প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
বনির বুক কাঁপছিল। জীবনে প্রথম এই ঘটনা ঘটাতে চলেছে। ওর বন্ধুদের কারও কারও রীতিমতো গার্লফ্রেন্ড, প্রায়-গার্লফ্রেন্ড আছে। কিন্তু সে জীবনে প্রথম এমন কিছু ঘটাচ্ছে। যদিও তার শরীরী অনুভূতি আগে ঘটে গেছে।
সেই ক্লাস নাইনে। অখিলস্যরের কোচিংয়ে। ও আর কৌশিক ছাড়া কেউ ছিল না সেদিন ক্লাসে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। অখিলস্যর তার মধ্যেই কী একটা কাজে বেরোলেন। কৌশিক, আচমকাই, ওকে স্পর্শ করেছিল। বনি একধাক্কায় ওকে সরিয়ে দিয়েছিল। তারপর কী হল, একদম চুপ করে গেল দুজনেই। কৌশিক আবার ওর প্যান্টের ওপর হাত রাখল। বনি আর সরায়নি। কৌশিক, ওর ঘাড়ে, চুমু খেল। আচম্বিত। বনির শরীরে আশ্চর্য এক বিদ্যুৎ খেলে যাচ্ছিল। কৌশিক বনির হাতটা তুলে নিয়ে ওর প্যান্টের ওপর বসায়। তারপর ওরা চুমু খায় পরস্পরকে।
এই ঘটনা একবার নয়, তিন-চারবার ঘটেছিল। বনির ভাল লাগত। তারপর আর লাগল না। শুধু তাই নয়, তুমুল, তুঙ্গ অপরাধবোধ হল। ছেলের সঙ্গে ছেলের এমনটা হয় না কি? তখনও বনি কাউকে বলে উঠতে পারেনি সে-কথা। খালি ভেবে গেছে এটা অন্যায়, এটা হয় না। তখনও এমনটাই ভাবা স্বাভাবিক ছিল আসলে।
বনি নিজের শরীর নিয়ে কুঁকড়ে গেল আরও। একলষেঁড়ে হয়ে গেল। কেউ ওকে জিজ্ঞেস করেনি কিছু। ও কাউকে বললে কেউ কি ওকে সাহস জোগাবে? বলবে, এই নিয়ে আসলে ভাবার কিচ্ছু নেই। এমনটা হতেই পারে। বরং সবাই ওকে নোংরা বলবে। ওকে কিছুতেই সমর্থন করবে না কেউ।
ও কি কৌশিকের বয়ফ্রেন্ড? কৌশিক আর ও প্রেম করত না কি? না তো! কৌশিকেরও নাকি কোন একটা মেয়েকে ভাল লাগে। তবে বাকিরা মেয়েদের নিয়ে যেভাবে, যতটা কান গরম করা কথা বলে, ও তা আদৌ বলে না। ও কেবল বলে, ভাল লাগে।
বনি আজ যেন অনেকটা হালকা। আজ, ও ওর বাকি বন্ধুদের মতোই। ওকে আর কেউ অস্বাভাবিক বলবে না।
কিন্তু কেউ ওকে বলে দিল না, ও যা করেছে, তা আসলেই স্বাভাবিক।
বাবলি, মানে দেবদত্তার সঙ্গে আজকের দেখাটা কেমন হবে, তা ও জানে না। এটা ঠিক ওরকম দেখা করা নয়, যেমনটা ওর বন্ধুরা করে, আর ও অবাক হয়ে শোনে।
বাবলির সঙ্গে দেখা হয়েছিল বনির কাল। চাঁদনি রাতে। ছোটখাটো হলেও অ্যাকসিডেন্ট তো! ক্লান্তি ভর করারই কথা ছিল বনির। কিন্তু বনি জানে, কেন ওর ঘুম আসেনি সারারাত। বনি জানে, আধোরাত অবধি ওর ঘুম না আসার কারণ আলাদা, বাকি রাতটা ঘুম না আসার কারণ একেবারেই আলাদা। বনি ছাদে উঠে এসেছিল, কারণ ওর বারবার মনে হচ্ছিল, সেদিন বিকেলের ওই আশ্চর্য ঘটনার পরে যেসব প্রশ্ন জেগেছিল, তার উত্তর ওকে খুঁজে বের করতে হবে। ওর কথা কি কেউ বিশ্বাস করবে?
