পীযূষ দত্ত
পশ্চিমবঙ্গের সাংসদদের তালিকায় একজনও বামপন্থী না থাকা গোটা রাজ্যের জন্য আশঙ্কাজনক। বামপন্থীদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে না। যে দাবি নিয়ে কেরল, রাজস্থান, তামিলনাড়ু বা বিহারের বামপন্থী সাংসদেরা লড়বেন, সেই লড়াই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য লড়ার লোক থাকল না
৪ জুনের ফলাফল এ-কথা প্রমাণ করে দিয়েছে, ‘মোদি ম্যাজিক’ আর কিছুই নয়, ‘স্যান্ডো গেঞ্জির বুকপকেট’ মাত্র। ‘৪০০ পার’-এর বাতি জ্বলবার আগেই নিভিয়ে দিয়েছেন ভারতের জনসাধারণ। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও এই নির্বাচনে বিজেপির ভাগ্যে জোটেনি। অন্যদিকে বিরোধী জোট ইন্ডিয়া, মাঝমাঠ থেকে ফরোয়ার্ড লাইন ভালই সামলেছে। উত্তরপ্রদেশের ফলাফল কেবল বিস্মিত-ই করেনি, দেশবাসীকে একপ্রকার ঝাঁকিয়ে দিয়ে গেছে।
সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাইয়ের মতো বলতে ইচ্ছে করছে, “এবারের সংসদটা দেখতেও ভাল লাগবে!”
শুধু ইন্ডিয়া জোট নয়, এ-বছর উত্তরপ্রদেশের নাগিনা লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়ে সংসদে যাবেন দলিত নেতা ভীম আর্মির চিফ চন্দ্রশেখর আজাদ রাবণ।
অতএব, বিজেপির পক্ষে খেলাটা এবার কঠিন।
এইসবের মধ্যে দেশজুড়ে বামপন্থীদের ফলাফলও মন্দ নয়। মোট নয়জন এমপি এবার তারা সংসদে পাঠাতে চলেছেন। সিপিএমের জয়ী প্রার্থীরা হলেন, রাজস্থানের শিকর অঞ্চলের আমরা রাম, কেরলের আলাথুরের প্রার্থী কে রাধাকৃষ্ণণ, তামিলনাড়ুর মাদুরাই থেকে এস ভেঙ্কাটেশন এবং ডিন্ডিগুল থেকে সাচিথানানথাম আর।
অন্যদিকে বিহারের আরা এবং কারাকাট অঞ্চল থেকে জয়ী হয়েছেন সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের প্রার্থীরা। সুদামা প্রসাদ এবং রাজা রাম সিং।
আরেকদিকে আরএসপি প্রার্থী এনকে প্রেমাচন্দ্রন কোল্লাম লোকসভা কেন্দ্র থেকে জয়ী হয়েছেন। দুইজন সিপিআই প্রার্থী জয়ী হয়েছেন নাগাপাত্তিনাম এবং তিরুপুর কেন্দ্র থেকে।
হিসেব বলছে গতবারের থেকে এইবারের নির্বাচনে গোটা দেশে বামেদের ফলাফলও যথেষ্ট ভাল।
তবে যা আশঙ্কার, তা হল এইবারের নির্বাচনে আগেরবারের মতোই পশ্চিমবঙ্গে বামেদের আসনসংখ্যা শূন্য থেকে গেল। আশঙ্কা কেন, তাতে একটু পরে আসছি। তার আগে একবার দেখে নেওয়া যাক দেশজুড়ে বামপন্থীদের এই সাফল্যের কারণ কী, এবং পশ্চিমবঙ্গে বামেদের এই দুর্দশার কারণ-ই বা কী।
খেয়াল করলে দেখব, বামপন্থীদের দেশজোড়া এই সাফল্যের পিছনে রয়েছে তাদের সাংগঠনিক জোর, বুথস্তরের সংগঠন, গণ-আন্দোলনে নেতৃত্বকারী ভূমিকা নেওয়া। জাঠ সম্প্রদায় অধ্যুষিত শিকর এলাকায় আমরা রামের মতো নেতার জয়, সে-কথা হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে দেয়। তিনি এর আগেও তিনবার এমএলএ পদ সামলেছেন। তবে লোকসভা ভোটে বিজেপির দুইবারের এমপি সুমেধানন্দ সরস্বতীকে হারিয়ে, বামেদের ঝুলিতে ‘হিন্দি হার্টল্যান্ড’-এ এই সাফল্য নিয়ে আসার পিছনে রয়েছে অল ইন্ডিয়া কিষান সভা। খাতায় কলমে ভারতের অন্যতম বৃহৎ কৃষক সংগঠন। সেই সংগঠনেরই নেতা হলেন আমরা রাম। ২০১৭ সালে রাজস্থানের শিকর অঞ্চলে যে কৃষক আন্দোলন হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিলেন এই আমরা রাম। শুধু রাজস্থান নয়, দেশের কৃষক আন্দোলনের অন্যতম বলিষ্ঠ মুখ তিনি।
ফলে, কৃষক আন্দোলনে আমরা রামের ভূমিকা এবং সিপিএমের সংগঠন, বলা যায় এই দুইটিই কাজ করেছে এই জয়ের পিছনে।
অন্যদিকে, বিহারের শাহবাদ এবং মগধ অঞ্চলে সিপিআই (এম-এল)-এর দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের ইতিহাস রয়েছে। আরা লোকসভা কেন্দ্রটি পড়ে শাহবাদের মধ্যে এবং কারাকাট পড়ে মগধের মধ্যে। রণবীর সেনার মতো ব্রাহ্মণ্যবাদী সামরিক বাহিনিগুলির বিরুদ্ধে এই সমস্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিনের লড়াই লড়েছিল সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন। যদিও, এই লড়াই একা লিবারেশন লড়েছিল বললে ভুল হবে। তৎকালীন মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র এবং নকশালপন্থী সংগঠন সিপিআই (এম-এল) পার্টি ইউনিটি-রও এই লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থেকেছে।
তবে এ-কথা অস্বীকার করা চলে না, সেই দীর্ঘদিনের লড়াই এবং সংগঠনের ফসলই আজ নিজেদের ঘরে তুলছে লিবারেশন।
অতএব, এইবারের নির্বাচনে এ-কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, যেখানে বামপন্থীদের তৃণমূল স্তরে সংগঠন রয়েছে সেখানেই বামপন্থীরা নির্বাচনী সাফল্যের আলো দেখছেন।
যে অঙ্কে দেশজুড়ে বামপন্থীরা ভাল ফলাফল করলেন, ঠিক সেই অঙ্কেই বাংলায় হারলেন বামপন্থীরা।
তারা তৃণমূল স্তরের সংগঠন গড়ার থেকে এই নির্বাচনেও বাড়তি গুরুত্ব দিলেন সমাজমাধ্যমে নিজেদের ফলোয়ার বাড়ানোর দিকে।
সমাজমাধ্যমে অস্তিত্ব বাড়ানো জরুরি, প্রচারের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। তবে সংগঠন তৈরির থেকে গুরুত্বপূর্ণ হয়তো নয়।
সর্বপ্রথম যেটা লক্ষণীয়, সেটা হল, বাংলায় বামেদের এখন মূল ভিত্তি সমাজের উচ্চমধ্যবিত্তেরা।
যে শ্রেণির অবস্থান চিরকাল দোদুল্যমান।
এরাই সেই অংশ, যাদের ‘সুইংগিং ভোটার’ বলা হয়ে থাকে। নিউ দিঘার সমুদ্র সৈকতের কিছু দোকানে দেখবেন সামনে ত্রিপল ঝোলানো থাকে। হাওয়া যেদিকে যায়, ত্রিপল সেদিকে যায়। এই ‘সুইংগিং ভোটার’-ও আসলে তাই।
ফলে, তাদের ভোট সময় সময় সিপিএম থেকে যায় বিজেপিতে, আবার কখনও তৃণমূলে।
এইবারের নির্বাচনেও তৃণমূল-বিরোধী এই শহুরে উচ্চমধ্যবিত্তের ভোট গিয়েছে বিজেপির দিকে। যা স্বাভাবিক।
স্বাভাবিক বললাম কারণ, এই উচ্চমধ্যবিত্ত অংশটি সিপিএমের প্রতি সিমপ্যাথেটিক মূলত দুটি কারণে। এক, এদের সিপিএমের সঙ্গে কোনও পারিবারিক যোগাযোগ রয়েছে হয়তো। আর দুই, এই শ্রেণির ‘মমতা অ্যালার্জি’।
এই শ্রেণির কাছে সিপিএমকে ভোট দেওয়া বাধ্যবাধকতা নয়। অপশনাল।
এই মুহূর্তে সে সিপিএমের থেকে বিজেপিকে বেশি ‘মমতা বিরোধী’ মনে করছে, ফলে সিপিএমেকে তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে ভাবতে চাইছে না।
এই শ্রেণির সঙ্গে সিপিএমের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এদের যে অংশটা এখনও সিপিএমে রয়েছে, তাদের একাংশের মধ্যে ভয়াবহ রকম মুসলিমবিদ্বেষ রয়েছে। যার দরুন এই নির্বাচনের আগে সেই সমর্থকদের একাংশ একাধিক গুজব ছড়াতেও শুরু করেছিল। আমারই দুইজন পরিচিত, একজন আমার থেকে বয়সে বেশ খানিকটা বড়, আরেকজন আমার সমবয়সী, নির্দ্বিধায় বলেছিল, “নওসাদ সিদ্দিকি তৃণমূলের থেকে চল্লিশ কোটি টাকা নিয়েছে।”
যার কোনও তথ্যপ্রমাণ তাদের হাতে হাজির ছিল না।
এই অংশটাই নির্বাচন-শেষে, রাজ্যের ভোটারদের ‘ভিখারী’, ‘অশিক্ষিত’ বলে ব্যঙ্গ করেছে।
মূল কথা হল, এই অংশটার সে অর্থে সিপিএমকে প্রয়োজন নেই। যেটা আছে সেটা সিমপ্যাথি মাত্র।
তবে যাঁদের ভোট সিপিএম এই নির্বাচনেও পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের ঝুলিতে আনতে পারল না, তাঁরা হলেন সেই ভোটাররা, যাঁরা শিকর লোকসভা কেন্দ্রে আমরা রামকে বিজয়ী করেছেন। অর্থাৎ, সমাজ বা অর্থনীতির মইতে যাঁরা নিচের দিকে রয়েছেন। যাঁদের প্রাত্যহিক দিনের সঙ্গে লড়াইয়ের বিশেষ যোগসূত্র রয়েছে। যাঁরা সমাজের সংখ্যালঘু অংশ— বিজেপি বা হিন্দুত্ববাদী শক্তি যাঁদের ক্রমাগত কোণঠাসা করবার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এই নির্বাচনের আগে, উত্তর সোনারপুরের বনহুগলি পঞ্চায়েতের কয়েকজন সুহৃদের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তাঁরা ধর্মগতভাবে মুসলিম। তাঁদের একজন বাজারের সবজি ব্যবসায়ী, আরেকজনের ফাস্টফুডের দোকান। তাঁদের মতে, তৃণমূল দুর্নীতি করেছে, তবে বিজেপি তাঁদের ধর্ম, পরিচয়, জীবিকা ধরে টান মারছে। অতএব, বিজেপিকে ঠেকানোর উপায় তৃণমূলকে ভোট দেওয়া।
এই যুক্তি ঠিক না ভুল, তা এখন বিচার্য নয়। বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পশ্চিমবঙ্গে সিপিএমের আওয়াজ তুলনামূলক কোমল হওয়ার দরুন এই নির্বাচনে তাদের এই দুর্দশা। অন্যদিকে তৃণমূলের এই চরম দুর্নীতি, এলাকায় এলাকায় বাইকবাহিনি, সিন্ডিকেটের তাণ্ডবের পরেও, তারা বিজেপির বিকল্প হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
তাহলে সোজা অঙ্ক বলছে, বিজেপি-তৃণমূলের বাইনারি এই নির্বাচনেও সিপিএম ভাঙতে পারল না। উপরন্তু তারা যে তৃণমূল-বিরোধী ভোটটার প্রত্যাশায় ছিল সেটাও এল না, অন্যদিকে বিজেপি বিরোধী শক্তি হিসেবেও নিজেদের মাটি মজবুত করতে পারল না।
ফলে, সিপিএমের এই বাজারে ঘুরে দাঁড়ানোর একমাত্র উপায় হয়তো তৃণমূল স্তরের সংগঠনকে মজবুত করা। শহরে বস্তি সংগঠন এবং গ্রামে কৃষক সংগঠনের দিকে নজর দেওয়া। সমাজমাধ্যমে তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেয়েও হয়তো জরুরি পাড়ার চায়ের দোকান বা মোড়ের মাথার জটলায় নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা।
শহরের উচ্চ মধ্যবিত্ত নয়, সিপিএমের হয়তো নিজেদের শিকড়ে ফিরে যাওয়াই এই সময় কাম্য, যাকে ইংরেজিতে বলে ‘ব্যাক টু দ্য বেসিকস্’।
পশ্চিমবঙ্গের সাংসদদের তালিকায় একজনও বামপন্থী না থাকা গোটা রাজ্যের জন্য আশঙ্কাজনক। বামপন্থীদের সংখ্যা কমে যাওয়া মানে পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে না। যে দাবি নিয়ে কেরল, রাজস্থান, তামিলনাড়ু বা বিহারের বামপন্থী সাংসদেরা লড়বেন, সেই লড়াই পশ্চিমবঙ্গের মানুষের জন্য লড়ার লোক থাকল না।
কারণ একথা আমরা এতদিনে বুঝে গিয়েছি, তৃণমূল বা বিজেপি কেউই সাধারণ মানুষের দাবি সংসদ অবধি পৌঁছে দিতে সফল হয়নি।
ফলে, যে তৃতীয় ধারার বামপন্থীরা সিপিএমের আসন সংখ্যা শূন্য হওয়ায় উল্লসিত হচ্ছেন, একবার ভেবে দেখবেন, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের সংসদে সদস্য সংখ্যা শূন্য হওয়ায় খেসারত কাকে দিতে হবে?
তৃণমূল বা বিজেপিকে নয়। আপনাকে এবং আমাকে।
*মতামত ব্যক্তিগত
পীযূষ দত্ত তোমায় জানাই সংগ্রামী অভিনন্দন। অসাধারণ বিশ্লেষণাত্মক লেখা..।