সুকুমার মল্লিক
চাষের কাজ তো রোজ থাকে না। আর নদীতে মাছ ধরাও বারো মাসের কাজ নয়। কাজের এই সঙ্কটের জন্যই আমাদের এখান থেকে বাইরে যেতে হয়। প্রায় সবাই যায়। চাষের অফ সিজন যে-সময়টা তখন কী করবে বাড়িতে! আর এই আয়লার পর তো গ্রাম ফাঁকা করে আমরা সবাই যলে গেছিলাম এদিক-ওদিক। আমি যেমন আন্দামানে গেছিলাম
আমাদের এই ঝড়খালি অঞ্চলে আগে মাছ ধরাই ছিল প্রধান জীবিকা। এখানকার চিংড়ি, কাঁকড়া দেশ-বিদেশে যায়। চাষবাস আগে একদমই হত না, জঙ্গল ছিল। তারপর একটু একটু করে গ্রাম তৈরি হল, জমি করে চাষবাসও শুরু হল— সেই সময়েই আয়লা এসে গেল। ব্যস, আবার বেশ ক-বছরের জন্য চাষবাস বন্ধ। আমরা তখন সবাই বাইরে চলে গেছিলাম খাটতে। আমি গেছিলাম আন্দামান।
আসলে চাষের কাজ তো রোজ থাকে না। কাজ হলে ওই দৈনিক ৩০০ টাকা রোজগার। আর নদীতে মাছের কারবারটা ভাল হলে মাসে ১০০০০ টাকাও কখনও কখনও হয়। নইলে ৫০০০, ৬০০০… ঠিক নেই। কিন্তু সেও তো বারো মাসের কাজ নয়।
কাজের সঙ্কটের জন্যই আমাদের এখান থেকে বাইরে যেতে হয়। প্রায় সবাই যায়। চাষের অফ সিজন যে-সময়টা তখন কী করবে বাড়িতে! আর এই আয়লার পর তো গ্রাম ফাঁকা করে আমরা সবাই যলে গেছিলাম এদিক-ওদিক। আমি যেমন আন্দামানে ছিলাম বললাম। ওখানে রোজগারটাও ভালই হত। কিন্তু আমার একবার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। তাই এখন আর যেতে পারি না। এই অসুখটা খুব কাবু করে দিয়েছে। এর জন্য একদিকে আয়ও কমে গেছে, আবার এই রোগের চিকিৎসারা জন্য খরচটাও বেড়ে গেছে।
তার সঙ্গে জিনিসপত্রের দাম। জিনিসপত্রের দাম বাড়লে গরিব মানুষের তো মুশকিল হবেই।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
আমাদের বাড়ি ছিল বাংলাদেশে। এদেশে আসার পর থেকে আমি এই সুন্দরবনের ঝড়খালিতে থাকি। আমাদের পরিবারে ৬ জন লোক। ছ-জনের মধ্যে আমি আর আমার ছেলে রোজগার করি। আমি চাষবাস করি, আর মাছ ধরি। ছেলেও তাই। বাড়িতে কিছু ছাগল-টাগল আছে। আমার স্ত্রী, বৌমা ঘরের কাজের পাশাপাশি ওগুলো দেখাশোনা করে। আমার স্ত্রী মাঠে চাষের কাজও করে।
মাঠের কাজ আর মাছের কাজ মিলিয়ে বাপ-ব্যাটায় যা রোজগার হয় সব মিলিয়ে টুকটাক করে চলে গেলেও দু-তিন মাস মতো খুব টানাটানি হয়ে যায়। সেই সময়টাতেই লোকের কাছে ধারদেনা করতে হয়। মাছের সিজনে বেরিয়ে আবার সেই ধারগুলো শোধ করি।
আমাদের স্বাস্থসাথী কার্ড হয়েছে। মাস দুয়েক আগে শুনলাম আমার নাকি বয়স্কভাতা এসেছে। ৬০ বছর বয়স হল তো। তবে শুনেছি খালি। এখনও খোঁজ নেওয়া হয়নি। সংসারের খাওয়াখরচ বেড়েছে অনেক আগের চেয়ে। এইসবগুলো হলে তো একটু ভালই হয়। এমনিতে এখন সরকারের থেকে যা পাই তার মধ্যে খাদ্যসুরক্ষার চাল-ডালগুলোই সবচেয়ে উপকারে লাগে।
নাতি-নাতনি দুটো স্কুলে পড়ে। ওরা যদি ঠিকঠাক পড়াশোনা করে সুস্থ একটা জীবন কাটাতে পারছে দেখে যেতে পারি, তবে ভাল হয়।
ভোট তো দেব। তবে টিভিতে খবরে যা দেখি তাতে মনে হয় আমাদের এই দেশ বা রাজ্য যারা পরিচালনা করছে, তাতে অনেক খামতি থাকছে। কেমন একটা অরাজক অবস্থা চারদিকে। সেই হিসেবেই মনে হয় একটা পরিবর্তন হলে বোধহয় ভাল হয়।
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সিদ্ধার্থ বর্মন