অংশুমান দাশ
এই নির্বাচনী চিত্রনাট্যে যশোর রোডের গাছ নাই, সোনম ওয়াংচুকের লাদাখ বাঁচাইবার অনাহার নাই, দেবল দেবের বীজ বাঁচাইবার গবেষণা নাই, ক্ষুদ্র কৃষকের বীজের অধিকার নাই, মেধা পাটকরের নদীকে বাঁধার বিরূদ্ধে অধিকারের লড়াই নাই, মহেশ-সরিতার জীবন দান করিবার প্রতি নজর নাই, বনরাজির উপরে বনবাসীর অধিকার নাই, মৃত্তিকাকে বাঁচাইয়া রাখার জন্য পরিকল্পনা নাই, কয়লাসভ্যতা হইতে পরিত্রাণের রাস্তা নাই। নাই নাই নাই। কী আছে? সকল রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্র জুড়িয়া রহিয়াছে— ফুটা কলস মেরামতের গল্প। তাহাকে বদলাইবার সঙ্কল্প নাই
পঞ্চবার্ষিকী উৎসব উপস্থিত হইয়াছে। পাড়ায় পাড়ায়, সন্ধ্যার রাস্তায় অকস্মাৎ মুখোমুখি হইবার ফলস্বরূপ অপরিকল্পিত আড্ডাতেও আশা ও হতাশা জমিয়া উঠিয়াছে। এই বার্ষিকী উৎসবে কখনও নোট, কখনও জোট, কখনও ঘোঁট প্রাধান্য পাইয়া থাকে— কখনও মুখোশ, কখনও মাথার টুপি, কখনও পোশাক, কখনও নিজের দেশ অপেক্ষা পার্শ্ববর্তী দেশও প্রাধান্য পাইয়া থাকে। অথচ মনুষ্য কখনও এই উৎসবের মুখ হইয়া উঠে না। তেমনই উপেক্ষিত থাকিয়া যায় বৃক্ষ, বনরাজি, নদী, মৃত্তিকা— যাহারা এই উৎসবের অঙ্গ হইয়া উঠিতে পারিত।
উৎসবের মূল কাণ্ডারীসকল নিজ নিজ ঢক্কানিনাদে মনোযোগ করিয়াছেন, উৎসব উপলক্ষ্যে নানাবিধ ঘোষণা ও হুঙ্কারে নিয়োজিত আছেন। কতিপয় মনুষ্য এই উপেক্ষিতদের পানে চাহিয়া চাহিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাসে আকাশবাতাস ভারি করিয়া তুলিতেছে— অথচ কাহাকেও আকুলিত করিতে পারিতেছে না। কাণ্ডারীগণের ঢক্কানিনাদে তাহারা হাঁসফাঁস করিতেছেন। কিছু ধামাধরা মনুষ্য ওই কতিপয় মনুষ্যের অসহায় অবস্থা দেখিয়া ‘উহারা অরণ্যে রোদন করিতেছে’ বলিয়া এ ওর গায়ে হাসিয়া হাসিয়া ঢলিয়া পড়িতেছে। কিছু মনুষ্য তাহাদের অপরূপ বাগ্মিতায় জ্ঞানদানন্দন হইয়া গরমে ঘামিয়া ঘামিয়া বৃক্ষের উপকারিতা সম্পর্কে কণ্ঠ ছাড়িয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িতেছে। বাকিরা ‘বিকাশ’ ও ‘উন্নয়ন’ ও ‘ন্যায়’ নামক আকাশকুসুম ভবিষ্যতের দিকে তাকাইয়া লালায়িত হইয়া পড়িতেছে। ওদিকে উৎসবের কাণ্ডারীগণের ঢক্কা নিদারুণ বাজিয়াই চলিতেছে।
গেরুয়া, নীল, লাল, সবুজ— সকল দলেরই ঢক্কানিনাদের প্রচারপত্র পড়িয়া বুঝিলাম, যাহারা যতই কণ্ঠ সাধুন— বৃক্ষ, বনরাজি, নদী, মৃত্তিকা ইত্যাদি পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়ে সকল দলই লবডঙ্কা। বিজেপি, কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম ও ডিএমকে-এর প্রচারপত্রে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে নেহাত রাখিতে হয় বলিয়া রাখা হইয়াছে— সকলই আসিয়াছে প্রচারপত্রের শেষ কয়টি পাতায় ঠাসাঠাসি করিয়া। যাহাদের অর্থ আছে তাহারা সুন্দর সুন্দর চিত্র সহযোগে পাতাগুলিকে সাজাইয়াছে বটে কিন্তু বক্তব্য সকলেরই এক এবং সমানভাবে অন্তঃসারশূন্য। এই চর্বিতচর্বণগুলি নির্মিত হইয়াছে এই ধারণা হইতে যে মাটির কলস ফুটা হইলে তাহাকে এখানে-ওখানে ন্যাকড়া গুঁজিয়া মেরামত করিলেই চলিবে, কলস বদল করিবার প্রয়োজন নাই। ইহাকে