সনাতন কোলে
চাষই আমাদের আয়, চাষই আমাদের ব্যয়। আমাদের যা রোজগার হয় সবই এই কৃষিকাজ থেকে। আবার মূল খরচটাও হয় কৃষিকাজেই। এবার এই আয়ের ব্যাপারটা অনিশ্চিত। আমাদের আয় হয় মূলত আলু আর তিল চাষ থেকে। কিন্তু এগুলোর দাম তো আমাদের হাতে থাকে না। ঝড়-বৃষ্টি হলে পুরো ফসলই মাটি। আলু বা তিলের দামের ওঠানামার ওপর আমাদের আয় কমে-বাড়ে। খরচের বেলা কিন্তু এরকম নয়। সার-কীটনাশক-ডিজেল-কেরোসিনের দাম শুধুই বাড়ে, কমে না
আমি কৃষিকাজ করি। তাই চাষবাস সম্পর্কে প্রথমে কিছু তথ্য দিই। কোটাক বা কে-২ একটা সার। আলুচাষে লাগে। তার দাম ছিল এক বস্তা ৭৮০ টাকা। এখন সেই সারের দাম ১৮০০ টাকা বস্তা। কীটনাশক লাগে একটা আমাদের— ক্লোরোপ্লাইরোফস। দু-বছর আগে সেটা কিনেছি ২০০ টাকায়। এখন তার দাম হয়েছে ৬০০ টাকা। যে-ওষুধটার দাম ছিল ৪০০ টাকা লিটার, তার দাম হয়েছে এখন ১০০০ টাকা লিটার। চাইলে এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। আরও বলি, আমাদের এখানে চাষে সাবমার্সিবল পাম্প লাগেই। আমাদের জেলা শুকনো জেলা। ফলে পাম্প ছাড়া শীতের ফসল চাষ করা যায় না। এবার এই পাম্পের জন্য ডিজেল, কেরোসিন লাগে। ডিজেলের দাম ছিল আগে ৬২ টাকা লিটার, সেটা এখন হয়েছে ৯০ টাকা লিটার। কেরোসিন ছিল ৩৯ টাকা লিটার, সেটা আজ হয়েছে ৭৯ টাকা লিটার।
এই হচ্ছে অবস্থা। এবার আমাদের মতো চাষিরা কীভাবে ভাল থাকবে বলুন!
কৃষকরা আন্দোলন করেছিলেন সরকারের কৃষিনীতির বিরুদ্ধে। এখনও করছেন। তাঁদের সেই আন্দোলন সম্পূর্ণ ন্যায্য। আমি নিজে কৃষক, আমিও চাই যাতে আমার ফসলটা আমি ন্যায্য দামে বিক্রি করতে পারি, চাষের এই অস্বাভাবিক খরচ যাতে কমে। কিন্তু কোনও সরকারই সাধারণ মানুষের কথা কিছু ভাবে বলে মনে হয় না।
চাষই আমাদের আয়, চাষই আমাদের ব্যয়। আমাদের যা রোজগার হয় সবই এই কৃষিকাজ থেকে। আবার মূল খরচটাও হয় কৃষিকাজেই। এবার এই আয়ের ব্যাপারটা অনিশ্চিত। আমরা ধান চাষ করি বছরের খোরাকিটার জন্য। ধান আমরা বিক্রি করি না। আমাদের আয় হয় আলু আর তিল চাষ থেকে। এবার এগুলোর দাম তো আমাদের হাতে থাকে না। আলু বা তিলের দামের ওঠানামার ওপর আমাদের আয় কমে-বাড়ে। খরচের বেলা কিন্তু এরকম নয়। সার বা কীটনাশকের দাম শুধুই বাড়ে, কমে না।
আয় বাড়াকমার কথা বলতে গত বছরের কথাই একটু বলি। গত বছর নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে-বৃষ্টিটা হয়েছিল, তাতে আমাদের সবার মাঠের আলু সব ধুয়ে-মুছে-পচে একাকার হয়ে গেল। কিচ্ছু ঘরে তুলতে পারিনি। এবার আলুচাষে ধরুন বিঘায় প্রায় ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হয়। সেই নিয়ে এসডি অফিস, বিডি অফিস, এগ্রিকালচার অফিস— সব জায়গায় গেলাম সবাই মিলে, কোনও সদুত্তর নেই। এক পয়সাও ক্ষতিপূরণ পাওয়া গেল না সরকারের থেকে।
আমি বাঁকুড়া জেলার কোতুলপুরের গোবিন্দপুর গ্রামের বাসিন্দা। আমাদের পোস্ট অফিস কঙ্কাবতী। আমার পরিবারে সদস্য-সংখ্যা চার। আমাকে বাদ দিয়ে আমার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী এবং মেয়ে। মেয়েটা বড় হয়েছে। ওকে নার্সিং পড়াচ্ছি। করবে হয়তো একটা কিছু চাকরিবাকরি। আমার স্ত্রী বাড়ির কাজই করে। আলাদা কোনও রোজগার করে না। সেটাই বলছিলাম, আমাদের যা রোজগার সবটাই এই কৃষিকাজ থেকে।
সেই রোজগারটা— বুঝতেই পারছেন, আমাদের তো ওরকম মাস-মাইনে বা মাসিক রোজগার হয় না— যা রোজগার হয়, ওই এককালীন, ফসল উঠলে। তা সেটাকে যদি মাস হিসেবে ভাগ করা যায়, তাহলে ওই গড়ে ১০০০০ টাকা মতো হয়। যেহেতু আমাদের রোজগারটা এরকম এককালীন, তাই চাষের সময় তো ধার করতেই হয়। এত খরচের চাষ না হলে করব কী করে? আমাদের তো আর জমানো টাকা নেই।
আমি সরকারের থেকে কৃষিঋণ নিই। গত বছরও নিয়েছি ৭০০০০ টাকা। চুক্তিটা হল এক বছরের মধ্যে শোধ করতে পারলে ৪ শতাংশ হারে সুদ দিতে হবে। কিন্তু ইন্সিওরেন্সের টাকাও কাটে। ফলে ওটা ওই ৭ শতাংশ হয়ে যায়। আর বছর যদি পেরিয়ে যায়, তাহলেই ১১ শতাংশ হারে সুদ দিতে হয়। এই যে আগের বছর ফসল নষ্ট হল, আমাদের তো মাথায় হাত পড়ে গেছে।
ইন্সিওরেন্সের কথায় আনন্দ পাবেন না। আমাদের কৃষিক্ষেত্রে ব্যক্তিগত ইন্সিওরেন্স হয় না, হয় মৌজাগত। টাকাটা কিন্তু নেওয়া হয় ব্যক্তিগতভাবেই। এবার ফসল নষ্ট হলে সরকার যদি হিসেবনিকেশ করে দেখে গোটা মৌজায় কত ফসল নষ্ট হয়েছে, দেখে যদি ঘোষণা করে, তবেই আপনি ইন্সিওরেন্সের টাকা পাবেন, নয়তো নয়। আমরা পাইনি আগের বছর।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
আর শুধু চাষেরই খরচ বাড়ছে তাই বা বলি কী করে? সব কিছুর দামই বাড়ছে। বললাম, আমার বৃদ্ধা মা আছেন বাড়িতে। মার নিয়মিত ওষুধ লাগে। সেটা আগে মাসে ১২০০ টাকায় হয়ে যেত। এখন দেড় হাজারের ওপর লাগে। বৌ-মায়ের কাপড় আগে কিনতাম ৩০০ টাকায়। এখন মিনিমাম ৫০০ টাকা লাগে।
ভোট চলছে, দেব। আগে রাগে দু-একবার ভোট দিইনি। তবে এ তো নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার। তাই প্রয়োগ করি সাধারণত। আর আমি ভোট না দিলে গ্রামের অন্য লোক ভোট দিয়ে দেবে। কিন্তু আমি কোনও কিছু পাওয়ার জন্য ভোট দিই না। কোনও কিছু পাব সে প্রত্যাশাও করি না। কারণ, ছোটবেলা থেকে শুধু প্রতিশ্রুতিই শুনেছি। কোনও কিছুই পূরণ হতে দেখিনি। ফলে এখন আর কিছু আশাও করি না।
বলুন তো, কথায় কাজে কারও মিল আছে? আমাদের জনধন অ্যাকাউন্ট হয়নি। শুনেছিলাম সেই অ্যাকাউন্ট হবে, আর তাতে ১৫ লাখ টাকাও আসবে! বছরে ২ কোটি বেকারের চাকরি হয়নি। এবার তৃণমূলের প্রার্থী এসেছিলেন ভোট চাইতে। তাঁকে বললাম, আপনি তো আগের ভোটে বিজেপির জন্য ভোট চাইলেন। এখন তৃণমূলের জন্য! আপনাকে সত্যি ভরসা করা যায়?
দেখুন, আমি চাষ করে খেলেও লেখাপড়া শিখেছি। দেশের খবর রাখি, বুঝি। দেশে বেকার সমস্যা হু হু করে বাড়ছে। কলকারখানা নেই, চাষের উন্নতি নেই। ভাল লাগার মতো কিছুই দেখতে পাই না।
আমাদের এখানে পানীয় জলের সমস্যা আছে। রাস্তার সমস্যা আছে। এছাড়া চাষের খরচ বাড়ার কথা তো বললাম। কিন্তু কিছু হবে সে-সবের? আমি ভরসা পাই না।
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষে সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেবাশিস মিথিয়া