাতে বিক্রি করে দেওয়া ঘিরে। তাঁরা প্রশ্ন করেন, বিভাজনের রাজনীতিকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে যে যে উত্তরগুলি অমিত শাহের মুখ দিয়ে পাঠকদের কাছে পরিবেশিত করা দরকার, সেই বিষয়গুলিকে ঘিরে।

এমন একটা প্রবাহের অবতারণা সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে করা হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হয়, ওই বিষয়গুলিই হচ্ছে এখন ভারতের সবথেকে বড় রাজনৈতিক বিষয়। ভয়াবহ অর্থসঙ্কট নিয়ে কোনও শব্দ অমিত শাহের মুখ থেকে ওই সাক্ষাৎকারে উচ্চারিত হয়নি। কারণ, গোদি মিডিয়া চায় না মানুষের রুটিরুজির মূল প্রশ্নগুলি নির্বাচনের ইস্যু হোক। সে-কারণেই তারা সেই প্রশ্নগুলি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সামনে পেয়েও না করে তাঁকে এগুলোই বলবার সুযোগ করে দিয়েছে যে, স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। উন্নয়ন হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের পাশের রাজ্য ওডিশা সম্পর্কেও এমন কিছু রাজনৈতিক মানসিকতা অমিত শাহ বলতে চেয়েছেন সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে, যাতে সাধারণ মানুষের মনে হয় হিন্দুত্ববাদী শক্তির তথাকথিত ডবল ইঞ্জিন সরকার ছাড়া ভারতের উন্নয়ন কোনওরকমভাবেই সম্ভব নয়। পাশাপাশি সবচেয়ে মজাদার বিষয় হল, আদালত ঘিরে ওই সাক্ষাৎকারে অদ্ভুত এক ধরনের অবস্থান অমিত শাহ নিয়েছেন।

দুর্নীতি ইত্যাদি অস্বস্তিকর প্রশ্ন উঠলে যেমন আদালতকে শিখণ্ডী মানছেন অমিত শাহ, ঠিক তেমনি ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদের জমির মালিকানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্ট নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে যখন সংবিধান-বহির্ভূতভাবে পবিত্র মসজিদ স্থানান্তরের পক্ষে রায়দান করেন, তখনও সেই আদালতকেই শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।

ইসলামে কোনও অবস্থাতেই মসজিদ স্থানান্তর করবার স্বপক্ষে কোনওরকম বিধিবিধান নেই। আর দীর্ঘ জাতীয় আন্দোলনের পর যখন ব্রিটিশের সঙ্গে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় তখন ভারতের প্রচলিত ধর্মীয় মতগুলির স্বাধীনতা রক্ষার পক্ষে সর্বসম্মত স্বাক্ষর করা হয়েছিল।

সেই অনুযায়ী মসজিদ স্থানান্তর করতে না পারার বিষয়টি হল ভারতের সহনাগরিক মুসলমানদের ব্যক্তিগত আইনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাঁদের ধর্মীয় স্বাধীনতা পালনের যে অধিকার ভারতের সংবিধান দিয়েছে, সেই অধিকাররক্ষার একটি প্রশ্ন। অথচ বাবরি মসজিদের জমির মালিকানা ঘিরে মসজিদ স্থানান্তরের পক্ষে রায়দান করে দেশের সুপ্রিম কোর্ট কেবলমাত্র যে ‘৪৭-এর ক্ষমতা হস্তান্তরের চুক্তির অবমাননা করেছে তা-ই নয়, তাকে লঙ্ঘন করেছে তা-ই নয়, দেশের সংবিধানে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের প্রচলিত নৃতাত্ত্বিক এবং ধর্মীয় স্বাধীনতারক্ষার যে অধিকার, সেই অধিকারকে খর্ব করা হয়েছে। কিন্তু মজার কথা হল আদালতের রায় বলে যখন এসবকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তখন মনে হয় যেখানে আদালত ভারতের শাসক বিজেপির পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করছে, সেখানে তাঁরা আদালতের অতি বড় সমর্থক। আর যেখানে আদালতের রায়ে তাঁরা বেকায়দায় পড়ছেন, সেখানে তাঁরা আদালতের রায়ের অতি বড় সমালোচক।

