সোমনাথ মুখোপাধ্যায়
আজকাল সন্তানকে মনপসন্দ করে গড়েপিটে নিতে অভিভাবকদের চেষ্টার অন্ত নেই। বেশ নামডাকওয়ালা স্কুলে ভর্তি করা থেকে শুরু হয় এই দৌড়, আর এর সমাপ্তিরেখা কোথায় টানা হবে তা কেউই জানে না। সবটাই একটা বড়সড় পরিকল্পনা বা স্ট্র্যাটেজির খেলা। একটু একটু করে ঘুঁটি সাজিয়ে একই সঙ্গে অফেন্স আর ডিফেন্সের আয়োজন। এখানে সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া, ভাল লাগা-মন্দ লাগার কোনও সম্পর্ক নেই। সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয় রক্তসম্পর্কের অভিভাবক ও সামাজিক চাহিদা ও মানমর্যাদার নিরিখে
খবরটা আজকের (১০ মে, ২০২৪) সমস্ত সংবাদপত্রেই বেশ গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছে। একটি ছোট্ট চিরকুট। তাতে খুব মরমী ভাষায় কয়েকটি কথা লেখা। লিখেছে রাজেন্দ্র মীনা। এই চিঠির খবর সংবাদপত্রের পাতায় ঠাঁই করে নেওয়ার আগে আপামর ভারতবাসী তার পরিচয় জানত এমনটা বোধ করি নয়। এখন অনেকেই হয়তো জানল। এই পরিচিতির কারণ কী? রাজেন্দ্র তার বাবা-মায়ের স্বপ্নপূরণে ব্যর্থতার আশঙ্কা করে দেশের এক আধুনিক পঠনপাঠন কারখানা থেকে পালিয়ে গিয়েছে বা বলা ভাল পালাতে বাধ্য হয়েছে। চিরকুটে কী লিখেছে রাজেন্দ্র?
বাড়ি ছেড়ে চললাম।
পাঁচ বছরের জন্য যাচ্ছি।
আমি আর পড়াশোনা করতে চাই না।
আমার কাছে হাজার আষ্টেক টাকা আছে।
…ফোনের সিম ভেঙে ফেলছি।
ফোনটা বিক্রি করে দেব।
চিঠির বয়ান পড়ে অনেক কথাই মনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে এই সময়ের তীব্র প্রতিযোগিতামূলক পঠনপাঠন সম্পর্কে। জানি, আমাদের সেকেলে ভাবনাচিন্তা নিয়ে একালে কিছু বলা হয়তো একেবারেই অমূলক তবুও মনে হয় বলাটা জরুরি। যে-শহরের নলেজ ফ্যাক্টরি থেকে রাজেন্দ্র ‘লাপাতা’ হয়েছে তার (কু)খ্যাতি দেশজোড়া। রাজস্থানের কোটা শহরের প্রশাসনিক আধিকারিকদের নিয়ত আশঙ্কায় থাকতে হয় এই বুঝি আরও একটা প্রাণ ঝরে গেল উচ্চাভিলাষী অভিভাবকদের প্রত্যাশার তীব্র চাপ সহ্য করতে না পেরে। রাজেন্দ্র নিজেকে শেষ করে দেয়নি বটে, কিন্তু মাত্র কিছুদিন আগে আর এক শিক্ষার্থী ভরত রাজপুত চাপের কাছে হার মেনে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে।
গত ৪ মে, ২০২৪, হরিয়ানা রাজ্যের এক NEET পরীক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর শুনতে না শুনতেই ভরতের আত্মহত্যার খবর উঠে এলো কাগজে। পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে ভরত ঠিক দুটি বাক্য লিখে রেখে গেছে তার বাবার উদ্দেশ্যে— “দুঃখিত বাবা। এবারও আমি নির্বাচিত হব না।” অসাফল্যের আশঙ্কায় ভরত নিজেকে শেষ করে দিল। নিজের এক আত্মীয় রোহিতের সঙ্গে এক হস্টেলে বসবাস করত ভরত। এই নিয়ে তৃতীয়বারের জন্য সর্বভারতীয় মেডিক্যাল পরীক্ষায় বসেছিল সে। আগের দুবার পাশ করতে না পারায় নিশ্চয়ই ভরতের মনে এক আশঙ্কার কালো মেঘ জমা হচ্ছিল। সে হয়তো উপলব্ধি করতে পারছিল যে