দশের কথা, দেশের স্বর— অষ্টম বর্ষ, প্রথম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

…কেমন আছেন ভারতবর্ষের এইসব নামহীন শ্রমজীবী মানুষজন? জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা জানতে চেয়েছি এই সোজাসাপটা বুনিয়াদি প্রশ্নের উত্তর, চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের মে ২০২৪ সংখ্যায়। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার উদযাপনের ঐতিহাসিক মে দিবস থেকে শুরু হয়েছে যে মাস, যে-মাস জুড়ে চলছে জনাদেশ নেওয়ার প্রক্রিয়া, সেই মাসে মাটির কাছাকাছি কান পেতে আমরা শুনতে চাইছি আমাদের সহনাগরিক, প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের কণ্ঠস্বর। … মে সংখ্যায় আমাদের প্রচ্ছদ ভাবনার শিরোনাম— দশের কথা দেশের স্বর।…

 

এই লেখার প্রথম শব্দটি তখনও টাইপ করা হয়নি, মৃদু ধরতাইয়ের খোঁজ চলছিল, এমন সময় চোখ গেল একটি কাঠবেড়ালির দিকে। অযোধ্যায় নবনির্মিত স্টেশন কমপ্লেক্সে বসানো হয়েছে কাঠবেড়ালির সুবিশাল ভাস্কর্য। পাঠক নিশ্চয়ই জানবেন কাঠবেড়ালির রামায়ণী অনুষঙ্গের কথা। শ্রীরামচন্দ্রের লঙ্কা অভিযানে সেতু নির্মাণের সময় বানরসেনার সঙ্গে সমুদ্রে পাথর ফেলার কাজে হাত লাগিয়েছিল সামান্য এক কাঠবেড়ালিও, ছোট্ট মুঠিতে করে নুড়ি বয়ে এনে সে-ও ফেলছিল সাগরের জলে। যতই সামান্য হোক এই শ্রমদান, রামের চোখ এড়ায়নি কাঠবেড়ালির একনিষ্ঠ ভক্তি ও উদ্যোগ, তিনি কাঠবেড়ালিকে কোলে তুলে নিয়ে হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন তার গায়ে, সেই স্নেহস্পর্শ কাঠবেড়ালির শরীরের ডোরাকাটা দাগ আজও ধারণ করে আছে। অযোধ্যা স্টেশনে কাঠবেড়ালির ভাস্কর্যের স্থাপনা নিঃসন্দেহে প্রতীকী, সামান্য ও অপরকেও যে যথাযোগ্য সম্মান দিতে হয়, এই ১৫ ফুটের কাঠবেড়ালি যেন তার উদার ঘোষণা। দেশনির্মাণে ভারতীয় রেলের যোগদান যেন এমনই মুষ্টি মুষ্টি শ্রমের যোগফল, ভাস্করের কল্পনা অযোধ্যার আবহে এই কথাটুকু অত্যন্ত শৈল্পিক ভঙ্গিতে পেশ করল। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, অযোধ্যাধাম স্টেশনের বাইরে, বর্তমান ভারতবর্ষে বাস্তব পরিস্থিতি এমন শৈল্পিক ও উদার নয় মোটেই।

ভেবে দেখতে গেলে, এই ভারতবর্ষ-ও প্রকৃত প্রস্তাবে, অগণিত কাঠবেড়ালির নির্মাণ। লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী মানুষ শত সহস্র নিযুত শতাব্দী ধরে নিজেদের শ্রমে তিলে তিলে গড়ে তুলেছে আমাদের দেশ। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে শহরে রাস্তায় বন্দরে ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে শ্রমজীবী মানুষের ঢল, তারা ছড়িয়ে পড়ছে রেলওয়ে স্টেশনে, পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের বাড়িতে, অ্যাপার্টমেন্টে, শপিং মলে। এমনকি সূর্যাস্তেও শেষ হচ্ছে না তাঁদের কাজ, প্রতিদিন এমনই এক বিপুল শ্রম ও সেবার ওপর দাঁড়িয়ে আছে আমাদের দেশ, গোটা বিশ্ব। নামহীন এই কাঠবেড়ালির দলই ভারতবর্ষের চালিকাশক্তি। এরাই আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ, উদয়াস্ত খেটে যাওয়া ও খেটে খাওয়া নামহীন বৈচিত্র্যহীন জনসমষ্টি— আম আদমি।