নানা ধরনের আর্থিক কেলেঙ্কারিতে যুক্ত লোকজন নিজেদের পিঠ বাঁচাতে যখন বিজেপিতে এসে জড়ো হচ্ছে, তখন তাদের ঘিরে আদালতের অবস্থান নিয়েও সুবিধাবাদী জায়গায় দাঁড়াতে দ্বিধাবোধ করছেন না অমিত শাহেরা। যে-সমস্ত লোকজন নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়েই, আদালতে মামলা চলাকালীন বিজেপিতে আসছে, যে-সম্পর্কে বিজেপিকে ওয়াশিং মেশিন বলে বিরোধীরা মন্তব্য করছেন, সেই বিষয়গুলি নিয়ে মামলা যে ধীরে চলো নীতি অবলম্বন করে চলছে তাতে প্রশাসনের কোনও অঙ্গুলিহেলনের কথা অমিত শাহ স্বীকার করছেন না। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, ভয়াবহ দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত লোকেরা, জেল খাটা লোকেরা, বিজেপিতে আসছে, আর আশ্চর্যজনকভাবে সেই সমস্ত মামলা ঠান্ডা করে চলে যাচ্ছে। এই ঠান্ডা ঘরে চলে যাওয়া নিয়ে ‘আমরা তো মামলা তুলে নিইনি’— এটাই গলাবাজি করে বলছে বিজেপি।

আমরা খুব ভালভাবেই জানি যে দীর্ঘদিন একটি মামলা, বিশেষ করে ফৌজদারি মামলা, আদালতের বিচারাধীন থাকলে, ধীরে ধীরে সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাব কীভাবে প্রকট হয়ে ওঠে। আর তার জেরে শেষপর্যন্ত অভিযুক্ত খালাস পেয়ে যায়। মজার কথা হল, বিজেপিতে চলে আসা লোকেদের মামলাগুলি এখনও চলছে— এই তত্ত্বের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোনিয়া গান্ধি, রাহুল গান্ধি, পি চিদম্বরমের বিরুদ্ধেও যে মামলাগুলি, সেগুলিও এগোয়নি, সে-কথাগুলিকে তুলে ধরছেন।

মানুষকে বিভ্রান্ত করবার পক্ষে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতখানি তরল এবং অরাজনৈতিক কথা বলতে পারেন এমনটা সম্ভবত অমিত শাহ দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আগে আর কোনও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভিতরে আমরা দেখতে পাইনি।

 

পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪

 

গোটা সাক্ষাৎকারটিতেই দুর্নীতির প্রশ্নে কোনওরকম গভীরতায় না গিয়ে, কীভাবে বিরোধীদের প্রতিও একটা সহনশীলতার ভূমিকা নিয়ে দেশের শাসককুল চলছে, সেটা বোঝাতেই যেন অমিত শাহ নিজেকে সবচেয়ে বেশি উজাড় করে দিতে চেয়েছেন। দুর্নীতির ক্ষেত্রে যদি বিরোধী শিবিরের মুড়ি-মিছরিকে এক পর্যায়ে এনে থাকেন, তাহলে সমস্ত বিরোধীদের ক্ষেত্রেই কেন উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে না কেন্দ্রীয় সরকার?— এ-বিষয়ে কিন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। বারবার বিভিন্ন ব্যক্তিবিশেষের নাম তোলা হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষ থেকে। এমনকি প্রশ্নকর্তাও সমস্ত প্রশ্নগুলিকে সেই পথেই ধাবিত করেছেন।

দুর্নীতির প্রশ্নে একাধিক ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বিজেপি দলের ভেতরে যে সমস্ত ব্যক্তিত্বকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে, তাদেরকে ঘিরে সমস্ত কিছু হালকা করে দেওয়াটাই যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের এই সাক্ষাৎকারে বলা কথাগুলির অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, সেটা সাক্ষাৎকারটি একটু গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা খুব সহজেই বুঝতে পারব।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার ভেতর দিয়ে আদালতকে শাসকের প্রভাবিত করবার একটা ইঙ্গিত উঠে আসছে। এই ইঙ্গিত থেকে কিন্তু অত্যন্ত ভয়াবহ একটা আভাস আমরা পাচ্ছি। যদি শাসক আদালতকে প্রভাবিত করবার চেষ্টা করে থাকে, সেই চেষ্টাটা যদি শেষ পর্যন্ত কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ হয়ে থাকে, তবে তা কেবল গণতন্ত্রের পক্ষেই একটা ভয়ঙ্কর অশুভদিকের সূচনা করছে তা নয়, সার্বিকভাবে দেশের মানুষের জান-মাল নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারটি যে এর দ্বারা ভয়ঙ্কররকমভাবে প্রশ্নচিহ্নের সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে, সে-বিষয়েও কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না।