পাশ করতে না পারলে তার বাবার বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ একেবারে বেকার হয়ে যাবে। মনের ভেতরে গুমরে ওঠা অস্থিরতা তাকে ক্রমশ গ্রাস করছিল, আর তাই তার সহপাঠী রোহিতের সাময়িক অনুপস্থিতির সুযোগে নিজেকে শেষ করে দিল ভরত। ভরত একা নয়, এই বছরের এ কয়মাসের মধ্যে দশজন ছাত্র আত্মহত্যা করেছে। ভাবা যায়! গত বছর আত্মঘাতী ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ২৭ জন। কেমন যেন গা-সওয়া হয়ে যাচ্ছে ঘটনাগুলো। এখনকার এই টপকে যাওয়া ‘ক্যারিয়ার বিল্ডিং’ প্রক্রিয়ার শেষ কোথায়? এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বারংবার, অথচ কোনও তরফেই কোনও হেলদোল নেই। আজকের কোটা শহর নবীন প্রজন্মের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের কাছে স্বপ্নপূরণের এক মোক্ষস্থল হয়ে উঠেছে, আত্মহননেরও বটে। অথচ রাজপুতানার এই শহরের অন্য পরিচয়, অন্যতর তাৎপর্য ছিল। আসুন একবার সেসব কথা জেনে নিই।
কোটা— চম্বলের ভূমি। রাজস্থানের তৃতীয় বড় শহর। রাজপুতানার এক গৌরবময় ইতিহাসের উত্তরাধিকারী। চম্বল নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে ওঠা কোটা রাজস্থানের নিজস্ব ঘরাণার মিনিয়েচার চিত্রশৈলীর আঁতুড়ঘর। এখানেই রয়েছে সুদৃশ্য রাজপ্রাসাদ, অত্যন্ত সমৃদ্ধ সংগ্রহশালা এবং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। এসবের পাশাপাশি কোটা বিখ্যাত স্বর্ণালঙ্কার শিল্প, বিখ্যাত ডোরিয়া শাড়ি, সিল্কের শাড়ি ও বিখ্যাত কোটা পাথরের জন্য যা দিয়ে মেঝে তৈরি করা এখন শহুরে বাবুদের আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
এসবের মধ্যে তো আশঙ্কার লেশমাত্র নেই। আর পাঁচটা দেশীয় শহরের মতো কোটাও বেশ ছিল। কিন্তু এই পরিচয় যথেষ্ট গৌরবের হয়তো ছি লনা তাই শিক্ষাব্যবসার হাত ধরে তার এক রূপান্তরের পর্ব শুরু হল। আজকের কোটা শহরের পরিচিতি নিশ্চিতভাবেই তার কোচিং সেন্টারের জন্য। কোটা এখন ভারতের সেরা কোচিং সেন্টার হাব— আমার, আপনার সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার পীঠভূমি। এই মুহূর্তে ভারতের উচ্চাকাঙ্খী অভিভাবকদের এলডোরাডো, স্বপ্নভূমি। সন্তানদের শিক্ষাখাতে অর্থ বিনিয়োগের দালাল স্ট্রিট।
এককালে আমাদের রাজ্যের নবদ্বীপ, ভাটপাড়া সারা ভারতের অন্যতম সেরা শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছিল। গঙ্গাপাড়ের কাশীও ছিল বিদ্যাচর্চার উৎকর্ষকেন্দ্র। আসলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার গোটা প্রক্রিয়াটাই এক গোলকধাঁধায় আটকে পড়েছে। আর তাই হয়তো আদর্শ, ভরতদের মতো তরুণদের আত্মহননের পথ বেছে নিতে হয়। অভিভাবকদের আকাশছোঁয়া প্রত্যাশার চাপ নিতে না পেরে রাজেন্দ্রকে চিঠি লিখে নিরুদ্দেশের পথে পাড়ি দিতে হয়।