কিন্তু চাঁদনি রাতে বাবলিকে ওভাবে জলছাদ থেকে উড়ে নামতে দেখে বনি বিশ্বাস করেছিল, বলা গেলে ওকেই বলা যাবে।
চাপা গলায় বনি বাবলিকে বলেছিল, এপাশের ছাদ থেকে, কার্নিশে ঝুঁকে পড়ে।
—কাল দেখা করবে, একবার?
এমন অতর্কিত প্রস্তাব একটা মেয়েকে দেবে বনি, কোনওদিন ভাবেনি। কিন্তু দিয়ে ফেলল।
বাবলি সরাসরি ‘না’ বলতে পারত অন্য কোনও সময়, কথার উত্তর না দিয়ে সোজা ছাদ থেকে নেমে আসতে পারত। কিন্তু বনির তার ঠিক আগে বলা কথাগুলো ওকে ভাবিয়ে তুলেছিল।
—কথা আছে তোমার সঙ্গে, তুমিই কেবল বুঝবে।
প্রথমেই এমনটা শুনে অবাক হয়েছিল বাবলি। কেন বাবলিই কেবল বুঝবে? কেন আর কেউ-ই বুঝবে না?
ওর মনে হয়েছিল, নিজেকে নিয়ে যে বিস্ময় ওর জাগছে হঠাৎই, তাও ও কেবল বনিকেই বলতে পারবে।
—কী করে লাফালে ওভাবে? মনে হল পালকের মতো! উড়ে নামলে।
বাবলি চুপ। এখনও।
—আগেও পারতে এরকম?
বাবলি তাকাল বনির দিকে। মাথা নাড়ল।
—আমার সঙ্গেও অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। কিছু তো একটা হচ্ছে বটেই।
রাতের ফিসফিসানি চিৎকারের চেয়ে বেশি পৌঁছে যায় ঘুমন্ত মানুষের কানে।
আলো জ্বলে উঠল বাবলিদের বাড়ির নিচে। সঙ্গে একটা গলা খাঁকরানি। স্যান্ডো গেঞ্জি পরা লোকটা জানলার সামনে এসে কুঁজো থেকে জল ঢালল। তারপর ঢকঢক করে গিলল জলটা। একবার উঁকি মারল জানলার বাইরে। নিচে, তারপর ওপরে। বনিদের ছাদের দিকে।
ছাদ ফাঁকা।
বাবলিও ততক্ষণে পা টিপে টিপে নেমে এসেছে নিচে।
আজ সকালে ওরা কোথায় দেখা করবে, ঠিক ছিল না। কখন দেখা করবে, তাও ঠিক ছিল না।
শেষরাতে ঘুমিয়েও ঘুমটা ভাঙল একেবারেই সকাল-সকাল। উত্তেজনায় ঘুম সহজে আসতে চায় না। বনি জানে, আজ বাবলির সঙ্গে দেখা হওয়ার পরেও সহজে ঘুম আসতে চাইবে না।
বনি চোখ কচলাতে কচলাতে যখন ছাদে এল, তখন শুধু ও দেখতে চাইছিল, কালকের রাতটা সত্যি ছিল, না ওর কল্পনা।
মার্চ মাসের সকাল, কিন্তু বসন্তের নামগন্ধ নেই। বরং স্যাঁতস্যাঁতে বর্ষার আবহ। শেষরাতে বেশ কিছুটা বৃষ্টি পড়েছিল। ছাদ শ্যাওলাভরা, ভিজে। তার মধ্যেই পড়েছিল চিরকুটটা। ওপাশের ছাদ থেকে ছুড়ে ফেলা। ছাদে পড়ে ভিজে গিয়েছিল ওই একপশলা বৃষ্টিতে।
নীল কালি ধেবড়ে গিয়েছিল। যেটুকু পড়া যাচ্ছিল, তাতে লেখা—
“বিকেল পাঁচটায় গীতিকার সামনে…”
গীতিকা বোসপাড়ার ভেতরের নতুন ফ্ল্যাটটার নাম।
হাতের লেখাটা দেবদত্তারই তো?