আদালতের উপর হিন্দুত্ববাদী শক্তির কতখানি আস্থা প্রকৃতপক্ষে আছে, তা আমরা তাদের অতীতে নানা ধরনের কার্যাবলির মধ্যে দিয়ে দেখেছি। কল্যাণ সিং উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন যখন ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সমস্তরকমের পরিকল্পনা রাষ্ট্রশক্তির একটা অংশকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দুত্ববাদী শিবির করে ফেলেছে, তখনও তারা আদালতের সামনে বলেছিল: তারা সমবেত হচ্ছে ধর্মসঙ্গীত গাওয়ার জন্য। ভজন-কীর্তন করবার জন্য।

কিন্তু কী উদ্দেশ্যে যে তারা মসজিদের সামনে সমবেত হয়েছিল, সশস্ত্রভাবে সমবেত হয়েছিল বললেই সঠিক কথা বলা হয়, তা আমরা পরবর্তীকালে দেখেছি। আদালতকে যে তারা কীভাবে বিভ্রান্ত করেছে, সেটাও আমরা দেখেছি। তাই আদালতকে নিজেদের প্রয়োজনে, নিজেদের মতো করে রাষ্ট্রশক্তি ব্যবহার করে আসছে, সে-বিষয়ে আমাদের কোনওরকম সংশয় নেই।

তার পাশাপাশি বলতে হয় যে, অমিত শাহের এই সাক্ষাৎকারে বলা কথাগুলোর ভেতর থেকে এটাই আমাদের কাছে সবচেয়ে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে, কথায় কথায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মসূচিগুলির সপক্ষে আদালতকে প্রয়োজনে মান্যতা, আবার প্রয়োজনে অস্বীকার করছেন, তাতে তাঁদের দুরভিসন্ধির দিকটাই সবচেয়ে বড় হয়ে আমাদের সামনে ফুটে উঠছে।

আসন্ন লোকসভা ভোটের সব থেকে বড় রাজনৈতিক প্রশ্নটি হল, দেশের মানুষ পেট ভরে খেতে পাবে কিনা। দেশের মানুষ অল্প মূল্যে আধুনিক চিকিৎসা পাবে কিনা। শাসক নানা ধরনের অর্নামেন্টাল ডেভেলপমেন্টের মোড়কে দেশের মানুষজনদের চিকিৎসার গোটা দায়দায়িত্ব দেশের লোকের করের টাকা দিয়েই বহুজাতিক এবং বেসরকারি চিকিৎসামাধ্যমকে দিয়ে দিয়েছে। সেই ব্যবস্থাকেই এই দেশের একমাত্র প্রামাণ্য চিকিৎসা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য আদাজল খেয়ে আত্মোৎসর্গ করেছে।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের মানুষ তাঁদের মেধা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী নিজের নিজের রাজ্যে মেধা বা শারীরিক পরিশ্রমের বিনিময়ে খেতে পারবে কিনা, নাকি নিজের রাজ্যকে কার্য্যত বৃদ্ধাশ্রমে পরিণত করে, দুমুঠো ভাতের জন্য অন্য রাজ্যে অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে জীবনপাত করবে— তারকা সাংবাদিকদের কাছে অমিত শাহের সামনে এই সমস্ত প্রশ্নগুলি কোনও গুরুত্ব পায়নি।