আজকাল সন্তানকে মনপসন্দ করে গড়েপিটে নিতে অভিভাবকদের চেষ্টার অন্ত নেই। বেশ নামডাকওয়ালা স্কুলে ভর্তি করা থেকে শুরু হয় এই দৌড়, আর এর সমাপ্তিরেখা কোথায় টানা হবে তা কেউই জানে না। সবটাই একটা বড়সড় পরিকল্পনা বা স্ট্র্যাটেজির খেলা। একটু একটু করে ঘুঁটি সাজিয়ে একই সঙ্গে অফেন্স আর ডিফেন্সের আয়োজন। এখানে সন্তানের ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া, ভাল লাগা-মন্দ লাগার কোনও সম্পর্ক নেই। সবটাই নিয়ন্ত্রিত হয় রক্তসম্পর্কের অভিভাবক ও সামাজিক চাহিদা ও মানমর্যাদার নিরিখে। “তোমার ছেলে কোটায় পড়ে না!”— প্রতিবেশী তথা স্বজনদের এমন ‘খিল্লির’ শিকার হতে হয় অনেকক্ষেত্রেই।
আমার এক পরিচিতজনের পুত্রসন্তানের কথা বলি। বেশ সপ্রতিভ, চটপটে। দেখেশুনে মনে হয়েছিল, ঠিকঠাক তরুজৎ করতে পারলে ভবিষ্যতে ভাল কিছু করতে পারে। আমার এমন মূল্যায়নের কথা ছেলেটির পিতৃদেবের কাছে একদিন সবিনয়ে পেশ করলাম। আমার কথা শুনে সে তো একেবারে গদগদ— “আপনার জহুরির চোখ। এতকাল কত কত ছেলেপিলেদের চরিয়েছেন, আপনার অনুমানের দাম আছে। আমি […]-কে বলব আপনার সঙ্গে দেখা করতে।”
এমন কথা শুনে আমিও যেন কৃতার্থ হয়ে গেলাম; তক্কে তক্কে রইলাম ছেলেটির প্রতীক্ষায়। দিনকতক পরে ছেলেটি এল একদিন। সঙ্গে তার মা। আমার ঘরে বইয়ের আয়োজন দেখে সে বেচারি একাধারে বিস্মিত এবং অভিভূত। তার উৎসাহ দেখে আমিও খানিকটা উৎসাহিত হয়ে বললাম— “পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য বই পড়ো?” আমার প্রশ্নটা লুফে নিয়ে ছেলেটির মা উত্তর দেন— “না, আসলে পড়াশোনার এত চাপ, টিউটোরিয়াল ক্লাসের স্যারেদের টাস্ক, ও আর সময় করে উঠতে পারে না।” দান উল্টে যাচ্ছে দেখে খানিকটা হতাশ হয়ে একটা মরিয়া চেষ্টা করি— “তাহলে তোমার অবসর কাটে কী করে?” অবসর কথাটা ছেলেটির কাছে নতুন বলে মনে হয়, সে বেশ হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। এবারও এগিয়ে আসেন তার মা। “এখন বড় হয়েছে তো, তাই আগের মতো ফুরসৎ পায় না। ওই ল্যাপটপ নিয়ে খানিকটা সময় কাটায়। ওর বাবার কড়া নির্দেশ লেখাপড়ার বিষয় ছাড়া অন্য কিছু দেখা চলবে না।” এমন উত্তর আমাকে কোণঠাসা করে ফেলে। শেষ চেষ্টায় ছেলেটির হাতে রাস্কিন বন্ড সাহেবের লেখা একটা বই তুলে দিয়ে বলি— এটা পড়ে দেখো। আনন্দ পাবে। বইয়ের প্রচ্ছদে বন্ড সাহেবের গোলগাল চেহারার ছবি দেখেই বোধহয় ছেলেটি উৎসাহিত হয়। “হ্যাঁ হ্যাঁ পড়ব।”— একরাশ উৎসাহ ঝরে পড়ে ওর গলায়। মা-ব্যাটা বিদায় নেয় কিছু পরেই। আমি আশ্বস্ত হই একথা ভেবে— যাক, এতদিনে একজনকে অন্তত পাওয়া গেছে।
এরপরের কাহিনি নাতিদীর্ঘ ও আমার কাছে অনেকটাই বিয়োগান্তক। একদিন সকালে বারান্দায় বসে খবরের কাগজের পাতা ওল্টাচ্ছি। হঠাৎ গেট খোলার আওয়াজ। উঠে দাঁড়াতেই নজরে এল সেই অভিভাবকটিকে। গুড মর্নিং বলে সম্ভাষণ করি। একটু উদ্বেগ নিয়েই বলি,
—কী ব্যাপার? এত সকাল সকাল!
—না, মানে বইটা ফেরত দিতে এলাম।
—বই? আচ্ছা কোন্ বই? ওহ্, বুঝেছি,যে বইটা […]। তা আপনি এলেন? […] আসবে বলেছিল। কেমন লাগল বইটা? কিছু বলেছে ছেলে?
