রিঙ্কু সিং
সরকাররা ভোট পাওয়ার জন্য এরকম কিছু কিছু দেওয়াথোওয়ার কাজ করেই। পাবলিকের টাকাই কিছুটা আবার পাবলিককে ফেরত দেওয়া। তাতে গরিব মানুষের কিছু হেল্পও হয়ে যায়। সেটা খারাপ না। ভোট আসছে। আমার এটাই মনে হয় যে-ই সরকারে আসুক সে যদি এই গরিব মানুষদের জন্য একটু ভাবে, তাদের যেন কাজকর্ম ঠিকঠাক থাকে, জিনিসপত্রের দাম যেন বেশি না বাড়ে, এসবগুলো করতে পারলে ভাল হয়
বিহারের ডুঙ্গিতে বাড়ি ছিল আমাদের। মা-বাবা, চার ভাইবোন। বাবা একটা মেডিসিন কোম্পানিতে কাজ করত। ওষুধপত্র ডেলিভারির কাজ। বিভিন্ন ওষুধের দোকানে, ডাক্তারখানায়। এখনও করছে সেই কাজটাই। চার ভাইবোনের মধ্যে এক ভাই বিয়েথা করে এই কলকাতারই ভবানীপুরে চলে এসেছে। ওখানেই কাজকর্ম করে। আরেক ভাই ছোট। ওই আছে এখন গ্রামে বাবা-মায়ের সঙ্গে। চোদ্দ বছর বয়স। আমার আর এক বোনের বিয়ে হয়েছে বিহারের দ্বারভাঙ্গায়। আর আমি তো এই এখানে— দমদমে।
আমি পেশায় গৃহ-পরিচারিকা। পাঁচটা বাড়িতে আপাতত কাজ করি। কোনও বাড়িতে সাত বছর, কোনও বাড়িতে পাঁচ বছর হয়ে গেল কাজ করা। এখানে আমাদের স্বামী-স্ত্রীর সংসার। স্বামী-স্ত্রী আর দুই মেয়ে আমাদের। মেয়ে দুটো ক্লাস নাইন আর সিক্সে পড়ে। আমার বর টোটো চালায়। বছর দুই যাবত করছে এই কাজটা। এর আগে নানারকম কাজ করত। কখনও রঙের কাজ, কখনও ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ। অনেক সময়েই কাজ থাকত না হাতে কোনও। আর সত্যি কথা বলতে সেইজন্যই আমার এই কাজ করতে বেরোনো।
আমিও অবশ্য প্রথম থেকেই যে এই গৃহ-পরিচারিকার কাজ করেছি, তা নয়। আগে বাড়িতে গেঞ্জি, ব্লাউজ এসবের সুতো কাটা, হেম-সেলাই করা— এসব করতাম। ঘাড়-পিঠ ব্যথা হয়ে যেত। চোখেরও সমস্যা হচ্ছিল। তখন পাড়ারই কিছু মহিলা বললেন, লোকের বাড়ির কাজ ধরতে। তারপর থেকে এটাই করছি। নইলে তো চলা মুশকিল। দুটো বাচ্চা নিয়ে, ঘর ভাড়া দিয়ে— হয় না। আর ওই যে বললাম, আমার বরের তখন কাজও থাকত না সেরকম নিয়মিত।
আমি পাঁচবাড়িতে কাজ করি। মাস গেলে এখন আমার ৯০০০ টাকা রোজগার হয়। বর যে টোটো চালায়, তাতে একটা মাসিক রোজগার আছে ৩৫০০ টাকার। একটা স্কুলের কিছু বাচ্চা নিয়ে যাওয়া-আসা করতে হয়। এর বাইরে আর যা কিছু ভাড়া খাটে তার মধ্যে থেকে মালিককে ২৫০ টাকা রোজ দিয়ে বাদবাকিটা থাকে। এই ২৫০ টাকা মালিককে রোজ দিতেই হয় রোজগার হোক না হোক। কোনওদিন ২০০ টাকাও যদি দেয় দু-তিনদিন গাড়ি দেয় না। এই যে চৈত্রমাস গেল, বা আরও কিছু কিছু মাসে যখন রোজগার হয় না ভাল তখন এরকম গাড়ি বন্ধ থাকে মাসে ৪-৫ দিন করে। নইলে মোটামুটি গড়ে ২৫০-৩০০ টাকা দিনে বাড়িতে আনতে পারে। এইটা আর স্কুলের টাকাটা নিয়ে হাজার দশেক মতো মাসে ওর রোজগার হয়।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
ঘর ভাড়ার কথা বলছিলাম। এইটাই আমাদের এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা। মাস গেলে ইলেকট্রিক বিল মিলিয়ে ৩৫০০ টাকা বেরিয়ে যায় ঘরভাড়ায়। এই ঘরটায় এসেছি বছর তিনেক হল। বছর-বছর ১০০ টাকা করে ভাড়া বাড়ে। আগের ঘরটার ভাড়া ছিল ১২০০ টাকা। কিন্তু সে একদমই ঘুপচি একটা টালির ঘর। মেয়ে দুটো বড় হচ্ছে, পড়াশোনা করছে, হত না ওই ঘরে। সরকার ঘর দেয়— কিন্তু সে যাদের ঘর আছে তাদের। ভাড়াটেদের দেয় না।