স্বভাবসুলভভাবেই অমিত শাহ তাঁর রাজনৈতিক শ্রেণি-অবস্থান থেকে এই সমস্ত কোনও প্রশ্নের ধারপাশ দিয়ে যাতে না যেতে হয় সেইজন্য খুবই সতর্ক ছিলেন। কত সহজে হিন্দু-মুসলমান, নাগরিকত্ব, সিএএ, এনআরসি, মন্দির-মসজিদ এই সমস্ত বিষয়গুলিকে একমাত্র প্রতিপাদ্য বিষয় করে, মানুষের রুটি— যা পেটের খিদে মেটায়, বস্ত্র— যা লজ্জা নিবারণ করে, গৃহ— যা মাথার উপর একখণ্ড ছাদ, ঝড়-জল-বৃষ্টিতে আশ্রয় দেয়, এই সমস্ত বিষয়গুলি যাতে উঠে না আসতে পারে তার জন্য একটা সুনিবিড় সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং তৈরি করা, সেই উদ্দেশ্যেই গোটা সাক্ষাৎকারটিকে যেমন অমিত শাহ পরিচালিত করেছেন, তেমন প্রশ্নকর্তারাও পরিচালিত করেছেন।

এই গোটা সাক্ষাৎকার-পর্বে নামকরা কাগজের সাংবাদিকযুগল আর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের অন্যতম মুখ্য প্রতিনিধি অমিত শাহ পরস্পর পরস্পরের প্রতিপূরক ছিলেন। পরিপূরক ছিলেন।

যে কোনও ঘটনা ঘটলেই সেই ঘটনাকে একটা সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়া হিন্দুত্ববাদী শিবিরের একটা রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য। সেই বৈশিষ্ট্য বজায় রাখবার একটা অদম্য চেষ্টা আলোচ্য সাক্ষাৎকারে আমরা অমিত শাহের সন্দেশখালি নিয়ে বক্তব্যের মধ্যে দেখতে পেলাম। সাক্ষাৎকারের শুরুতেই তিনি মুসলিম তোষণ শব্দটিকে তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার জায়গা থেকে ছুড়ে দিলেন। পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন ঘিরে বিজেপির যে মূল্যায়ন, সেই ধারাতেই মুড়ি-মিছড়িকে একদর করে দিতে, বামফ্রন্ট সরকারের আমলের সমস্ত প্রেক্ষিত, আর বিগত ১৪ বছর ধরে তৃণমূল সরকারের প্রেক্ষিতগুলিকে তিনি মিলিয়েমিশিয়ে একাকার করে দিলেন।

ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে, অর্থনীতির বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে, বামফ্রন্টের যে উদ্যোগ ছিল, সেগুলি বোঝবার মতো মানসিকতা আদৌ অমিত শাহের আছে কিনা এ নিয়ে সংশয়ের মধ্যেই এ কথা বলতে হয় যে, শ্রেণি-অবস্থান থেকে মমতা বা অমিত শাহ কেউই ভূমিসংস্কার, অপারেশন বর্গা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, একেবারে ভূমিস্তরে ক্ষমতাটাকে পৌঁছে দেওয়া— এই সমস্ত জিনিসকে বরদাস্ত করতে পারেন না।

পশ্চিমবঙ্গের যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গোটা ভারতে রোলমডেল হয়ে দাঁড়িয়েছিল, রাজীব গান্ধির সরকার পর্যন্ত সংসদে দাঁড়িয়ে সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থার প্রশংসা করতে বাধ্য হয়েছিল, সেই পঞ্চায়েতকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ক্ষমতায় আসবার পর আবার ক্ষমতা কেন্দ্রীকরণের একটা কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছেন। ভারতীয় সংবিধানে যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো আছে, সেই যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোতে বিজেপি বিশ্বাস করে না। এক সময় বামপন্থীরা যে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবি জানিয়েছিল জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে, অতীতে সেই আন্দোলনে জেরেই ইন্দিরা গান্ধি সরকার বাধ্য হয়েছিল সরকারিয়া কমিশন তৈরি করতে— সেই সমস্ত প্রেক্ষিতগুলিকে যেমন কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ধ্বংস করেছে, ঠিক তেমনিভাবেই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মূলধারায় যে ভূমিস্তরে ক্ষমতাকে প্রসারিত করবার লক্ষ্য রয়েছে, সেটিকে বানচাল করবার ক্ষেত্রে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের ভূমিকা এবং অবদান কোনও অংশে কম নয়।