—না মানে ওর কোনও দোষ নেই। আসলে আমিই ওকে এসব বইটই পড়তে বারণ করেছি। এইসব বই পড়ে এখন সময় নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। ওর টিউটোরিয়ালের সব স্যারেরাও এমন কথা বলেছে। আর তাছাড়া সামনের বছর থেকেই ভাবছি আমার ছেলেকেও কোটায় পাঠিয়ে দেব। এখানে থাকলে ছেলেরা মানুষ হবে না। আচ্ছা চলি।
ভদ্রলোক যেমন ঝড়ের মতো এসেছিলেন তেমন ঝড়ের গতিতেই প্রস্থান করলেন। আমার বিমূঢ় দশা দেখে বইয়ের মলাটের বাইরে এসে স্বয়ং বন্ড সাহেব যেন বলে উঠলেন— “I told you before not to share the book with anyone else.” আমি তখন রঁদার ভাস্কর্য।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
অভিভাবকদের একটা বড় অংশই এখন সন্তানদের নিয়ে এমন ডায়মন্ড ছকে মজে আছেন। সমাজের কিছু অংশের মানুষের কাছে এখন অর্থকরী স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে। না এলেও পরোয়া নেই। ঋণ নিয়ে ছেলেপিলেদের মানুষ (?) করতেই হবে। রাজেন্দ্রর বাবাও এমন ভেবেছিলেন হয়তো। তাঁর আশা ছিল কোটার কোচিং সেন্টারের কল্যাণে ছেলে রাজেন্দ্র একদিন ডক্টর সহাব বনেগা। ছেলের সুবাদে সমাজে মান সম্মান প্রতিপত্তি সব বাড়বে। আশা বোধহয় চিরদিনই কুহকিনী।
এই সময় থেকে কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে, ইউক্রেনে যুদ্ধ শুরু হলে সেই দেশে ডাক্তারি পড়তে যাওয়া ভারতীয় ছাত্রদের প্রত্যাবর্তনের কথা চিন্তা করুন। এদেশে সুযোগ না পেলেও ইউক্রেনে তাদের ঠাঁই মিলেছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে তদের দেশে ফিরিয়ে আনতেই জানা গেল ঋণজর্জরিত অভিভাবকদের চাঁটি-বাটি বিকিয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনি। অধিকাংশই সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। কষ্টকল্পিত মানুষ গড়তে এভাবে সন্তানের পাশে দাঁড়াতে হবে?
আসলে একটা বড় বাজার খুলে বসেছি আমরা। সব সম্পর্কই এখন বিকিকিনির হাটের পণ্য। সন্তানের ভবিষ্যৎ ভাবনায় বিভোর অভিভাবকরা এখন ইনভেস্টমেন্টের নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছেন। যেনতেনপ্রকারেণ কাজ হাসিল করতে হবে। রাজেন্দ্রকে আমি ধন্যবাদ দেব এই কারণে যে সে একটা বিকল্পের খোঁজেই হয়তো এতসব কায়েমি ব্যবস্থাকে পেছনে ফেলে নিজের মতো করে সবকিছুকে সাজিয়ে নিতে চাইছে। কাজটা কঠিন জেনেও রাজেন্দ্র পথে নেমেছে। মায়ের সঙ্গেই রাজেন্দ্রর কথা হত বেশি। তাই গর্ভধারিনী মায়ের কথা ভেবেই সে কিঞ্চিত আকুল। বাবার উদ্দেশ্যে লেখা চিরকুটে তাই সে লিখেছে— “মাকে চিন্তা করতে বারণ কোরো। আমি কোনও অন্যায় কাজ করব না। বছরে অন্তত একবার আমি তোমাদের ফোন করব। আমার কাছে তোমাদের সকলের ফোন নম্বর আছে।” বেচারি মা। ছোট ছেলে রাজেন্দ্রর এভাবে নিখোঁজ হওয়ার কথা জেনে একেবারেই ভেঙে পড়েছেন তিনি। পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুসন্ধানী দল তৈরি করা হয়েছে বছর কুড়ির এই তরুণকে খুঁজে বের করতে। এমন কাজ তো তাদের নিয়মিতই করতে হয়। খালি উদ্বেগ হয়, এমন অঘটনের ক্রমবর্ধমান বাড়বাড়ন্ত লক্ষ করে।