কেমন আছেন ভারতবর্ষের এইসব নামহীন শ্রমজীবী মানুষজন? জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে আমরা জানতে চেয়েছি এই সোজাসাপটা বুনিয়াদি প্রশ্নের উত্তর, চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের মে ২০২৪ সংখ্যায়। শ্রমজীবী মানুষের অধিকার উদযাপনের ঐতিহাসিক মে দিবস থেকে শুরু হয়েছে যে মাস, যে-মাস জুড়ে চলছে জনাদেশ নেওয়ার প্রক্রিয়া, সেই মাসে মাটির কাছাকাছি কান পেতে আমরা শুনতে চাইছি আমাদের সহনাগরিক, প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষের কণ্ঠস্বর। কেমন আছেন তাঁদের পরিজন? জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তাঁরা মূলত কী কী অসুবিধে ভোগ করছেন? আগের চেয়ে কি তাঁদের অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য বেড়েছে? কোনও সরকারি প্রকল্প কি সামান্য হলেও আর্থিক সুরক্ষা দিয়েছে তাঁদের? রাষ্ট্রের কাছ থেকে ঠিক কী আশা করেন তাঁরা? তাঁদের আগামী প্রজন্মকে নিয়ে তাঁদের শঙ্কা-চিন্তা-আশা-আকাঙ্খাই বা কী? তাঁরা কি নিয়মিত খবর দেখার, শোনার, বা পড়ার সময় পান? দেশের পরিস্থিতি নিয়ে নিয়মিত খবরাখবর রাখেন? ভোট দেন? তাঁরা কি আদৌ বিশ্বাস করেন যে দেশের সরকার বদল হলে তাঁদের জন্য ভাল কিছু হবে? এমনই নানা প্রশ্ন নিয়ে আমাদের প্রতিনিধিরা পৌঁছে গেছেন শহরে, গ্রামে, জেলায়, দূরে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রসঙ্গত, ভিনরাজ্যের একাধিক মানুষের কথা আমাদের সাক্ষাৎকার-ভাণ্ডারে উঠে এলেও, সংখ্যাটি প্রকাশের সময় আমরা সীমাবদ্ধ রইলাম শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই। এছাড়াও, প্রশ্নগুলি করার সময় অত্যন্ত সচেতনভাবে লক্ষ রেখেছি, আমাদের নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত বা ঝোঁক যেন তাঁদের উত্তরদানের প্রক্রিয়াকে ব্যাহত না করে। আমাদের সীমিত ক্ষমতায় যতটা বেশি সম্ভব মানুষের কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করেছি আমরা, যদিও সংখ্যাটা অতি নগণ্য, কাঠবেড়ালির নুড়ি-প্রতিম, হিসেবে আসে না। অতএব সংখ্যার বিচারে কোনওরকম প্রতিনিধিত্বের দাবি করি না আমরা। তবুও সাক্ষাৎকারগুলিতে নির্ভুল শোনা যাবে শ্রমজীবী মানুষের গলার স্বর। অনেকগুলি কথোপকথনের মধ্যে থেকে কিছু সুনির্বাচিত সাক্ষাৎকার অনুলিখন করে প্রকাশ করলাম আমরা। মে সংখ্যায় আমাদের প্রচ্ছদ ভাবনার শিরোনাম— দশের কথা দেশের স্বর।

কী বললেন তাঁরা? সাধারণ মানুষের কথাবার্তা থেকে উঠে এল কি কোনও কেন্দ্রীয় অভিজ্ঞতার সুর? পাঠক, জানি সেসব নিজেই পড়ে নেবেন একটু কষ্ট করে। শুধু অল্প দু-কথায় সেরে নিই আমাদের নিজস্ব পাঠ।

 

এক, ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির সুপার হাইওয়ে ধরে ইন্ডিয়া দৌড় শুরু করলেও, ভারতের এই অমৃতকালেও সাধারণ মানুষ বুনিয়াদি সমস্যায় জর্জরিত৷ প্রতিদিন রতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় পরেরদিন জীবনধারণের দুশ্চিন্তা তাঁদের মাথায় ভর করে থাকে। খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক ন্যায়— কোনও ক্ষেত্রেই প্রান্তিক শ্রমজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষের সম্মানজনক জীবনযাপনের ন্যূনতম মানদণ্ড ছুঁতে পারছি না আমরা। তথ্য-ভারাক্রান্ত করতে চাইছি না এই লেখাটিকে, কিন্তু আমরা জানি স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষে বেকারত্বের হার বর্তমানে সর্বোচ্চ স্তরে ঘোরাফেরা করছে, ক্ষুধা ও অপুষ্টি ক্রমশ তীব্রতম থাবা বসাচ্ছে দেশে, আর ঠিক এই সময়ে দেশের সম্পদের সিংহভাগ ঘনীভূত হচ্ছে দেশের ধনীতম অতি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর হাতে, যারা সর্ব অর্থে ভারতরাষ্ট্রে শাসকদের শ্রেণিসহোদর। রাষ্ট্র শ্রমজীবী মানুষদের কাজে লাগায় বটে, কিন্তু কাজ ফুরোলে তাঁদের কথা ভুলে যেতে সময় লাগে না। তাই বিপুল সংখ্যক অভিবাসী শ্রমিকদের কী হবে তা না ভেবেই দেশের প্রধানমন্ত্রী একদিনের নোটিসে লকডাউন ঘোষণা করে দিতে পারেন। কোভিডকালে পুঁজিপতিদের বিপুল পরিমাণ অনাদায়ী ঋণ মকুব হয়ে যায় অথচ সর্বস্বান্ত শ্রমিকদের ঘরে ফেরবার ট্রেনভাড়া কড়ায়-গণ্ডায় উসুল করা হয়। রেললাইনে আর আমাদের অসহায় বিবেকের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে মৃত শ্রমিকদের পুঁটলি থেকে খুলে পড়া কয়েকটি শুকনো রুটি। আমরা কোনওদিন যেন না ভুলি, এই রাষ্ট্রের হাতে শত শত জামলো মকদমের খুনের রক্ত লেগে আছে৷ অবশ্য এমনটাই হওয়ার ছিল, পুঁজির বাঘে একবার সওয়ার হলে রাষ্ট্র ইচ্ছা করলেও তার কল্যাণকামী সমাজবাদী চরিত্র বজায় রাখতে পারবে না, এটা জানা কথাই। শাসক ও শাসিতের মধ্যেকার দূরত্ব ক্রমশ বেড়ে চলা ছাড়া আর কোনও ভবিষ্যৎ নেই এই অসম বাস্তুতন্ত্রের।