অত ভেবে লাভ নেই। বিকেলে ওদিকটায় গেলেই হল। কিন্তু বাড়ি থেকে ছাড়বে তো? কালই ওরম একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে!
একমাত্র উপায় বাপ্পার সঙ্গ নেওয়া, সেটা হলে আবার বাপ্পাকে পুরোটা বলতে হয়।
কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেল বনি।
সাহেব ওরফে সপ্তর্ষি মেট্রো স্টেশন থেকে নেমে প্রথমে কিছুক্ষণ থই পেল না, কোথায় এসেছে। একা একা উত্তর কলকাতা ছেড়ে বেরোনো ওর আগে হয়ে ওঠেনি। এই প্রথমবারের জন্য ও এভাবে দক্ষিণ কলকাতার একটা মেট্রো স্টেশনে নেমে অকুল পাথারে পড়ল।
রোহিতাশ্ব বাইক নিয়ে আসবে বলেছিল। ও নিজেই সেই প্রস্তাবটা খারিজ করল। কাল ওর বাইকে ওরকম বেয়াড়া একটা ঘটনা ঘটায়, আজ আর ওই বাইকে সওয়ার হতে চাইছিল না সাহেব। তাই বলেছিল নিজেই পৌঁছে যাবে।
কালকের দিনটা এখনও হজম হচ্ছে না সাহেবের। ওভাবে ডার্ট ছুড়ে খুনের চেষ্টা কে করল? কারাই বা ওদের নজর রাখছিল? তার মধ্যে আচমকা বনির ব্যাপারটা… বাপ্পার যে এত কীসের রাগ ওর ওপর…
এইসব ভাবতে ভাবতে, দুবার অটোস্ট্যান্ড গুলিয়ে, অবশেষে একটা অটোতে সওয়ার হয়ে বসে সাহেব আবিষ্কার করল, মেট্রোর টিকিট কাটার পর ওর পকেটে আর একটিও পয়সা নেই!
মাথায় বাজ পড়ল ওর। ওদিকে অটো তখন চলছে। রোহিতাশ্বর নম্বর আছে, ওকে ফোন করে দিলে, অটোর স্টপেও যদি টাকাটা নিয়ে আসতে পারে!
এইসব সাত-পাঁচ ভেবে ফোনটা সবে বের করেছিল সাহেব।
অটোর সামনের সিটে বসেছিল সাহেব। একটু বাইরের দিকেই বেরিয়েছিল শরীরটা।
আচমকাই ঘটনাটা ঘটল।
একটা বাইক এসে গেল অটোর ঠিক পাশে। মুখে রুমাল বাঁধা দুজন বসে সেই বাইকে।
পেছনে তুমুল চিৎকার! সাহেব বিস্ময়ে বাইকের দুজনকে দেখতে গিয়েই খেয়াল করল, পেছনে দৌড়চ্ছে ট্রাফিক সার্জন-সহ একটা ভিড়। চিৎকার থেকে বুঝল, বাইকটা চুরি করে এরা পালাচ্ছে।
—দিনেদুপুরে শালা বাইক চুরি করে পালাচ্ছে!
পান-চেবানো গলায় লাল পিকে মোড়া উচ্চারণে মন্তব্যটা ছুড়ে দিল মধ্যবয়সি অটোচালক। বোঝা গেল না, পেছনের ওই ভিড়কে সাহায্য করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আছে কি না তার।
সাহেবেরও এই ঘটনাটার মধ্যে না জড়ালেই চলত। অটো বেরিয়ে যেত অটোর মতো। কিন্তু কোথা থেকে যে কী হয়ে গেল! কথা নেই বার্তা নেই, বাইকের সামনের লোকটা ওর কলার টেনে ধরল, ফলে অটো থেকে ওর শরীরটা বেশ কিছুটা বেরিয়ে এল। ওর ভয় পেয়ে যাওয়ার কারণ নেই, জিম করা চেহারা এমনিতেই। তাই ও-ও দুম করে লোকটাকে ধরে মারল একটা হ্যাঁচকা টান। লোকটা অটোর গা ঘেঁষেই পড়ল। যথারীতি বাইকটা হোঁচট খেল মাঝরাস্তায়। আরেকজন ছিটকে গেল ফুটপাথের ধারে।
অটো এবার থামল সজোরে ব্রেক কষে। সাহেব টাল সামলাতে না পেরে রাস্তায় পড়ল। মাথায় একটা হালকা ঘষটানি লাগল ওর। তার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কপালের একপাশে হাত দিয়ে ও বুঝল, চাপচাপ রক্ত জমা হচ্ছে সেখানে।
ভিড়টা ওর দিকেই ছুটে আসছে ক্রমশ। অটোওয়ালা চিৎকার করে চলেছে টানা। দুজন বাইকচোরও উঠে দাঁড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে এসেও পিছনের ভিড়ের কথা ভেবে পালানোর চেষ্টা করছে। ওর দৃষ্টি ক্রমে ঝাপসা হচ্ছে যেন!
এই অবস্থায় ওকে কেউ একটা ঘেঁটি ধরে টেনে তুলল! কে যে সে, তা দেখার আগেই ফ্যাসফ্যাসে একটা গলা ওর কানের সামনে ভেসে এল।
—থ্রো আউট দ্য ড্যাম রিং! আদারওয়াইজ ইউ ওন্ট সারভাইভ!
সাহেব ওই অবস্থাতেও চকিতে ফিরে তাকাল! ভিড়টা ততক্ষণে ওকে ঘিরে ফেলেছে। ওর আবছা দৃষ্টি যতদূর গেল, ও দেখল, একটা কালো ছায়ামূর্তি যেন দূরে চলে যাচ্ছে, যার অবয়বটাই কালো পোশাকে ঢাকা।
কে ও? আংটির কথা, ওটা যে এখন ওর কাছে, এইসবই ওই লোকটা জানে? বাইকের লোকগুলোই বা কে?
ভিড়টার কিছুটা অংশ ওকে ধরে ফেলল মাটিতে পড়ে যাওয়ার আগেই, বাকিটা ছুটল বাইকচোরদের পিছনে।
এরপর আর কিছুই মনে নেই ওর।
বাপ্পার সাহায্য নিয়েছে বটে বনি, তবে কোথায় যাবে কী করবে বিশদে বলতে হয়নি। এই যা বাঁচোয়া! বলেছে, বন্ধুর বাড়ি যাবে। ওকে গীতিকা-র সামনেই ছেড়ে গেছে বাপ্পা, এখানে সত্যিই বনির স্কুলের বন্ধুর বাড়ি। বাপ্পা বলেছে, আবার নিয়ে যাবে এসে।
বনি অপেক্ষা করতে লাগল। পাঁচটা বাজতে এখনও দশ মিনিট বাকি। দেরি করার ঝুঁকি ও নেয়নি কোনওভাবেই।
বনি একটু সাহস করেই বেরিয়ে এল গলির আরেকটু ভিতর দিকটাতে এল। এদিক দিয়েও তো আসতে পারে দেবদত্তা, ওরফে বাবলি।
এল যদিও পিছন থেকেই। ওর পিঠে টোকা দিয়ে ডাকল, ওই!
বনির সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল।
ওরা দুজনেই চুপ।
হঠাৎ একখানা পুলিশের গাড়ি এসে সশব্দে দাঁড়াল গলিটার ভেতরে।
একজন অফিসার নেমে একটা বাড়ির দরজা ঝাঁকিয়ে দিল সজোরে।
—কবিতা দে আছেন?
দরজা খুলল রিনি, ওরফে কবিতা দে।
—আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে থানায় যেতে হবে, একটা ব্যাড নিউজ আছে। টুপি খুলে বলল অফিসার।
[আবার আগামী সংখ্যায়]