বিজেপি সরকার রাজ্যের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার প্রশ্নে ভয়ঙ্কররকমের কৃপণ, সমস্ত ক্ষমতাকেই তারা কেন্দ্রীভূত করতে চায় কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নয়, কেন্দ্রীকরণই তাদের লক্ষ্য। অপরপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে লোকদেখানোভাবে মমতা অনেক কথা বললেও তিনি নিজে নবান্নের বাইরে ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে একেবারে কেন্দ্রীয় সরকারের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই চলেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের, স্থানীয় সরকারের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে পরিপূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষেত্রটিকে মমতা অটুট রেখেছেন? না সেটি পরিচালনার ভার বেসরকারিভাবে তিনি আমলাদের উপর দিয়েছেন? এ নিয়ে গোটা পশ্চিমবঙ্গে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।

এই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্নে একটি রাজনৈতিক উচ্চারণও আমরা কিন্তু অমিত শাহের কাছ থেকে শুনতে পেলাম না সংশ্লিষ্ট সাক্ষাৎকারে। বরঞ্চ, ‘এক দেশ, এক ভোট’ ইত্যাদি বিজেপির নিজস্ব স্লোগানগুলির মধ্যে দিয়ে অমিত শাহ বুঝে বুঝিয়ে দিলেন, তাঁরা যদি আগামী লোকসভায় নিজেদের সাফল্যকে ধরে রাখতে পারেন, তাহলে ভারতে গণতন্ত্রের প্রবহমানতার ক্ষেত্রে একটা বড়রকমের সঙ্কট আসন্ন।

সন্দেশখালির ঘটনাকে মুসলমান তোষণের জের হিসেবে বর্ণনা করে যে ধরনের রাজনৈতিক সমীকরণের ইঙ্গিত ওই সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ দিয়েছেন, তাতে এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে আগে ওঠে যে, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাবাহিনি কি শীতঘুমে ছিল? নাকি, তৃণমূলের তৈরি করা অরাজকতার ফসল যাতে বিজেপির ঘরে ওঠে, সেদিকে লক্ষ্য রাখতেই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাবাহিনি সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল? যার জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, সন্দেশখালির ন্যক্কারজনক ঘটনাকে পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক বিভাজনের স্বার্থে ব্যবহার করবার স্পর্ধা দেখালেন?

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণেরও দু-বছর আগে। নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতাসীন হয়ে যে বিভাজনের রাজনীতিকে গোটা ভারত জুড়ে কায়েম করেছেন, সেই বিভাজনের রাজনীতির প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে মমতা যেভাবে পথ চলতে শুরু করেছিলেন— অর্থাৎ ইমাম-মুয়াজ্জিন ভাতা ইত্যাদি— এগুলি ছিল প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে প্রোমোট করে সঙ্ঘ-বিজেপির ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতাকে অক্সিজেন দেওয়ার উদ্যোগ।

মুসলমান সমাজের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক উন্নয়নের ব্যাপারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এক দশকেরও বেশি শাসনকালে কী করেছেন, এই প্রশ্ন যদি সমাজবিজ্ঞানীদের কাছে করা হয়, উত্তর আসবে— শূন্য। সমাজবিজ্ঞানীরা রাজনৈতিক দলের তল্পিবাহক হয়ে কখনও তাঁদের গবেষণাকে পরিচালিত করেন না।

কিন্তু একটা বড় অংশের রাজনৈতিক দল সমাজবিজ্ঞানকেও পরিচালিত করতে চায়, তাদের ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে। তাই মমতার দল যেমন বলবে তারা সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য আত্মনিবেদিত, আবার ঠিক তেমনি আরএসএসের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি বলবে এই তথাকথিত মুসলিম তোষণের বিরুদ্ধে। অথচ মুসলিম সমাজ এই বাংলার বুকে যে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক অবনমনের মধ্যে রয়েছেন, সেই জায়গা থেকে তাদের বের করে নিয়ে আসবার এতটুকুনি কার্যক্রম বাংলার শাসকদল করেনি।

তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘হাজি বিবি’ সেজে ভুল আরবি উচ্চারণে মুসলমান সমাজের কিছু ধর্মীয় লব্জ আওড়ালেই কি মুসলমান সমাজের জন্য আত্মনিবেদিত হয়ে গেলেন? নাকি, মমতার ওই রাজনৈতিক ভেক, হিন্দুদের সভায় গিয়ে তিলক কাটা, বৈষ্ণবদের সভায় গিয়ে নামাবলি গায়ে দেওয়া, আবার শিখদের অনুষ্ঠানে গিয়ে তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতিকে অবলম্বন করা— তার মধ্যে দিয়ে কি সংশ্লিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক জীবনের এতটুকু উন্নতি হয়েছে? আর্থিক স্বনির্ভরতার ক্ষেত্রে বিগত ১৩ বছরের শাসনকালে মুসলমান সমাজের জন্য মমতা কী করেছেন? মুসলমান সমাজের আধুনিক বিজ্ঞানমুখী শিক্ষার জন্য কি রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক উদ্যোগ মমতা নিয়েছেন? মমতা ইমাম মুয়াজ্জিনদের ভাতার ব্যবস্থা করেছেন। তার ফলে মুসলমান সমাজের কত অংশের মানুষ উপকৃত হয়েছে? ইমাম মুয়াজ্জিনদের ভাতা দিয়ে কি মুসলমান সমাজের এই গুটিকয়েক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে আপামর মুসলমান সমাজের একটা দূরত্ব মমতা রচনা করে দেননি? মুসলমান সমাজের একটা বড় অংশের মানুষদের মধ্যে একটা হীনম্মন্যতা তৈরি করে, মুসলমানকে মুসলমানের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেওয়ার যে ভয়ঙ্কর বিসমার্কীয় নীতি মমতা অবলম্বন করে চলছেন, সেই নীতি তিনি অবলম্বন করছেন কার স্বার্থে সেটা একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে সম্প্রতি অমিত শাহের ওই দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে।

 

পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি

 

বিজেপির রাজনৈতিক লক্ষ্য হল মুসলমান সমাজকে ধনে-প্রাণে মারা। গুজরাত গণহত্যার কালে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহেরা যে পদ্ধতিতে মুসলমানদের উপরে আক্রমণ শানিয়েছিলেন, সেই একই পদ্ধতিতে কেন্দ্রে বিগত ১০ বছর ধরে তাঁরা আক্রমণ শানিয়ে চলেছেন মুসলমান সমাজের প্রতি। যেখানে সম্ভব করতে পারছে মুসলমানকে প্রাণে মারছে। যেখানে সম্ভব করতে পারছে না, সেখানে মুসলমানকে ভাতে মারছে। গোটা ভারত জুড়ে আজ এই নারকীয় অবস্থা।

ভারতীয় সমাজব্যবস্থাকে ধর্মান্ধ সম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস-বিজেপি এবং তার সাঙ্গপাঙ্গরা আজ এই নরকে এনে দাঁড় করিয়েছে। হিন্দুত্ববাদী শক্তির মুসলমান নির্যাতনের এই কৌশলকে আরও তির্যক করে তোলবার উদ্দেশ্যে গোটা ভারত জুড়ে প্রতিযোগিতামূলক সম্প্রদায়িক নীতি নিয়ে চলা একটা বড় অংশের রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে সমীকরণের অঙ্ক এখন গভীর থেকে গভীরতর।

এই সমীকরণ যাতে সাধারণ মানুষ বুঝতে না পারে, সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে রাখতে তাই ওই সাক্ষাৎকারে অমিত শাহ বারবার মুসলিম তোষণ এবং মমতার সঙ্গে একটা ছদ্ম-সংঘাতের পরিবেশ তৈরি করবার চেষ্টা করেছেন। একই প্রচেষ্টা তিনি করেছেন তাঁর আরেক নিবিড় রাজনৈতিক গোপন সহচর ওডিশার নবীন পাট্টনায়ক সম্পর্কেও।

সাধারণ মানুষ যাতে মনে করে, তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজু জনতা দলের মতো রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ রয়েছে বিজেপির সেই উদ্দেশ্যে নির্বাচনী সভাগুলিতে কিছু নরমগরম কথা বলে বা সাক্ষাৎকারগুলিতে কিছু নরমগরম কথা বলে এই ছদ্ম-দ্বন্দ্ব, যাকে বামপন্থী নেতারা ‘বাইরে কুস্তি ভেতরে দোস্তি’ বলে অভিহিত করে থাকেন, সেই পরিবেশটা যাতে বজায় থাকে, সেই স্বার্থেই আলোচ্য সাক্ষাৎকারে প্রায় গোটা সময়টা ধরে নিজেকে পরিচালিত করলেন দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ।


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...