বর টোটো চালানোর পর থেকে সংসারটা চলে যাচ্ছে মোটামুটি। তবু প্রতি মাসেই কিছু ধারদেনা করতেই হয়। এই ঘরভাড়া দেওয়ার সময়ে, মেয়েদের পড়াশোনায় ওরকম মাসে কোনও খরচ না হলেও— মানে ওই টুকিটাকি খাতাটা, পেনটা এসব কিছু লাগে— বছরে একটা বড় খরচ হয়। তা দুই মেয়ে মিলিয়ে ওরকম ৭-৮০০০ টাকা মতো। সেই সময়ে তো ধার করতেই হয়।
এই সমস্যাগুলো একটু মিটলে ভাল হয়। ঠিকঠাক কাজ থাকবে, ঠিকঠাক রোজগার। যাতে প্রতি মাসের শেষে এই ধারদেনাটা করতে না হয়। ঘরভাড়া দিয়ে, খেয়ে-পরে যদি হাতে কিছু টাকা রাখা যেত ভাল হত। এমনিতেই মাসের শেষে টান পড়ে যায়। এবার যদি সেরকম কিছু হয়, মানে কারও অসুখবিসুখই হল, আমার বা আমার বরের, বা বাচ্চাদের— তখন তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। আমাদের তো জমানো কিছু নেই।
আমাদের গ্যাস নেই, স্টোভেই রান্নাবান্না করি। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও এমনি নেই। তবে একটা জনধন অ্যাকাউন্ট আছে। কিন্তু ওতে কী হয় জানি না। আর মেয়েদের কন্যাশ্রী অ্যাকাউন্টও একটা আছে। ওতে গত বছর, মানে ২০২৩-এ একবার ১০০০ টাকা এসেছিল, তারপর থেকে আর কিছু আসেনি। স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে। আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। এটাই একমাত্র একটু উপকারে আসে। মাসে মাসে একটা টাকা পাওয়া যায়।
আসলে সরকাররা ভোট পাওয়ার জন্য এরকম কিছু কিছু কাজ তো করেই। পাবলিকের টাকাই কিছুটা আবার পাবলিককে ফেরত দেওয়া। তা তাতে গরিব মানুষের কিছু হেল্পও হয়ে যায়। সেটা খারাপ না। ভোট আসছে। হইচই হচ্ছে। আমার এটাই মনে হয় যে-ই সরকারে আসুক সে যদি এই গরিব মানুষদের জন্য একটু ভাবে, তাদের যেন কাজকর্ম ঠিকথাক থাকে, জিনিসপত্রের দাম যেন বেশি না বাড়ে, এসবগুলো করতে পারলে ভাল হয়।
মেয়েদের পড়াতে চাই। অন্তত উচ্চমাধ্যমিকটা অবধি তো বটেই। কলেজে মনে হয় পারব না। যা খরচা! বলছিলাম না, এখনই বছরে একবার দুই মেয়ের মিলিয়ে প্রায় ৭-৮০০০ টাকা খরচ হয়। তখন খুবই চাপে পড়তে হয়। অনেক টাকা ধার হয়ে যায়। এটা তো বাড়বে আরও। তাই উচ্চমাধ্যমিকটা অব্দি চালিয়ে তারপর যদি কিছু চাকরির ট্রেনিং, কম্পিউটার, বা এমনি অন্য কোনও হাতের কাজ শেখাতে পারি, তাহলে কিছু করে খেতে পারবে।
দেশের খবর, সত্যি বলতে, কিছু রাখা হয় না। নিজেদের রোজকার কাজকর্ম, নানা ঝামেলা, এসব নিয়েই দিন চলে যায়। রাতে শুয়ে একটু মোবাইল দেখি। ভিডিও-টিডিও। খবর-টবর শোনা বা পড়া হয় না। আমার একটা স্মার্টফোন আছে। বরেরও। মেয়েরাও দেখে। ও-ই। তবে দেশে এখন ধর্ম নিয়ে বেশ মাতামাতি হচ্ছে। রামনবমীতে এত মিছিল-টিছিল কখনও দেখিনি। ধর্ম নিয়ে মারামারিও হচ্ছে শুনি। কী দরকার বুঝি না! সবাই তো মানুষ। আমরা তো খেটেই খাব। তাতে আবার এইসব ঝামেলা কেন? রামমন্দির হল, হ্যাঁ একটা বড় মন্দির হল, ভালই হল। তবে ওই অতগুলো টাকায় যদি গরিব মানুষের জন্য কিছু করা যেত, সে-ও তো ভগবানকেই সেবা করা হত, তাই না?
ভোট আসছে, দেব। কিন্তু ও নিয়ে খুব কিছু চিন্তাভাবনা করি না। আমাদের তো খেটেপিটেই দিন পার করতে হবে…
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত