প্রবুদ্ধ বাগচী
উনিশ শতকের মাঝামাঝি যখন একদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর অন্যদিকে বেথুন সাহেব বা ডেভিড হেয়ার একসঙ্গে জুড়ি বেঁধে শহর কলকাতার নানা জায়গায় একের পর এক স্কুল তৈরি করে চলেছেন, তখন তাঁদের নিয়মিত কাজ ছিল এইসব স্কুলগুলির প্রতিদিনের কাজকর্ম কেমন চলছে তা পরিদর্শন করা। শোনা যায়, ডেভিড হেয়ার যখন রাজপথে পালকি করে এইসব স্কুলে যেতেন, তার পালকির পিছু পিছু ছুটত স্থানীয় বালকরা— মুখে তাদের কাতর চিৎকার— মি পুওর বয়! হ্যাভ পিটি! টেক মি ইন ইওর স্কুল! সত্যি সত্যি যে এই বালকরা দরিদ্র ঘরের বাসিন্দা ছিল বা স্কুলে গিয়ে তাদের ‘মিড ডে মিল’ গোছের কিছু জুটত এমন আদৌ নয়। লর্ড মেকলের তৈরি করা ভারতীয় শিক্ষার অভিমুখ মেনে নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন তাদের এদেশীয় শিক্ষা বিষয়ে কর্মসূচি কী হবে, মোটামুটিভাবে তা ঠিক করে নিয়েছে। পাশাপাশি সেকালের পাশ্চাত্য শিক্ষার আওতায় আসা ভারতীয়রাও চাইছেন, এই শিক্ষার আলোই ছড়িয়ে দিতে হবে এইদেশে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মূলত সংস্কৃত ভাষা ও দর্শনের ছাত্র হয়েও বারবার সওয়াল করছেন পাশ্চাত্য দর্শন পাঠের ওপর। বুনিয়াদি স্তরে আরও কেমন সুচারুভাবে বাংলা ভাষা পড়ানো যায়, গণিত, জড়বিজ্ঞান, জীববিদ্যার পাশে পাশে ইংরেজিও শেখা যায় এইসবই তাঁর ভাবনার বৃত্তে ঘোরাফেরা করছে। দেশীয় নৈয়ায়িক ও শাস্ত্রজ্ঞদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বিদ্যাসাগর মশাই-ই জোর গলায় বলেছেন বেদান্ত ও সাংখ্যদর্শন ভ্রান্ত— ছেলেপুলেদের পাশ্চাত্য দর্শনের সঙ্গে পরিচয় করাতেই হবে। তাই ডেভিড হেয়ারের পিছু পিছু দৌড়ে যারা স্কুলে ভর্তির আবেদন করছিল সেদিন, তাদের খিদেটা ঠিক পেটের ছিল না। চাহিদা ছিল নতুন সামাজিক পরিস্থিতির ভিতর নিজেদের স্থাপন করার।
শিক্ষার কাঠামো বা তার উদ্দেশ্য যাই হোক, আমাদের রাজ্যে সেই উনিশ শতক থেকেই শিক্ষাসত্রগুলি প্রতিষ্ঠার পেছনে চলমান হয়ে থেকেছে স্থানীয় বিদ্যোৎসাহী মানুষদের উৎসাহ ও উদ্যোগ। তাঁরা এটুকু বুঝেছিলেন, শিক্ষার যে বিপুল চাহিদা তৈরি হচ্ছে সেটা সম্পূর্ণভাবে কোম্পানির বদান্যতায় বা পরে সাম্রাজ্যের প্রযোজনায় পূরণ হওয়া সম্ভব নয়। দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা হিন্দু কলেজ— এগুলোর স্থাপনার পেছনে স্থানীয় উৎসাহী ধনী মানুষ ও শিক্ষানুরাগীর ভূমিকা আমরা সবাই জানি। আরেকটু নিচের স্তরে স্কুল তৈরিতেও এই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ‘কমিউনিটি পার্টিসিপেশন’ ছিল প্রধান চালিকাশক্তি। শুধু স্কুল তৈরি নয় তাতে পড়ুয়ার জোগান ও নিয়মিত পরিচালনার সুচারু ব্যবস্থা সবটাই কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন স্থানীয় মানুষ। এটা ঠিক, একেবারে গোড়ায় বেথুন সাহেব বা বিদ্যাসাগরকে জনে জনে বুঝিয়ে স্কুলে ডেকে আনতে হয়েছে। বেথুন স্কুলে ছাত্রীদের আসাযাওয়ার জন্য পালকি বা ঘোড়াগাড়ির ব্যবস্থা করতে হয়েছে অন্তঃপুরিকাদের আব্রু রক্ষায়। কিন্তু ওই পালকি বা ঘোড়াগাড়ির দেওয়ালে বিদ্যাসাগর নিজের খরচে খোদাই করে দিয়েছেন শাস্ত্রের সেইসব ব্যাখ্যা যেখানে নারীদের শিক্ষাদান নিয়ে স্পষ্ট অনুমোদন রয়েছে প্রচলিত শাস্ত্রকারদের।
বিদ্যাসাগর বা সমকালীন অন্যান্য স্মরণীয় ব্যক্তিত্বরা যে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন, ক্রমে তা সারা রাজ্যেই ছড়িয়ে পড়ে। অবিভক্ত বাংলার নানা জেলায় স্থানীয় মানুষ এলাকার ভূস্বামী বা রাজাদের আর্থিক সাহায্যে নিজেদের গ্রামেগঞ্জে একটি-দুটি করে বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন, তৈরি হয়েছে কলেজও। অবশ্য কেবলমাত্র ধনী জমিদারদের অনুগ্রহের কথা বললে ইতিহাসের বিকৃতি হয়, বহুক্ষেত্রে এলাকায় শিক্ষার চাহিদা পূরণে সক্রিয় অংশ নিয়েছেন এলাকার মানুষ, যাঁরা নিজেরা হয়তো তেমন শিক্ষার পরশ পাননি। তবু নিজেদের ছেলেরা কেন শিক্ষার সুযোগ পাবে না এই জিজ্ঞাসা তাঁদের মধ্যে জাগরুক হয়ে উঠেছে বারবার। আর তাই যে-কোনওভাবে গ্রামের একখণ্ড জমির ব্যবস্থা করে একেবারে কাঁচামাটির চালাঘরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একেকটা স্কুল। স্থানীয় কোনও শিক্ষিত তরুণ নিজেই এগিয়ে এসে ভার নিয়েছেন পড়ানোর, গ্রামের মানুষ নিজেরা নিজেদের সামান্য সঙ্গতির মধ্যেও তাঁকে জুগিয়ে গেছেন থাকাখাওয়ার সংস্থানটুকু। তবে একশ্রেণির সম্পন্ন জমিদাররাও নিছক প্রজাপীড়নের অভ্যাস থেকে বেরিয়ে স্থানীয় শিক্ষার প্রসারে কাজ করেছেন, তাঁদের অবদান একেবারে ভুলে থাকা উচিত নয়।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
এটা ঠিক উপনিবেশের প্রভুরা সর্বজনীন শিক্ষার কথা কোনওকালেই ভাবেননি, তাঁদের এমন ভাবার কথাও ছিল না। কিন্তু যে-কোনওভাবেই হোক শিক্ষার একটা চাহিদা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, পিতা ঠাকুরদাস চেয়েছিলেন পুত্র ঈশ্বর ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে ভর্তি হোক কারণ, সেখানে সংস্কৃত শিখলে কোম্পানির অফিসে একরকম কেরানির চাকরি পাওয়া যায়। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ শাসনে ইংরেজি শিখে যা হোক ছোটখাটো একটা চাকরি পাওয়া যেত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে অবধি গ্রামীণ বাঙালির জীবন খুব সামান্য অর্থেই অতিবাহিত হতে পারত। পুব-বাংলার ছেলেরা কলকাতা শহরে চাকরি করে সারা সপ্তাহ মেসে থেকে সপ্তাহান্তে যাঁরা বাড়ি যেতেন, তাঁরা দেশের বাড়িতে কিছু টাকাও পাঠাতে পারতেন মাস শেষে যাতে তাঁদের পরিবারের মোটামুটি চলে যেত। কাজেই শিক্ষার আত্মিক মূল্য যাই হোক, একটা ব্যবহারিক মূল্য তো ছিলই। তাই আপামর বাংলাদেশে প্রাইমারি, উচ্চ-প্রাইমারি বা আরও উঁচুমানের স্কুল তৈরির ইতিহাসের সঙ্গে ব্যক্তি বা সমষ্টিগত উদ্যোগের যোগাযোগ ঐতিহাসিক।
এর পাশাপাশি, ব্রিটিশ প্রশাসন কিন্তু স্কুলশিক্ষার একটা নজরদারির ব্যবস্থার কথাও ভেবেছিল। অবশ্য বাংলার শিক্ষা-প্রশাসনে স্কুল ইন্সপেক্টর বা বিদ্যালয় পরিদর্শকের ভূমিকা প্রথম চালু করেছিলেন বিদ্যাসাগর। শিক্ষা-প্রশাসনের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সংঘাতের কাহিনি আমরা সবাই জানি। সেই যে শিক্ষা-প্রশাসনের বড়কর্তা যাঁকে পরে বলা হবে ডিপিআই অর্থাৎ ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইন্সট্রাকশন ঈশ্বরচন্দ্রের সামনে জুতো শুদ্ধ পা টেবিলে তুলে তাঁকে ‘অভ্যর্থনা’ করেছিলেন এবং ঈশ্বরচন্দ্র-সুলভ কাঠিন্যে তিনিও তাঁকে প্রত্যুত্তর দিয়েছিলেন অচিরেই। বিদ্যাসাগর নিজের স্থাপিত স্কুলগুলি নিজে পরিদর্শনে যেতেন এবং শিক্ষকদের অনিয়ম দেখলে ব্যবস্থা নিতেও কুণ্ঠিত হতেন না। খুব কাছের মানুষের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হত না। মেট্রোপলিটন স্কুলের একদা-শিক্ষক তরুণ নরেন্দ্রনাথ দত্তকেও তিনি এই বিষয়ে রেয়াত করেননি বলেই শোনা যায়।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য জেলায় জেলায় স্কুল পরিদর্শক পদটি একটা গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে বিবেচিত হতে থাকে যার ধার ও ভার ছিল সাংঘাতিক। স্কুলে ইন্সপেক্টর আসবেন, এটা ছিল স্কুল পরিচালন সমিতি, প্রধান শিক্ষক ও সহ-শিক্ষকদের এক ভীষণ মাথাব্যথা, আজকের পরিভাষায় ‘চাপের ব্যাপার’। এই মাহেন্দ্রক্ষণটির জন্য ছাত্রদের তৈরি করা, তারা যাতে পরিদর্শকের সামনে বেচাল কিছু করে না বসে এইসব নিয়ে স্কুল কমিটির রাতের ঘুম উড়ে যেত। এর দুটো কারণ। স্কুলগুলি ব্যক্তি বা সমষ্টি উদ্যোগের পরিচালিত হলেও তার সিলেবাস, পঠন-পাঠন এবং স্বল্প হলেও আর্থিক গ্র্যান্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে এই পরিদর্শন ছিল প্রধান ফ্যাক্টর। পরিদর্শক যদি ইতিবাচক রিপোর্ট না দেন তাহলে সরকারের চোখে সেই স্কুল দুয়োরানি হয়ে যাবে, এটা না বললেও চলে। তাই ইন্সপেক্টর মহোদয়ের আবির্ভাব মানে সাজো সাজো রব— স্কুলের সেক্রেটারি গাছ থেকে কচি ডাব পেড়ে রাখছেন, হেডস্যার নিজে জোগাড় করে আনছেন মাখা সন্দেশ, শিক্ষকরা ধোপদুরস্ত হয়ে হাজিরা দিচ্ছেন আগেভাগেই। যে শিক্ষকের পদ অনুমোদিত নয় তিনি হাত কচলে ইন্সপেক্টর-স্যারকে আর্জি জানাচ্ছেন তাঁর কেসটা একটু দেখার জন্য, এ-ও প্রায় আমাদের চেনা ছবি। বাংলা গল্পে উপন্যাসে ফিল্মে স্কুলের ইন্সপেক্টর আসা নিয়ে কত মজার উপাখ্যানেরই না ছড়াছড়ি। ইন্সপেক্টরের আরেকটা গুরুত্ব, আজ আর নেই, কিন্তু একদা অবশ্যই ছিল— তা হল, স্কুলে ঠিক কী পড়ানো হচ্ছে। প্রাক-স্বাধীনতা যুগে বিপ্লবী আন্দোলনের স্থানীয় সংগঠক অনেক ক্ষেত্রে ছিলেন স্কুলের শিক্ষকরাই। ছাত্রদের সঙ্গে (এবং ছাত্রীদের) সরাসরি যোগ থাকায় তাদের প্রণোদিত করার কাজটা তাঁরাই করতেন। কিন্তু সাম্রাজ্যের শাসকদের তো এত আলগা দিলে চলে না, তাই ইন্সপেক্টরদের এটাও একটা কাজ ছিল, সব ঠিকঠাক চলছে কি না সেই বার্তা উঁচুস্তরের প্রভুদের কাছে পৌঁছে দেওয়া। যদিও এইসব বজ্র আঁটুনির মধ্যেও সূর্য সেনের মতো ব্যতিক্রমী শিক্ষক আমরা পেয়েছি, যিনি এরই মধ্যে থেকে স্বদেশব্রতী ছাত্রছাত্রীদের বেছে নিতেন। অবশ্য স্বাধীনতার পর স্কুল পরিদর্শকেদের এই দায় আজ আর তেমন নেই— আগামীতে তা ফিরে আসবে কি না তা এখনই নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।
উত্তর-স্বাধীনতা পর্বে স্কুল-কলেজ তৈরির ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা সমষ্টিগত প্রয়াসে যে ভাটা পড়েছিল আদৌ তা নয়। সরকারিস্তরে বলা হয়েছিল শিক্ষার যথাসম্ভব বিস্তার করাই তাদের অগ্রাধিকার। তাই রাজ্যের জেলায় জেলায় গ্রামে গ্রামে যেভাবে আগেও আঞ্চলিক উদ্যোগে স্কুল কলেজের স্থাপনা চলছিল তাতে তো ভাটা পড়েইনি, উপরন্তু সরকারিভাবে সেগুলোকে আরও উৎসাহিত করার চেষ্টাই ছিল প্রোজ্জ্বল। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ভবতোষ দত্ত যখন ষাটের দশকে রাজ্যের শিক্ষা অধিকর্তা ছিলেন তখন এলাকার স্কুলবাড়ি তৈরি ও সংস্কারের জন্য সরকারি বাজেটে অর্থ সংস্থান হত। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, কীভাবে দূরদূরান্তের স্কুল কমিটির কর্তারা স্কুলবাড়ি তৈরির অনুদান পাওয়ার জন্য তাঁর মহাকরণের দফতরে ভিড় জমাতেন। এইসব অর্থের সবটাই আঁকাবাঁকা পথে উধাও হয়ে যেত তা নয়— কিছু ব্যতিক্রম থাকলেও বহু বহু এলাকায় আঞ্চলিক স্কুলটির প্রতি এলাকাবাসীর দরদ ও আগ্রহ থাকত, তাঁরা নজর রাখতেন স্কুলের প্রতিদিনের কাজে। নানান সমালোচনা মেনে নিলেও এটা ঠিক, রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠার পর রাজ্যে প্রচুর স্কুল তৈরি হয়, নিম্নস্তরের স্কুল উন্নীত হয় উচ্চস্তরে। কলেজের সংখ্যাও বাড়ে। একদিকে উচ্চমাধ্যমিক অবধি শিক্ষা অবৈতনিক করা, অন্যদিকে শিক্ষকদের বেতনের দায় সরকারের নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া— এই দুই পদক্ষেপের অভিঘাত ছিল সুদূরপ্রসারী। মেনে নিতেই হবে এর রাজনৈতিক ডিভিডেন্ড শাসক বামফ্রন্ট পেয়েছে, কিন্তু তাই বলে এই প্রয়াসকে লঘু করে দেখা ঠিক হবে না। এই শিক্ষাবিস্তারের পেছনে আঞ্চলিক মানুষের সক্রিয় উদ্যোগকে