এত কাণ্ডের পরেও কি আমাদের মনে নতুন করে ভাবনার স্রোত প্রবাহিত হবে? মনে হয় না। সবাই সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে জুয়া খেলাতেই হয়তো মজে থাকতে চাইবে। আমাদের উত্তর-প্রজন্মের এমন পরিণতির জন্য কাকে দায়ী করব আমরা? শিক্ষা এখন অপশিক্ষার কুৎসিত মলাটে মুখ ঢেকেছে। রাষ্ট্রের মদতে যথার্থ গুণমানের সর্বজনীন শিক্ষার অন্তর্জলি যাত্রা সম্পন্ন প্রায়। দেশজুড়েই এখন ডামি প্রতিষ্ঠানের রমরমা। এমন না হলে তথাকথিত কৃতীদের টেস্টপেপারের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে কাজে লাগানো হয়? পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর কৃতীরা স্কুল ইউনিফর্মের বদলে কোচিংসেন্টারের লোগো লাগানো পোশাক পরে ছবি তোলে? রাস্তা জুড়ে শোভা পায় কৃতীদের ছবি লাগানো কোচিংসেন্টারের বড় বড় হোর্ডিং? পণ্যায়িত সমাজে এমনটাই হয়তো স্বাভাবিক। সন্তানের সামনে সেই আজব খুড়োর কলের মতো এক অবাস্তব স্বপ্নের পুঁটুলি ঝুলিয়ে দিয়ে সমানেই তাকে তাড়িয়ে মারছি যাতে সে পাঁচ ঘণ্টার পথ দেড় ঘন্টায় পাড়ি দিতে পারে। সন্তানদের ছুটিয়ে দিয়ে কেমন দার্শনিকসুলভ নির্লিপ্ততায় নির্দ্বিধায় বলতে পারছি— কিছু পেতে হলে কিছু তো ছাড়তেই হবে বাবা। আর তাই হয়তো স্বপ্নপূরণের নামে তরতাজা প্রাণগুলোকে এভাবে অকালে ঝরে পড়তে দেখেও আমরা সবাই কেমন নির্লিপ্ততায় বুঁদ হয়ে আছি।
বিদায়ী লোকসভার মাননীয় স্পিকার সাহেব ওম বিড়লার নির্বাচনী ক্ষেত্র হল কোটা। আমাদের ভাবী প্রজন্মের এমন করুণ পরিণতি দেখে তিনি কী বলেন? কোটার কথায় গদগদ হয়ে দেশের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীজি যখন বলেন— কোটা হল নবভারতের কাশী, তখন হতাশ হতে হয়। একদল শিক্ষামাফিয়ার নির্লজ্জ আগ্রাসনের শিকার আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা। দেশে সম্মানযোগ্য কর্মসংস্থানের অভাব আমাদের তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছে এমন মূল্যবোধহীন দুর্গম শিক্ষাপথের পথিক হতে। সবকিছু জেনেও আমরা ওই পথেই ঠেলে দিচ্ছি আমাদের সন্তানদের। Catch them Young— এই আপ্তবাক্যকে মাথায় রেখেই এখন অষ্টম শ্রেণি থেকেই কোটা ফ্যাক্টরিতে শুরু হয়েছে ছাত্রদের মগজ ধোলাই করার কাজ। অষ্টম শ্রেণি মানে বয়ঃসন্ধিকালের শুরু, যখন আগামীর স্বপ্নে বিভোর হয়ে উঠতে থাকে কিশোর-কিশোরী মন; ঠিক তখনই মনের ভেতর উথলে ওঠা স্বপ্নের আহুতির জন্য একালের কাশী(?!) কোটা স্বপ্নমেধ যজ্ঞের বেদি প্রস্তুত করছে। আত্মাহুতির এমন সুযোগ কি আমরা হেলায় ঠেলে দিয়ে বলব—
আয় রে তোরা বাঁধা পথের শেষে,
ছোট রে তোরা জীবনপথে
প্রাণের হাসি হেসে।
এতদিনের ভুলগুলো সব ঝেড়ে
আয় রে সবাই কালের খুঁটি নেড়ে,
নতুন করে গড়ি।
মরা গাঙে আসুক জোয়ার,
ভাসাব আজ তরী।।
রাজেন্দ্র, ভাল থেকো।
শনিবার ৫ মে, ২০২৪
লেখক আমাদের আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিলেন। সন্তানের ভবিষ্যৎ গড়ার এমন পরিণতি?