ম্লেচ্ছ ভাষায় ‘বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল’ বলিয়া থাকে। সকলেই রাস্তা চওড়া করিবার, প্রবলভাবে সড়ক-সেতু-বিমানবন্দর-কারখানা ইত্যাদি অবকাঠামো বানাইবার কথা বলিতেছে। সকলেই বলিতেছে— রাসায়নিক সারে ছাড় দিব, কৃষকদিগকে কিছু ফসলের জন্য ন্যূনতম মূল্য নিশ্চিত করিয়া দিব, বড় বড় গুদাম বানাইব। ক্ষমতাসীন দল একধাপ আগাইয়া বলিতেছে— ‘ড্রোন আনিব, মেশিন আনিব, প্রযুক্তি আনিব, ক্ষুদ্র কৃষক বলিয়া ভারতবর্ষে কিছু থাকিবে না’। সকলেই একসুরে বলিতেছে ‘হুক্কা হুয়া— উপঢৌকন দিব, উৎকোচ দিব, মাসে মাসে মাসোহারা দিব। তোমরা চিন্তা করিও না, সকল অধিকার পরিত্যাগ করিয়া কেবল কায়মনোবাক্যে আমাদিগকে সমর্থন করো’। বিরূদ্ধ শক্তি বলিতেছে— ‘বিজেপির খনি খুঁড়িবার, জঙ্গল বিক্রি করিবার, কারখানাকে ব্যাবসার ছাড়পত্র দেওয়ার নীতি ভুল— আমরা নতুন করিয়া এইসব দখল করিবার নীতি বানাইব’।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
এমতাবস্থায় এই উৎসবের বাজারে দেওয়াললিখনের ন্যায় একটি ললাটলিখন স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়া লওয়া দরকার। এই মুহূর্তে প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের যা অবস্থা হইয়াছে তাহাতে ইহা অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কিছুই নাই। যদি নদী শুকাইয়া যায়, পাতা ঝরিয়া যায়, মাটি বাক্রহিত হইয়া যায়— আর কোনও কিছুই আমাদের রক্ষা করিতে পারিবে না— এমনকি সংবিধানও নহে। এই বিষয়টিতে যেহেতু উৎসবের মূল কাণ্ডারীগণের কেহই মনোযোগ দিতেছে না— তাহাদের সকলকেই সমুদ্রে নিক্ষেপ করাই একমাত্র উপায়। নদী, বনরাজি, মৃত্তিকাই এই উৎসবের প্রথম ও প্রধান বিষয়— এ-ব্যাপারে কাহারও কোনও দ্বিমত থাকা উচিত নহে বলিয়াই মনে হয়।
অথচ, বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ— যাহাদের প্রতিদিনের অন্ন উপার্জনের পরিশ্রম এমন সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিয়াছে যে এই সকল চিন্তা তাহাদের কাছে বিলাসিতা ব্যতীত আর কিছুই নহে। উন্নয়নের এমন সংজ্ঞা আমাদের শেখানো হইয়াছে ও সেই সংজ্ঞার এমন বিশ্বায়ন হইয়াছে যে আমরা এই মত একবাক্য গ্রহণ করিয়াছি, যে ব্যাঙ্কক হইতে ব্যাংচাতরা, ম্যাঞ্চেস্টার হইতে মদনপুর— উন্নত জীবনের অর্থই হইল বহুলভোগ্য পণ্য। যাহার মান রাখিতে এই কয়লা ও খনিজ পদার্থ-নির্ভর সভ্যতা, সব কিছু পুড়াইয়া আমাদের হাতে উন্নয়নের চুষিকাঠি ধরাইয়া দিয়াছে। জনতার ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছ হইতে আমাদিগের কিছু কিছু অপরিহার্য পরিষেবা এমনিই পাওয়ার কথা ছিল— তাহাও কিনিতে হয় নগদ কড়ি ফেলিয়া— যেমন শিক্ষা, যেমন স্বাস্থ্য। ‘ফেলো কড়ি মাখো সার্ভিস’ পদ্ধতিকেও তাই স্বাভাবিক উন্নয়ন বলিয়া মানিয়া লহিয়াছি। কাণ্ডারীগণের কেহ কি বলিয়াছে যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবা সকলের জন্য এক হইবে এবং তাহা বিনামূল্যে মিলিবে? কেহ কি বলিয়াছে— শহরে শহরে বিশাল বড় বড় কারখানা, চিকিৎসাকেন্দ্র, অফিস, কাছারি, বিদ্যালয় না করিয়া প্রতি ক্ষুদ্রতর