সরকার বাতিল করে দেয়নি। বর্তমান প্রতিবেদকও এমন একটি মফস্বলের স্কুলে পড়েছে যা তৈরি হয়েছিল মূলত স্থানীয় এক ধনী পরিবারের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষণায়। আসলে রাজ্যের শিক্ষা প্রসারের সঙ্গে রাজ্যব্যাপী শিক্ষাসত্রগুলির এই বিশেষ চরিত্রের প্রয়াস অন্তত বাংলার ক্ষেত্রে এক জরুরি ঘটনা, অন্য রাজ্যের বিষয়ে কী হয়েছে জানা নেই।
আর তাই এই জোয়ারের পর যখন বিপুল ভাটার টান তা চোখে পড়ে আরও বেশি বেশি। রাজীব গান্ধি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন যে শিক্ষানীতি করেছিলেন তাতে ‘নবোদয় স্কুল’ নামের এক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কথা বলা হয়েছিল। মূলত সেই ছিল শিক্ষায় ব্যক্তিগত পুঁজির প্রথম নেমন্তন্নের চিঠি। তবে সারা দেশেই এই প্রকল্প নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে, এই রাজ্যের বামপন্থীরাও এটা মেনে নেননি। তখনও শিক্ষা বিষয়টি সংবিধানের যৌথ তালিকায় থাকলেও, রাজ্যের শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাদেশিক সরকারের জোরের জায়গা ছিল অনেকটাই— কলকাতা ও তার বাইরে কেন্দ্রীয় বোর্ডের স্কুল ছিল হাতে-গোনা সামান্য কিছু যা মূলত বিত্তবানদের ঘরের পড়ুয়াদের জন্যই বরাদ্দ। এমনকি কলকাতার পুরনো মিশনারি স্কুলের অনেকগুলোই ছিল রাজ্যের বোর্ডের অধীন, সাউথ পয়েন্ট বা সেন্ট লরেন্স মেনে চলত এই রাজ্যের সিলেবাস। কিন্তু এই পরিব্যাপ্ত বিধি ‘বাম’ হতে শুরু করে মূলত এই শতকের গোড়ায় যখন উদার অর্থনীতির ‘আশীর্বাদ’ গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে একশ্রেণির মাথায়।
আরও দশ বছরের মধ্যে কী করে যেন এই বার্তা ক্রমেই রটে গেল যে রাজ্যের সরকার-পোষিত স্কুলগুলি তাদের কৌলীন্য হারিয়েছে, ওখানে আর আমাদের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠানোর কোনও অর্থই নেই। কোনও মিডিয়া কিন্তু এরকম কোনও ‘ব্রেকিং নিউজ’ করেছে বা সকালের সংবাদপত্র বাহাত্তর পয়েন্টে হেডিং করেছে এমন নয়। কিন্তু এগুলো কেমন করে যেন রটে যায়— যেমনভাবে কলকাতায় ছেচল্লিশের সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের সময় একদিকে রটে গিয়েছিল মেছুয়াবাজারের মুসলমানেরা ঠনঠনিয়া কালীমন্দির লুঠ করে নিয়েছে, আরেকদিকে রটানো হয়েছিল তিলজলার হিন্দুরা নাকি পার্কসার্কাসের মুসলমান বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে! ব্যাপারটা অনেকটা এমনই। এটা ঠিক বছর বারো-পনেরো ধরে অন্তত কলকাতা ও বৃহত্তর কলকাতার বিভিন্ন সরকারি ও সরকার অনুমোদিত স্কুলগুলিকে টেনে নামানো হয়েছে দৈন্যে। ঠিক যেভাবে খুব কৌশলে প্রচার করা হয়েছিল বিএসএনএলে কেউ কাজ করে না, সরকারি ব্যাঙ্ক বা বিমা সংস্থাগুলো