শম্ভুনাথ চক্রবর্তী
যে-কোনও কিছু করতে বা করাতে গেলেই টাকা দিতে হয়— আমার মতো গরিব মানুষেরও পঁচিশ হাজার টাকা ঘুষ দিতে চলে গেল। আমি যদি থানায় জানাতাম, আমাকে কাজ ফেলে কলকাতা ছোটাছুটি করতে হত, বারবার ডাকত, হয়রান করত, আমার প্রতিদিনের যে রোজগার তাও বন্ধ হয়ে যেত। আমার সামান্য কাজ, তাও যদি বন্ধ হয়ে যায়, আমাকে তো কেউ এক পয়সা দেবে না। তাই ভয়ে পুলিশকে কিছু জানাইনি, পুলিশ আমার সমস্যার প্রতিকার করার চেয়ে উলটে আমাকেই হয়রান করবে
আমার বড় মেয়ে কলেজে পড়া শেষ করেছে। ছোট মেয়ে স্কুলে পড়ে। বড় মেয়েকে নার্সিং ট্রেনিং করিয়েছি। এখনও চাকরি পায়নি। ও একবার কলকাতার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিল, একজন মধ্যস্থতাকারী আমাকে ওই নার্সিংহোমের এইচআর বলে নিজের পরিচয় দিল। চাকরির জন্য নগদ ২৫ হাজার টাকা চাইল। গ্রামের মানুষ সরল বিশ্বাসে টাকাটা দিয়ে দিলাম, আজও চাকরি হয়নি, এবং টাকাটিও ফেরত পাইনি। এখন তো, টিভিতে তো দেখি, যে-কোনও কিছু করতে বা করাতে গেলেই টাকা দিতে হয়— আমার মতো গরিব মানুষেরও পঁচিশ হাজার টাকা ঘুষ দিতে চলে গেল। এখন আমি যদি পুলিশ বা থানায় জানাতে যেতাম, আমাকে কাজ ফেলে কলকাতা ছোটাছুটি করতে হত, আমাকে বারবার ডাকত…. হয়রান করত, আমার প্রতিদিনের যে রোজগার তাও বন্ধ হয়ে যেত। আমার সামান্য কাজ, তাও যদি বন্ধ হয়ে যায়, আমাকে তো কেউ এক পয়সা দেবে না। তাই ভয়ে পুলিশকে কিছু জানাইনি, পুলিশ আমার সমস্যার প্রতিকার করার চেয়ে উলটে আমাকেই হয়রান করবে।
লোভে পড়ে ভুল করেছি। এভাবে নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে সৎ পথে চাকরি পাক, সেই ব্যবস্থা চাইছি। দুই মেয়েই যদি স্বাবলম্বী হতে পারে খুব ভাল হয়।
আমি পেশায় পুরোহিত। গ্রামের গেরস্থ বাড়ি বাড়ি পূজার্চনা করি, বিয়ে দিই, শ্রাদ্ধ-শান্তি করাই। নিবাস শ্রীপুর গ্রাম (কামারপুকুর), থানা গোঘাট, হুগলি জেলা। বাড়িতে দুই মেয়ে ও স্ত্রী বর্তমান। গ্রামে এর-ওর বাড়ি কিছু না কিছু পূজা, মঙ্গল অনুষ্ঠান লেগেই থাকে, ফলে কমবেশি সারা বছরই কাজ পাই। আমার মাসিক আয় আট থেকে দশ হাজার টাকা, স্ত্রীর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ছাড়া আর কোনও আয় নেই। আপাতত আমার পরিবারে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুবিধা ছাড়াও জনধন অ্যাকাউন্ট, রেশন কার্ড, স্বাস্থ্যসাথী কার্ড আছে। মাসের খরচ চালাতে কখনও-সখনও ধার করতে হয়। খুব বেশি নয়।
যজমানবাড়ি এবং বাড়ি-বাড়ি পূজা করে যে চাল-ডাল পাই তাতে সংসার চলে যায়। একটা সুবিধে যে এই জীবিকায় এখন আর বেশি কেউ আসছে না। ফলত, প্রতিযোগিতা কম। কোনও বাড়িতে পুজো করতে গেলে, বিশেষ করে দুর্গাপুজোয়, অথবা কারও বাড়িতে শ্রাদ্ধশান্তির কাজ পেলে এবং বিয়ে দিলে কিছুটা নগদ টাকা মানুষ দেন। আয় আগের চেয়ে কিছুটা বাড়ায় পরিস্থিতি একটু ভাল হয়েছে নিঃসন্দেহে। এছাড়া আমি একটি মন্দিরে নিত্যপূজার কাজ করি সেখানে প্রতিদিন পাঁচশোর মতো চাল, আলু ও কিছু নগদ দক্ষিণা পাই। রেশনের কিছুটা চালও পাই প্রতি সপ্তাহে। তাতে মোটামুটি আমাদের পরিবারের সকলের খোরাকির চালটুকু জোগাড় হয়ে যায়। তবে মেয়েদের পড়াশোনার খরচ, ঔষধপত্রের খরচ, স্টেশনারি ও মুদিখানার দোকানে সব জিনিসেরই দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। ছোট মেয়েকে যে প্রাইভেট টিউশন পড়াই, তার মাইনে হঠাৎ করে অনেকটা বেড়ে গেছে।
পড়ুন, ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০২৪
দেশের অবস্থা তো নিজের অভিজ্ঞতাতেই বললাম। তবে সরকার বদল হলেও এই অবস্থার তেমন কোনও পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না। কোথাও কোনও সমস্যা হলে তার প্রতিকারের কোনও পথ নেই। আমার অভিজ্ঞতা, কোনও জায়গাতে কোনও কিছু জানিয়েই প্রতিকার হয় না। অনেক তো বয়স হল, দেখছি নির্বাচনের আগে এক-একজন একেক রকম প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু ভোট শেষ হলেই যে কে সেই। একই ব্যাপার! এটুকু বুঝে নিয়েছি আমাদের চিরদিন খাটতে হবে। খেটে খেতে হবে। নেতাদের অবশ্য অন্য বিষয়। আমাদেরই গ্রামের এক-দুজনের কিছুই ছিল না, আজ গাড়ি-বাড়ি, হাতে দামি মোবাইল ফোন, গলায় সোনার চেন। এসব দেখে আর অবাক হই না। জানি ভোট দিয়ে যেই আসুক, কোনও কিছুরই সুরাহা হবে না, তবুও ভোট একটা গণতান্ত্রিক অধিকার, সেটা প্রয়োগ করা দরকার। সেই ভেবেই ভোট দিতে যাব।
*সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পক্ষে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন কাশীনাথ নন্দী