প্রশাসনিক কেন্দ্রে কেন্দ্রে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও রোজগারের উপায় হইবে— যাহাতে এই সকল কিছু প্রয়োজনে ছোটাছুটি করিবার জন্য আর বৃহৎ রাস্তার প্রয়োজন হইবে না, স্থানীয়ভাবে মনুষ্যপ্রজাতি আরও স্বয়ংসম্পূর্ণ হইয়া উঠিবে? কেহ কি স্বপ্ন দেখিয়াছে যে, স্থানীয় কৃষক-কারিগর-শিক্ষক-ছাত্র-ব্যবসাদারের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এক বিকেন্দ্রিত সমাজ মাথা তুলিয়া দাঁড়াইবে? কেহ কি ঘুণাক্ষরেও ভাবিয়াছে, কারখানা ও ব্যবসার মুনাফা উৎপাদনের ঊর্ধ্বসীমা বাঁধা হইবে— যাহাতে কারও কারও হাতে অনন্ত সম্পদ সংগৃহীত হইবার সম্ভাবনাকে প্রতিরোধ করা যাইতে পারে? একমাত্র এইভাবেই কার্বন নিঃসরণ কমিতে পারে, সাম্য আসিতে পারে, পরিবেশের উপর ঋণাত্মক প্রভাব কমিতে পারে। উন্নয়নের স্বপ্ন দেখাইয়া, উৎকোচ প্রদান করিয়া, সবুজ প্রযুক্তির আড়াল তৈয়ার করিয়া, চৌখশ শহরের (ম্লেচ্ছ ভাষায় স্মার্ট সিটি) ঘোষণা করিয়া, গ্রামের মানুষ দুধ না খাইয়া শীতল পানীয় খাইবে এই স্বপ্ন দেখাইয়াই এই কাণ্ডারীসকলের দিনাতিপাত হইতেছে। আর এই স্বপ্নে বিভোর হইয়া, ভোগ্যপণ্যকে আরাধ্য করিয়া মূলা ঝোলানো গর্ধভের ন্যায় (কেউ কেউ ইহাকে অন্ধ ভক্ত বলিয়া থাকে) আমরা দৌড়াইয়া মরিব— ইহাই সকল রাজনৈতিক দলের চিত্রনাট্য।
এই চিত্রনাট্যে যশোর রোডের গাছ নাই, সোনম ওয়াংচুকের লাদাখ বাঁচাইবার অনাহার নাই, দেবল দেবের বীজ বাঁচাইবার গবেষণা নাই, ক্ষুদ্র কৃষকের বীজের অধিকার নাই, মেধা পাটকরের নদীকে বাঁধার বিরূদ্ধে অধিকারের লড়াই নাই, মহেশ-সরিতার জীবন দান করিবার প্রতি নজর নাই, বনরাজির উপরে বনবাসীর অধিকার নাই, মৃত্তিকাকে বাঁচাইয়া রাখার জন্য পরিকল্পনা নাই, কয়লাসভ্যতা হইতে পরিত্রাণের রাস্তা নাই। নাই নাই নাই। কী আছে? সকল রাজনৈতিক দলের প্রচারপত্র জুড়িয়া রহিয়াছে— ফুটা কলস মেরামতের গল্প। তাহাকে বদলাইবার সঙ্কল্প নাই। আছে ক্ষুদ্র দানাশস্য মিলেট লইয়া বাড়াবাড়ি, জিন বদল করিয়া ফসল আনিবার বিষয়ে প্রচ্ছন্ন সমর্থন, প্রাকৃতিক কৃষির প্রকল্প দিয়া মুনাফালোভী বাজারমুখী চাষকে আড়াল করিবার চেষ্টা, জলবায়ু বদলের মোকাবিলায় এখানে ওখানে উদাহরণ তৈয়ার করার ঘোষণা, নানাবিধ কমিটি ও খসড়া পরিকল্পনার তৈয়ার করার প্রস্তাব। এই সকল চক্ষুতে ধূলা নিক্ষেপ করার উদ্যোগে ব্যাপৃত থাকা কাণ্ডারীদের ছুড়িয়া ফেলিয়া সত্যকার রাজনীতির কথা না বলিতে পারিলে আমাদের কাল শেষ হইয়া আসিল।
পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি
লোকে জনান্তিকে বলিবে— এ সব আকাশ কুসুম কথা। লোকে রে রে করিয়া উঠিবে— এত জনসংখ্যার কী হইবে? অর্থনৈতিক বৃদ্ধি না হইলে আমাদের দেশ পাকিস্তান হইতে পিছাইয়া পড়িবে! আমরা কষ্ট করিয়া পড়াশুনা করিয়া, চুরি করিয়া, শোষণ করিয়া এত সম্পদ জমাইলাম— তাহার কী হইবে? হে নিন্দুকসকল, এই সকল কর্দম নিক্ষেপণেরই উত্তর দেওয়া যায়। কিন্তু, আমি উত্তর দেওয়ার সেই কষ্ট করিব যদি আপনারা বলিতে পারেন গত ছিয়াত্তর বছর ধরে ফুটা কলসি মেরামত করিয়া, আর ধামা ধরিয়া আপনারা কোন স্বর্গরাজ্যে আমাদের পৌঁছাইয়া দিলেন?