অপদার্থ, বিমান সংস্থা, বন্দর বা সরকারি হাসপাতালগুলিতে সরকারি অর্থের অপচয় হয়। একটু ক্রোনোলজি খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, এই প্রচার শুরু ও বিস্তারে প্রশ্রয় জুগিয়েছে প্রশাসন। প্রথমে খোদ সরকারি স্কুলগুলিতে শূন্যপদে নিয়োগ বন্ধ করা হল, তারপর অনুমোদিত স্কুলগুলিতে নিয়োগের নামে শুরু হল ঢালাও বেনিয়ম এবং অযৌক্তিক বদলি নীতি— আজ যার পরিণাম এক চূড়ান্ত স্থিতাবস্থা— না হল নিয়োগ না হল তার সমাধান। শিক্ষাখাতে সরকারি বাজেট বরাদ্দ ঠিক কতটা বেড়েছে এই সময়ে? মূল্যবৃদ্ধির সাপেক্ষে তা বলার মতো নয়, এর মধ্যেও স্কুলের নির্দিষ্ট পরিকাঠামো বিস্তারের জন্য বরাদ্দ তিলমাত্র। পরিসংখ্যান তুলে বাড়তি লজ্জা দেওয়ার অবকাশ নেই। বৃহত্তর কলকাতার বহু স্কুলকে সরাসরি বলে দেওয়া হয়েছে নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদের করতে— তারা স্কুলের বাড়ি ভাড়া দিচ্ছেন সামাজিক অনুষ্ঠানে, সভা-সমিতিতে। এইভাবেই দূরদর্শনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাদের দায় আর সরকার নেবে না— এবার ‘প্রসার ভারতী’— নিজেদের খরচ নিজেরা তোলো।
এই বাস্তবতার দুটো ধাক্কা। একে তো শহরের ‘সরকারি স্কুল’, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বাংলা বোর্ডের স্কুলে লেখাপড়া হয় না, এমন একটা ধারনার পোক্ত নির্মাণ। আর তার উপপাদ্য হচ্ছে, অতএব যাদের পকেটে রেস্ত আছে তারা প্রাইভেট স্কুলে যাও। আর যাঁরা শহরের উদ্বৃত্ত মানুষ, যাঁরা জল নিতে ‘টাইম কল’-এ লাইন দেন, রেশনের চাল না কিনলে যাঁদের হাড়ি চড়ে না— তাঁদের জন্য পাড়ার প্রাইমারি বা মাধ্যমিক স্কুল। সেখানে পোশাক আছে, বর্ষাতি আছে, মিড ডে মিলের খিচুড়ি আছে, কিন্তু শিক্ষা নেই। এখানে আরও একটা বিপজ্জনক কিনারা হল, মিড ডে মিলের প্রকল্পকে নিশানা করা— শিশুরা তো স্কুলে খেতেই যায়! এইরকমের একটা ‘খাওয়ানোর’ ক্ষণিক বিদ্যুৎ-উদ্ভাস দেখেছে এই রাজ্যের বাচ্চারা যখন গত বিগত পঞ্চায়েত ভোটের আগে আকস্মিক বলা হয়েছিল, ভোট না মেটা পর্যন্ত পড়ুয়ারা বাড়তি হিসেবে ফল বা মাংস পাবে— ভোট মিটলেই বাড়তি পুষ্টির এই আয়োজন ফুরুৎ! কী অপরিসীম অবজ্ঞা আর অবহেলার অভিজ্ঞান! ঠিক, শহরাঞ্চলে সরকারি স্কুলে পড়ুয়া কমেছে— সেটা পড়ুয়াদের বা তার অভিভাবকদের দোষ নয়। হতশ্রী কাঠামোর স্কুলগুলিকে পাড়ার মধ্যে, এলাকার মধ্যে খাড়া করে রাখা হয়েছে শুধু এইটুকু জানান দেওয়ার জন্য যে, আপনারা আপনাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের এখানে পাঠাবেন না! পারলে অন্য জায়গায় দিন কারণ এই বাড়িতে হয়তো আমরা একদিন ঠান্ডা পানীয় বা কেক-প্যাস্ট্রির দোকান করব অথবা ছোটখাটো শপিং মল বা ব্যাঙ্কোয়েট হল— কখন কী ঘটে যায় কিচ্ছু বলা যায় না!
কিন্তু আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিবেদন (২৪ এপ্রিল, ২০২৪) থেকেই জানা যাচ্ছে, মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কার একটি স্কুলে ছাত্রসংখ্যা ন-হাজার, ওই জেলারই সুতি অঞ্চলে একটি স্কুলের পড়ুয়া দশ হাজারের ওপর। নদীয়ার কালিগঞ্জ ব্লকের এক স্কুলের ছাত্র প্রায় দু-হাজার, ঝাড়গ্রামের একটি পিছিয়ে পড়া এলাকায় তা সাড়ে ন-হাজার। তিনটি জেলাই কিন্তু রাজ্যের মধ্যে খুব প্রাগ্রসর নয়— তাহলে এইসব পড়ুয়া কারা? সবাই যদি স্কুল ছেড়েই দেয় তাহলে শিক্ষক নিয়োগের বেনিয়মে ‘বাতিল শিক্ষক’-দের বিপর্যয় সামলাতে এসব স্কুলের কর্তৃপক্ষ চোখ কপালে তুলছে কেন? এইসব বাচ্চারা বুঝি স্কুলে শুধু খেতে যায়? আসলে এই পুরো ব্যাপারটাই এক বিপণনের চোরা কৌশল। স্মরণে রাখা দরকার, ২০২০-র ‘জাতীয় শিক্ষানীতি’-তে প্রত্যক্ষভাবে বেসরকারি স্কুলের পক্ষে নিদান দেওয়া হয়েছে আর ওই নীতি প্রাথমিকভাবে ‘মানছি না, মানব না’ ঘোষণা করলেও অচিরেই রাজ্যের সরকারি নীতি থেকে ওই ‘না’ শব্দটা ব্যাঙাচির লেজের মতোই খসে পড়েছে। সুতরাং স্পষ্ট দুটো বিভাজন— রাজধানী ও অন্যান্য নাগরিক এলাকায় সরকারি স্কুলের আদ্যশ্রাদ্ধ করা মানে শিক্ষার চাহিদাটাকে বেসরকারি পুঁজির খাতে বইয়ে দেওয়া; আর খেলার মাঠটা যদি আলাদা করে মসৃণ করে দেওয়া যায় তাহলে সেখানে খেলুড়ের অভাব হওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে, বিপুল গ্রামাঞ্চল, যাদের বাসিন্দাদের অত বেশি খরচ করে ঘরের ছেলেমেয়েদের পড়তে পাঠানো কল্পনার বাইরে— তাছাড়া সেখানে তো আর প্রাইভেট স্কুলের তেমন বেচাকেনা নেই! সুতরাং দশ হাজার পড়ুয়ার স্কুলে চব্বিশজন শিক্ষক চাকরি খোয়ালে কীই বা আসে যায়— ‘ওরা’ তো স্কুলে ‘খাওয়ার লোভে’ আসে! আর চাকরি পাওয়া বা না-পাওয়ার বৃত্তটা যদি আরও ঘেঁটে দেওয়া যায় তাহলে আসল বাজারটা আরও একটু বিছিয়ে বসে, এই আর কী!
তাহলে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হয় কীভাবে? হ্যাঁ সেইটাই বলার কথা। একটু নজর করলেই দেখা যাবে ঠিক কীভাবে গড়ে ও বেড়ে উঠছে আহ্লাদিত প্রাইভেট স্কুলগুলি। সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয় তাদের সাড়ম্বর শুভমুক্তি-র— অনেকটা ঠিক ব্লকবাস্টার হিন্দি ফিল্মের মতোই। সবুজে জুড়োনো ক্যাম্পাস, বাতানুকূল ক্লাসঘর, দিবারাত্র আন্তর্জাল-যোগ, আসমানি নীল সুইমিং পুল, বাস্কেটবল কোর্ট— আহা কী মনোরম এক ‘স্মার্ট প্রতিবেশ’! তদন্ত করে দেখা যায়, এসব স্কুলগুলি সচরাচর লোকালয়ের কিছুটা বাইরে এক লপ্তে অনেকটা জমি নিয়ে ধাঁ করে তৈরি। এবং এই স্কুলগুলির বেশিরভাগই নানা ‘সন্ত’-এর নামে তৈরি— মিশনারি দুনিয়ায় এত ‘সেন্ট’-এর অস্তিত্ব আছে স্বয়ং পোপ কি তা আগে জানতেন? অথবা আরেকটা তকমা হল এগুলো সবই নাকি ‘ইন্টারন্যাশনাল স্কুল’— এই তকমার ভিত্তি কী? এরা সবাই কি দুন স্কুল বা হার্ভার্ড স্কুলের সমান নাকি? গুণবিচারের আগে যে দর্শনধারী হওয়াটাই বেশি দরকার এখন আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝছি। এই দর্শনধারীদের জন্য খুলে দেওয়া হচ্ছে বাজার, আরও বাজার— তীর্থক্ষেত্রের পান্ডারা অথবা লালবাতি এলাকার টাউট-রা তো এভাবেই ‘খদ্দের’ ডাকেন বলে দেখা যায়! এগুলো কি তার চেয়ে খুব আলাদা?
পড়ুন, গুজরাত গণহত্যার বিচার হয়নি
অন্যদিকে সেই যে আমাদের গ্রামের বা গঞ্জের স্কুলগুলি, যা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় বাসিন্দাদের কত আবেগ, কত সভা, নিজেদেরই ভিতর কত খিটিমিটি— তারপর এক চিলতে জমির সংস্থান, একটু একটু করে ইট বালি ঢালাই, ডিআই অফিসে দৌড়োদৌড়ি— তারপর একটি দুটি করে লাজুক তরুণ বা তরুণীর শিক্ষকের পদার্পণ। কী নিবিড় এক বহুস্তরীয় নির্মাণ! গাঁয়ের লোকে তেমন পড়াশোনা না জানলেও এলাকার মাস্টারকে বলেন, ম্যাস্টর আমাদের ছেলেপুলেগুলিকে একটু দেখো— শীতলপাটির মতো কী অনাবিল ভরসা! হ্যাঁ, এরাই আবার দিদিমণি চুড়িদার পরে এলে নিন্দেমন্দ করেন, বাজার গরম হয় কিন্তু সেটার মানে এই নয় ওই দিদির ওপর তাঁদের ভরসা নেই। আমাদের গ্রামে-গঞ্জের এইসব আঞ্চলিক উদ্যোগগুলি দুশো বছর ধরে আসলে যা বহন করছিল সেটা পুরনো রেনেসাঁ-র ইতিবাচক ঐতিহ্য যা আজ সরস্বতী নদীর মতোই মজা নালা— এটাকেই কি একটু শীলিত ভাষায় বলা হয় প্যারাডাইম শিফট?
ওই তো রাত পোহাতেই চকচকে স্কুলের বাসগুলি এসে দাঁড়াচ্ছে রাজপথে। তার ভিতরে সেঁধিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্মার্ট প্রজন্ম। সার বেঁধে তারা ঢুকে যাচ্ছে প্রকাণ্ড ফটকের অন্দরে। আহা কী শান্তি! কড়া ডিসিপ্লিনের ধ্বজা কেড়ে নিয়েছে তাদের কিচিরমিচির। আর তারপর চিচিং বনধ হয়ে যাচ্ছে লোহার ভারসই পেল্লাই গেট। বেড়া। এপারে এক দেশ, ওপারে আরেক। কেউ কাউকে দেখতে পায় না।