দুই, দেখা যাচ্ছে, আঞ্চলিক স্তরে রাজ্য সরকারগুলি কিছু সুরাহার ব্যবস্থা করেছেন, মানুষের হাতে বিশেষত মেয়েদের হাতে কিছু নগদ অর্থ তুলে দিয়ে। উদাহরণ— পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চালু করা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও কন্যাশ্রী প্রকল্প। একে ডোল রাজনীতি বলে অবজ্ঞা ও সমালোচনা করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাড়ির মেয়েদের-মায়েদের হাতে সরাসরি অর্থ তুলে দেওয়া আন্তর্জাতিক সমাজমুখী অর্থনীতির একটি মান্য মডেল এবং নারীর ক্ষমতায়নের পক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। যদিও এই প্রকল্পগুলি সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শাসকদলের দিশাহীন রাজনীতি, নীতিহীনতা ও আপাদমস্তক দুর্নীতিকে মেনে নেওয়ার ও মানিয়ে নেওয়ার পক্ষে কোনও অজুহাত হতে পারে না।

তিন, খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের পরিসরে ধর্ম কোনও বিষয়ই নয়। উদয়াস্ত নিজেদের গ্রাসাচ্ছাদনের বন্দোবস্ত করতে ও পরিবার-পরিজনকে সামান্য সচ্ছল জীবন দেওয়ার চেষ্টায় তাঁরা এতখানি ব্যস্ত, যে ধর্ম ও তার রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময়, ইচ্ছে ও প্রয়োজন কোনওটাই তাঁদের নেই। ভারতের রাজনীতিতে ধর্মপরিচয়ভিত্তিক সঙ্কীর্ণ মতাদর্শের অনুপ্রবেশ ভোটব্যাঙ্ক-বিভাজন ও মেরুকরণের উদ্দেশ্যে এক সচেতন নির্মাণ। মানুষের বুনিয়াদি সমস্যাগুলির সুষম ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান রাষ্ট্রের পক্ষে করা আর সম্ভব নয়, কারণ তা করলে তার দোসর পুঁজির স্বার্থ ক্ষুণ্ণ হবে। ধর্ম-জিগির এবং তার ওপর ভিত্তি করে রাজনৈতিক-সামাজিক- সাংস্কৃতিক আধিপত্যকামী রাজনীতি আসলে মানুষকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে অন্যত্র ব্যস্ত রাখার ছল। প্রান্তিক ও নিম্নবিত্ত মানুষের কথাবার্তা থেকে স্পষ্ট যে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি তাঁদের মনোজগতে বলার মতো কোনও ছাপ ফেলেনি। মন্দির-মসজিদ কোনও কিছু নিয়েই তাঁরা চিন্তিত নন। শ্রমজীবী মানুষের এই নীরব উপেক্ষা নিঃসন্দেহে আশা জাগায়।

কাঠবেড়ালির শ্রমে ক্রমশ গড়ে উঠছে বড়লোকের দেশ, অথচ সেই দেশে কাঠবেড়ালির কোনও অংশীদারিত্ব নেই, তাঁদের সম্মান নেই, তাঁদের উন্নতির জন্য রাষ্ট্রের কোনও সামগ্রিক মঙ্গলচিন্তা নেই। অযোধ্যা স্টেশনের কাঠবেড়ালির স্ট্যাচুর ভাস্কর্য-ভাবনার মধ্যে যে তথাকথিত ঔদার্য, তা দেশের সাধারণ শ্রমজীবী জনগণের প্রেক্ষিতে এক জান্তব প্রহসন, এক চূড়ান্ত অ্যান্টিথিসিস। হ্যাঁ, শ্রমজীবী মানুষের গায়েও কাঠবেড়ালির মতো ডোরাকাটা দাগ আছে, তবে তা কোনও কল্যাণকরস্পর্শ নয়, সে দাগ দারিদ্রের, অশিক্ষার, ভেঙে পড়া জনস্বাস্থ্য পরিকাঠামোর, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের। সে-দাগ পরিচয়-রাজনীতির ওপর ভর করে দাঁড়ানো বৈষম্য-সৃষ্টিকারী রাষ্ট্রের মারের দাগ। দশের কথা দেশের স্বর-এর সাক্ষাৎকারগুলি মন দিয়ে পড়লে নিবিড় পাঠক নিশ্চয়ই সেই মারের দাগগুলি দেখতে পাবেন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...